বাংলা রচনা

রচনা: বাংলাদেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষি উন্নয়ন

2.9/5 - (9 votes)

ভূমিকা

জল ভালা ভাসা, সবার ভালা চাষা

Table of Contents

চাষার বলে দেশটা নাচে, সোনা ফলে গাছে গাছে। – (বাংলা প্রবাদ)

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি এদেশের অধিকাংশ মানুষের প্রধান উপজীবিকা। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রন এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে কৃষিখাতের ভূমিকা অপরিসীম। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই বাংলাদেশের মাঠে প্রান্তরে যে কৃষিদ্রব্য উৎপন্ন হয়, তার সাথে সমগ্র দেশবাসীর ভাগ্য জড়িত। মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া এদেশের প্রায় সকলেই পত্যক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষি উন্নয়ন
ছবিটি তুলেছেন রিমন, (নয়াকান্দি, চাঁদপুর)

কৃষক কাকে বলে

গাহি তাহাদের গান –
ধরণির হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমান।
শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে
ত্রস্তা ধরণি নজরানা দেয় ডালি ভরে ফুলে ফলে। – জীবন-বন্দনা (কাজী নজরুল ইসলাম)

কৃষক এমন একজন ব্যক্তি যিনি কৃষিকাজে নিয়োজিত থেকে ফসল উৎপাদন করেন। একজন কৃষক তাঁর নিজের জমিতে অথবা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কিংবা অন্যের জমিতে শ্রম দিয়ে ফসল উৎপাদনে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু অগ্রসরমান অর্থনীতিতে কৃষক বলতে মূলতঃ যার নিজস্ব খামার বা জমি আছে তাকে বুঝায়। জমিতে নিয়োজিত কর্মীগণ খামার কর্মী, ক্ষেত মজুর ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়ে থাকেন।

বাংলাদেশের কৃষি

বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থা কৃষিভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। এদেশে রয়েছে কৃষি উৎপাদিত অর্থকরী ফসল সােনালি আঁশ পাট। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির সূচনা অপরিসীম। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, এদেশের কৃষিব্যবস্থা অনেকটা সেই প্রাচীন পদ্ধতিরই রয়ে গেছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের কৃষিব্যবস্থাকে পুরােপুরি আধুনিকায়ন করা হয়নি। কৃষি উৎপাদনে কোনাে আমূল পরিবর্তনও আসেনি, যার ফলে আমাদের কৃষি আজ অনেক পিছিয়ে পড়েছে। আমাদের দেশের খাদ্যের যে চাহিদা তা আমাদের কৃষির ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। কিন্তু এটি বিবেচনা করে এ খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, বরং কৃষি আজ অনেক অবহেলিত। অথচ আমাদের দেশে খাদ্য চাহিদা পূরণে কৃষিব্যবস্থা উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন অপরিহার্য।

জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব

কৃষিপ্রধান দেশে কৃষিই জাতির মেরুদণ্ড। জনসংখ্যার বিরাট ভারে মুখথুবড়ে পড়া অর্থনীতির চাকাকে সতেজ করে তুলতে পারে একমাত্র কৃষিকাজ। বিশাল জনগণের নিরন্নমুখে অন্ন জোগাতে হলে প্রয়োজন কৃষির ব্যাপক সম্প্রসারণ।
জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিতে জাতীয় অর্থনীতির যে বিরাট অগ্রগতি হতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাট এবং পাটশিল্পের প্রসার। তাই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একমাত্র সােপান হচ্ছে কৃষি। এছাড়া নিম্নলিখিত বিষয়গুলাে কৃষির গুরুত্বের সঙ্গে জড়িত

১। খাদ্য উৎপাদনে কৃষি ও কৃষক : বাংলাদেশের মােট ভূমির পরিমাণ প্রায় ১৪.৪ মিলিয়ন হেক্টর যার প্রায় ১৩.৩ শতাংশ জুড়ে রয়েছে বনভূমি, ২০.১ শতাংশে রয়েছে স্থায়ী জলাধার ঘরবাডি শিল্পকারখানা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি এবং অবশিষ্ট ৬৬.৬ শতাংশ জমি কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২২ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৮.২৯ লক্ষ হেক্টর। এর ৯০ শতাংশ জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ খাদ্যশস্য কৃষি ও কৃষক জোগান দিয়ে থাকে।

