
নিরাপদ সড়ক চাই সম্পর্কে ভাষণ: “নিরাপদ সড়ক চাই”-শীর্ষক আলোচনা সভায় উপস্থাপনের জন্য একটি
ভাষণ তৈরি করো।
“নিরাপদ সড়ক চাই”-শীর্ষক আলোচনা সভা উত্তর : আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানের মাননীয় সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথিবৃন্দ এবং আগত সম্মানিত সুধীমণ্ডলী, আসসালামু আলাইকুম ।
সম্মানিত সুধীমণ্ডলী, আমাদের দেশে দিন দিন সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে মানুষ । আবার অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করে অথর্ব জীবন নিয়ে বেঁচে আছেন, যা মোটেই কাম্য নয়। প্রতিটি মানুষই কামনা করে সুস্থ জীবন, স্বাভাবিক মৃত্যু। অথচ আজ আমরা ঘর থেকে বের হলে নিশ্চয়তা দিতে পারি না সুস্থ দেহে ফেরার। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২ হাজার ৭১৩টি। নিহতের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫৮২ জন । ২০১৫ সালে সারাদেশে ২ হাজার ৬২৬টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৩ জন মারা যান, আহত হন ৬ হাজার ১৯৭ জন। ২০১৮ সালের সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয় ৮৫২০ জন, মারা যায় ৩০২৬ জন। ২০১৯ সালে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৭৮৮ জন।
[box type=”note” align=”” class=”” width=””]আরও পড়ুনঃ পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে ভাষণ[/box]
সুধীবৃন্দ, আপনারা জানেন ‘পথ যেন না হয় মৃত্যুর, পথ যেন হয় শান্তির’ -এই স্লোগান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন করছেন অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। ১৯৯৩ সালে ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন ঢাকা থেকে বান্দরবান যাবার পথে চন্দনাইশ এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। সেই থেকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশব্যাপী নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। দীর্ঘ দশ বছর ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা) সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণাসহ নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাতে থাকে। এর প্রেক্ষিতে ২০০৩ সালে তৎকালীন সরকার ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করে। কিন্তু এ ঘোষণা শুধু ঘোষণায় থেকে যায়। বাস্তবে নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে ব্যাপক প্রাণহানিসহ জাতীয় সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। দিন দিন গুণিতক হারে বাড়ছে দুর্ঘটনা। একই সাথে বাড়ছে অকালমৃত্যুর হার ও জাতীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ।
সুধীবৃন্দ, আপনারা জেনে বিস্মিত হবেন যে, বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্টে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন গড়ে ৫৫ জন। আর এদের ৩২ শতাংশই হচ্ছেন পথচারী। চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ট্রাফিক ব্যবস্থার বেহাল দশা, খানাখন্দেভরা সড়ক- মহাসড়ক, ওভারটেক করার প্রবণতা এবং পথচারীদের অজ্ঞতার কারণে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার দুর্ঘটনাকে অনিবার্য করে তুলেছে। যে হারে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে তা একসময় মহামারিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই এখনই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিকার ও প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে ।
[box type=”note” align=”” class=”” width=””]আরও পড়ুনঃ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে একটি ভাষণ[/box]
সুধীবৃন্দ, আমরা আর সড়ক দুর্ঘটনা দেখতে চাই না। প্রতিদিন অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনায় এ দেশের বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করছে, পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে লাখ লাখ মানুষ। একটি সড়ক দুর্ঘটনা বয়ে নিয়ে আসে অপরিসীম যন্ত্রণা। অধিকাংশ পরিবার কর্মক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে হয়ে পড়ে অসহায়। তাই আসুন, সড়ক ব্যবহারে সবাই সচেতন হই। মনে রাখবেন, সড়ক দুর্ঘটনা প্রাকৃতিক নয়, মানবসৃষ্ট কারণ। সে হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার হন। কিন্তু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার জনাকাঙ্ক্ষিত উদ্যোগ নেই বাংলাদেশে । ফলে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। এমন কোনোদিন নেই, যেদিন সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে না, যেদিন সড়ক দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে না। রাস্তায় নামলেই মৃত্যুদূত তাড়া করছে যাত্রী বা পথচারীকে। প্রতিদিনই সাধারণ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় রক্তাক্ত হচ্ছেন, ছিন্নভিন্ন লাশে পরিণত হচ্ছেন। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো এখন মৃত্যু-উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই প্রাণহানি ও সম্পদহানির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। অথচ সড়ক দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করে জুতসই সমাধান-উদ্যোগের কথা সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হলেও বাস্তবে এ বিষয়ে কোনো তৎপরতা নেই। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় জীবনের অপচয় যেন নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ কর্তৃপক্ষ কার্যকর উদ্যোগ নিলে সড়ক দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর মিছিল রোধ করা সম্ভব ।
সুধীবৃন্দ, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি রোজকার ঘটনা। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। জনসচেতনতা, প্রশিক্ষিত চালক ও আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত হলেই নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট মহল। তার আগে জেনে নিই কোন কোন কারণ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হলো অদক্ষ চালক, সড়কের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বেশি, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, রাস্তার জ্যামিতিক ত্রুটি, নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালানো, পথচারী ও যাত্রীদের অসাবধানতা, রাস্তা- ঘাটের বেহাল অবস্থা, দুর্ঘটনার পর মামলা নিতে গড়িমসি ও প্রভাব বিস্তার, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, অনিরাপদ সড়ক এবং আইনের দুর্বলতা, চালক-পথচারীদের ট্রাফিক আইন না জানা, জানলেও না মানা ইত্যাদি। এসব ত্রুটি দূর করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন কমে আসবে বলে বিজ্ঞ মহলের অভিমত। পাশাপাশি প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ ।
সুধীমণ্ডলী, আর নয় অস্বাভাবিক মৃত্যু, চাই স্বাভাবিক মৃত্যু। সচেতনতা গড়ে উঠুক আমাদের সবার। দূর হোক দুর্ঘটনা। সবাইকে ধন্যবাদ।