আজকের বিষয় – “বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক কর্মপদ্ধতি ও বিজ্ঞান চর্চার গুরুত্ব”
আকাশ পথে উড়ে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাওয়া, কম্পিউটারের এক একটি বােতাম টিপে পৃথিবীর যে কোনাে স্থানে অবস্থানকারী আগ্রহী ব্যক্তি হিসেবে প্রয়ােজনীয় সব তথ্য আহরণ করার মত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারা, টেলিভিশনের পর্দায় পৃথিবীর সব ধরণের গুরুত্বপূর্ণ খবর বা বিনােদনের উপকরণ খোজা, প্রচণ্ড গরমে ফ্যান বা এ.সি. চালিয়ে ঠান্ডার পরশ পাওয়া, জটিল রােগের ক্ষেত্রেও সঠিক অনুসন্ধান ও চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে বেঁচে থাকার আশ্বাস পাওয়া হয়তাে গত শতাব্দীর মানুষের কাছে ছিল চরম বিস্ময় অথবা রূপকথার বুলি, কিন্তু এসবই আজকের প্রযুক্তি নির্ভর মানুষের কাছে অতি সাধারণ ঘটনা। যার মূলে রয়েছে বিজ্ঞান কিংবা বিশেষ জ্ঞানের প্রয়ােগ। বিজ্ঞানের এ সফল প্রয়ােগই উন্নত সভ্যতার চাবিকাঠি। এ যুগের মানুষ বিজ্ঞান ছাড়া চলতে পারে না, আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজে ওতােপ্রােতভাবে জড়িয়ে আছে বিজ্ঞান, ব্যক্তি জীবন থেকে জাতীয় জীবনের অগ্রগতিতে বিজ্ঞানের দান অপরিসীম।
বিজ্ঞান কীঃ
বিজ্ঞান শব্দের অর্থ ‘বিশেষ জ্ঞান’। আমাদের চারপাশের পরিবেশে সব সময়ই কিছু না কিছু ঘটছে এবং আমরা যদি তা দেখতে, উপলব্ধি করতে বা বুঝতে পারি তবে বলা চলে আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ছে। কিন্তু এ জ্ঞান হলাে সাধারণধর্মী জ্ঞান। বিজ্ঞান হলাে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি থেকে প্রাপ্ত ও যাচাইকৃত জ্ঞান। বিভিন্ন মনিষী বিজ্ঞানের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন।
- রবার্ট সান্ডের মতে, “বিজ্ঞান হল জ্ঞানের সমাবেশ ও একটি পদ্ধতি।”
- কুলসন ও স্টোনের মতে, “বিজ্ঞান হল সুসংবদ্ধ জ্ঞান।”
আমরা বলতে পারি বিজ্ঞান হলাে, কোনাে সমস্যা সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান। আর যিনি উপরের পদ্ধতি অনুসরণ করে কোনাে সমস্যার সমাধান করেন তিনিই বিজ্ঞানী।
বৈজ্ঞানিক কর্মপদ্ধতি
সকল বিজ্ঞানীই তাদের গবেষণার কাজ পরিচালনার জন্য এক বা একাধিক নির্দিষ্ট ধারাবাহিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন। এই পদ্ধতিকেই বৈজ্ঞানিক কর্মপদ্ধতি বলে। এ পদ্ধতিগুলাের মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে এবং সবগুলােই ধারাবাহিক। বৈজ্ঞানিক কর্মপদ্ধতির প্রথমেই বিজ্ঞানী –
- একটি সমস্যা চিহ্নিত করেন।
- সমস্যাটি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেন।
- যাবতীয় তথ্যের ভিত্তিতে বিচার বিশ্লেষণ করে সমস্যাটি সম্পর্কে আনুমানিক সিদ্ধান্ত নেন।
- এ আনুমানিক সিদ্ধান্ত সঠিক কিনা তা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
- পরীক্ষার শেষে আনুমানিক সিদ্ধান্ত এবং পরীক্ষার সাহায্যে প্রাপ্ত তথ্যের তুলনা করেন। যদি সিদ্ধান্ত দুটি না মিলে তবে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
- সবশেষে গৃহীত সিদ্ধান্ত অন্যের যাচাইয়ের জন্য তার পরীক্ষার ধারাবাহিক পদ্ধতি ও সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন।