২। পুষ্টি সমস্যা সমাধানে কৃষকের ভূমিকা : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসংখ্যার প্রায় ৯৪ শতাংশ অপুষ্টির শিকার। আমাদের কৃষকরা মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, শাকসবজি জোগান দিয়ে দেশের মানুষের পুষ্টিহীনতা দূর করতে অবিরাম কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

৩। শিল্পায়নে কৃষি ও কৃষকের অবদান : শিল্পায়নের ক্ষেত্রে কৃষি ও কৃষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প, চিনিশিল্প, কাগজ শিল্পের প্রধান উপকরণ আসে কৃষি থেকে। এরকম আরও ছােট-বড় অনেক শিল্প রয়েছে যার কাঁচামাল আমরা কৃষি থেকে পেয়ে থাকি।

৪। রপ্তানি আয়ে কৃষি ও কৃষির ভূমিকা : চা, পাট, বস্ত্রসহ যেসব উপকরণ আমরা বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক
মুদ্রা অর্জন করছি তা প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষভাবে কৃষি থেকে আসে। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১৩.২৯ শতাংশ (২০২০-২১)।

৫। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৃষির ভূমিকা : এমন অনেক কর্মসংস্থান রয়েছে যা প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষভাবে কৃষি ও কৃষকের
সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন- কৃষক যখন কৃষি কাজ করে তখন বিভিন্ন পর্যায়ে তাকে শ্রমিক নিয়ােগ করতে হয়। পাশাপাশি কৃষি থেকে উৎপন্ন কাঁচামাল দিয়ে প্রতিষ্ঠিত শিল্প-কারখানায় নতুন নতুন কর্মের সংস্থান হচ্ছে। দেশে মোট কৃষি পরিবারের সংখ্যা মোট ১,৬৫,৬২,৯৭৪ (তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২২)

কৃষকের জীবন

বাংলাদেশের কৃষকেরা অতি সহজ ও সরল জীবন-যাপন করে। তাঁদের জীবনের মূল সম্বল একজোড়া হালের গরু ও পুরাতন ভোঁতা কৃষি যন্ত্রপাতি। কৃষকের শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে এ দেশ অনুপম সুন্দর, পুষ্পময় ও মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছে। তপ্ত রোদে, বৃষ্টিতে ভিজে, ঘাম ঝরিয়ে, কঠিন মাটি চিরে নতুন ফসলের অযুত সম্ভাবনায় দেশকে সমৃদ্ধ করছে এ দেশের বাংলার কৃষক। কৃষি নির্ভর এই দেশে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ লোক কৃষিজীবী। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলার কৃষক তাঁদের ন্যায্য অধিকারটুকুও পায় না।

বাংলাদেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষি উন্নয়ন

অবহেলা অনাদরে নীরব কষ্টে দিন পার করে তারা। অথচ, তারাই দেশের স্বার্থে নিজের সুখ-শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। চরম দারিদ্র্যের সাথে সর্বদা তাঁদেরকে লড়াই করতে হয়। একবেলা খেয়ে, না খেয়ে, অর্ধনগ্ন থেকে বর্ষায় ভিজে, শীতে কেঁপে তাঁদের দুঃখের জিবন-যাপন করতে হয়। রোগে, শোকে, দুঃখে ও পরিশ্রমে একজন কৃষক কঙ্কালসার হয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় দিন যাপন করে। দারিদ্র্যের দুঃসহ পীড়নের ফলে সে রোগে অউসধ-পথ্য কিনতে পারেনা। শান্তিময় সচ্ছল জীবনের কণামাত্রও সে আস্বাদন করতে পারে না। তবুও মাঠ ভরা সোনার ফসল দেখলে তাঁদের মন আনন্দে নেচে ওঠে।

কৃষকদের অতীত অবস্থা

পূর্বে দেশের জনসংখ্যা কম ছিল, সেই অনুপাতে জমির পরিমাণ ছিল বেশি। উর্বরাশক্তি অনেক বেশি ছিল বলে জমিতে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হতাে। সেজন্য তখনকার দিনে কৃষককুলকে দুঃখকষ্টের সম্মুখীন হতে হতাে না। তাদের জীবনযাত্রার মান বর্তমানের ন্যায় এত নিম্নস্তরের ছিল না। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার বিবরণ থেকে জানা যায়, সে যুগের কৃষকদের গােলা ভরা ধান ছিল, গােয়াল ভরা গােরু ছিল, পুকুর ভরা মাছ ছিল। ফলে তাদের কণ্ঠে ছিল সুখের গান। কিন্তু কালক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমতে শুরু করে। তার ওপর আধুনিক যুগের বৃহদায়তন শিল্পের সাথে প্রতিযােগিতায় টিকতে না পেরে বাংলার কৃষি ও কৃষক আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বিশেষ করে ইংরেজ শাসনামল থেকেই বাংলার কৃষককুলের অবনতি ঘটে চলেছে।

