বাংলা রচনা

বাংলাদেশের নিসর্গে ষড়ঋতুর প্রভাব – রচনা

Rate this post

ছয়টি ঋতু নিয়ে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।  তাই বাংলাদেশের নিসর্গে ষড়ঋতুর প্রভাব চোখে পড়ার মত। কারন ছয়টি ঋতুর রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। আজকের রচনায় ষড়ঋতুর প্রভাব এর ভালো ও খারাপ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করব। লিখাটি  ৬ ৭ ৮ ৯ ১০ ১১ ১২ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপকারে আসবে।

বাংলাদেশের নিসর্গে ষড়ঋতুর প্রভাব - রচনা

সূচনা

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি আমাদের এ বাংলাদেশ। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, রত্নধারিণী চিত্রময়ী বাংলাদেশ। এ দেশে বনে বনে ফুলের সমারােহ, মাঠে মাঠে নানা জাতের ফসলের আগমনী গান, বনে-প্রান্তরে, কাননে-কান্তারে সবুজের আলপনা। আমাদের বাংলাদেশে বছরে ছয়টি ঋতুর আবির্ভাব ঘটে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত- এ ছয়টি ঋতুর প্রভাবেই নিসর্গ ধারণ করে বিচিত্র রূপ। এদের কোনােটিই হঠাৎ এসে হাজির হয় না। বাংলাদেশের বিচিত্র ঋতু পরিক্রমা মাসের সীমারেখাও মেনে চলে না। তবু প্রতি দুমাসকে একটি ঋতু হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। একেক ঋতুর একেক রূপ একাকার হয়ে যায় আরেকটি রূপের সাথে। তবু একসময় আমরা অনুভব করি প্রকৃতির একটি রূপ পেরিয়ে অন্য একটি রূপের মধ্যে এসে পড়েছি।

বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি

বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিতে ষড়ঋতুর প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সমগ্র অঞ্চল এক বিস্তীর্ণ, সমভূমি। বাংলাদেশে সামান্য পরিমাণে উচ্চভূমি রয়েছে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাংশ, সিলেট জেলার উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশ এবং মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার দক্ষিণাংশ উচ্চভূমির অন্তর্গত। এসব এলাকায় বৃষ্টিপাত ও শীতের পরিমাণ বেশি। সমভূমি এলাকার অধিকাংশ লােকদের বর্ষায় অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। বর্ষাকালে নদীর দুকূল প্লাবিত হয়ে সমতল এলাকায় বন্যার সৃষ্টি হয়। সমতল এলাকায় গ্রীষ্মকালে গরমের প্রাধান্য থাকে। এসব এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম। সমতল ভূমির লােকজনের চেয়ে পাহাড়ি এলাকার লােকজন তুলনামূলকভাবে সাহসী হয়ে থাকে। 

বাংলাদেশের তাপমাত্রা

বাংলাদেশ নাতিশীতােষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত। এদেশের ওপর দিয়ে ক্রান্তীয় মৌসুমি বায়ু বছরের প্রায় অধিকাংশ সময় প্রবাহিত হয়। ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৪৫° সেলসিয়াস এবং শীতকালে ১৫ থেকে ২৫° সেলসিয়াস থাকে। এদেশে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বেশি শীত ও এপ্রিল-মে মাসে গরম বেশি থাকে। তবে প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ের কারণে যেভাবে সমস্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আমাদের দেশেও তার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। 

জলবায়ু

মৌসুমি বায়ু এ দেশের ওপর দিয়ে বছরের অধিকাংশ সময়ই প্রবাহিত হয়। ফলে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বায়ু প্রবাহের দিক পরিবর্তিত হয়। গ্রীষ্মকালে এদেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। এ বায়ু প্রচুর জলীয় বাষ্প বহন করে। ফলে গ্রীষ্মের শেষে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। 

নদনদীর প্রভাব

নদনদী বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের মাটিকে উর্বর করেছে অসংখ্য নদীউপনদী। শীতে নদীগুলাে খানিকটা শুকিয়ে গেলেও বর্ষায় যেন নতুন প্রাণ পেয়ে দুকূল ছাপিয়ে যায়। এ সময় বাংলার জমিতে পলিমাটি পড়ে জমির উর্বরা শক্তি বাড়ায়। 

