
“বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা” শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে আগত সম্মানিত প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথিবৃন্দ, অনুষ্ঠানের সভাপতি এবং অভ্যাগত অতিথিবৃন্দ আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আজকে এ মহতী অনুষ্ঠানে কিছু বলার জন্য আমন্ত্রন জানিয়ে আমাকে সম্মানিত করার জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজকদের আমি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
সম্মানিত সুধীমণ্ডলী,
আজ এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে, যা আমাদের দেশের খুব প্রাচীন একটি ব্যাধি। ব্যাধি বললাম এ কারণে যে, আজও বিষয়টি আমাদের সমাজজীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। সেটি হলো বাল্যবিবাহ ।
বাল্যবিবাহ, অর্থাৎ উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগেই কন্যাকে পাত্রস্থ করা। তার মানে হলো, একটি কন্যাশিশুর যখন সমবয়সীদের সঙ্গে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা, খেলাধুলা করার কথা, পড়াশোনা করার কথা এবং পারিবারিক মণ্ডলে বেড়ে ওঠার কথা, ঠিক তখনই তাকে আমরা সংসার নামক জিঞ্জিরে কয়েদ করে ফেলছি। তাতে কী হচ্ছে? তাতে করে অনেক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সে সমস্যাগুলো কী আসুন তা আগে জেনে নেই ।
নারী শিক্ষার অগ্রগতি ব্যাহত হওয়া ছাড়াও বাল্যবিবাহের কারণে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। মা হতে গিয়ে প্রতি ২০ মিনিটে একজন মা মারা যাচ্ছেন।
- প্রতি ঘণ্টায় মারা যাচ্ছে একজন নবজাতক। নবজাতক বেঁচে থাকলেও অনেক সময় তাকে নানা শারীরিক ও মানসিক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়।
- অপ্রাপ্তবয়স্ক মা প্রতিবন্ধী শিশু জন্মদান করতে পারে।
- বাল্যবিবাহের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদের আশঙ্কা তৈরি হওয়া ছাড়াও নানা পারিবারিক অশান্তি দেখা দেয় ৷
- বাল্যবিবাহ শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি করে না, পারিবারিক, সামাজিক এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধনেও সহায়ক হয়। যেমন- শিক্ষার আলো এবং স্বাস্থ্যগত কারণে অল্প বয়সের মেয়েটি তার নিজের সম্পর্কে সচেতন নয়, সুতরাং পরিবার সম্পর্কে তার ধারণা না থাকাই স্বাভাবিক বিষয় ।
- স্বামী, সংসার, শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে বুঝে ওঠার আগেই সংসার এবং পরিবারের ভারে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে শ্বশুরবাড়ির থেকেও তার ওপর চাপের সৃষ্টি হয়, শুরু হয় অশান্তি, পারিবারিক কলহ এবং সর্বোপরি পারিবারিক নির্যাতন ।
- এই পারিবারিক নির্যাতনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার হয় পরিবারের সবাই, বিশেষ করে শিশুরা ভোগে নানা মানসিক অশান্তিতে। এতে তারা লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়, পরিবারের প্রতি জন্মে নানা রকম অনীহা, ফলে তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নানা রকম অনৈতিক কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ে।
- বাল্যবিবাহের শিকার ছেলে ও মেয়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনের মতো মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, যা তাকে তার সারা জীবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করে।
- বাল্যবিবাহ একদিকে আইন এবং সংবিধানের লঙ্ঘন, অন্যদিকে বাল্যবিবাহের বর ও কনেকে তার ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়।
- অপরিণত বাড়ন্ত পুষ্টিহীন শরীরে বেড়ে ওঠে আরেকটি অনাগত ভবিষ্যৎ অপুষ্টিগত অভিশাপের বোঝা নিয়ে। জন্ম দিবে কিছুদিন পর আরেকটি অপুষ্টিতে আক্রান্ত প্রজন্ম। বেড়ে চলে মা ও নবাগত শিশুর জীবনের ঝুঁকি।
সম্মানিত অতিথিবৃন্দ,
বাল্যবিবাহের নেতিবাচক দিকগুলো কী এবং তার প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী আশা করি তা আপনাদের বোধগম্য হয়েছে। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে প্রখ্যাত মনীষী ও দার্শনিক নেপোলিয়ান বোনাপার্টের সেই অমর বাণী, যার মর্মার্থ ছিল এ রকম- একটি সুস্থ জাতি পেতে প্রয়োজন একজন শিক্ষিত মা । আজ এই একুশ শতকে এসেও বাংলাদেশের ৬৬% মেয়ে এখনো শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, যার প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ ।
এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, আগামী প্রজন্মের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতেও বাল্যবিবাহ একটি বড় বাধা। সুতরাং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা সময়ের প্রয়োজনে অপরিসীম। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে এ ব্যাধিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে একটি সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলি, যেখানে আমাদের মেয়েরা আগামী সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে। দেশকে নানাভাবে করবে সমৃদ্ধ ।
সবাই ভালো থাকুন। সচেতন হোন। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বাধার প্রাচীর গড়ে তুলুন- এ কামনা করে আমার বক্তব্য শেষ করছি।