বহুব্রীহি সমাস কাকে বলে
সে সমাসে সমস্যমান পদগুলাের কোনটির অর্থই প্রধানভাবে না বুঝিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে বুঝায়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমনঃ বহু ব্রীহি (ধান) আছে যার = বহুব্রীহি। এখানে ‘বহু’ কিংবা ‘ব্রীহি’ কোনােটিরই অর্থের প্রাধান্য নেই, যার বহু ধান আছে এমন লােককে বােঝাচ্ছে। একইভাবে, শূল পাণিতে (হাতে) যার = শূলপাণি। এখানে ‘শূল’ পূর্বপদ এবং ‘পাণি’ উত্তর পদ। কিন্তু ‘শূলপাণি’, শব্দ বােঝাচ্ছে মহাদেবকে, যার হাতে শূল আছে। এরকম আরেকটি শব্দ ‘নীলকণ্ঠ’ অর্থাৎ নীল কণ্ঠে যার। এই শব্দে নীল বা কণ্ঠ কোনােটাই প্রধান বক্তব্য নয়; এখানে বুঝতে হবে শিবকে, কেননা বিষপানে শিবের কণ্ঠই নীল হয়ে গিয়েছিল। এই সমাসের ব্যাসবাক্যে যে, যিনি, যার, যাতে ইত্যাদি শব্দের প্রয়ােগ থাকে। যেমন : লােচন যার = আয়তলােচনা (স্ত্রী) , মহান আত্মা যার = মহাত্মা , স্বচ্ছ সলিল যার = স্বচ্ছসলিলা, নীল বসন যার = নীলবসনা, স্থির প্রতিজ্ঞা যার = স্থিরপ্রতিজ্ঞ, ধীর বুদ্ধি যার = ধীরবুদ্ধি।
- ‘সহ’ কিংবা ‘সহিত’ শব্দের সঙ্গে অন্য পদের বহুবীহি সমাস হলে ‘সহ’ ও ‘সহিত’ এর স্থলে ‘স’ হয়। যেমনঃ বান্ধবসহ বর্তমান = সবান্ধব, সহ উদর (অর্থাৎ মাতৃগর্ত) যার = সহােদর
- বহুব্রীহি সমাসে পরপদে মাতৃ, পুত্র, স্ত্রী ইত্যাদি শব্দ থাকলে এ শব্দগুলাের সঙ্গে ‘ক’ যুক্ত হয়। যেমন: নদী মাতা (মাত) যার = নদীমাতৃক, বি (বিগত) হয়েছে পত্নী যার = বিপত্নীক।
- বহুব্রীহি সমাসে সমস্তপদে ‘অক্ষি’ শব্দের থলে ‘অক্ষ’ এবং ‘নাভি’ শব্দ থলে ‘নাভ’ হয়। যেমন- কমলের ন্যায় অক্ষি যার = কমলাক্ষ, পদ্মা নাভিতে যার = পদ্মনাভ।
- বহুব্রীহি সমাসে পরপদে ‘জায়া’ শব্দ স্থানে ‘জানি হয় এবং পূর্বপদের কিছু পরিবর্তন হয়। যেমন- যুবতী জায়া যার = যুবজানি (‘যুবতী’ স্থলে ‘যুব’ এবং ‘জায়া’ থলে ‘জানি’ হয়েছে)।
- বহুব্রীহি সমাসে পরপদের ‘চুড়া’ শব্দ সমস্তপদে ‘চূড়’ এবং ‘কর্ম’ শব্দ সমস্তপদে ‘কর্মা’ হয়। যেমন- চন্দ্র চুড়া যার = চন্দ্রচূড়। বিচিত্র কর্ম যার = বিচিত্রকর্মা।
- বহুব্রীহি সমাসে ‘সমান’ শব্দের থানে ‘স’ এবং ‘সহ’ হয়। যেমন- সমান কর্মী যে = সহকর্মী, সমান বর্ণ যার = সবর্ণ, সমান উদর যার = সহােদর ইত্যাদি।
- বহুব্রীহি সমাসে পরপদে ‘গন্ধ’ শব্দ স্থানে ‘গন্ধি’ বা ‘গন্ধা’ হয়। যথা— সুগন্ধ যার = সুগন্ধি, পদ্মের ন্যায় গন্ধ যার = পদ্মগন্ধা, মৎস্যের ন্যায় গন্ধ যার = মৎস্যগন্ধা।
বহুব্রীহি সমাসের প্রকারভেদ
বহুব্রীহি সমাস আট প্রকার : যথাঃ সমানাধিকরণ বহুব্রীহি, ব্যধিকরণ বহুব্রীহি, ব্যতিহার বহুব্রীহি, মধ্যপদলােপী বহুব্রীহি নঞর্থক বহুব্রীহি, অলুক বহুব্রীহি, প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহি এবং সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি।
(১) সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাসঃ যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদ বিশেষণ ও পরপদ বিশেষ্য, তাকে সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমনঃ পীত অম্বর যার = পীতাম্বর, পােড়া মুখ যার = মুখপােড়া, দশ ভুজ যায় = দশভুজা, কালাে পাড় যার = কালােপেড়ে (শাড়ি), হত হয়েছে শ্রী যার = হতশ্রী, খােশ মেজাজ যার= খােশমেজাজ ইত্যাদি।
(২) ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সমাসঃ ব্যধিকরণে ব্যাসবাক্যের পদ দুটো এক বিভক্তির না হয়ে ভিন্ন ভিন্ন বিভক্তির হয়। বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদ এবং পরপদ কোনােটিই যদি বিশেষণ না হয়, তবে তাকে বলে ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সমাস। যেমনঃ বীণা পাণিতে যার = বীণাপাণি, রত্ন গর্ভে যার = রত্নগর্ভা, নীল কণ্ঠে যার = নীলকণ্ঠ, আশীতে (দাঁতে) বিষ যার = আশীবিষ (অর্থাৎ সাপ), শশ অঙ্কে যার = শশাঙ্ক (চাঁদ), শূল পাণিতে যার = শূলপাণি, কথা সর্বস্ব যার = কথাসর্বস্ব ইত্যাদি।
