শরতে হেমন্তে বাংলাদেশ যেন অপরূপ রুপে ফুটে উঠে। প্রকৃতিকে সাজায় শরৎ, আর কৃষকের গৃহভান্ডার ভরিয়ে তােলে হেমন্ত। বাঙ্গালির জীবনে শরৎ-হেমন্তর প্রভাব অনেক। আজকের রচনায় আমরা শরৎ-হেমন্তর রুপ, বাংলাদেশে এর প্রভাব এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে পয়েন্টসহকারে আলোচনা করব। ৬ ৭ ৮ ৯ ১০ ১১ ১২ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপকারে আসবে।
ভূমিকা
সবুজ শ্যামলিমায় পরিপূর্ণ আমাদের এ দেশ অপরূপ ঋতুবৈচিত্র্যের আধার। অপূর্ব রূপ এবং অফুরন্ত সম্ভার নিয়ে এখানে একের পর এক আবর্তিত হয় ছয়টি ঋতু। বর্ষার অবিশ্রান্ত রিমঝিম গানের অলস বিধুর মরণ যখন ক্লান্তিতে মনকে বিষন্ন করে তােলে, ঠিক তখন শরৎ তার সিগ্ধ রূপ-মাধুর্য নিয়ে হঠাৎ আলাের মতাে নীল আকাশে ঝলমল করে হেসে ওঠে। শিউলি ঝরা শরতের মেঘশূন্য নীলাকাশ, হেমন্তের কনক ধানের সােনালি সম্ভার প্রকৃতিকে করেছে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। কবি আবেগে উচ্ছসিত হয়ে বলে ওঠেন-
আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে
শিউলিতলার পাশে পাশে ঝরাফুলের রাশে রাশে।
শিশির ভেজা ঘাসে ঘাসে অরুণরাঙা চরণ ফেলে
নয়ন ভুলানন এলাে।
ঋতু পরিক্রমায় শরৎ ও হেমন্ত
কোথায় এমন হরিৎ ক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে।এমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে।
ঋতুচক্রে শরৎকাল
শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
মুড়িয়ে গেছে ছাপিয়ে মোহন অঙ্গলি
শরৎ তোমার তোমার শিশির ধোয়া কুন্তলে
বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতে হৃদয় ওঠে চঞ্চলি
শরৎকালে বনে-উপবনে শিউলি, গােলাপ, বকুল, মল্লিকা, কামিনী, মাধবী প্রভৃতি ফুল ফোটে। বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা আর নদীর ধারে কাশফুল। এ সময়ে তাল গাছে তাল পাকে। হিন্দুদের দুর্গাপূজাও এ সময় অনুষ্ঠিত হয়।
ঋতুচক্রে হেমন্তকাল
বাংলা বর্ষপঞ্জিতে এর ব্যাপ্তিকাল কার্তিক ও অগ্রহায়ণ (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য ডিসেম্বর)। হেমন্ত শরতেরই বিলম্বিত রূপ। বঙ্গ-ঋতুনাট্যের সে চতুর্থ শিল্পী, উদাসীন, পৌঢ় এবং বিষন্ন। হেমন্তে নেই শরতের বনৈশ্বর্য, আছে সুদূর-ব্যাস্ত এক বৈরাগ্যের বিষন্নতা। রূপসি হেমন্ত ধূসর কুয়াশায় নয়ন ঢেকে ফসল ফলাবার নিঃসঙ্গ সাধনায় থাকে নিমগ্ন। ক্ষেতে-খামারে রাশি রাশি ভারা ভারা সােনার ধান উঠতে থাকে। চারদিকে অন্তহীন কর্মব্যস্ততা। ঘরে ঘরে চলছে নবান্ন উৎসব। প্রাচুর্যময়ী হেমন্তের ফুলের বাহার নেই, সৌন্দর্যের জৌলুশ নেই, রূপ-সজ্জারও নেই প্রাচুর্য। আছে মমতাময়ী নারীর এক অনির্বচনীয় কল্যাণী রূপশ্রী। সে আমাদের ঘর সােনার ধানে ভরে দিয়ে শিশিরের মতাে নিঃশব্দ চরণে বিদায় গ্রহণ করে।
শরৎ ও হেমন্তের রূপ
শরৎ শ্বেতশুভ্রতার প্রতীক। শরতের আগমন লঘু চপল ছন্দে, শুভ্র জ্যোৎস্না আর ফুলের সুষমার উজ্জ্বল বর্ণিলতায়। শরতের স্নিগ্ধ শ্যামলিমা সমগ্র প্রকৃতিকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করে তােলে। শারদ-রাতের অপূর্ব জোৎস্নার লাবণ্য, শরতের মৃদু-মন্দ হাওয়া, নদীর দুপাড়ের কাশবন, শিশিরধৌত উজ্জ্বল শারদ প্রভাত, গাছের পাতায় ঝকঝকে রােদের ঝিলিক, নদীতীরে ফুটে থাকা অজস্র কাশফুল, শিউলির স্নিগ্ধ সুবাস মনকে উচ্ছসিত করে তােলে। শারদ প্রকৃতির মধুর রূপে মুগ্ধ কবি তাই বলে ওঠেন-
আজিকে তােমার মধুর মুরতি,
হেরিনু শারদ প্রভাতে.
