সালাতের পূর্বে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। ওযূর দ্বারা পবিত্রতা অর্জিত হয় (ফরয গোসল ছাড়া) । ওযূর ফরযগুলো ছুটে গেলে তা পরিপূর্ণ হয় না। তাই ওযূর ফরয ও কীভাবে ওযূ করতে হয়, ওযূ কি কি কারণে ভেঙ্গে যায় এগুলো সম্পর্কে আমাদের জানা জরুরী।
আজকের পোস্টটি পড়ে আমরা জানতে পারবো, ওযূ কী এর ফরয, ওযূর ফজিলত, ওযূ ভঙ্গের কারণসমূহ
ওযূ কী?
ওযূর আভিধানিক অর্থ স্বচ্ছতা। পারিভাষিক অর্থে পবিত্র পানি দ্বারা শারঈ পদ্ধতিতে হাত, মুখ, পা ধৌত করা ও (ভিজা হাতে) মাথা মাসাহ করাকে ওযু বলে।
ওযূর ফরয
ওযুর মধ্যে ফরয হল চারটি।
- ১. কুলি করা, নাকে পানি দেওয়া ও ঝাড়া সহ পুরা মুখমণ্ডল ভালভাবে ধৌত করা।
- ২. দুই হাত কনুই সমেত ধৌত করা,
- ৩. (ভিজা হাতে) কানসহ মাথা মাসাহ করা ও
- ৪. দুই পা টাখনু সমেত ধৌত করা।
“হে বিশ্বাসীগণ! যখন তোমরা ছালাতের জন্য প্রস্তুত হও, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় কনুই সমেত ধৌত কর এবং তোমাদের মাথা মাসাহ কর ও পদযুগল টাখনু সমেত ধৌত কর…..” (মায়েদাহ ৬)।
অত্র আয়াতে বর্ণিত চারটি ফরয বাদে ওযূর বাকী সবই সুন্নাত ।
ওযূর ফজিলত
(১) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন,…… “কালো ঘোড়া সমূহের মধ্যে কপাল চিতা ঘোড়া যেভাবে চেনা যায়.. ক্বিয়ামতের দিন আমার উম্মতের ওযূর অঙ্গগুলির ঔজ্জ্বল্য দেখে আমি তাদেরকে অনুরূপভাবে চিনব এবং তাদেরকে হাউয কাওছারের পানি পান করানোর জন্য আগেই পৌছে যাব। অতএব যে চায় সে যেন তার ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে চেষ্টা করে”। (মুসলিম, মিশকাত হা/২৯৮, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩, পরিচ্ছেদ-৩।, মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৯০।)
(২) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “আমি কি তোমাদের বলব কোন বস্তু দ্বারা আল্লাহ তোমাদের গোনাহ সমূহ অধিকহারে দূর করেন ও সম্মানের স্তর বৃদ্ধি করেন?….. সেটি হল কষ্টের সময় ভালভাবে ওযূ করা, বেশী বেশী মসজিদে যাওয়া ও এক সালাতের পরে আরেক সালাতের জন্য অপেক্ষা করা।” (মুসলিম, মিশকাত হা/২৮২।)
(৩) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “সালাতের চাবি হল ওযূ” (আবুদাউদ, তিরমিযী, দারেমী, মিশকাত হা/৩১২, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩, অনুচ্ছেদ-১।)
(৪) তিনি বলেন, “মুসলমান যখন ফরয সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে সুন্দরভাবে ওযূ করে এবং পূর্ণ মনোনিবেশ ও ভীতি সহকারে সুষ্ঠুভাবে রুকূ- সিজদা আদায় করে, তখন ঐ ওযূ ও সালাত তার বিগত সকল গুনাহের কাফফারা হিসাবে গৃহীত হয়। তবে গোনাহে কাবীরাহ ব্যতীত”। (মুসলিম, মিশকাত হা/২৮৬ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩, পরিচ্ছেদ-১।)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ঐ ব্যক্তি গোনাহ থেকে এমনভাবে মুক্ত হয়, যেমনভাবে তার মা তাকে পরিচ্ছন্নভাবে প্রসব করেছিল । (মুসলিম, মিশকাত হা/১০৪২ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘নিষিদ্ধ ওয়াক্ত সমূহ’ অনুচ্ছেদ-২২।)