কৃষকদের বর্তমান অবস্থা

কৃষকদের বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত শােচনীয়। দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান তাদের অধিকাংশের নেই। রােগশােক, দুঃখ-দারিদ্র্য এখন তাদের নিত্যসঙ্গী। অশিক্ষা এবং কুসংস্কারে তাদের জীবন দুর্বিষহ এ অবস্থার পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যথা :

  • নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের মানুষ সভ্যতার চরম শিখরে গেলেও আমাদের কৃষক সমাজ ও কৃষি এখনাে পশ্চাৎপদ রয়ে গেছে।
  • কৃষকেরা মান্ধাতার আমলের কৃষি পদ্ধতিতেই কৃষিকাজ করে চলেছে।
  • ভোতা লাঙল আর অর্ধ-মৃত দুটি বলদই কৃষকদের ভরসা।
  • আবাদি জমির পরমান কমে যাওয়া।
  • পরিশ্রমের তুলনায় ন্যায্য পারিশ্রমিক না পাওয়া।

বাংলাদেশের কৃষি সমস্যা

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। অন্যদিকে দেশের কৃষকদেরও অবস্থার কোন উন্নতি হচ্ছে না। ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কারণে এদেশে একর প্রতি ফলন কম হয়। ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। নিন্মে বাংলাদেশের কৃষি সমস্যাগুলো উল্লেখ করা হলঃ

প্রকৃতি নির্ভর

বাংলাদেশের কৃষি প্রকৃতি নির্ভর। আমাদের দেশে সেচ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের উপর কৃষকদের নির্ভর করে থাকতে হয়। সময়মত ও পরিমিত বৃষ্টিপাত হলে ফসল ভালো হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় অধিকাংশ সময় মৌসুমি বায়ুর খামখেয়ালির জন্য বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হয়। এজন্য বলা হয়ঃ

Agriculture system of Bangladesh is a gamble of the Monson

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

বাংলাদেশের কৃষি সমস্যার অন্যতম প্রধান কারন হল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অতি বৃষ্টির জন্য বন্যা ও জলাবদ্ধতা, অনাবৃষ্টির জন্য খরা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বা্‌ ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বিভিন্ন সময়ে কোটি কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয় এবং কৃষকগণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সনাতন পদ্ধতির চাষাবাদ

দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে এগিয়ে গেলেও আমাদের দেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে আধুনিক পদ্ধতি চাষাবাদ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে কৃষকগণ সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে চলছে। ফলে কৃষিযোগ্য প্রচুর উর্বর জমি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে একর প্রতি ফলন অত্যন্ত কম এবং ফসলের মান ও গুণ নিম্নমানের।

সার ও উন্নত বীজের অভাব

ভালো সার ও উন্নত বীজের অভাবে বাংলাদেশে কৃষির উন্নতির ব্যাঘাত ঘটছে। বাংলাদেশের কৃষকরা অশিক্ষিত এবং দরিদ্র হওয়ায় উৎকৃষ্ট সার ও বীর জোগাড় করতে পারে না এবং এগুলোর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে তাদের জ্ঞান সীমিত।

অশিক্ষিত ও দরিদ্র কৃষক

বাংলাদেশের কৃষক একদিকে দরিদ্র এবং অপরদিকে অশিক্ষিত। তাছাড়া তারা সহজে নানারকম কুসংস্কার আর অদৃষ্টবাদীতায় বিশ্বাস করে। তাই আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান সীমিত। ফলে সরকারের প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও কৃষির আধুনিকরণ সম্ভব হয়ে উঠছে না।

ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থা

বাংলাদেশের কৃষকদের দুরবস্থার আরো একটি অন্যতম কারণ হলো ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থা। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার অভাব, পণ্য সংরক্ষণের অভাব, অধিক মধ্যস্বত্ব কারবারি উপস্থিতি, সংঘটিত বাজারের অভাব বিদ্যমান। ফলে কৃষকগণ ফসলের ন্যায্য মূল্য পায়না।