নোটঃ পরপদ কৃদন্ত বিশেষণ হলেও ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সমাস হয়। যেমন- দুই কান কাটা যার = দুকানকাটা।
(৩) ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাসঃ পরপর ক্রিয়া বােঝাতে যে বহুব্রীহি সমাসে একই পদ দ্বিত্ব হয়ে পূর্বপদ ও উত্তরপদে বসে, তাকে ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাস বলে। এ সমাসে পূর্বপদে ‘আ’ এবং উত্তরপদে ‘ই’ যুক্ত হয়। যেমন : হাতে হাতে যে যুদ্ধ = হাতাহাতি, হেসে হেসে যে আলাপ = হাসাহাসি, লাঠিতে লাঠিতে যে যুদ্ধ = লাঠালাঠি, কানে কানে যে কথা = কানাকানি।
(৪) মধ্যপদলােপী বহুব্রীহি সমাসঃ যে বহুব্রীহি সমাসে ব্যাসবাক্যের ব্যাখ্যামূলক মধ্যবর্তী পদ লুপ্ত হয় তাকে মধ্যপদলােপী বহুব্রীহি সমাস বলে। এর অন্য নাম উপমাত্মক বহুব্রীহি। যেমন- হাতে খড়ি দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = হাতেখড়ি, মৃগের নয়নের ন্যায় নয়ন যার = মৃগনয়না, স্বর্ণের আভার মত আভা যার = স্বর্ণাভ, চন্দ্রের ন্যায় বদন যার = চন্দ্রবদনা, মীনের ন্যায় অক্ষি যার = মীনাক্ষী, পদ্মের ন্যায় গন্ধ যার = পদ্মগন্ধা, সােনার মত উজ্জ্বল মুখ যার = সােনামুখী, এক দিকে চোখ যার = একচোখা ।
(৫) নঞ বা নঞর্থক বহুব্রীহি সমাসঃ যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদ নঞর্থক বা নিষেধাৰ্থক অব্যয় তাকে নঞর্থক বহুব্রীহি সমাস বলে। নঞ বহুব্রীহি সমাসে সাধিত পদটি বিশেষণ হয়। যেমন- নি (নাই) ভুল যার = নির্ভুল, নাই ঈমান যার = বেঈমান, নাই অহঙ্কার যার = নিরহঙ্কার, নাই লজ্জা যার = নির্লজ্জ, ন (নাই) জ্ঞান যার = অজ্ঞান, না (নাই) চারা (উপায়) যার = নাচার, না (নয়) জানা যা = নাজানা, অজানা, অ (নেই) বুঝ যার = অবুঝ, বে (নেই) হায়া যার = বেহায়া, ন (নাই) জ্ঞান যার = অজ্ঞান, বে (নাই) হেড যার = বেহেড, না (নয়) জানা যা = নাজানা ইত্যাদি।
(৬) অলুক বহুব্রীহি সমাসঃ যে বহুব্রীহি সমাসে বিভক্তির লােপ হয় না, তাকে অলুক বহুব্রীহি সমাস বলে। অথবা, যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্ব বা পরপদের কোনাে পরিবর্তন হয় না, তাকে অলুক বহুব্রীহি বলে।
যেমন— হাতে খড়ি দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = হাতেখড়ি, গায়ে হলুদ দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = গায়ে-হলুদ , মাথায় পাগড়ি যার = মাথায়পাগড়ি ইত্যাদি।
(৭) প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহিঃ যে বহুব্রীহি সমাসের সমস্তপদে আ, এ, ও ইত্যাদি প্রত্যয় যুক্ত হয় তাকে বলা হয় প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহি সমাস। যেমন : এক দিকে চোখ (দৃষ্টি) যার = একচোখা (চোখ + আ) , ঘরের দিকে মুখ যার = ঘরমুখাে (মুখ + ও), নিঃ (নেই) খরচ যার = নি-খরচে (খরচ + এ)
(৮) সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাসঃ পূর্বপদ সংখ্যাবাচক এবং পরপদ বিশেষ্য হলে এবং সমস্তপদটি বিশেষণ বােঝালে তাকে সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাস বলে। এ সমাসে সমস্তপদে ‘আ’, ‘ই’ বা ‘ঈ’ যুক্ত হয়। যেমন : দশ গজ পরিমাণ যার = দশগজি, চৌ (চার) চাল যে ঘরের = চৌচালা, তিন পায়া যার = তেপায়া, দুই নল যার = দোনলা।
লক্ষণীয়ঃ সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদ বা পরপদের অর্থ প্রধান না হয়ে তৃতীয় কোনাে অর্থ প্রধান হয়, অপরপক্ষে দ্বিগু সমাসের পূর্বপদটি সংখ্যাবাচক শব্দ হয় এবং পূর্বপদের অর্থ প্রধান হয়। যেমন :
দ্বিগু সমাস : চৌ রাস্তার সমাহার = চৌরাস্তা।
বহুব্রীহি : চৌ চালা আছে যার = চৌচালা।