বাংলা রচনা

বাংলা রচনাঃ স্বদেশপ্রেম (১৯ পয়েন্ট)

4.3/5 - (2306 votes)

ভূমিকা

নিজ দেশ ও জন্মভূমির প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসাই স্বদেশপ্রেম। স্বদেশের প্রকৃতি ও ধূলিকণা আমাদের নিকট অতি প্রিয় ও পবিত্র। শিশুকাল থেকেই মানুষ স্বদেশের মাটিতে বেড়ে ওঠে। মায়ের বুক যেমন সন্তানের নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত আশ্রয়, স্বদেশের কোলে মানুষ তেমনি নিরাপদ ও নিশ্চিত আশ্রয় লাভ করে। স্বদেশকে ভালোবাসার মাঝেই মানব জীবনের চরম সার্থকতা নিহিত। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-

সার্থক জন্ম আমার জন্মেছি এই দেশে।
সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।

স্বদেশপ্রেম কী

স্বদেশপ্রেম মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ যে দেশে জন্মগ্রহণ করে সেটিই তার জন্মভূমি। জন্মভূমির প্রতি, স্বজাতির প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধাবোধই স্বদেশপ্রেম। দেশপ্রেমীর নিজ দেশের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা, সীমাহীন আনুগত্য। বিশ্বের উন্নত জাতিগুলো স্বদেশের জন্য আত্মত্যাগ করেই উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছে। স্বদেশপ্রেম না থাকলে দেশ ও জাতির উন্নতি আশা করা যায় না। স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সুখী দেশ গড়তে হলে তাই নাগরিকদের অবশ্যই স্বদেশপ্রেমী হতে হবে।

স্বদেশপ্রেমের উৎস

প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দেশকে ভালোবাসে। সকল জীবের মধ্যেই এ গুণ বিদ্যমান। বন্যপশুকে বনভূমি ছেড়ে লোকালয়ে আনলে, পাখিকে নীড়চ্যুত করলে তারা আর্তনাদ শুরু করে। এটি করে নিজ আবাসস্থানের প্রতি ভালোবাসার টানে। নিজ আবাসের প্রতি ভালোবাসা থেকে জন্ম নেয় স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা। স্বদেশের মাটি, পানি, আলো, বাতাস যেন আমাদের জীবনেরই অঙ্গ। এগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অঙ্গহানির শামিল। এগুলোর প্রতি মমত্ববোধ থেকেই সৃষ্টি হয় স্বদেশপ্রেম। দেশের মাটির প্রতি মমত্ববোধের সাথে মিশে থাকে শ্রদ্ধা, প্রীতি ও গৌরববোধের আকাঙ্ক্ষা।

দেশপ্রেমের অভিব্যক্তি

গর্ভধারিণী জননীকে সন্তান যেমন ভালােবাসে, তেমনি দেশ-মাতৃকাকেও মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই শ্রদ্ধা করতে এবং ভালােবাসতে শেখে। দেশ ও দশের প্রতি মানুষের যে বন্ধন ও আকর্ষণ তা থেকেই স্বদেশপ্রেমের জন্ম। দেশ যত ক্ষুদ্র বা যত দরিদ্রই হােক না কেন, প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে তার জন্মভূমি, তার দেশ, সবার সেরা। যে কোনাে ব্যক্তির সকল প্রাপ্তি তার স্বদেশের অবদান বলে স্বদেশের প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে তার ধন, জন, মান, এমনকী জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে দ্বিধা করে না। দেশ ও জাতির জীবনে যখন সুখ আর ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য তখন মানুষের স্বদেশপ্রেম থাকে গভীর ঘুমঘােরে মগ্ন। দুঃখ, নির্যাতনের আঘাতে আঘাতেই হয় সেই সুপ্তি-মগ্নতার আবরণ উন্মােচন। দেশের যখন সংকটমুহুর্ত, যখন বহিঃশত্রুর উল্লাস-অভিযানে দেশের স্বাধীনতা বিপর্যস্ত হয়। যখন রক্তচক্ষু বিদেশি শাসকের নির্যাতন চরমে, যখন পরাধীনতার বিষজ্বালায় জর্জরিত মানুষ মুক্তিকামনায় উদ্বেল-অস্থির , যখন দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার প্রয়ােজন হয় তখনই আসে মানুষের স্বদেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রের দীক্ষালগ্ন। তখন দেশাত্মবােধ শ্রেণী, ধর্ম-বর্ণ-গােত্র সব ভুলে একই ভাবচেতনা দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে।

