
দিন বদলের পালায় বাংলাদেশ রচনাঃ প্রিয় শিক্ষার্থী তোমরা অনেকেই দিন বদলের পালায় বাংলাদেশ রচনাটির জন্য অনুরোধ করেছিলে। বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। তাই বিভিন্ন বই থেকে পয়েন্ট সংগ্রহ করে রচনাটি সুন্দরভাবে তোমাদের জন্য উপস্থাপন করা হল।
রচনা: দিন বদলের পালায় বাংলাদেশ
ভূমিকা
বাংলাদেশের ইতিহাস, এক অর্থে শিকল ভাঙার কাহিনী। বস্তুত হাজার বছর ধরে বাঙালি তার শিক্ষা-সংস্কৃতি, ভাষা-স্বাধীনতাসহ নিজ অধিকার আদায়ে কঠোর সংগ্রাম করে আসছে। বাঙালি বীরের জাতি। যাবতীয় প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করার ঐতিহ্য বাঙালির আছে। আছে যে-কোনো প্রতিকূল পরিবেশে মোকাবেলা করার অদম্য সাহস । এজন্যই কবি সুকান্ত বলেছেনঃ
সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়;
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবুও মাথা নোয়াবার নয়।
শত সমস্যার মধ্যেও আজ আবার নতুন করে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্ন দেখছে দিন বদলের, সমৃদ্ধতর এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের। নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্র তৈরি করাই এখন সময়ের বড় কাজ।
দিন বদলের পালায় আমাদের সফলতা ও অগ্রযাত্রা
স্বাধীনতার পর পাঁচটি দশক গত হয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে নানা ক্ষেত্রে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনীর পরিচয় রেখেছি। পরিবেশ সংরক্ষণ, নারীর ক্ষমতায়ন, অলাভজনক উন্নয়ন উদ্যোগ বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণ, গ্রামীণ অনানুষ্ঠানিক খাতের বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক উদ্যোক্তারা যথেষ্ট সাফল্য দেখিয়েছেন। এদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও পুঁজির সমর্থন দিতে পারলে এরা অসাধ্য সাধন করবেন।
কৃষি ক্ষেত্রে এসেছে ব্যাপক সাফল্য। বাংলাদেশ আজ কৃষিতে আত্মনির্ভরশীল । এটা ১৫ বছর আগেও কল্পনা করা যেত না। কৃষি খাতে আধুনিক ধারার প্রবর্তন ঘটেছে। বিশেষ করে হাইব্রিড শস্যের চাষাবাদ, আধুনিক সেচ পদ্ধতি। কৃষিতে বহুমুখীকরণ বিশেষ করে শাকসবজি উৎপাদন বেড়েছে কল্পনাতীতভাবে। কৃষিজাত দ্রব্যের রপ্তানিতেও বেশ এগিয়েছে। বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ৪ কোটি মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।
[box type=”note” align=”” class=”” width=””]আরও পড়ুনঃ রচনা: বাংলাদেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষি উন্নয়ন[/box]
আমাদের খাদ্য চাহিদার মাত্র ১০-১৫ শতাংশ আমদানি করতে
হয়। স্বাধীনতার পর আমাদের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে, তা হলো প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ। গড়ে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে আড়াই থেকে তিন লক্ষ জনশক্তি চাকরি নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। এ যাবৎ এদেশের প্রায় ত্রিশ লক্ষ নাগরিক পৃথিবীর নানা দেশে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে গিয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় অনেক এগিয়ে গেছে। নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য উপবৃত্তি চালু করা হয়েছে।
দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, যেমন- গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, প্রশিকা, আশা প্রভৃতি ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আইটি খাত রপ্তানি বাণিজ্যে বিশেষ অবদান রাখতে শুরু করেছে। দেশে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে। বলতে গেলে বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এগিয়ে চলেছে।
