একটি চাঁদনী রাত বা, একটি পূর্ণিমা রাত বা, জোছনা রাত রচনা
ভূমিকা
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই
মাগাে আমার শােলক বলা কাজলা দিদি কই।
বাংলার আকাশে চাঁদ ওঠে বলেই মায়ের মুখের মধুর হাসি হৃদয় কেড়ে নেয়। শিশুর চোখে আনন্দের ঝিলিক আনে। শিশু রাজপুর হয়ে ডালিম কুমার সাজে। মা তাকে চড়কা বুড়ির গল্প শােনান আর চাঁদ মামাকে ডেকে শিশুর কপালে টিপ দিয়ে বলেন
আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা।
চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।
সন্ধ্যাসবিতা পশ্চিম গগনে ডুব দিয়ে অস্তরবির রক্তরাগ ছড়াতে না ছড়াতেই মৌন প্রকৃতির বুক চিরে পূর্বদিগন্তে উদ্ভাসিত হল পূর্ণ চাঁদ। মৌন প্রকৃতির বুকে জেগে উঠল বিচিত্র অনুভূতি। জোছনার অনুরাগে বিহ্বল হয়ে উঠল বসুন্ধরা। জোছনার চুমু খেয়ে প্রকৃতি স্বতন্ত্র বৈচিত্র্য নিয়ে স্বপ্নিল হয়ে উঠল। সৃষ্টি যেন স্বপ্নে কথা বলার বাসনায় উন্মুখ। শুধু মানব মনে নয়, বিশাল ও বিপুল ধরিত্রীর সর্বত্রই অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ। অনির্বচনীয় আনন্দের বন্যা।
চাঁদনীর রাতের রূপ
বাংলার আকাশে সব ঋতুতে জোছনা ঝরা রাত একরকম নয়। শরৎ ও হেমন্তে জোছনা বিধৌত শান্ত সিন্ধ রজনী মােলায়েম আবেশ সৃষ্টি করে। হৃদয় শেফালির গন্ধে মৌ মৌ করে। শীতের জোছনা কুয়াশা মলিন। সেখানে পাণ্ডর চাঁদ বিবর্ণ ছায়া ফেলে, প্রকৃতির বুক নীরস ধূসরতায় আচ্ছন্ন হয়। বসন্তে জাগে নতুন আবাহন। দখিনা মলয়ে পুষ্পকলিরা খেলা করে, বাতাসে জাগে মদির গন্ধ, প্রকৃতির বুক ভরে চাঁদের আলাে রাতের মহিমাকে করে দীপ্ত। এমনি করেই বাংলার রাতে ষড়ঋতুর জোছনা ঝরে।
চাঁদনী রাতের প্রকৃতি
গ্রামবাংলার আলাে-আঁধারের স্নিগ্ধ মিতালিতে ঝলমল করে ওঠে চাঁদনী রাত। রাতের এ রূপ প্রকৃতিতে এক অস্পষ্ট মায়ালােক রচনা করে। প্রকৃতির পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে কোমল পরশ। রাতের নির্মেঘ আকাশে যে দিকেই তাকানাে যায় সে দিকেই জোছনার আলাের খেলা চলে। মৃদুমন্দ দখিনা বাতাসে নদীর ঢেউগুলাে দোল খেতে থাকে। এমন চন্দ্রালােকিত রাতের শােভা দেখতে কার না ইচ্ছে করে? মাঝরাতে পূর্ণিমার চাঁদকে মাথার উপরে দেখে মনে হয় যেন বিশাল আকাশের গায়ে কেউ একটি বড় গােলাকার বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। সে আলােয় আলােকিত সারা পৃথিবী। মধ্যরাতের এ ভরা পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকালে যে কারাে মনে পড়বে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই অমিয় বাণী ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানাে রুটি’। তবুও মানুষ চাঁদ দেখে তার জোছনা পান করে-