স্বদেশপ্রেম তখন মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। সবাইকে একই চেতনায় একপ্রাণ হয়ে মহৎ লক্ষ্য সাধনে ব্রতী করে। গড়ে ওঠে মানব-সম্প্রীতি। দেশের মর্যাদার জন্যে মানুষ অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেয়। শত শত শহিদের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই হয় দেশপ্রীতির প্রাণ-প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও জাতীয়তাবােধ হল স্বদেশপ্রেমের প্রধান উৎস। কত বীরের আত্মবলিদানে তখন স্বদেশের মৃত্তিকা হয় রক্তে রাঙা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তাে স্বদেশপ্রীতিরই জ্বলন্ত স্বাক্ষর।

স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ

মানুষ সমগ্র বিশ্বের বাসিন্দা হলেও একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে সে বেড়ে উঠে। একটি বিশেষ দেশের অধিবাসী হিসেবে সে পরিচয় লাভ করে। এ দেশই তার জন্মভূমি, তার স্বদেশ। মানুষ স্বদেশে জন্মগ্রহণ করে ও স্বদেশের ভালোবাসায় লালিত-পালিত হয়। নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সকল উপাদান সে স্বদেশ থেকে পায়। ফলে স্বদেশের প্রতি প্রবল মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়। এ জন্য মানুষ স্বদেশের গৌরবে গৌরবান্বিত হয় এবং স্বদেশের অপমানে অপমাণিত হয়। স্বদেশের স্বাধীনতা ও মান-মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে। কবি ঈশ্বচন্দ্র গুপ্ত তাই লিখেছেন-

মিছা মনিমুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম
তার চেয়ে রত্ন নাই আর।

স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ

স্বদেশপ্রেম মানব হৃদয়ে লালিত হয়। আর স্বদেশপ্রেম প্রকাশ পায় জাতীয় জীবনের দুঃসময়ে মানুষের কর্মের মাধ্যমে। স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষায়, স্বদেশের মানুষের কল্যাণ সাধনে মানুষের মনে স্বদেশপ্রেম জেগে ওঠে। যাঁরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, দেশের জন্য সংগ্রাম করেছেন তাদের নাম ও কীর্তি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁদের সে প্রেম ও আত্মত্যাগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে চিরকাল। স্বদেশের তরে জীবন উৎসর্গকারীরা সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়-

ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।তোমাতে বিশ্বময়ীর তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।

দেশপ্রেমের ভিন্নতর বহিঃপ্রকাশ

কেবল দেশকে ভালোবাসার মধ্যে দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ নয়। দেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে নেওয়া যেমন শিল্প সাহিত্য, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতির ক্ষেত্রে অবদান রাখাও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। সম্প্রতি ২৬ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা গাইতে ২ লক্ষ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন মানুষের একত্রিত হওয়া দেশপ্রেমরই বহিঃপ্রকাশ। দেশের কল্যাণ ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে বিশ্বসভ্যতায় গৌরব বাড়ানো যায়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ড. মুহাম্মদ ইউনুস, সাকিব আল হাসান প্রমুখের গৌরবময় অবদানের জন্য বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ আমরা নবী করীম (স.) এর মধ্যে দেখতে পাই, দেশকে ভালোবেসে তিনি বলেছিলেন-

হে মাতৃভূমি তোমার লোকেরা যদি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না করত তবে আমি কখনই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।

স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম

স্বদেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। স্বদেশপ্রেম কখনও বিশ্বপ্রেমের বাধা হয় না। দেশপ্রেম যদি বিশ্ববন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের সহায়ক না হয় তবে তা প্রকৃত দেশপ্রেম হতে পারে না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই দেশপ্রেমের চেতনায় উৎসাহিত হতে হবে। যে নিজের দেশকে ভালোবাসে না সে অন্য দেশ, ভাষা, গোষ্ঠী তথা মানুষকে ভালোবাসতে পারবে না। তাই দেশপ্রেমের মধ্যেই বিশ্বপ্রেমের প্রকাশ ঘটে।

স্বদেশপ্রেম রচনা
স্বদেশপ্রেম রচনা

দেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের মধ্যে সম্পর্ক

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতে, জাতীয়তা ও স্বদেশপ্রেম যখন সঙ্কীর্ণতার অন্ধকূপে বন্দি হয়ে উগ্র ছিন্নমস্ত রূপ ধারণ করে, তখন বিশ্বপ্রেম পদদলিত হয়। স্বদেশকে একমাত্র পরম প্রিয় মনে করে আমরা বিশ্বকে শত্রু মনে করি এবং তাকে ধ্বংস করবার জন্য ধাবিত হই। তখন শুভ বিচার-বুদ্ধি স্বদেশপ্রেমের অন্ধ আবেগে লুপ্ত হয়। ফলে পরপর হানাহানি এবং অবারিত রক্তক্ষয় অনিবার্যরূপে দেখা দেয়। আর, নানা মারণাস্ত্র আবিষ্কারের ফলে সেই হানাহানি অচিরেই ধারণ করে বিভীষিকাময় রূপ।

