Uncategorized

ট্রেন দুর্ঘটনার সাতকাহন এবং জনগণের করনীয়

Rate this post

সারা দেশে রেল যোগাযোগকে নিরাপদ ও সহজলভ্য বলে মনে করা হয়। উন্নত বিশে রেল যোগাযোগ বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু বাংলাদেশে রেল যোগাযোগ মানেই ভোগান্তি। সাথে যুক্ত হয়েছে দুর্ঘটনা। স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে রেল ছাড়া গতি নেই। তাই রেল পথে দেশের সবচেয়ে বেশী মানুষ যাতায়াত করে। 

বিপুল এই জনসংখ্যার জন্য রেল পরিবহন কতোটা নিরাপদ? কেন এত দুর্ঘটনা ঘটছে? রেলের মূল সমস্যা এবং সাধারণ জনগনের কী আসলেই কিছু করার আছে এইসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

সম্প্রতি, ২৯ জুলাই ২০২২, দুপুর দেড়টার দিকে বড়তাকিয়া রেলস্টেশনের কাছে খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে আসা মহানগর প্রভাতীর ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত হয়েছেন। 

ট্রেন দুর্ঘটনার সাতকাহন এবং জনগণের করনীয়
ছবি: ইন্টারনেট 

বর্তমান বিশ্বে  রেল পরিবহন আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে নিরাপদ এবং সস্তা পরিবহনের মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে, পুরানো ট্রেন পরিচালনা ব্যবস্থার কারণে অসহনীয় বিলম্বের পাশাপাশি ঘন ঘন রেল দুর্ঘটনার কারণে রেলওয়েকে অন্যান্য পরিবহনের বিকল্প হিসাবে স্বীকৃত নয়।

সব ধরনের রেল দুর্ঘটনার মধ্যে সংঘর্ষই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। অতএব, বর্তমান গবেষণার সামগ্রিক উদ্দেশ্য ছিল সংঘর্ষের কারণে রেল দুর্ঘটনার কারণগুলি বোঝা এবং প্রাসঙ্গিক প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাগুলি খুঁজে বের করা। 

প্রথমে এই গবেষণায় বর্তমান সিগন্যালিং এবং ইন্টারলকিং সিস্টেম, ট্রেন নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা ব্যবস্থা, লেভেল ক্রসিং-এ নিরাপত্তা কর্মক্ষমতা, দুর্ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ রেলওয়ের সার্বিক নিরাপত্তার অবস্থা পরীক্ষা করা হয়েছে। 

অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করা গেল যে, এই ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশ রেলওয়ে ১৯ শতকের সিগন্যালিং ও অপারেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে। বাংলাদেশে গেইটম্যান ছাড়াই অনুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১১৮৪ (৮০%)। বর্তমানে লেভেল ক্রসিং ঘনত্ব প্রতি কিমি রুটে 0.৮৮। বাংলাদেশ রেলওয়েতে প্রয়োজনীয় জনশক্তির ঘাটতি নিরাপদ ও দক্ষ ট্রেন চলাচলের জন্য অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা। মানবসৃষ্ট গাফিলতির চেয়ে রেললাইনে ত্রুটি বা যান্ত্রিক কারণে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। ট্রেনের কোনো কোচ বা বগির কোনো একটি চাকা যদি লাইনচ্যুত হয়, সেটিও দুর্ঘটনার সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

বাংলাদেশে রেল দুর্ঘটনার চালচিত্র

বিগত ১০ বছরে রেল দুর্ঘটনা  এক-তৃতীয়াংশে নেমে এলেও বড় দুর্ঘটনা থামানো যাচ্ছে না। দুঃখের বিষয় হল বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে রেললাইনের ত্রুটি বা রেলক্রসিংয়ে গাড়িচালকদের গাফিলতির কারণে।

বাংলাদেশ আসলে ঠিক কি সংখ্যক রেল দুর্ঘটনা হয়েছে তার সঠিক হিসাব করা বেশ কঠিন। কারণ কেউই এর সঠিক হিসাব সংরক্ষণ করছেন না। শুনতে খারাপ লাগলেও, বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছেও এর সঠিক হিসাব নেই। আসুন বিগত ও বর্তমান সময়ের বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসা রেল দুর্ঘটনার চিত্র দেখা যাক।

