অথবা, দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার [Doinondin jibone biduut rochona]
অথবা, বর্তমান সভ্যতায় বিদ্যুতের অবদান [bortoman sovobotay biduuter obodhan rachona]
অথবা, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সমস্যা ও সমাধান [biduut somosha o somadha rochona]
অথবা, দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুৎ অথবা, বিদ্যুৎ সংকট প্রতিকার
অথবা, প্রাত্যহিক জীবনে বিদ্যুৎ রচনা [pratohik jibone biddut rochona]
সংকেত : সূচনা, বিদ্যুৎ কী, বিদ্যুতের আবিষ্কার, সভ্যতার অগ্রগতিতে বিদ্যুৎ, প্রাত্যহিক জীবনে বিদ্যুৎ, চিকিৎসাক্ষেত্রে বিদ্যুৎ, যােগাযােগ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ, শিল্পোন্নয়নে বিদ্যুৎ, বিদ্যুতের ক্ষতিকর দিক, উপসংহার।
সূচনা
বিদ্যুৎ মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কার। এটি আবিষ্কারের ফলে মানুষের জন্যে অনেক কঠিন ও সাধ্যাতীত কাজ সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়ে ওঠেছে। বিদ্যুৎ অন্ধকারে আলাের ব্যবস্থা করেছে। দূরকে নিকট করেছে, অজানাকে জানার সহজ ও সুন্দর পদ্ধতির আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। বিজ্ঞান নব নব আবিষ্কার এনে দিয়ে মানব সভ্যতাকে প্রতিনিয়তই সমৃদ্ধ হচ্ছে।
বিদ্যুৎ কী
বিদ্যুৎ হচ্ছে একপ্রকার শক্তি। শক্তির সুনিয়ন্ত্রিত প্রয়ােগ ব্যতীত কোনাে কাজই সমাধা করা যায় না। সুনিয়ন্ত্রিত বিদ্যুৎশক্তির সাহায্যে দ্রুততার সঙ্গে অনেক কঠিন কার্য সমাধা করা যায়। বিদ্যুৎশক্তি বর্তমান বিশ্বকে অনেক দ্রুতগামী করে তুলেছে। এ শক্তি মানুষের মন্থর জীবনে এনে দিয়েছে এক চঞ্চল গতিপ্রবাহ। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ কর্ম-সম্পাদনের এক অতুলনীয় জাদু শক্তি।
বিদ্যুতের আবিষ্কার
বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেন। আর এই বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়ােগ-কৌশল কার্যকর করেন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন। বর্তমান সভ্যতার বিকাশ এবং অগ্রগতি সাধনে ফ্যারাডে ও এডিসনের এই আবিষ্কার নবদিগন্ত উন্মােচন করেছে।
সভ্যতার অগ্রগতিতে বিদ্যুৎ
আধুনিক বিশ্ব গৌরবান্বিত এক মহিমা। এই গৌরবান্বিত মহিমা একদিনে গড়ে ওঠেনি। বহু প্রজন্ম পার হয়ে, অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে সভ্যতা আজ আধুনিকতা লাভ করেছে। এই মহিমান্বিত সভ্যতা বিজ্ঞানের অবদান। আর বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় উপকরণ বিদ্যুৎ হচ্ছে আধুনিক সভ্যতার চালিকাশক্তি। বলতে গেলে, বর্তমান সভ্যতা বিদ্যুতের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল বিদ্যুৎশক্তি ছাড়া আজকের দিনে মানুষের পক্ষে এক পা-ও চলা সম্ভব নয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে, কলকারখানায় , সন্ধ্যায় ঘরে আলাে জ্বালাতে, গরম থেকে নিষ্কৃতি পেতে ইত্যাদি প্রতিটি কাজেই বিদ্যুতের আবশ্যকতা রয়েছে। তাই বলা যায়, আধুনিক সভ্যতা বিদ্যুৎনির্ভর সভ্যতা।
প্রাত্যহিক জীবনে বিদ্যুৎ
বর্তমান সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিদ্যুৎ। পৃথিবীকে সম্পূর্ণ করায়ত্ত করার জন্য মানুষ বিদ্যুৎকে বিভিন্নভাবে কাজে লাগাচ্ছে। বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক জীবনের কথা কল্পনাও করা যায় না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম। আমাদের নিত্যপ্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি, যেমন- বৈদ্যুতিক পাখা, বাতি, বেতার, টেপরেকর্ডার, টলিভিশন, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, ফ্যাক্স, ই-মেইল, টেলেক্স, রেফ্রিজারেটর, কম্পিউটার, এয়ারকন্ডিশনার ইত্যাদি পরিচালনায় বিদ্যুতের কোনাে বিকল্প নেই। এছাড়া চিকিৎসাক্ষেত্রে, যােগাযােগ ব্যবস্থায়, অফিস-আদালতে, শিল্পক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ছাড়া গতি নেই। যেমন ঃ