সাহিত্যের আয়নায় দেশপ্রেম

বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক তাদের কবিতা, কাব্য, নাটক, গান, উপন্যাস প্রভৃতি লেখনির মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেমকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের বিকাশ ঘটে ব্রিটিশ আমল থেকেই। নীলদর্পণ, আনন্দমঠ, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি গ্রন্থে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে। এছাড়া নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের সাহিত্যে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে।

ছাত্রজীবনে স্বদেশ প্রেমের শিক্ষা

স্বদেশপ্রেম মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলেও এ গুণটি তাকে অর্জন করতে হয়। তাই ছাত্রজীবন থেকেই দেশপ্রেমের দীক্ষা গ্রহণ করতে হয়। দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসতে হবে। ছাত্রজীবনে যে দেশপ্রেম মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় তা মনে আজন্ম লালিত হয়। আজকের ছাত্ররাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে দেশের ভালো-মন্দ তাদের উপর অর্পিত হবে। সবার আগে দেশের বিপদে-আপদে ও প্রয়োজনে ছাত্রদেরকেই এগিয়ে আসেত হবে। প্রয়োজনে দেশের স্বার্থে ছাত্রদেরকে জীবন উৎসর্গ করতে হবে। যেমনটি ছাত্ররা করেছিল ১৯৫২ সালের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অকাতরে প্রাণ উৎসর্গ করে।

স্বদেশপ্রেমের উপায়

স্বদেশের উপকারে নাই যার মন
কে বলে মানুষ তারে পশু সে জন।

পবিত্র ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে “দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।” পৃথিবীতে এমন কোন ধর্ম নেই, যে ধর্মে দেশকে ভালবাসার নির্দেশ দেয়া হয় নি। দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মত্যাগকে সবচেয়ে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রত্যেক নাগরিকই নিজ নিজ কর্মের সীমারেখায় স্বদেশপ্রেমের পরিচয় দেয়। স্বীয় দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করার মধ্যে দেশপ্রেম নিহিত। জাতির জন্য দেশের জন্য প্রত্যেক মানুষের, তা সে ছােটই হােক কি বড়ই হােক-তার কিছু না কিছু করার আছে। জাতির জন্য যদি কিছু অবদান রাখা যায় তবে তাতে দেশপ্রেমের নিদর্শন থাকে। তবে উগ্র স্বদেশপ্রেম মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর। অন্ধ স্বদেশপ্রেম মানুষকে সংকীর্ণ করে জাতিতে জাতিতে বিরােধের সৃষ্টি করে এবং মানুষের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনে। অপরদিকে মানবিকতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক মহামানব বিশ্ববরেণ্য হয়েছেন। তাদের স্বদেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমে রূপান্তরিত হয়েছে।

স্বদেশপ্রেমের প্রভাব

স্বদেশেপ্রেমের মহৎ চেতনায় মানব চরিত্রের সৎ গুণাবলি বিকশিত হয়। মানুষের মন থেকে সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা দূর হয়। স্বদেশপ্রেম মানুষকে উদার ও মহৎ করে, পরার্থে জীবন উৎসর্গ করতে প্রেরণা দেয়। স্বদেশপ্রেমের কারণেই মানুষ আত্মসুখ ত্যাগ করে দেশ ও জাতির কল্যাণ করে, দেশবাসীকে ভালোবাসো।

স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত

যুগে যুগে অসংখ্য মনীষী স্বদেশের কল্যাণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং নাম না জানা লক্ষ লক্ষ শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য জীবন দিয়ে অমর হয়েছেন। বিশ্ব অঙ্গনে দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত রেখেছেন চীনের মাওসেতুং, রাশিয়ার লেলিন ও স্ট্যালিন, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন প্রমুখ ব্যক্তি। দেশেপ্রেমের জন্যেই তাদের সকলের নাম বিশ্বের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

