
মুজিববর্ষ রচনা
প্রিয় শিক্ষার্থী, তোমরা অনেকেই মুজিববর্ষ রচনাটির জন্য অনুরোধ করেছিলে। তাই তোমাদের জন্য বিভিন্ন বই থেকে পয়েন্ট নিয়ে সুন্দরভাবে রচনাটি উপস্থাপন করা হল। আশা করি তোমাদের উপকারে আসবে।
ভূমিকা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। বার বার কারাবরণ করেছেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, মামলা-হামলা সবকিছু উপেক্ষা করে নিজ আদর্শে অবিচল থেকেছেন। অন্যায়ের সঙ্গে তিনি কখনো আপোস করেননি। কখনো মাথা নত করেননি। তিনি বলেছেন, ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ।’ তাঁর জন্মশতবর্ষ তাই আমাদের কাছে এক অবিস্মরণীয় দিন।
মুজিবের জন্ম, পারিবারিক পরিচয় ও শৈশব
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ, মঙ্গলবার রাত ৮টায়, সাবেক ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুন। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান সরকারি আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। পিতা-মাতার ছয় সন্তানের মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন তৃতীয়। বাড়িতে পরিচিতরা তাঁকে ডাকতেন ‘খোকা’ নামে। বঙ্গবন্ধুর বড় বোনের নাম ফাতেমা বেগম, সেজ বোন হেলেন, মেজ বোন আছিয়া বেগম এবং ছোট বোন লাইলী। বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের। ছেলেবেলা থেকেই শেখ মুজিব খেলাধুলা ও নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। বিদ্যালয়ে শিক্ষাকালীন একাধিক খেলায় পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি ।

মুজিবের ছাত্রজীবন
মাত্র ৭ বছর বয়সে ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর ১৯২৯ সালে তিনি ভর্তি হন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। এরপর ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন করেন। তারপর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৪৪ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে আইএ এবং ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করেন। সেই বছর ভারত বিভাগের পর শেখ মুজিব আইন অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তবে ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এ জন্য তিনি আইনের পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। যদিও ২০১০ সালে এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে স্থাপন করেছে বঙ্গবন্ধু চেয়ার।
রাজনীতিতে মুজিব
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবদ্দশায় ব্রিটিশ, ভারত, পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ-এই তিনটি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ভোগ করেছেন। রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি হয় ১৯৩৯ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে পড়ার সময়। তবে প্রকৃতপক্ষে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িয়ে পড়েন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়াশোনা শুরু করার পর। ১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে তিনি ব্রিটিশ ভারত থেকে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান তৈরি সংক্রান্ত আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
এরপর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর তাঁর কর্মক্ষেত্র হয় ঢাকা শহর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পরে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এই প্রতিষ্ঠান তাঁকে বিক্ষিপ্ত আন্দোলনের মুখ থেকে ছাত্রনেতার আসনে উন্নীত করে। এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হন। তার কিছুদিন পর তিনি মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগে যোগদান করে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন ৷
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ
প্রতিনিয়ত তৎকালীন শাসকের দমনমূলক নীতির দ্বারা শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান থেকে একাধিকবার শাসকবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে গ্রেফতার হন। অবশেষে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তিনি স্বাধীনতার ডাক দেন। ৭ই মার্চ, বাঙালি জাতির নতুন দিগন্ত সূচনার এক ঐতিহাসিক দিন। এ দিন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বলেন,
রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। তবু এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা
