
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংস্কৃতি রচনা ৬ ৭ ৮ ৯ ১০ ১১ শ্রেণি। HSC SSC JSC
ভূমিকা
বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি বলিষ্ঠ চেতনা, আত্মপ্রত্যয়ের দৃঢ় উচ্চারণ। প্রখ্যাত চিন্তাবিদ মনীষী সৈয়দ ইসমাইল হােসেন সিরাজী লিখেছেন- ‘আলােক ব্যতীত যেমন পৃথিবী জাগে না, স্রোত ব্যতীত যেমন নদী টেকে না, স্বাধীনতা ব্যতীত তেমনি জাতি কখনাে বাঁচিতে পারে না।’ আমরাও সেই চিরন্তন সত্যের পথ ধরেই ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে অর্জন করেছি আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদিকে যেমন করুণ, শােকাবহ, লােমহর্ষক, তেমনি ত্যাগের মহিমাব্যঞ্জিত ও বীরত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক সেই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল যে বােধ বা চেতনাকে কেন্দ্র করে তারই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তাকে চির সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে আবহমান কাল ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রেরণা জোগাবে এ জাতিকে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পটভূমি
দু’শ বছর ধরে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছিল এ জাতি। ১৯৪৭ সালে সেই জাতাকল থেকে এ উপমহাদেশের মানুষ মুক্তিলাভ করলেও মুক্তি আসে নি বাঙালি জাতির। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানি শাসকদের শৃঙ্খলে আবার বন্দি হল বাঙালিজাতি। ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে সংগ্রাম করে মুক্তির পথ খুঁজছিল বাঙালি জাতি। সবশেষে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সশত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুরু এবং ১৬ ডিসেম্বর দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রতিষ্ঠা অর্জন করে। এ প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে বাঙালি জাতির হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে মহত্তম ও গৌরবময় ঘটনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় যে স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছে তারই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সেই চেতনার মূল লক্ষ্য ছিল , পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিড়ে শােষণমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সেই সমাজে মানুষ পাবে তার মৌলিক অধিকারগুলাে। লঙ্ঘিত হবে না মানবাধিকার। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিব নগরে আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক ঘােষিত স্বাধীনতাকে সমর্থন ও অনুমােদন করা হয় যে ঘােষণাপত্রটি পাঠ করে তার একটি লাইন ছিল ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার জন্যেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।’ এই ঘােষণাপত্রের চেতনার ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার প্রস্তাব পাশ করার পর পরই ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ যে বেতার ভাষণটি দিয়েছিলেন তাতে সাধারণ মানুষের স্বপ্নের কথা খুবই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল।
সেদিন তিনি অন্তরের গভীরতম প্রত্যয় দিয়ে বলেছিলেনঃ ‘এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ। খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-জনতা তাদের সাহস, তাদের আত্মাহুতি, তাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ।… বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্য রচিত হােক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা তােক ক্ষুধা, রােগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি।’ মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে তিনি আরও বলেছিলেনঃ “যাঁরা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করেছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাঁদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা।” বস্তুত সােনার বাংলার স্বপ্ন ছিল এদেশের সাধারণ মানুষের অন্তরের গহীনে। সার্বভৌম এক রাষ্ট্র তাদের নানামাত্রিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে বলেই তারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের আশা ছিল নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির আলােকে গড়ে উঠবে এক নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপট। এ প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অবিস্মরণীয় উক্তিটি স্মরণ করা যেতে পারে ‘বিদ্যাকে যদি হীরার সঙ্গে তুলনা করা হয় তা হলে তাতে যে দ্যুতি ছড়িয়ে পড়বে সে-ই হবে তার সংস্কৃতি।’ এ মন্তব্যের আলােকে পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে আমাদের যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে তার মূলে কাজ করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব ও চেতনার বিকাশ
বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ থেকে যে চেতনা লাভ করেছে তা জাতির সকল আন্দোলনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। সমগ্র জাতি একতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে এই যুদ্ধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ঐক্যবদ্ধ জাতি দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে তার পেছনে মুক্তিসংগ্রামের আত্মত্যাগ কাজ করেছে। অত্যাচার আর শােষণের কালাে হাত গুড়িয়ে দেওয়ার শক্তি ও প্রেরণা এসেছে এই স্বাধীনতার যুদ্ধ থেকে। বাংলাদেশের মানুষের স্বাজাত্যবােধের স্ফুরনের উৎস এই যুদ্ধ। ‘৭১ সাল দেশ ও জাতির নতুন ইতিহাসের জন্মদাতা। অধিকার আদায়ের জন্যে আত্মসচেতন হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। এই দিনগুলােতে মানুষ নতুন করে জেগে উঠেছিল। সে জাগ্রত চেতনা ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের মানুষের পরবর্তী কর্মকাণ্ডে। গত আটত্রিশ বছর ধরে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকশিত হয়েছে আমাদের সমাজজীবনে। ব্যক্তিস্বাধীনতা, নারীমুক্তি আন্দোলন, নারীশিক্ষা, গণশিক্ষা, সংবাদপত্রের ব্যাপক বিকাশ, সর্বোপরি গণতান্ত্রিক অধিকার চেতনা ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে সমাজে।
এরশাদ সরকারের নয় বছরে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে প্রবল গণজোয়ারের মধ্য দিয়ে নবতর বিজয় অর্জন ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারও প্রেরণা জুগিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতা ও কথাসাহিত্যে এক নবতর সাহিত্যধারার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে কবিতা চর্চা ও কথাসাহিত্য চর্চা আজকে যতটা ব্যাপ্তি, পেয়েছে তার পেছনে বড় প্রেরণা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে গানে এবং নাটকে। গণসচেতনতামূলক বক্তব্যধর্মী নাটক ব্যাপকভাবে রচিত হয়েছে স্বাধীনতার পর। আমাদের দেশাত্মবােধক গানের ক্ষেত্রে এক নতুন জোয়ার এনেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। অসংখ্য গীতিকার রচনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাথা তাদের গানে। তবে আমাদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আশানুরুপভাবে প্রতিফলিত হয় নি। খুব সামান্য সংখ্যক চলচ্চিত্রেই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা প্রকাশ পেয়েছে।
মুক্তির সগ্রাম ও স্বপ্নের বাংলাদেশ বনাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
প্রকৃত প্রস্তাবে শােষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে এদেশের সাধারণ মানুষ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থেকে সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ে তােলার স্বপ্নও তাদের সেদিন তাড়া করেছিল। তবে সে সময়ের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামের প্রত্রিকার ২১ নভেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় বলা হয়েছিল : “স্বাধীন বাংলাদেশের ছবিও সকল শ্রেণীর মানুষের মনে এক রকম নয়। কৃষক ভাবিতেছে স্বাধীন বাংলাদেশে সে জমি পাইবে, সামন্তবাদী শােষণের নাগপাশ হইতে পাইবে মুক্তি। শ্রমিক ভাবিতেছে সে পাইবে বাঁচার মত মজুরি, কাজের নিরাপত্তা, রাজনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার। যুগ যুগ ধরিয়া সে সভ্যতার পিলসুজ হইয়া কাটাইয়াছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্যদিয়া এমন এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দুয়ার খুলিয়া যাইবে সেখানে সে সভ্যতার নির্মাতা হিসাবে উহার ফল ভােগেরও অধিকারী হইবে। সকলের অন্ন, বত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আশ্রয়ের মতাে ন্যূনতম চাহিদাগুলি মিটিবে।”