দেশপ্রেম ও রাজনীতি

বস্তুত রাজনীতিবিদদের প্রথম ও প্রধান শর্তই হল দেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেমের পবিত্র বেদিমূলেই রাজনীতির পাঠ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাজনীতিবিদ দেশের সদাজাগ্রত প্রহরী। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিবিদদের চেহারা ভিন্ন। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই মহত্তর, বহত্তর কল্যাণবােধ থেকে ভ্রষ্ট। ব্যক্তিক ও দলীয় স্বার্থচিন্তাই অনেক ক্ষেত্রে প্রবল। দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, মানুষের প্রয়ােজনে সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার সাধনা, দেশপ্রেমের অঙ্গীকার ও সার্থকতা, তা এখন প্রায়ই অনুপস্থিত।

বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি ও দেশপ্রেম

নগর কেন্দ্রীক সভ্যতায় মানুষ তার পাশের বাড়ির মানুষের কথাই ভুলে গেছে। মানুষ আজ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। দেশের মানুষের চিন্তা করার মানসিকতা তার নেই। মানুষের মধ্যে বাঁচার তাগিদ আজ আর কেউ অনুভব করে না। কেননা মানুষের মধ্যে বাঁচা মানে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য বাঁচা। কিন্তু সবাই এখন নিজের জন্য বাঁচতে চায়। তাই দেশ ও জাতির জন্য আমাদের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

উগ্র দেশপ্রেম

দেশপ্রেম দেশ ও জাতির জন্য গৌরবের। কিন্তু উগ্র দেশপ্রেম ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দুটি বিশ্বযুদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদ তথা উগ্র দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনির উগ্র জাতীয়তা ও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তাই উগ্র দেশপ্রেম সব সময় অশুভ, চির অকল্যাণকর ও চির অশান্তির।

দেশপ্রেম ও আমাদের কর্তব্য

পৃথিবীতে বীর, বিপ্লবী, ত্যাগী মহৎ দেশপ্রেমিক মানুষের সংখ্যা কম নয়। দেশে দেশে এই মহৎ দেশপ্রেমিক মানুষেরা তাদের ত্যাগের আদর্শ রেখে গেছেন। তারা এই পৃথিবীকে করতে চেয়েছেন সুন্দর, কল্যাণকর, শান্তিময়। কিন্তু মানুষের এই স্বপ্ন আজো স্বার্থক হয় নি। যে লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে তারা জীবন উৎসর্গ করেন মানুষ সেই ত্যাগ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনকে আরাে দুঃখময় করে তােলেন। মানুষ জীবন দেয় ঠিকই কিন্তু তার অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ হয় না। আজো পৃথিবীতে হিংসা, দ্বেষ, হানাহানি, অশান্তি দূর হয় না, মানুষের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। তবে কি
‘বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা / তার যতাে মূল্য সেকি ধরার ধুলায় হবে হারা?’

মানুষের সার্বিক মুক্তি ও কল্যাণ ছাড়া এইসব মহৎ আত্মত্যাগ ও জীবন উৎসর্গ প্রকৃত মর্যাদা পাবে না। আমরা যদি বীর, বিপ্লবী, ত্যাগী দেশপ্রেমিকদের মর্যাদা দিতে চাই তাহলে তাদের কর্ম ও আদর্শকে মূল্য দিতে হবে। তাহলেই তাদের জীবনদান ও দেশপ্রেম সার্থক হবে। আর এটাই হচ্ছে দেশপ্রেমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের শ্রেষ্ঠ উপায়। এটাই হচ্ছে দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ।

উপসংহার

স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়
দাসত্বশৃঙখল বল কে পরিবে পায় হে
কে পরিবে পায়। (রঙ্গলাল)।

জন্মভূমি সকলেরই প্রিয়, তা রক্ষার দায়িত্বও সকলের। তবে মনে রাখতে হবে নিজের দেশকে রক্ষার নামে অপরকে আক্রমণ করা মানবতাবিরোধী। স্বদেশপ্রেমের মতো পবিত্র গুণ আর নেই। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের উচিত স্বদেশকে ভালোবাসা। প্রকৃত দেশপ্রেমী মানুষ সকলের কাছে পরম পূজনীয়। দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মত্যাগকারী ব্যক্তিই বিশ্ববরেণ্য। দেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরই অংশ বিশেষ। নিজস্বার্থকে ত্যাগ করে সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশকে ভালােবাসাই দেশপ্রেম। আর দেশের উর্ধ্বে সমগ্র পৃথিবীকে ভালােবাসাই বিশ্বপ্রেম। বিশ্বপ্রেমের মধ্য দিয়ে সকলের সঙ্গে উদার ভ্রাতৃত্ব ঘােষণা করে বলতে হবেঃ

সব ঠাই মাের ঘর আছে আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া
দেশে দেশে মাের দেশ আছে আমি সেই দেশ লব জুঝিয়া।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

One Comment

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button