দীর্ঘ টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ২৫শে মার্চ রাত বারোটা কুড়ি মিনিটে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সর্বস্তরের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশ মুক্ত করার আহ্বান জানান । তার অতি অল্পক্ষণের মধ্যে তিনি শেষ বারের জন্য গ্রেপ্তার হন। তার পরদিনই রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক নিধনযজ্ঞ শুরু করে। এমতাবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ও পুলিশ রেজিমেন্টে কর্মরত বাঙালিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তি আন্দোলনের উদ্দেশ্যে গঠিত মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। এই পর্যায়ে মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এই মুক্তিবাহিনী এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। তারপর সে বছরের ডিসেম্বর মাস নাগাদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী যোগদানের পর পাকিস্তানি বাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। অবিলম্বে শেখ মুজিব করাচির কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দিল্লি হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের সামনে এক আবেগঘন বক্তৃতা দেন ।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী
নবগঠিত রাষ্ট্রের পুনর্নির্মাণ সংগ্রামে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তি আন্দোলন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনরায় গড়ে তোলার কাজে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ সময় তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিস্তৃত পরিসরে জাতীয়করণ কর্মসূচি কার্যকর করা হয়। শরণার্থী পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া
শাসন বিতর্কে মুজিব
স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে নানা অভাব-অভিযোগ উঠতে থাকে । প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের প্রথম দিকে দেশজুড়ে ব্যাপক জাতীয়করণ ও শ্রমিক সমাজতন্ত্রের নীতি প্রবর্তনের মতো প্রক্রিয়াগুলো অদক্ষতা, মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি এবং দুর্বল নেতৃত্বের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার কারণে মুজিবের ওপর ইসলামপন্থী নেতৃবৃন্দ অসন্তুষ্ট হন। এর মধ্যেই এই অসন্তোষে নতুন মাত্রা যোগ করে ১৯৭৪ সালে দেশব্যাপী দেখা দেওয়া দুর্ভিক্ষের ঘটনা। এই সময়ে দ্রব্যমূল্যের অসামঞ্জস্যতা, স্বজনপোষণ, শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা তথা ভারতের ওপর সর্বক্ষেত্রে অধিক নির্ভরশীলতার কারণে শেখ মুজিবকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। এমন পরিস্থিতির সমাধানের জন্য শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করেন। এমন পরিস্থিতিতে মুজিবের প্রাক্তন সহযোগীরাও মুজিববিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাতে লিপ্ত হন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনের এক করুণ অধ্যায়। এদিন ভোরে কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা বাঙালির জাতির কাণ্ডারিকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করে। এ হত্যাকাণ্ড কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ছিল না, ছিল মুজিব নামের বটবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করার নীলনকশা। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী একদল নরপশু তাদের ষড়যন্ত্রের নীলনকশা অনুযায়ী এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা ছিল মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় এবং বাঙালির অপূরণীয় ক্ষতি।
মুজিববর্ষ কী
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালনের জন্য ঘোষিত বর্ষকে মুজিববর্ষ বলে। এ ছাড়াও মুজিববর্ষেই (২০২১ সালের ২৬ মার্চ) বাংলাদেশ স্বাধীনতার অর্ধ-শতবার্ষিকীতে পদার্পণ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় ঘোষিত বর্ষটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। উপমহাদেশে অশোকবর্ষের পর আর কোনো বর্ষ নেই। যুক্ত হলো মুজিববর্ষ। তাই আমাদের গর্বের ও গৌরবের সীমা নেই ৷

মুজিববর্ষের স্থায়িত্বকাল
বাংলাদেশ সরকার ২০২০-২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। ১০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়া ক্ষণ গণনার মাধ্যমে ১৭ মার্চ মুজিববর্ষে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। ১৭ মার্চ, ২০২০ থেকে শুরু হয়ে ১৭ মার্চ, ২০২১ সাল পর্যন্ত মুজিববর্ষের কর্মকাণ্ড চলে। কিন্তু পরবর্তীতে করোনা ভাইরাসের কারণে মুজিববর্ষের গ্রহণ করা কর্মসূচিগুলো নির্ধারিত সময়ে যথাযথভাবে করতে না পারায় মুজিববর্ষের মেয়াদ প্রায় ৯ মাস বাড়ানো হয়। এ সময়কাল ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বাড়িয়ে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এক প্রজ্ঞাপনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানায়, “স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের লক্ষ্যে সরকার ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ সময়কে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। মুজিববর্ষ উদ্যাপনের লক্ষ্যে গৃহীত কর্মসূচিগুলো কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির কারণে নির্ধারিত সময়ে যথযাথভাবে করা সম্ভব হয়নি।