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নেতা মোজাফফর আহমদ লিখেছিলেনঃ ‘কৃষকরা বলাবলি করিতেছে এবারে তারা জমি পাইবে, পাটের ন্যায্য মূল্য পাইবে, প্রতিদিনের প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিবে, ঘুস, রিশওয়াত ও অন্যান্য দুর্নীতির হাত হইতে মুক্তি পাইবে। শ্রমিক মনে করে যে তার বাঁচার মত ন্যায্য মজুরি পাইবে। ছাত্র ভাবে এবার তারা লেখাপড়ার সুযােগ পাইবে। যুবক মনে করে এবার তার চাকরির সংস্থান হইবে। এক কথায়, আজ এদেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-শিক্ষক-বৃদ্ধ, নর-নারী, ডাক্তার-কবিরাজ-দোকানদার-ব্যবসায়ী, রিকশাওয়ালা-খেতমজুর আপামর জনসাধারণ ভাবিতেছে গরিব এবার মানুষের মতাে বাঁচিতে পারিবে, কথা বলিবার অধিকার পাইবে।’
বস্তুত শিক্ষা ও কর্মে গতিময় এক দেশের স্বপ্নে বিভাের মুক্তিযােদ্ধারাই এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান- এই স্বীকৃতি তারা পেতে চেয়েছিল। সবাই মিলে দেশ গড়ব, কৃষি ও শিল্প বিপ্লব ঘটাব, আত্মনির্ভর এক বাংলাদেশ গড়ে তুলব’- এই আকাঙ্ক্ষাই ছিল আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কিন্তু আজ এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, এ চেতনাকে আমরা সঠিকভাবে আমাদের দেশ পরিচালনার মূলমন্ত্র করতে পারি নি। বরং কতিপয় লােভী এবং স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে সেই চেতনা হয়েছে ভূলুণ্ঠিত। যে স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেই স্বপ্ন নানা কারণেই গত আটত্রিশ বছরেও সাফল্যের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারে নি। স্বাধীনতার পর বারবার সামরিক অভ্যুত্থান, হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরােধী দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের তৎপরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুবসমাজের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা, বেকারত্ব, জনস্ফীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, ঘুস, দুর্নীতি ইত্যাদি অবক্ষয় স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিপন্ন করে চলেছে। প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সভা, সমিতি, বিবৃতিতে বারবার যে কথাটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারণ করেছেন তা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার কথা। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরােধী কার্যকলাপ বারবার সংঘটিত হয়েছে প্রশাসনের ভেতরে এবং বাইরে। প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রাপ্য সম্মান এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন গত আটত্রিশ বছরে।
সমাজ-বাস্তবতার প্রেক্ষাপট (রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিফলন)
আজ তাহলে আমরা কেমন আছি? এ প্রশ্নের সােজাসাপ্টা উত্তর হল মুক্তিযুদ্ধের মৌল আকাঙ্ক্ষা থেকে আজ আমরা বহু দূরে। অস্থির এই সময়ে দাঁড়িয়ে এ কথা বলা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্ভর একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও অর্থনীতি গড়ার মতাে দেশপ্রেমিক একটি জাতিই আমরা গড়তে পারি নি। যে কার্যকরী রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন একটি জাতি গঠনে সহায়ক হতে পারত তার সন্ধানই পেলাম না। এর জন্য আমাদের সীমাহীন লােভ এবং অপরাধ করে, পার পেয়ে যাবার অপসংস্কৃতিই মূলত দায়ী। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার ভেতর যে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের চেতনাও প্রােথিত ছিল সে-কথাটি যেন আমরা ভুলেই গিয়েছি। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এ বিষয়টির খুব ভালাে ব্যাখ্যা করেছেনঃ “আমরা আর মামুরা- এই স্বজনতন্ত্র ও স্বজনাশ্রিত রেওয়াজের একটা আশু অবসান হওয়া উচিত। সমাজে কীভাবে পরিবারতন্ত্র বা প্রায়-রাজতন্ত্রের বিকাশ লাভ করে নৃতাত্ত্বিকদের কাছে তার গবেষণার জন্য বাংলাদেশ একটা বড় আকর্ষণীয় ও দৃষ্টান্তমূলক চারণভূমি।”
