স্বাস্থ্য কথা

ডেঙ্গু: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই কি বাড়ছে মশা? বাড়ছে মশাবাহিত রোগ?

ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা মশার দ্রুত বংশবৃদ্ধি ও বেশিদিন বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেয়।

5/5 - (2 votes)

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভুগতে হচ্ছে সবাইকে; কিন্তু জীব জগতে লাভ কি কারও হচ্ছে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, অন্তত একটি প্রাণীর জন্য সুবিধা হয়ে এসেছে এই পরিস্থিতি, তা হল মশা।

এই মশা, যে কি না সবচেয়ে বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে, হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক, তার জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র অবস্থা সবচেয়ে অনুকূল। জলবায়ু পরিবর্তন তীব্র তাপদাহ নিয়ে আসছে। সেইসঙ্গে ঝড়-বন্যার কারণে দীর্ঘদিন জলাবদ্ধ অবস্থাও থাকছে, যেখানে মশা বংশবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। মশার বিস্তারে এই পরিবেশই সব থেকে উপযুক্ত।

কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মত যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয়ভাবে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ নিয়ে সতর্ক করেছে দেশটির সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন সেন্টার।

ডোরাকাটা মশা মানুষের ত্বকে রক্ত খায়। মশা ডেঙ্গু জ্বর ও ম্যালেরিয়ার বাহক।

এমন খবরে আলোচনায় এখন মশা। কিন্তু ম্যালেরিয়া সংক্রমণের এই ঘটনার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, সেটি খুব শিগগিরই নিশ্চিত করে বলা কঠিন।

তবে যুক্তরাষ্ট্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ম্যালেরিয়াও যে ছড়াতে পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক করে আসছেন বিজ্ঞানীরা।

এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি মশা নিয়ে নতুন উদ্বেগ তৈরি করছে। এমন কোনো অঞ্চল যেখানে কয়েক প্রজন্ম ধরে বা কখনই মশা ছিল না, সেখানেও প্রাণঘাতী এই রোগের বিস্তার ঘটাচ্ছে মশা।

ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা মশার দ্রুত বংশবৃদ্ধি ও বেশিদিন বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেয়। অনেক জায়গায় তীব্র শীতে মশা মরে গেলেও এখন সেগুলো টিকে থাকছে এবং অধিকাংশ সময় বংশবিস্তার ঘটাচ্ছে। মশার ভেতরে ভাইরাস বা পরজীবীর বেড়ে ওঠার গতিও বাড়িয়ে দেয় তাপমাত্রা।

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক অলিভার ব্র্যাডি বলেন, তাপমাত্রা যত তীব্র হয়, ম্যালেরিয়া সংক্রমণের প্রক্রিয়ার সময়কালও তত ছোট হয়ে আসে। ফলে তাপমাত্রা বাড়লে মশা শুধু দীর্ঘদিন বাঁচেই না, সেগুলো খুব দ্রুত সংক্রামকও হয়ে ওঠে।

এছাড়া তাপমাত্রা বাড়লে মশারা আরও সুবিধা পায়। গরম বেশি পড়লে সকালে-বিকালে লোকজন ঘরের বাইরে চলে আসে, যেটি মশার দংশনের জন্য উপযুক্ত সময়।

তাপমাত্রা শহরগুলোকে সবুজায়নের কার্যক্রম বাড়ানোর দিকেও ঠেলে দিচ্ছে, যার একটি অত্যাবশ্যকীয় শীতল প্রভাব রয়েছে। কিন্তু এটি আবার রক্তচোষা এই কীটের একটি আদর্শ প্রজনন স্থল হয়ে উঠতে পারে। গরম আর আর্দ্র অবস্থা মশার জন্য উপযুক্ত। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে মশার উপদ্রবের ব্যাপ্তিকাল বেড়েছে বলে সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে তুলে ধরেছে অলাভজনক সংস্থা রিসার্চ গ্রুপ ক্লাইমেট সেন্ট্রাল।

যুক্তরাষ্ট্রের আড়াইশ স্থানের চার দশকেরও বেশি সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। তারা দেখেছেন, ৭০ শতাংশেরও বেশি এলাকা মশার জন্য উপযুক্ত ছিল। এছাড়া দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মশার প্রায় ২০০ প্রজাতির বেশিরভাগই ক্ষতিকর নাহলেও সেখানে প্রায় এক ডজন প্রজাতির মশা আছে যেগুলো চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, জিকা ও ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে।