বছরব্যাপী মুজিববর্ষের আয়োজন
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং বাংলাদেশে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ৮ মার্চ বাংলাদেশ সরকার এবং জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি জনস্বার্থে ১৭ মার্চের পূর্ব ঘোষিত অনুষ্ঠান ছোট পরিসরে করার ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে আমন্ত্রিত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সফরও বাতিল করা হয়। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ে নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠানও করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিববর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে। ২০২০ সালের ৮ই মার্চ দেশে করোনা মহামারি দেখা দিলে ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে ২০২০ পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন দেশে সাধারণ ছুটি পালিত হয়। যে কারণে এই সময়ের মধ্যে মুজিববর্ষের জন্য গৃহীত নানা কর্মসূচি পালন করা সম্ভব হয়নি।
মুজিবের আদর্শ ধারণ ও চর্চা
১৯৭৫ সালে নিজ দেশের রাজধানী ঢাকার কাছে ধানমন্ডিতে সেনা অভ্যুত্থানের দ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলেও, তাঁর জীবনের আদর্শগুলোর কোনোদিন মৃত্যু হবে না । শেখ মুজিব বিশ্বাস করতেন ‘বাঁচো এবং বাঁচতে দাও’ নীতিতে। স্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণের পর পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে তাঁর নীতি ছিল ‘কারোর সঙ্গে বৈরিতা নয় সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’। এই নীতির দ্বারাই তিনি বিভিন্ন বিরোধী রাষ্ট্রের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এই নীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েই তিনি ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালীন কোনো একটি পক্ষে অংশগ্রহণ না করে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগদান করেন। তাছাড়া রাজনৈতিক জীবনের সূচনালগ্নে শেখ মুজিব সমাজতন্ত্র দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই সমাজতন্ত্র এবং মার্কসীয় দর্শনের প্রভাব তাঁর শাসননীতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেও মুজিবের জীবনচর্যা ছিল আর পাঁচটা অত্যন্ত সাধারণ মানুষের মতো। তিনিও সমকালীন বিশ্বের অন্যান্য শুভাকাঙ্ক্ষী নেতার মতো জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণায় বিশ্বাস করতেন। তাই তাঁর আদর্শ ধারণ করে তার চর্চা করা একান্ত উচিত।
শতবর্ষে মুজিবের প্রাসঙ্গিকতা
বাংলাদেশের এই নক্ষত্রসম ব্যক্তিত্বটির জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে এত আলোচনা হওয়ার প্রধান কারণ হলো জন্মের এক শতাব্দী পরেও জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মুজিবের আদর্শগত প্রাসঙ্গিকতা। মুজিব অনুসৃত প্রায় সব নীতি এখনো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। সময় যত এগোচ্ছে বিশ্বজুড়ে ধনতান্ত্রিক বিশ্বায়নের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক বিভিন্ন আদর্শের মিলন ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা তত বেশি অনুভূত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোর সাথে সমাজতন্ত্রের মিলন ঘটানোর এই চেষ্টাই করেছিলেন মুজিব। আবার বাংলাদেশের পক্ষে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগদানের প্রাসঙ্গিকতাও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। আর অন্যদিকে সময় যত এগিয়ে চলেছে, বিশ্বজুড়ে মুজিব অনুসৃত জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা ততই আদর্শ রাষ্ট্রনীতি বলে বিবেচিত হচ্ছে। তাই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, যে মৃত্যুর এতদিন পরেও শেখ মুজিবের দর্শনগুলোর প্রাসঙ্গিকতা এখন তো কমে যায়ইনি, বরং সময়ের সাথে সাথে সেগুলো আরো গুরুত্ব লাভ করেছে।
মুজিববর্ষের চেতনা
বাংলার মানুষকে বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে ভালোবাসতেন। পরম দেশপ্রেম এবং মানুষের প্রতি অক্ষয় ভালোবাসা ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন :
একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা। যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।
বঙ্গবন্ধুর এ কথার মর্মার্থকে আমলে নিয়ে মুজিববর্ষকে আমাদের চেতনায় লালন করতে হবে, গড়ে তুলতে হবে সুখী- সমৃদ্ধ মানুষের সোনার বাংলা ।
উপসংহার
বাঙালির মহাজাগরণের পথিকৃৎ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে দেশটির জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন, যে দেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের কথা ভেবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঘোষিত মুজিববর্ষ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কবির ভাষায় তাই বলতে ইচ্ছে করে-
জন্মেছিলে তুমি, তাই জন্মেছে এই দেশ। মুজিব তোমার আরেকটি নাম স্বাধীন বাংলাদেশ।