১। বাংলাদেশের ইতিহাসে দেশে সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৯ সালের ১৫ জানুয়ারী টঙ্গীর মাজুখানে। সেদিন দু’টি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৭০ জন যাত্রী নিহত হয় এবং ৪০০ যাত্রী আহত হয়।

১। ১৬ নভেম্বর ২০১৯, তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক “ট্রেন দুর্ঘটনা ও ভ্রমণের নিরাপত্তা” শিরোনামে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, রেলপথের সিলেট রুট হয়ে উঠেছে মরণফাঁদ। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার কসবা উপজেলায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ১৬ জন।

২। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত আড়াই বছরে রেল দুর্ঘটনায় (নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-গাজীপুর) নিহত আট শতাধিক। আহত ও পংগুত্ব বরণ করেছেন ছয় শতাধিক। শুধু রেলওয়ে পুলিশের হিসাব মতে, মৃত্যুর সংখ্যা ৭০০।

৩। পরিসংখ্যান বলছে, বিগত নয় মাসে রেলের সিলেট রুটে অন্তত ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন মানুষ। 

৪। ২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রথম আলোর এক রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, ২০১০ সালে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা ২০৪টি, ২০১১ সালে ১৬৫, ২০১২ সালে ১৩৮, ২০১৩ সালে ১৬৭, ২০১৪ সালে ১৪৭টি, ২০১৫ সালে ৮৮ টি, ২০১৬ সালে ৬৭টি, ২০১৭ সালে ৭১ এবং ২০১৮ সালে ৭২টি, ২০১৯ সালে প্রায় ৫০টিরও বেশী দুর্ঘটনা ঘটে। 

৫। বেসরকারি গবেষণা বলছে, ১০ বছরেই বাংলাদেশের রেলপথে প্রায় দুই হাজার ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় আড়াই শতাধিক যাত্রী। আহত হয়েছেন হাজারো। অথচ, রেলের হিসাব মতে, ১০ বছরে মোট এক হাজার ৯৬১টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে রেলের ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকারও বেশি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬৩ জন।

বাংলাদেশ রেল দুর্ঘটনার কারণ

দুর্ঘটনা রোধে রেলওয়ের অনেক বিধিবিধান রয়েছে। সেই বিধিবিধানগুলো মানা হয় না বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এর বাহিরেও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

  • জনবলের অভাবঃ বর্তমানে দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি (২০২২ সালের পরিসংখ্যান মতে)। মাত্র ২৭ হাজার জনবল নিয়ে চলছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। অথচ,  ১৯৭৩ সালে রেলে জনবল ছিল ৬৮ হাযার। তখন দেশের মানুষ ছিল ৭ কোটি। দেশে রেল চালকের সংকট থাকায় তাঁদের উপর বাড়তি চাপ পড়ছে। কাজ করতে গিয়ে শরীর ক্লান্ত হয়ে তন্দ্রা বা ঘুম আসা স্বাভাবিক। এতে দুর্ঘটনা ঘটে। 
  • ডবল লাইন না থাকাঃ দেশে এক লাইনে ট্রেন চলে, তাই কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে পুরো এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যতক্ষণ এটি ডাবল লাইনযুক্ত না হয়, এই সমস্যাটি বিদ্যমান থাকবে। ত্রুটিপূর্ণ লাইন মেরামতের সময় লুপ লাইনে যাওয়ার সময় ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
  • মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন এবং জীর্ণ লাইনঃ দেশের রেলপথে শতাব্দী প্রাচীন অপ্রচলিত ইঞ্জিন-কোচ দিয়ে জরাজীর্ণ লাইনে চলছে যাত্রী পরিবহন। এর পাশাপাশি রেল পার্টিতে পাথর না থাকা, ফেস প্লেট না থাকা, ঢিলেঢালা নাট-বোল্ট ইত্যাদিও রেল দুর্ঘটনার কারণ।
  • অসতর্কতা ও অবহেলাঃ ৮০ শতাংশের বেশি রেল দুর্ঘটনা ঘটে কর্মীদের অবহেলার কারণে। গত পাঁচ বছরের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,  ৮০% ভুলের মধ্যে রয়েছে লাইন পরিবর্তনের জোড়া ভুলভাবে স্থাপন করা ও ভুল সংকেত দেওয়া।
  • ত্রুটিপূর্ণ সিগনালঃ ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যালিং সিস্টেমের কারণে রেল দুর্ঘটনা ঘটছে। সিগন্যাল লাইট মাঝে মাঝে ঠিকমতো ফ্ল্যাশ হয় না। কোনটা হালকা আর কোনটা উজ্জ্বল। উজ্জ্বল হলে কোনো সমস্যা নেই। যেখানে আলো কম, তা দেখা যায় না। এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
  • অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং ঃ রেললাইনে অন্য যানবাহনের অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, মোট সংঘর্ষের ৭৩% এবং মোট মৃত্যুর ৯০% লেভেল ক্রসিংয়ে ঘটেছে।