বৈদ্যুতিক পাখা ও বাতি
গ্রীষ্মের তপ্ত আবহাওয়ায় মানুষকে প্রশান্তি এনে দেয়ার ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক পাখার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি ছাড়া মানুষ গ্রীষ্মকালে এক মুহূর্তও চলতে পারে না। আর এর প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে বিদ্যুৎ । অন্যদিকে বৈদ্যুতিক বাতি মানবজীবনের নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসগুলাের মধ্যে একটি। বাসগৃহ, রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত | প্রভৃতি আলােকিত করতে এর প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। এটি ছাড়া শহর-বন্দর এক প্রকার অচল হয়ে পড়ে।
রেফ্রিজারেটর ও এয়ার-কন্ডিশনার
রেফ্রিজারেটর বিজ্ঞানের একটি বিস্ময়কর অবদান। এতে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করা হয়। এটি পচন রােধ করে খাদ্যদ্রব্যকে সতেজ রাখে। আর বিদ্যুৎই এর কার্যক্ষমতা বজায় রাখে। আবার গরম বাতাসকে শােষণ করে বাসগৃহ ও অফিস-আদালতকে শীতল করার কাজে এয়ার-কন্ডিশনার ব্যবহৃত হয়, যা বিদ্যুতের সাহায্যেই চলে।
রেডিও ও টেলিভিশন
রেডিও ও টেলিভিশনের সাহায্যে দেশ-বিদেশের চলতি ঘটনাবলির খবরাখবর জানা যায়। চিত্তবিনােদন, শিক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও তথ্য প্রচার করা হয়। টেলিভিশনের সাহায্যে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ঘটনা জানার পাশাপাশি তা সরাসরি দেখা যায়। আর এর কার্যক্রম বিদ্যুতের সাহায্যেই সম্পাদিত হয়। এছাড়া দূরবর্তী স্থানে সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য টেলিফোন, মােবাইল ফোন, টেলিগ্রাফ, ফ্যাক্স ও ই-মেইল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মূলে রয়েছে বিদ্যুৎ।
কম্পিউটার
বিজ্ঞানের অপর একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার হচ্ছে কম্পিউটার। এটি দ্রুত ও নির্ভুল গণনা এবং তথ্য সংরক্ষণ, ব্যবসায়-বাণিজ্য, চিকিৎসা, খেলাধুলা, প্রকাশনা, শিল্প-কারখানা, শিক্ষা, জনসংখ্যা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রেই এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্লেন ও ট্রেনের আসন সংরক্ষণ করা থেকে শুরু করে দাবা ও বিভিন্ন প্রকার ভিডিও গেম খেলা ইত্যাদি কম্পিউটারের মাধ্যমে করা যাচ্ছে। কম্পিউটারের সাহায্যে ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে অপরাধী শনাক্ত করা যায়। এটি আজ স্থায়ী আসন করে নিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, টেলিযােগাযােগ, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস, পােস্টাল সার্ভিস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে। আর মানবসভ্যতার অগ্রদূত কম্পিউটারের এসব কর্মকাণ্ডের মূলে রয়েছে বিদ্যুৎশক্তির অবদান।
চিকিত্সক্ষেত্রে বিদ্যুৎ
আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রকৃত অর্থেই উন্নততর চিকিৎসা ব্যবস্থা। আর এই উন্নতির পেছনে রয়েছে বিদ্যুতের অপরিসীম অবদান। এক্স-রে বা রঞ্জনরশ্মি আবিষ্কারের ফলে মানুষের দেহের ভেতরকার অবস্থা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হচ্ছে। ইসিজি আল্টাসনোগ্রাফি প্রভৃতি যন্ত্র বিদ্যুৎচালিত এবং এগুলাের রিপাের্টও বিদ্যুৎচালিত কম্পিউটারের মাধ্যমে দ্রুত ও নিখুঁতভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
মুদ্রণশিল্প