(৫) ওযূ করার পর সর্বদা দু’রাক’আত ‘তাহিইয়াতুল ওযূ’ এবং মসজিদে প্রবেশ করার পর দু’রাক’আত ‘তাহিইয়াতুল মাসজিদ’ নফল সালাত আদায় করবে। এই আকাংখিত সদভ্যাসের কারণেই জান্নাতে বেলাল (রাঃ)-এর অগ্রগামী পদশব্দ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বপ্নের মধ্যে শুনেছিলেন। (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩২২; তিরমিযী, আহমাদ, , মিশকাত হা/১৩২৬ ‘ঐচ্ছিক ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩৯।)
তবে মসজিদে গিয়ে জামা’আত চলা অবস্থায় পেলে কিংবা একামত হয়ে গেলে সরাসরি জামা’আতে যোগ দিবে। (মুসলিম, মিশকাত হা/১০৫৮ ‘জামা’আত ও উহার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-২৩।)
ওযূ করার নিয়ম
“আমার উম্মতের উপর কষ্টকর মনে না করলে আমি তাদেরকে এশার সালাত দেরীতে এবং প্রতি সালাতে মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম”।
এখানে ‘প্রতি সালাতে’ অর্থ ‘প্রতি সালাতের জন্য ওযূ করার সময়’। অতএব ঘুম থেকে উঠে এবং প্রতি ওয়াক্ত ছালাতের জন্য ওযূর পূর্বে মিসওয়াক করা উত্তম। এই সময় জিহ্বার উপরে ভালভাবে হাত ঘষে গরগরা ও কুলি করবে।
(১) প্রথমে মনে মনে ওযূর নিয়ত করবে।” (২) “বিসমিল্লাহ” বলবে। অতঃপর (৩) ডান হাতে পানি নিয়ে” দুই হাত কব্জি সমেত ধুবে’ এবং আঙ্গুল সমূহ খিলাল করবে।’ এরপর (৪) ডান হাতে পানি নিয়ে ভালভাবে কুলি করবে ও প্রয়োজনে নতুন পানি নিয়ে নাকে দিয়ে বাম হাতে ভালভাবে নাক ঝাড়বে। তারপর (৫) কপালের গোড়া থেকে দুই কানের লতী হয়ে থুত্নীর নীচ পর্যন্ত পুরা মুখমণ্ডল ধৌত করবে ও দাড়ি খিলাল করবে। এজন্য এক অঞ্জলি পানি নিয়ে থুনীর নীচে দিবে। অতঃপর (৬) প্রথমে ডান ও পরে বাম হাত কনুই সমেত ধুবে। এরপর (৭) পানি নিয়ে দু’হাতের ভিজা আংগুলগুলি মাথার সম্মুখ হ’তে পিছনে ও পিছন হ’তে সম্মুখে বুলিয়ে একবার পুরা মাথা মাসাহ করবে। একই সাথে ভিজা শাহাদাত আংগুল দ্বারা কানের ভিতর অংশে ও বুড়ো আংগুল দ্বারা পিছন অংশে মাসাহ করবে। পাগড়ীবিহীন অবস্থায় মাথার কিছু অংশ বা এক চতুর্থাংশ মাথা মাসাহ করার কোন দলীল নেই। বরং কেবল পূর্ণ মাথা অথবা মাথার সামনের কিছু অংশ সহ পাগড়ীর উপর মাসাহ অথবা কেবল পাগড়ীর উপর মাসাহ প্রমাণিত। অতঃপর (৮) ডান ও বাম পায়ের টাখনু সমেত ভালভাবে ধুবে ও বাম হাতের আংগুল দ্বারা পায়ের আংগুল সমূহ খিলাল করবে। (৯) এভাবে ওযূ শেষে বাম হাতে কিছু পানি নিয়ে লজ্জাস্থান বরাবর ছিটিয়ে দিবে ও নিম্নোক্ত দো’আ পাঠ করবে-
উচ্চারণ : আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহূ লা-শারীকা লাহূ, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আব্দুহূ ওয়া রাসূলুহু। আল্লা-হুম্মাজ্’আল্নী মিনাত্ তাউয়াবীনা ওয়াজ্ আলনী মিনাল মুতাত্বাহ্হিরীন।