জনগণের করনীয়

পরিসংখ্যান বলছে, অধিকাংশ রেল দুর্ঘটনা ঘটছে লেভেল ক্রসিংয়ের সময়। তাই বলা যায়, লেভেল ক্রসিংয়ের সময় সতর্কতা অবলম্বন করলেই দুর্ঘটনা অনেকটাই কমানো সম্ভব।
  • জনহীন লেভেল ক্রসিংয়ে গাড়ি পারাপারে সতর্কতা অবলম্বন করুন। গাড়ির গতি কমিয়ে দিন। দরকার হলে গাড়ি থেকে নেমে রেল লাইনের উভয় দিন ভালো করে পর্যবেক্ষণ করুন। 
  • যেখানে স্টপ বোর্ড লাগানো আছে ঠিক ওইখানেই আপনার গাড়িটি থামান।
  • কোনো ট্রেন/ট্রলি গেটের কাছে আসতে দেখলে বা ট্রেন/ট্রলির শব্দ শুনলে তখন ট্রেন লাইন অতিক্রম করবেন না।
  • ট্রেনের গতি কখনই অনুমান করবেন না। কোনো ট্রেন/ট্রলি না আসলেই ক্রস করুন।
  • বন্ধ থাকা অবস্থায় লেভেল ক্রসিং গেট পার হওয়ার চেষ্টা করবেন না।
  • ট্রেন চলাচলের জন্য গেট বন্ধ থাকলে গেটম্যানকে গেট খুলতে বাধ্য করবেন না।
  • চলমান ট্রেন থেকে প্রবেশ/নামবেন না।
  • ফুটবোর্ডে ঝুলে ঝুলে যাবেন না। ট্রেন মিস হতেই পারে তাই বলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝুলে ঝুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন।

ভবিষ্যতে ট্রেনের সংঘর্ষ কমানোর জন্য, কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, যেমন সম্ভাব্য গ্রেড বিভাজন, ট্রেন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে জিপিএস ভিত্তিক যানবাহন ট্র্যাকিং সিস্টেম ব্যবহার, সংঘর্ষবিরোধী ডিভাইস বা স্বয়ংক্রিয় ট্রেন থামানোর ডিভাইস চালু করা, রাস্তা ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা সচেতনতা লেভেল ক্রসিং এ ট্রেন পরিচালনার সাথে সম্পর্কিত সমস্ত কর্মীদের মানসিক অক্ষমতা এবং শারীরিক সুস্থতা, বিশেষ করে লোকো মাস্টার, নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত।

তথ্য সূত্রঃ

১। রেলকর্মীদের গাফিলতিতে বড় দুর্ঘটনাপ্রথম আলো
২। ট্রেন দুর্ঘটনা ও ভ্রমণের নিরাপত্তা – দৈনিক ইত্তেফাক
৩। ১০ বছরে ২ হাজার রেল দুর্ঘটনা, মৃত্যু ২৬৩ জনের – বাংলা নিউজ ২৪ 
৪। Analysis of rail accidents due to collision and their preventive measures in Bangladesh – buet.ac.bd

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Back to top button