ব্রহ্মপুত্র নদের একটি দৃশ্য।
ব্রহ্মপুত্র নদের একটি দৃশ্য। ছবিঃ Shutterstock

বাংলাদেশে যে সােনার ফসল ফলে সেটি নদীরই দান। আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল হলেও তা আশ্বিন মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে দেখা যায়। নদীপথে তখন পাল উড়িয়ে সারি সারি নৌকা চলে। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। বর্ষাকালে নদীতে মাছ ধরার দৃশ্য বড়ই চমৎকার। নদীর দুধারের জেলেদের বাড়িগুলাে ছবির মতাে মনে হয়। উঠতে মাঝিরা নদীতে মাছ ধরে। এ সময় তাদের নৌকায় হারিকেনের আলাে মিটমিট করে এ দৃশ্য মানব হৃদয়কে আকৃষ্ট করে।

বিভিন্ন ঋতুতে বাংলাদেশের নিসর্গ

বিভিন্ন ঋতুতে বাংলার প্রকৃতি নব নব রূপে সজ্জিত হয়। আমাদের কাছে মনে হয়, প্রকৃতি প্রতি দুমাস পরপর তার খােলস পালটিয়ে নতুন পােশাক পরছে। গ্রীষ্মের আগমনে বাংলার প্রকৃতি রুক্ষ, বিবর্ণ ও শুষ্ক হয়ে ওঠে। হারিয়ে যায় বাংলার সবুজ প্রকৃতির শ্যামল শােভা। এ সময় কালবৈশাখি নবরূপে আবির্ভূত হয়ে সবকিছু ভেঙে দিয়ে যায়। প্রচণ্ড রুক্ষতা কাটিয়ে নেমে আসে বর্ষা। বর্ষার আগমনে পালটে যায় প্রকৃতির রূপ। বৃষ্টির অঝাের ধারায় গাছে গাছে, পাতায় পাতায় লাগে শিহরন, জাগে সজীবতা। বৃষ্টিস্নাত গ্রামগুলােকে দ্বীপ বলে মনে হয়। যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। জলের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ধান আর পাটের সবুজ গাছ। কবির ভাষায়ঃ-

ঘন গৌরবে নব যৌবনা বরষা।
শ্যাম গম্ভীর সরষা।

বর্ষার অবিরাম বর্ষণের পর আসে স্নিগ্ধ শরৎ। বাংলাদেশের ঋতুচক্রে সবচেয়ে উজ্জ্বল ঋতু এ শরৎ। শরতের প্রথমদিকে সারাদিন চলে মেঘ, বৃষ্টি আর আলাের লুকোচুরি খেলা। আকাশে ভাসতে থাকে শুভ্র বলাকার মতাে সাদা মেঘ। সারারাত ফুটে ভােরবেলায় ঝরে পড়ে শিউলি। নদীতীরে কাশফুল শুভ্র হাসি ছড়িয়ে দেয় চারদিকে। শরৎ বন্দনা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে এভাবে বাজে-

আজি কি তোমার মধুর মূরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে!
হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ

ঝলিছে অমল শোভাতে।
হেমন্ত বাংলার কৃষকের আনন্দের ঋতু। এ সময় মাঠে মাঠে ধান পাকে। সকালের সােনালি রােদে যখন সোনালি ধানের ডগা দোল খায়, তখন মনে হয় মাঠের সর্বত্র সােনা ছড়িয়ে আছে। কৃষকের গােলা নতুন ধানে ভরে ওঠে। ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্নের উৎসব। কবি বলেন-

পৌষ তােদের ডাক দিয়েছে, আয়রে চলে আয় আয় আয়
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে মরি হায় হায় হায়।

শীত আসে উত্তরের হিমেল হাওয়া নিয়ে। গাছপালা হারায় সজীবতা। শুরু হয় পাতা ঝরার পালা। প্রকৃতি তার রূপসজ্জার অলংকার ছুড়ে ফেলে রিক্ত বৈরাগীর রূপ নেয়। গরম কাপড়, কাঁথা, লেপ ইত্যাদি জড়িয়ে সময় কাটায় বাঙালি। শীতের রােদের সকাল বড়ই উপভােগ্য। শীতের জীর্ণতা ঘুচিয়ে প্রকৃতিকে নতুন করে সাজাতে আসে বসন্ত। এ সময় প্রকৃতিতে দারুণ চাঞ্চল্য জাগে। গাছের শূন্য শাখাপ্রশাখা নতুন সবুজ কিশলয়ে বিকশিত হয়। বসন্তের জাদুময়ী পরশে বৃক্ষলতাদি নব-পুষ্প পল্লবে সুশােভিত হয়ে ওঠে। এ সময় প্রকৃতির প্রায় সব প্রকার গাছে ফুল ও নতুন পাতা দেখা যায়। ফুলে ফুলে ফুলেল বাংলার প্রকৃতি কবি দ্বিজেন্দ্রলালের চোখে ধরা পড়ে এভাবে-

পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী; কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি,
গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে।
তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।

বাংলাদেশের নিসর্গের বৈরী রূপ

বাংলাদেশের নিসর্গে ষড়ঋতুর প্রভাব দ্বিমুখী। এর কল্যাণকর দিকের পাশাপাশি বৈরী দিকও রয়েছে। গ্রীষ্মকালে বাংলার প্রকৃতি রুক্ষ রূপ পরিগ্রহ করে। ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে যায়। কৃষকেরা বৃষ্টির জন্য প্রকৃতির পানে চেয়ে থাকে। পানীয় জলের অভাবে অনেকে কষ্ট করে থাকে। বর্ষাকালে প্রকৃতি কখনাে কখনাে ধ্বংসাত্মকরূপে আবির্ভূত হয়। অতিরিক্ত বন্যায় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তখন মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। বন্যা, জলােচ্ছাসের ফলে মানুষদের অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ভােগ করতে হয়। উপকূলবর্তী মানুষদের সাথে প্রকৃতি নিয়তই বৈরী আচরণ করে। গবাদি পশুর অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। অর্ধাহারে ও অনাহারে গবাদি পশুর পাশাপাশি অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটে। বন্যা পরবর্তী রােগ যেমন— কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় মহামারি আকার ধারণ করে। শীতকালে এদেশের গরিব মানুষদের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভােগ করতে হয়। শীতের কাপড়ের অভাবে সাধারণত বৃদ্ধ ও শিশুদের বেশি কষ্ট ভােগ করতে হয়।

বাংলাদেশের নিসর্গের কল্যাণময়ী রূপ

বাংলাদেশের প্রকৃতিতে ষড়ঋতুর প্রভাব অপরিসীম। প্রতিটি ঋতুই কোনাে না কোনাে আশীর্বাদ নিয়ে হাজির হয় আমাদের মাঝে। গ্রীষ্মকালে রুক্ষতা আর কঠোরতার মধ্যেও প্রকৃতি ডালি ভরে সাজিয়ে দেয় বিচিত্র সব ফল। বর্ষা নদীর দুকূল প্লাবিত করে আমাদের ফসলের জমিতে পলিমাটি ফেলে। এ পলিমাটির জন্যই আমাদের দেশে সােনার ফসল ফলে। নদীনালা কানায় কানায় ভরে যাওয়ার ফলে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। আমরা যে মাছে ভাতে বাঙালি সেটা বর্ষারই অবদান। অনেকে মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করে। শরৎকে স্বচ্ছ ঋতু বলা যায়। শরতের প্রকৃতি মানবহৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায়। শীত উপভােগের ঋতু। এ সময় নানা ধরনের সবজি পাওয়া যায়। বাংলার ঘরে ঘরে পিঠা, পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। বসন্তকালকে ঋতুরাজ বলা হয়। অশােক, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া আর শিমুলের গাছে যেন লাল ফুলের আগুন লাগে। বসন্ত মানবহৃদয়ে নবজাগরণ, নব উদ্যম সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। 

উপসংহার

বাংলাদেশের নিসর্গের ন্যায় এমন বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। এ দেশের প্রকৃতি বিধাতার এক অপরূপ দান। বাংলাদেশের প্রকৃতির সাথে ছয়টি ঋতু এমনভাবে মিশে আছে যে, তাদের প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গই মনে হয়। অসংখ্য ধ্বংসলীলা ও ক্ষয়ক্ষতি থাকলেও বাংলাদেশ আমাদেরই দেশ, আমরা ভালােবাসি এদেশের প্রকৃতিকে। প্রকৃতির পরতে পরতে ছড়ানাে আল্পনা আমাদের মনের ক্যানভাসে বুলিয়ে দেয় নানা রঙের তুলির ছোঁয়া।


রচনাটির সাথে সম্পৃক্ত বিষয়সমূহঃ

↬ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (Dwijendralal Ray)

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button