ও চাঁদ সামলে রাখাে জোছনাকে।
কারাে নজর লাগতে পারে।
চাঁদনী রাতের বর্ণনা
চাঁদের হাসি বাধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলাে।ও রজনীগন্ধা তােমার, গন্ধসুধা ঢালাে।পাগল হাওয়া বুঝতে নারে, ডাক পড়েছে কোথায় তারেফুলের বনে যার পাশে যায়, তাকেই লাগে ভালাে।
মানবমনে চাঁদনী রাতের প্রভাব
চাঁদ হেরিছে চাঁদ মুখ তারমবমির আরশীতে।
মহিমের ঘােড়াগুলি ঘাস খায় জোছনার প্রান্তরে।
আমার নিজস্ব অনুভূতি
সােনার খাঁচায় দিনগুলি মাের রইল না রইল নাসেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
দূরে কোথায়-দূরে-দূরে।আমার মন বেড়ায় ঘুরে ঘুরে।
তােমার পদে এ মিনতি করি দয়াময়,আমার মরণ যেন চাঁদনি-রাতে হয়।
স্তব্ধতা ধীর লয়ে আমার চারপাশ জুড়ে নিবিড় শান্তি নিয়ে এল। দূরে নদীর চরে ডাহুক ডাকছে, এপারে ডাহুকী ব্যথার রাগিনী জাগিয়ে তুলেছে বিরহী হৃদয়ের আকুল কান্নায়। আমার তনুমন সমর্পিত প্রকৃতির মনােহর রূপ মাধুর্যের লাস্যময় সিদ্ধ সৌন্দর্যের গভীরে। চকোর-চকোরির বিরহকাতর কান্নার রেশ আমার চিত্তের আনন্দকে ম্লান করে দিল। চাঁদনি রাতের বুক ভরে বিরহী পাখির করুণ সুর আমার মগ্ন চৈতন্যে সহসা বেদনার ছোঁয়া দিয়ে গেল। আমার অস্তিত্বে অনুভবে আর কোনাে অনুভূতি নেই। শুধু পবিত্র এক পরিবেশ শুভ্রতার চাদর গায়ে দিয়ে সজাগ জীবনবােধে হদয়ের গভীরে নাড়া দিয়ে গেল। আমার কোনাে মালিন্য নেই, অহেতুক আতিশয্য নেই। নেই কোনাে সাংসারিক দুশ্চিন্তা কিংবা কর্মের তাড়া। জাগ্রত সে রাত। শুধু আমাকে অনাবিল অনিন্দ্য ভুবনের মহিমাদীপ্ত জোছনা স্নিগ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। একটু পরেই সকালের আলাে ফুটবে। চাঁদের উজ্জ্বলতা যাবে নিভে। যে চাঁদ সারা রাত আমার বুকের ভেতর নানা চিন্তাভাবনার খেলা খেলেছে তার সব শক্তি যাবে ফুরিয়ে। যে আমি সারা রাত চাঁদকে ঘিরে আনন্দ-বেদনায় উদ্বেল হয়েছি। সেই আমাকেও পা বাড়াতে হবে সংসারের প্রাত্যহিকতায়। এই তাে জীবন। তবুও একটি রাতের চাঁদের আলাে আমার ভেতরে এক চিলতে আলাে ফেলে আমার নানা উপলব্ধিকে জাগিয়ে তুলল। আজ বুঝতে পারলাম, কেন কবি লিখেছিলেন-
এমন চাঁদের আলাে
মরি যদি তাও ভালাে
সে মরণ স্বরগ সমান।
উপসংহার
চাঁদনী রাত প্রতিটি মানুষকে মােহিত করে, প্রতিটি মানুষ এর রূপে মুগ্ধ হয়। গ্রামবাংলায় চাঁদের এমন যে, যে একবার এ রূপ দেখেছে সেই তাতে মজেছে-মজনুওয়ালা হয়ে। চাঁদনী রাতে গ্রামের পরিবেশ ভিন্ন রুপে আবির্ভূত হয়।