জ্ঞান বিকাশের জন্য মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার বিজ্ঞানের একটি বিস্ময়কর সাফল্য। মুদ্রণযন্ত্রের সাহায্যে আজ হাজারাে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই প্রকাশিত হচ্ছে, যা মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান রাখছে। তা ছাড়া সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদ পাঠের দুর্লভ সুযােগ পাওয়া যাচ্ছে। এসব বই ও সংবাদপত্র ছাপার কাজ বিদ্যুতের সাহায্যে সম্পাদিত হচ্ছে।
যােগাযােগ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ
যােগাযােগ ব্যবস্থাকে সহজ ও দ্রুততর করার লক্ষ্যে উন্নত দেশগুলাে তৈরি করেছে অত্যাধুনিক রেলগাড়ি ও বিমান। যার মূলে রয়েছে বিদ্যুৎ। এছাড়া ভূগর্ভে স্থাপিত পাতাল রেললাইনে দ্রুততম টিউব রেল চালু করা হয়েছে, যা বিদ্যুতের সাহায্যে চলে।
শিল্পোন্নয়নে বিদ্যুৎ
আধুনিক সভ্যতায় উন্নত জীবনযাপনের পূর্বশর্ত হচ্ছে শিল্পোন্নয়ন। আর এই শিল্পোন্নয়নের জন্য প্রয়ােজন বিদ্যুৎ। কারণ, বিদ্যুৎ ছাড়া কলকারখানা চলতে পারে না। বিদ্যুৎ কলকারখানার স্থবিরতা দূর করে শিল্পোৎপাদনে গতি সঞ্চার করেছে।
মহাকাশ অভিযানে বিদ্যুৎ
বিদ্যুতের বিস্ময়কর অবদানের একটি অন্যতম ক্ষেত্র হলাে মহাকাশ অভিযান ও মহাকাশ বিজয়। এই বিদ্যুতের সাহায্যেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গণনা, নির্ভুল দিক নির্ণয়, পরীক্ষিত। তাপমাত্রা সংরক্ষণ এবং মহাকাশ অভিযানের হুবহু ছবি পৃথিবীতে প্রেরণ। ইত্যাদির মতাে অকল্পনীয় কাজ বাস্তবে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। বিদ্যুতের সাহায্যেই বিভিন্ন নভােযান ও নভােখেয়া গ্রহ-উপগ্রহে উৎক্ষেপণ করা হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে যুক্তরাষ্ট্রের ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক প্রযুক্তিনির্ভর মহাকাশ সংস্থা নাসা (NASA)
অন্যান্য ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ
বর্তমান সভ্যতা ও আগামী প্রজন্মের অগ্রগতির নিয়ামক হলাে বিদ্যুৎশক্তি। আধুনিক সভ্যতার বিস্ময়কর অবদান রােবট। বিদ্যুতের সাহায্যেই এই যন্ত্রমানবের কাজ চলে। রােবটের সাহায্যেই সাগরতলের রহস্য সন্ধানের মতাে বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ অসাধ্য অনুসন্ধানের কাজ চালানাে হচ্ছে। বিদ্যুতের পরােক্ষ শক্তিকে কাজে লাগিয়েই আধুনিক জৈব-প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎশক্তি ব্যতীত বহুল আলােচিত পারমাণবিক শক্তিকেও কাজে লাগানাে সম্ভব নয়। বিদ্যুতের কল্যাণেই আধুনিক উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে জিন প্রযুক্তির বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মােচন করা সম্ভব হয়েছে। এভাবে আধুনিক জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্ৰই বিদ্যুতের কাছে ঋণী হয়ে পড়ছে।
বিদ্যুতের ক্ষতিকর দিক
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের সীমাহীন উপকারিতার পাশাপাশি কিছু অপকারিতাও রয়েছে। বৈদ্যুতিক শক কেড়ে নেয় মানুষের মূল্যবান জীবন। তাছাড়া বৈদ্যুতিক তার থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের ফলে নষ্ট হয় কোটি কোটি টাকার সম্পদ।
উপসংহার
বিদ্যুৎ আধুনিক জীবন ও সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি। এটি ছাড়া উন্নত ও অভিলাষী জীবন কল্পনা করা যায় না। মাইকেল ফ্যারাডে বলেন : ‘Electricity is the soul of civilization.’ অর্থাৎ, বিদ্যুৎ হচ্ছে সভ্যতার প্রাণ। কিন্তু আমাদের দেশে প্রয়ােজনের তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন খুবই কম। তদুপরি, আমাদের অসচেতনতার কারণে যথেষ্ট বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে। তাই জাতীয় জীবনে উন্নতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদ্যুতের স্বাভাবিক উৎপাদন ও এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।