হে মাতঃ বঙ্গ! শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শােভাতে
শরৎকালে গাছে গাছে দেখা যায় পত্র-পল্লবে সবুজের ছড়াছড়ি। হালকা কুয়াশা আর বিন্দু বিন্দু জমে ওঠা শিশির, যেন শরৎ প্রভাতের প্রথম উপহার। মৃদু বাতাসের দোলায় আন্দোলিত হয় কাশবন। স্নিগ্ধ সূর্যকিরণে মাঠ-ঘাট ঝলমল করে। সুনীল আকাশের ছায়া পড়ে শান্ত নদীর বুকে। আকাশে-বাতাসে আর দূর্বাঘাসে শরৎরানী তার স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দেয়। নবীন ধানের মঞ্জরীতে তখন লাগে স্নিগ্ধ হিল্লোল। শারদীয় প্রভাতের এ অপূর্ব সৌন্দর্যকে কবি তুলে ধরেছেন এভাবে-
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ,
আমরা গেঁথেছি শেফালী মালা।
নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে,
সাজিয়ে এনেছি ডালা।
আলাে-আঁধারি কুয়াশা গায়ে মেখে হেমন্ত ঋতুর অভিষেক ঘটে বঙ্গপ্রকৃতিতে। ধূসর বর্ণের হেমন্তে আজ পরিপূর্ণতা, রিক্ততার কণামাত্র নেই। হেমন্ত এ দেশের মাটির সন্তানদের হাতে তুলে দিয়েছে শস্য সম্পদের ভান্ডার- অন্নপূর্ণার মতাে। নিজেকে চিরকাল গুটিয়ে রেখেছে তার দানের আড়ালে। কুয়াশার আবছা পর্দার আড়ালে শান্ত সৌম্য হেমন্ত-বিষন্নতার প্রতিমূর্তি। কবিগুরুর গানে হেমন্ত ধরা দিয়েছে এভাবে-
ধরার আঁচল ভরে দিলে
প্রচুর সোনার ধানে।
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ
পূর্ণ তোমার দানে।
আপন দানের আড়ালেতে
রইলে কেন আসন পেতে,
আপনাকে এই কেমন তোমার
গোপন করে রাখা।
হেমন্তের ধূসর পাণ্ডুরতাকে সবাই বিস্মরণে প্রয়াসী। কেবল জীবনানন্দ দাশের কাব্যেই হেমন্ত পেয়েছে শীর্ষস্থান। কবি লিখেছেন-
অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে,
সে সবের ঢের আগে আমাদের দু’জনের মনে
হেমন্ত এসেছে তবু
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও হেমন্তের কল্যাণদাত্রী রূপকে ভােলেননি। তিনি লিখেছেন-
হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা,
হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা।
সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,
কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা।
ফসলকাটা ও উৎসবাদি
নতুন ফসলে সুবর্ণ যুগ আসে।
এইতাে হেমন্তের দিন, দিল নব ফসলের সম্ভার।
অঙ্গনে অঙ্গনে ভরি এই রূপ আমার বাংলার।
শরতের সরােবরে পদ্মের সাথে হৃদয় মেলে দিয়ে ফুটে ওঠে বাংলাদেশের প্রাণ। বাংলাদেশ আপনার হৃদয়কে আমাদের কাছে। উজাড় করে দেয় এ শরতে। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। বাংলাদেশের মানুষের আনন্দ, উৎসব, ঐশ্বর্য নির্ভর করে ফসলের ওপর। শরৎ নিয়ে আসে আগাম ফসলের বার্তা। তাই নবজীবনের আশ্বাসবাণী শােনায় শরৎ।
শরতের উৎসব
শরৎকাল উৎসবের সাজে সজ্জিত হয় শস্যবিচিত্রা ধরিত্রী। আকাশে-বাতাসে বাজে মধুর আগমনী গান। মানষের মনে লাগে উৎসবের রং। শরতের ভুবন বিজয়ী রূপের প্রেক্ষাপটেই রচিত হয় উৎসব-বেদি। বাঙালির হৃদয় মন আসন্ন উৎসবের আনন্দ-জোয়ারে প্লাবিত হয়। বাঙালির মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ শারদ-উৎসব দুর্গাপুজোর আয়ােজনে মুখর হয়। বাংলার গ্রাম-নগর দিকে দিকে তারই আনন্দ-স্রোত।