প্রয়োজনীয় মৌসুমি মূলধনের অভাব

চাষের মৌসুমে প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে কৃষকরা কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি যেমনঃ লাঙ্গল, গরু, বীজ, সার, কীটনাশক ওষুধ ইত্যাদি সময় মতো যোগান দিতে পারে না ফলে কৃষিকার্য বাধাগ্রস্থ হয়।

পানি সেচের অভাব

কৃষকদের দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ হলো পানি সেচের অভাব। খরা বা শুষ্ক মৌসুমের বৃষ্টির পানির উপর নির্ভর করে জমি চাষাবাদ করা সব সময় সম্ভব হয় না। ফলে অনেক জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়।

ভুমিক্ষয়

বাংলাদেশের কৃষকদের দুরবস্থার আরও একটি কারণ হলো ভূমিক্ষয়। ভূমিক্ষয়ের কারণে মাটির উপরিভাগে পলিমাটি অপসারিত হয়ে ভূমির উর্বরতা কমে যায় এবং লবণাক্ততা বেড়ে যায়। যার ফলে ফসল উৎপাদন কম হয়।

জলাবদ্ধতা ও লবনাক্ততা

জলাবদ্ধতা ও লবনাক্ততা বাংলাদেশের কৃষির উন্নতির প্রধান অন্তরায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় হাওর ও বিলে বিপুল পরিমাণ জমি জলাবদ্ধতার কারণে অনাবাদি অবস্থায় পড়ে থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষিযোগ্য ফসল প্রায় প্রতি বছরই সমুদ্রের লোনা পানি ঢুকে নষ্ট করে ফেলে।

অন্যান্য কারণসমূহ

কৃষি সমস্যার অন্যান্য কারণগুলো হলঃ কৃষি ঋণের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ ভূমি ব্যবস্থা, মৌসুমি বেকারত্ব, কীটনাশক ঔষধের অভাব, ভূমির মালিকানা, কীটপতঙ্গের আক্রমণে ফসল নষ্ট ইত্যাদি।

কৃষি সমস্যা সমাধানের উপায়

কৃষির উপর এদেশের অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই কৃষি উন্নয়ন ও কৃষকদের দুরাবস্থা দূর করার জন্য কৃষি সমস্যা সমাধান করা প্রয়োজন। সেইসাথে কৃষি বহুমুখীকরণ করা অতীব জরুরি। কৃষি বহুমুখীকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে প্রাচীন চাষ পদ্ধতির বদলে আধুনিক ও উন্নত পদ্ধতি প্রয়োগ ঘটানো। কৃষি সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নের বিষয়গুলো বিবেচনা করা প্রয়োজন।

কৃষি আধুনিকীকরণ

দেশে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটলেও কৃষি আধুনিকীকরণে এর কোন প্রভাব পড়েনি। তার মূল কারণ হলো বেশির ভাগ কৃষক সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদে অভ্যস্ত। তাছাড়া কৃষকদের স্বল্প মূলধনে কৃষির আধুনিক যন্ত্রপাতির যোগান দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই কৃষি আধুনিকীকরণে কৃষকদেরকে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাথে পরিচিত করার পাশিপাশি এর সঠিক ব্যবহার ও অর্থের যোগানের ব্যবস্থা করতে হবে।

অনাবাদী জমি চাষ

বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল ও হাওড় এলাকায় বহু জমি পতিত রয়েছে। তাছাড়া ভিটেমাটি, পুকুরের পাড়, বাড়ির আশেপাশে অনাবাদী জমিতে তরকারি, শাকসজি, বৃক্ষরােপণ ও ফল-মূলের চাষ করা প্রয়ােজন। কেননা কোনাে প্রকার জমি পতিত রাখা যাবে না । গ্রামাঞ্চলে খাস পুকুর ও হাজামজা পুকুরগুলােকে সংস্কার করে মাছের চাষ করা প্রয়ােজন।

শুষ্ক মৌসুমে পানি সেচ

পানি সেচের অভাবে আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণ জমি অনাবাদী থাকছে। প্রকৃতির খেয়ালখুশির ওপর নির্ভর না করে গভীর নলকূপ স্থাপন, খাল-খনন, নদী সংস্কার ইত্যাদির মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি সেচের ব্যবস্থা করে জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসলের চাষ করতে হবে।