উদাহরণ : একজন চিকিৎসকের চিকিৎসা পদ্ধতি লক্ষ্য করলে আমরা এর বাস্তব প্রয়ােগ দেখতে পাই। মনে করুন, একজন রােগী একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে আসলেন। এখানে রােগীর অসুখটাই চিকিৎসকের সমস্যা। প্রথমে চিকিৎসক রােগীর অসুখ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য রােগীর কাছ থেকে সংগ্রহ করেন। এ তথ্যের ভিত্তিতে তিনি রােগীর অসুখ সম্পর্কে একটি আনুমানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ সিদ্ধান্ত সঠিক কিনা তা যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা- নিরীক্ষা (যেমন : রক্ত পরীক্ষা, মল-মূত্র পরীক্ষা) করেন, অবশ্য এ পরীক্ষা তিনি নিজ হাতে করেন না। এ পরীক্ষা নিরীক্ষা হতে প্রাপ্ত তথ্যের সাথে তিনি আনুমানিক সিদ্ধান্তের তুলনা করেন। সবশেষে তিনি একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং রােগীর সে অনুযায়ী চিকিৎসা পদ্ধতি নির্দিষ্ট করেন। রােগীর ভবিষ্যৎ শারিরীক অবস্থার প্রতি দৃষ্টি রাখেন যতদিন না পর্যন্ত সে সুস্থ হয়ে ওঠে। আমরা সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করলেন। আমরা উপরের বাস্তব উদাহরণটির মাধ্যমে বলতে পারি যে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে আমরা সুষ্ঠু সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারি এবং সমস্যার সমাধান করতে পারি।
বিজ্ঞান চর্চার গুরুত্ব
- জেমস ওয়াটের (James Watt) বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার আঠার শতাব্দীতে মানব সমাজের এক বহু কল্যাণকর আবিষ্কার। এরপর রেলগাড়ি আবিষ্কৃত হলাে। ক্রমান্বয়ে উড়ােজাহাজ আবিষ্কৃত হলাে। মাইকেল ফ্যারাডে (Michael Faraday) বিদ্যুৎ আবিষ্কার করলেন। বিদ্যুৎ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ তার আরাম-আয়েশ, সুখ-সমৃদ্ধির ব্যবস্থা করে নিলেন, ফলে আলাে জ্বললাে, পাখা ঘুরলাে, শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হলাে।
- উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হতে বিজ্ঞানের আবিষ্কার অতি দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। এ সময় পদার্থ বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েলের (James Clerk Maxwell) বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গবাদ, প্ল্যাংক (Planck)-এর কণিকা তত্ত্ব, আইনস্টাইন (Albert Einstein)-এর আপেক্ষিক তত্ত্ব বিস্ময়কর আবিষ্কার, এসময়ে মার্কনি এবং আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagdish Chandra Bose) বিদ্যুৎ তরঙ্গের সাহায্যে বার্তা প্রয়ােগ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এভাবে বেতারের আবিষ্কার সম্ভব হয়।
- রকেট চালিত মহাকাশযানে চড়ে মানুষ অনেক বছর আগেই চাঁদে পৌছেছে। পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া যাচ্ছে তা রিয়্যাক্টরের মাধ্যমে ধনাত্মকভাবে বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা যাচ্ছে।
- চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মানুষ এখন অনেক জটিল রােগ থেকে সহজেই মুক্তি পাচ্ছে। পেনিসিলিন, ক্লোরােমাইসিন, স্ট্রেপটোমাইসিনসহ, এইডস রােগের প্রতিরােধমূলক ঔষধ বা ক্যান্সার রােগের নিরাময় মূলক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে কোটি কোটি মানুষ রক্ষা পেয়েছে বিভিন্ন রােগ-ব্যাধি হতে। রঞ্জন রশ্মির সাহায্যে আমরা শরীরের ভিতরের চিত্র দেখে বুঝতে পারি কোনাে অংশে কি ধরনের অসুস্থতা দেখা দিয়েছে। রেডিয়ামের সাহায্যে অনেকাংশে ক্যান্সারকে প্রতিহত করা যায়।
- কৃষি বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এখন অনেক উন্নতজাতের ধান ও পাটের চাষ হচ্ছে। ভালাে সার জমিতে প্রয়ােগের ফলে আমরা প্রচুর ফসল পাচ্ছি। আরাে আবিষ্কৃত হয়েছে কলের লাঙল, পানি সেচের যন্ত্র, স্প্রে মেশিন।
কাজেই মানব সভ্যতাকে উন্নতির উচ্চতর শিখরে পৌছে দিতে বিজ্ঞানের অবদান অপরিসীম, এবং একারণেই নিজেদের প্রয়ােজনে তথা মানবজাতির কল্যাণে প্রত্যেকের উচিৎ বিজ্ঞান চর্চা করা।