দিন বদলের পালায় আমাদের সমস্যা ও সম্ভাবনা
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে সভ্যতার রূপ, পাল্টে যাচ্ছে তার পারিপার্শ্বিক জীবনব্যবস্থা। নতুন শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও প্রস্তুতি চলছে নিজেকে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে সম্মানজনক স্থানে প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু সম্প্রতি আমাদের জাতীয় জীবনে নানা কারণে বিশৃঙ্খলা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে স্বার্থান্বেষী মানুষ মাত্রই মেতে উঠেছে ক্ষমতাধর হওয়ার প্রতিযোগিতায়। কল্যাণমুখী রাজনীতি হয়ে পড়েছে কলুষিত। তার ফল হয়েছে ভয়াবহ। শিক্ষার ক্ষেত্রে, সমাজজীবনের অলিতে-গলিতে উচ্ছৃঙ্খলতার ভয়াবহ রূপ দেখা যাচ্ছে। একদিকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব- কলহ, অপরদিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা, ফলে শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য, সমাজসেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা যুবসমাজকে বিপথগামী করেছে।

সমাজজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির থাবা বিস্তৃত হচ্ছে। গোটা প্রশাসনকে দুর্নীতিবাজদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র বানিয়ে একশ্রেণির রাজনীতিক-অসাধু ব্যবসায়ী এবং দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতিবাজেরা বিদেশি অর্থ, সাধারণের বাস্তুভিটা, খাল-বিল, নদী-নালা, পাহাড়, বন-বাদাড় দখল করে বিলাস-ব্যসনে মত্ত হয়েছে। ওদিকে বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে আমাদের সমাজজীবনে চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে।
দিন বদলের পালা ও সরকারি উদ্যোগ
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নানা সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা, ভুল-ত্রুটি ও সফলতা নিয়ে প্রায় ২ বছর সময়কাল অতিক্রম করেছে। এ সময়ে সরকার বিচার বিভাগ পৃথককরণ, নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস, দুদক প্রভৃতি পুনর্গঠন করেছে। সরকারের আরেকটি ইতিবাচক কাজ হলো ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী এ কাজটি সম্পন্ন করায় প্রশংসা অর্জন করে। সরকার নির্বাচনি আইন এবং প্রক্রিয়ারও উল্লেখযোগ্য সংস্কার করে। এসব সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অতীতের সকল গ্লানি, ব্যর্থতা, সংঘাতময় রাজনীতির ঐতিহ্য পেছনে ফেলে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বাধীনতার অঙ্গীকার ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের অভিশাপমুক্ত উন্নত ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমনঃ
(১) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ ও বিশ্বমন্দার মোকাবেলায় সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। (২) দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা করা। (৩) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন । (৪) দারিদ্র্য ঘুচাও বৈষম্য রুখো নীতি গ্রহণ। (৫) সুশাসন প্রতিষ্ঠা। (৬) স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ। (৭) কৃষি ও পল্লি উন্নয়ন। (৮) পরিবেশ ও পানি সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা। (৯) শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার। (১০) শিক্ষার মানোন্নয়ন। (১১) নারীর ক্ষমতায়ন। (১২) শিশু-কিশোর কল্যাণ। (১৩) যুবসমাজ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। (১৪) মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা। (১৫) ধর্মীয় সংখ্যালঘু, অনুন্নত সম্প্রদায় ও অনগ্রসর অঞ্চলের উন্নয়ন। (১৬) গণমাধ্যমে