বর্তমানে আমাদের সমাজজীবনে চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে। এ অবক্ষয় যুবসমাজকেও প্রভাবিত করছে, দোলা দিচ্ছে তাদের মন-মানসিকতাকে। আমাদের যুবসমাজের সামনে আজ কোনাে আদর্শ নেই। নেই অনুপ্রাণিত করার মতন কোনাে মহৎপ্রাণ মানুষ। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। যুব সমাজকে নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মতাে কোনাে পরিকল্পনা নেই, ফলে তারা প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসরমান। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই আমাদের যুবসমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও যুবসমাজের অবক্ষয়ের আর একটি কারণ। একদিকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অপরদিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা, শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য, সমাজসেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা যুবসমাজকে বিপথগামী করেছে। তরুণসমাজ অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করে, সমাজে সমাজ-বিরােধীর যে সম্মান, যে প্রতিপত্তি, সেখানে একজন জ্ঞানী, সৎ মানুষের মূল্য তুচ্ছ। সততা সেখানে লাঞ্ছিত, অসহায়। বিবেক সেখানে বিবর্জিত। জ্ঞানী-গুণীরাও তাদের খাতির করে। রাজনৈতিক নেতাদের তারা ডান হাত। জঘন্য, নিষ্ঠুর কাজকর্ম করেও তারা আইনের চোখে নিরাপদ। প্রশাসন প্রয়ােজন মতাে ওদের ব্যবহার করে। কী তাদের মূলধন ? তারা অনায়াসে মানুষ খুন করে, ডাকাতি করে, জনজীবনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এই মূলধন নিয়েই ওরা সমাজের বিশিষ্ট মানুষ।
আজ তাই মানবিক ও ধর্মীয়। মূল্যবোধও গৌণ হয়ে উঠেছে। বস্তুত সমাজের সর্বস্তরে আজ যে মূল্যবােধের অভাব, তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া যুবকদের মাঝে প্রতিনিয়ত বিস্তৃতি ঘটছে। এভাবে তরুণসমাজকে বিপথগামী করার জন্যে আরও নানা উপকরণ সদা-সক্রিয়। আজ আমাদের যুবকদের সুসংগঠিত করে সত্য এবং ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবােধ জাগিয়ে তুলতে হবে। তাদের সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের যে আত্মত্যাগ ছিল, সমগ্র জাতি একতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে জীবন উৎসর্গ করেছিল, তা আবার পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে, তরুণদের জাগিয়ে তুলতে হবে। তারা সচেতন হলে কোনাে রকম অন্যায় কুমন্ত্রণা তাদের বশীভূত করতে পারবে না। সমাজে যতদিন অন্যায় অবিচার মাথা উঁচু করে থাকবে ততদিন যুবসমাজকে সুপথে আনা কষ্টকর। ধর্ম ও শিক্ষার আলাে ছড়িয়ে দিয়ে তাদের সামনে থেকে অন্ধকার দূর করতে হবে। রীতিমত শরীরচর্চা এবং নানারকম খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকার সমস্যা দূর করতে হবে। তাছাড়া যারাই সমাজে অপরাধকর্মে লিপ্ত হয় তাদের জন্যে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যুবকরাই দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং জাতির কর্ণধার। তাদের মনে এ চেতনাবােধ জাগিয়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়ােজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির সংঘবদ্ধ প্রয়াস ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক পদক্ষেপ। এজন্যে দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়ােজন তেমনি প্রয়ােজন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গৌরবগাথা আর আত্মত্যাগের ইতিহাস ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে তুলে ধরা। যে আদর্শ, লক্ষ্য ও চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী লাখ লাখ মানুষ তাদের তাজা প্রাণ দিয়েছে, শত-সহস্র মা-বােন ইজ্জত দিয়েছে- সমাজ ও জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের সেই আদর্শ ও চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
উপসংহার
উপযুক্ত আলােচনায় এটা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭১ সালে আমরা যে কঠিন আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তখনি সাফল্যে উদ্ভাসিত হবে যখন রাজনৈতিক স্বাধীনতা আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতায় রূপান্তরিত হবে। সেই লক্ষ্যে আজ সমাজের সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনাকে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়ােজন। দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মহৎ লক্ষ্যসমূহ জাগ্রত করা গেলে, তবেই আমাদের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এক গৌরবময় স্তরে উত্তীর্ণ হবে।
- বাংলাদেশ (Bangladesh)
- সৈয়দ ইসমাইল হােসেন সিরাজী (Ismail Hossain Siraji)
- বাংলা ভাষা আন্দোলন (Bengali language movement)
- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের (Constitution of Bangladesh)
- তাজউদ্দীন আহমেদ (Tajuddin Ahmad)
- মোজাফফর আহমদ (Muzaffar Ahmed)
- মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (Muhammad Habibur Rahman)
Thank you