ছুটির ঋতু শরৎ
শরতের অনুপম রূপ-বৈভবের মাঝখানেও বাঙালির মনে বেজে ওঠে ছুটির বাঁশি। আকাশে-বাতাসে তার উদার মুক্তি আহ্বান। জোছনা পুলকিত রাত্রির মােহিনী রুপ বাঙালিকে উতলা করে। ঘরের বন্ধন ছিন্ন করে সে ওই অফুরান সৌন্দর্যের জোয়ারে ভেসে যেতে চায়। তার শিউলি-বিতানে, শিশির সিক্ত তৃণপল্পবে, আকাশের সীমাহীন নীলিমায় , দোয়েল-শ্যামার কলকণ্ঠে, ভ্রমরের গুঞ্জনে তার কেবলই উদাস হাতছানি ছুটির সাদর আমন্ত্রণে। একে উপেক্ষা করার সাধ্য কার। গৃহবন্দি জীবনের ক্লান্তি ভুলতে সে দূর-দূরান্তরে বেরিয়ে পড়ে। শরৎ তাই ছুটির ঋতু। অবকাশের ঋতু। শরতের রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে মনটা কেবল চলি চলি করে- বর্ষার মত সে অভিসারে চলা নয়, সে অভিমানের চলা।
শরতের অর্থনৈতিক অবদান
শরৎ ফসলের ঋতু নয়। আগামী ফসলের সম্ভাবনার বাণীই সে বহন করে আনে। পাকা ধানের ডগায় সােনালি রােদ গলে গলে পড়ে। চকচক করে কৃষকের চোখ আনন্দে। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের ক্ষেত দেখে কৃষক আশায় বুক বাঁধে। আর কিছুদিন পরেই ঘরে উঠবে সােনার ধান, পরম আদরের ধান। মাঠে মাঠে নবজীবনের আশ্বাস। বর্ষায় যে বীজ বপন, হেমন্তে যে পাকা ফসলের পরিণত-প্রতিশ্রুতি, শরতে তারই পরিচর্যা। অনাগত দিনের স্বপ্ন সম্ভাবনায় তার নম্র নেত্রে খুশির ঝিলিক। এরই ওপর কৃষি-প্রধান বাংলাদেশের আয়-ব্যয়ের হিসাব রচিত হয়। তাই অর্থনৈতিক প্রবাহে শরৎ ঋতুরও রয়েছে এক অপরিহার্য ভূমিকা।
শীতের আগমন
হেমন্ত ঋতুতে ত্যাগের যে পালা সূচিত হয়, তা পরিণতি লাভ করে শীত ঋতুতে। পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে নতুনের আহবানে আসে শীত। শীতের প্রচণ্ডতা-সজীবতা ও প্রাণ স্পন্দনকে নির্জীব করে দেয়। প্রকৃতির পালা বদলের হাওয়ায় শীত আসে রিক্ততা আর শূন্যতার ডালি নিয়ে। পাতাঝরা শূন্য গাছ আর ফসলহীন মাঠ দেখে মনে হয় প্রকৃতি যেন বৈরাগ্যের বসন পরেছে। তবু শীতের সকালে খেজুর রস যেন ভিন্ন রকম আস্বাদে ও আমেজে চির আকাঙ্ক্ষিত। শীতকে উদ্দেশ্য করে কবি বলেছেন-
শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকীর ঐ ডালে ডালে।
পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।
উপসংহার
ঋতুবৈচিত্র্যের বর্ণিল উপস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রকৃতি পরিপূর্ণ। আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল শরৎ ও হেমন্ত ঋতু প্রকৃতিকে সজ্জিত করে তােলে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। প্রকৃতিকে সাজায় শরৎ, আর কৃষকের গৃহভান্ডার ভরিয়ে তােলে হেমন্ত। শরৎ উজ্জল, উচ্ছল। হেমন্ত ধূসর, মলিন। তাই বঙ্গ প্রভৃতির ঋতুরঙ্গ বৈচিত্রের প্রেক্ষাপটে এই দুই ঋতুরই ভিন্নমাত্রার সমান পদচারণা। শরতে হেমন্তে রূপসী বাংলাদেশ যেন আরও রূপসী হয়ে উঠে উৎসবে ও আনন্দে।
রচনাটির সাথে সম্পর্কিত বিষয়:
ষড়ঋতু (রচনা)
বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র (রচনা)
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য (রচনা)
বাংলাদেশের নিসর্গে ষড়ঋতুর প্রভাব (রচনা)
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রচনা)