বিকল্প ফসল উৎপাদন

আমাদের দেশে প্রতি বছর একই জমিতে একই প্রকার ফসল উৎপাদনের জন্য জমির উর্বরতা হ্রাস পায়। উচ্চফলনশীল বীজ ও সার ব্যবহার করে একই জমিতে বছরে তিন-চার ধরনের ফসল ফলানাে যায়।

জলাবদ্ধ ও নিচু জমি চাষ

জলাবদ্ধতা দূরীকরণের মাধ্যমে কৃষির বহুমুখীকরণ সম্ভব । শক্তিশালী পাম্পের সাহায্যে পানি নিষ্কাশন করে নিচু জলাবদ্ধ জমিকে চাষের আওতায় আনতে হবে।

সমবায় খামার গঠন

বাংলাদেশে উত্তরাধিকার আইনের ফলে কৃষিজমি বহুখণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জমির খণ্ডিতকরণ রােধ ও অধিক ফসল ফলানাের জন্য সমবায় চাষ পদ্ধতি প্রবর্তন করা প্রয়ােজন। এতে পরিকল্পিত উপায়ে বিভিন্ন জাতের ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

কৃষি প্রশিক্ষণ প্রদান

কৃষি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অদক্ষ কৃষকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

সহজ শর্তে ঋণ

বেশিরভাগ কৃষক দরিদ্র হওয়ার কারণে অর্থের অভাবে কৃষি উপকরণ সঠিক সময়ে সরবরাহ করতে পারে না। এতে উৎপাদন কম হয়। তাই কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে পারলে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

ভালো বীজ সরবরাহ

বীজ ভালো না ফলে ফলন ভালো হয় না। তাই কৃষকদেরকে ভালো বীজ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষি সমস্যা অনেকটাই লাঘব করা সম্ভব হবে।

কৃষি উন্নয়নে সরকারের গৃহীত উদ্যোগ

দেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকার টেকসই সার বিতরণ নেটওয়ার্ক গঠন করার মাধ্যমে কৃষকের কাছে সব ধরনের সার সময়মতো পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। চার, বেসরকারি বীজ আমদানিকে উৎসাহিত করায় দেশে ভুট্টা, সবজি, গোলআলু এবং পাট বীজ সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিটি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে ল্যাব উন্নয়নসহ নানামুখী গবেষণা পরিচালনা করার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য সরকার বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে কৃষি বিষয়ক অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছে। যা কৃষি বহুমুখীকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

‘খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্পের মাধ্যমে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে ২৫% কম মূল্যে ৩৫টি জেলায় ৩৮ হাজার ৩২৪টি বিভিন্ন প্রকার কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে। তাছাড়া বিএআরআই এবং বিআরআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি মোট মূল্যের ৬০% পর্যন্ত ভর্তুকি মূল্যে কৃষকের নিকট সরবরাহ করে যাচ্ছে। কৃষকের উৎপাদন খরচ হ্রাস করার জন্য সরকার বিদ্যুতের রিবেট প্রদান করেছে এবং বীজ, সারসহ ইক্ষু চাষিদের সহায়তা ভর্তুকি বছর বছর বৃদ্ধি করেছে।

সরকার অঞ্চলভিত্তিক ১৭টি সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এলাকা উপযোগী ফসলের জাত উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, সেচ অবকাঠামো নির্মাণ করে সেচের আওতা বৃদ্ধি করা, কৃষিজাত পণ্যের বাজার সুবিধা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের ১০টি কৃষি অঞ্চলে ২৪৫টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) স্থাপন করা হয়েছে।

সরকার নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে ফসল উৎপাদনে প্রণোদনা প্রদান করেছে ও কৃষি পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।

উপসংহার

কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। অর্থনীতির অন্যান্য খাতের প্রবৃদ্ধির হার তুলনামুলকভাবে বেশী হওয়ায় অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব পূর্বের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। যদি একক খাত হিসেবে কৃষির অবদান অন্যান্য খাত থেকে এখনও অনেক বেশি। তাই কৃষি খাতের উন্নতির জন্য কৃষি সমস্যা চিহ্নিত করে সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের শিক্ষিত সচেতন মানুষদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।

তথ্যসূত্র

১. কৃষক – উইকিপিডিয়া

২. ইবনে বতুতা – উইকিপিডিয়া

৩. কৃষি পরিসংখ্যান – http://www.brri.gov.bd/

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button