গুরুতর মশাবাহিত রোগগুলো যুক্তরাষ্ট্রে বিরল হলেও অন্যান্য দেশগুলোর ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন নয়। সাম্প্রতিক ওই গবেষণার বরাতে সিএনএন জানিয়েছে, ম্যালেরিয়ার বিধ্বংসী রূপ দেখছে আফ্রিকার সাহারা অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তন সেখানে মশাদের পরিসর উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ম্যালেরিয়া ছড়ানো অ্যানোফিলিস মশা বছরে গড়ে প্রায় ২১ ফুট উচ্চতায় ওঠে এবং দক্ষিণে ৩ মাইল পর্যন্ত চলে যায়।

এই প্রতিবেদনের সহলেখক জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির বায়োলজিস্ট কলিন কার্লসন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনকে অনুসরণ করে মশার এই দিক বা গতি পরিবর্তন হয়। ফলে এর আগে কখনও ম্যালেরিয়া হয়নি, এমন অঞ্চলেও মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে।

মশাবাহিত আরেকটি মারাত্মক রোগ হল ডেঙ্গু, যেটি উষ্ণ বিশ্বে বেড়েই চলছে। ‘ব্রেকবোন ফিভার’নামে পরিচিত এই রোগের ফলে জ্বর, বমি বমি ভাব বা বমি, অবসাদ, ডায়রিয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হয়, হতে পারে মৃত্যুও। ডেঙ্গুর নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই, ফলে রোগীদের উপসর্গগুলো দূর করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না।

মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের সবথেকে কঠিন প্রাদু্র্ভাবের সঙ্গে লড়াই করছে পেরু। দেশটিতে প্রায় দেড় লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। ২৫০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অস্বাভাবিকভাবে মাত্রায় বৃষ্টিপাত এবং উষ্ণতা সেখানে মশার জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে।

যদিও বিজ্ঞানীরা এই প্রাদুর্ভাবের পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা এখনও পুরোপুরি মূল্যায়ন করতে পারেননি, বলেন কার্লসন।

ডেঙ্গু এখন ইউরোপ ও আমেরিকার দরজায় কড়া নাড়ছে। কার্লসন বলেন, একশ কোটি লোক ডেঙ্গু সংক্রমণের উপযুক্ত আবাহওয়ার সংস্পর্শে আসবে। আর এসব লোকেদের বেশিরভাগই হবে পশ্চিম ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও নাতিশীতোষ্ণ চীনের।

টেক্সাস, ফ্লোরিডা, হাওয়াই ও অ্যারিজোনায় স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে।

ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল (ইসিডিসি) গত সপ্তাহে সতর্ক করে বলেছে, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ ছড়ানো ‘এইডিস অ্যালবোপিকটাস’ প্রজাতি ইউরোপের উত্তর ও পশ্চিম দিকে ছড়াচ্ছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত উষ্ণায়নের এই মহাদেশকে গ্রাস করছে৷

ইসিডিসির বিশেষজ্ঞ সেলিন গসনার সিএনএনকে বলেন, “অবাক করার বিষয়টি হল সংক্রমণের গতি। যেসব অঞ্চলে এই মশা ছিল, সেরকম এলাকার সংখ্যা এক দশকে তিন গুণ বেড়েছে।”

এমনকি মশার এই ক্ষেত্রগুলোর বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ দুর্ভাগ্যজনকভাবে ডেঙ্গুর বিরাট প্রাদুর্ভাব বা বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি দেখছে।

সেলিন গসনার জানান, ইতিমধ্যেই যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রয়েছে, সেখানে ভবিষ্যতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়বে। এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে চলেছে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের কিছু অংশের ঝুঁকির দিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি।

“এটি সত্যিই একটি ভীতিকর পরিস্থিতি; কারণ এই অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক লোক বাস করে। ফলে এমনকি সেখানে ছোটখাটো পরিবর্তনগুলোও বিপর্যয়কর হতে পারে।”

তবে গসনার বলেন, জলবায়ু সংকটের সঙ্গে মশাদের প্রতিক্রিয়া কেমন, সে সম্পর্কে এখনও অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে রোগের মধ্যে সম্পর্কটা জটিল।

অন্যদিকে জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির বায়োলজিস্ট কলিন কার্লসন বলেন, “তাপমাত্রা কীভাবে মশার রোগ সংক্রমণের ক্ষমতাকে পরিবর্তন করতে পারে, সে সম্পর্কে আমরা ভালোই জানি। কিন্তু এর ফলে মশারা কীভাবে দ্রুত নতুন জায়গায় চলে যায় এবং সামগ্রিক মশার জনসংখ্যা বাড়ছে কিনা, সে সম্পর্কে আমরা কম জানি।”

ফলে এখন মশাবাহিত রোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে সংযোগ আরও ভালভাবে বোঝার উপায়গুলো খুঁজে বের করার কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

Related Articles

Back to top button