স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্য-প্রবাহ নিশ্চিত করা। (১৭) শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গঠন। (১৮) সংস্কৃতি ও ক্রিয়ার উন্নয়ন। (১৯) পররাষ্ট্রনীতি জোরদার। (২০) সুশাসনের জন্য আইনের শাসন ও দলীয়করণ রোধ। (২১) রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন (২২) দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন। (২৩) নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়ন। (২৪) অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উদ্যোগ। (২৫) দেশ গঠন ও দেশ পরিচালনায় তরুণদের অংশগ্রহণ, তাদের সৃজনশীলতা বিকাশের সর্বোচ্চ সুযোগ করে দেয়া।
রূপকথা (ভিশন ২০২১) অনুযায়ী কতিপয় লক্ষ্যমাত্রা
(১) ২০১০ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে নিট ভর্তির হার হবে ১০০%। (২) ২০১১ সালের মধ্যে দেশের সব মানুষের জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা। (৩) ২০১২ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে। (৪) ২০১৩ সালের মধ্যে প্রতিটি বাড়িকে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে। (৫) ২০১৩ সালে বার্ষিক অর্থনৈতির প্রবৃদ্ধির হার হবে ৮%। (৬) ২০১৭ সালে এই হার ১০% উন্নীত করে অব্যাহত রাখা হবে। (৭) ২০১৩ সালে বাংলাদেশের বিদ্যুতের ব্যবহার হবে ৭ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০১৫ সালে ৮ হাজার মেগাওয়াট। (৮) ২০২১ সাল নাগাদ দেশের মোট বিদ্যুৎ ২০ হাজার মেগাওয়াট ধরে নিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। ২০২১ সালে জাতীয় আয়ের বর্তমান হিসাবে কৃষিতে ২২; শিল্পে ২৮ ও সেবা খাতে ৫০%-এর পরিবর্তে হবে যথাক্রমে ১৫, ৪০ ও ৪৫%। (১০) ২০২১ সালে বেকারত্বের হার বর্তমান ৪০% থেকে ১৪ শতাংশ নেমে আসবে। (১১) ২০২১ সালের মধ্যে দেশের ৮৫ শতাংশ নাগরিকের মানসম্পন্ন পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত হবে। (১৪) ২০২১ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ। (১৫) ২০২১ সালের মধ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতিদিন ন্যূনতম ২১২২ কিলো ক্যালোরির ঊর্ধ্বে খাদ্য নিশ্চিত করা হবে। (১৬) সকল প্রকার সংক্রামক ব্যাধি সম্পূর্ণ নির্মূল করা হবে। (১৭) ২০২১ সালে গড় আয়ুকাল ৭০-এর কোটায় উন্নীত হবে। শিশু মৃত্যুর হার ৫৪ থেকে ১৫%-এ নামিয়ে আনা হবে ইত্যাদি। ভিশন ২০২১ পুরোপুরি সফল না হলেও এর লক্ষমাত্রা যে অনেক দূও এগিয়ে গেছে তা নিশ্চিত বলা যায়।
দিন বদলের পালা ও আমাদের করণীয়
স্বাধীনতার ৫০ বছরে সোনার বাংলাকে ঘিরে যে স্বপ্ন আমরা দেখেছি, তা বাস্তবে রূপ দিতে পারিনি। সমাজের কাছে আমরা প্রতিটি মানুষ দায়বদ্ধ। ঋণ পরিশোধের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যও আছে আমাদের। অন্নহীনে অন্ন এবং নিরক্ষরকে জ্ঞানের আলো দিয়ে আমাদের স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে হবে। সব রকম বিভেদ-বিচ্ছেদ ভুলে, হানাহানি-সংঘাত ভুলে, সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা জলাঞ্জলি দিয়ে দেশ গড়ার কাজে ব্রতী হতে হবে, তবেই আমাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিবে।
উপসংহার
স্বাধীন বাংলাদেশের জীবনমান ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন এক জায়গায় থেমে নেই। দিন দলের পালায় আমরা এগুচ্ছি সামনের দিকে। অসামান্য সম্ভাবনার দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। এ সম্ভাবনাকে এতদিন সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়নি। পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো হলে বাংলাদেশ কখনোই পিছিয়ে থাকবে না। অবশ্যই দিন বদল হবে। আর এর জন্যে অনাগত দিনে একটি উন্নত ও আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এ সত্যের বিকল্প নেই।