অর্থ : ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই । তিনি একক ও শরীক বিহীন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল’ (মুসলিম)। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে তওবাকারীদের ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন!! (তিরমিযী)।
ওযূ ও মাসাহ্-এর অন্যান্য মাসায়েল
(১) ওযূর অঙ্গগুলি এক, দুই বা তিনবার করে ধোয়া যাবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তিনবার করেই বেশী ধুতেন। তিনের অধিকবার বাড়াবাড়ি। ধোয়ার মধ্যে জোড়-বেজোড় করা যাবে।
(২) ওযূর মধ্যে ‘তারতীব’ বা ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরী।
(৩) ওযূর অঙ্গগুলির নখ পরিমাণ স্থান শুষ্ক থাকলেও পুনরায় ওযূ করতে হবে। দাড়ির গোড়ায় পানি পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। না পৌঁছলেও ওযূ সিদ্ধ হবে ।
(৪) শীতে হোক বা গ্রীষ্মে হোক পূর্ণভাবে ওযূ করতে হবে। কিন্তু পানির অপচয় করা যাবে না। রাসূল (সাঃ) সাধারণতঃ এক ‘মুদ্দ’ বা ৬২৫ গ্রাম পানি দিয়ে ওযূ করতেন।
(৫) ওযূর জন্য ব্যবহৃত পানি বা ওযূ শেষে পাত্রে অবশিষ্ট পানি নাপাক হয় না। বরং তা দিয়ে পুনরায় ওযূ বা পবিত্রতা হাছিল করা চলে। রাসূল (সাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম একই ওযূর পাত্রে বারবার হাত ডুবিয়ে ওযূ করেছেন।
(৬) ওযূর অঙ্গগুলি ডান দিক থেকে ধৌত করা সুন্নাত ।
(৭) ওযূ শেষে পবিত্র তোয়ালে, গামছা বা অনুরূপ কিছু দ্বারা ভিজা অঙ্গ মোছা জায়েয আছে।
(৮) ওযূ থাক বা না থাক, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রতি ওয়াক্ত ছালাতের পূর্বে ওষু করায় অভ্যস্ত ছিলেন। তবে মক্কা বিজয়ের দিন তিনি এক ওযূতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করেন এবং এ সময় মোযার উপর ‘মাসাহ’ করেন।
(৯) মুখে ওযূর নিয়ত পড়ার কোন দলীল নেই। ওযূ করাকালীন সময়ে পৃথক কোন দো’আ আছে বলে জানা যায় না। অনুরূপভাবে ওযূর প্রত্যেক অঙ্গ ধোয়ার পৃথক পৃথক দো’আর হাদীছ ‘জাল’। ওযূ শেষে সূরায়ে ‘কন্দর’ পাঠ করার হাদীছ মওযূ বা জাল ।
(১০) ওযূর অঙ্গে যখমপট্টি বাঁধা থাকলে এবং তাতে পানি লাগলে রোগ বৃদ্ধির আশংকা থাকলে তার উপর দিয়ে ভিজা হাতে মাসাহ করবে।
ওযূ ভঙ্গের কারণসমূহ
পেশাব পায়খানার রাস্তা দিয়ে দেহ থেকে কোন কিছু নির্গত হলে ওযূ ভঙ্গ হয়। বিভিন্ন ছহীহ হাদীছের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, এটিই হল ওযূ ভঙ্গের প্রধান কারণ। পেটের গণ্ডগোল, ঘুম, যৌন উত্তেজনা ইত্যাদি কারণে যদি কেউ সন্দেহে পতিত হয় যে, ওযূ ছুটে গেছে, তাহলে পুনরায় ওযূ করবে। আর যদি কোন শব্দ, গন্ধ বা চিহ্ন না পান এবং নিজের ওযূর ব্যাপারে নিশ্চিত থাকেন, তাহলে পুনরায় ওযূর প্রয়োজন নেই। ‘ইস্তেহাযা’ ব্যতীত কম হোক বা বেশী হোক অন্য কোন রক্ত প্রবাহের কারণে ওযূ ভঙ্গ হওয়ার কোন ছহীহ দলীল নেই।
এই রকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন। এর পাশাপাশি গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন।