
পুতুল পূজা বা পৌত্তলিকতা ছিল আরবদের সর্বজনীন ধর্ম। আদ, সামুদ, জারঈম এবং আমালিকা কাওম ছিল সম্পূর্ণরূপে মুশরিক বা পৌত্তলিক। পবিত্র কা’বা গৃহে ৩৬০ টি প্রতিমা রাখা হয়েছিল। লাত- মানাত, উজ্জা প্রভৃতি দেব-দেবী ছিল বিখ্যাত ।
আরবরা অসংখ্য দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ছিল। আল্লাহর কন্যা স্বরূপ তাদের কল্পিত মূর্তি বানিয়ে নানা উপলক্ষে তারা সেগুলোর পূজা করত। তাদের মূর্তিগুলোর মধ্যে ছিল লাত-মানাত, উজ্জা, হোবল, ওয়ার, সাওয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক, নসর প্রভৃতি প্রধান প্রধান দেব-দেবী। তারা হযরত ইবরাহীম, হযরত ইসমাইল, হযরত ঈসা এবং হযরত মরিয়মের মূর্তিও কাবা গৃহে স্থাপন করেছিল । প্রতি বছর তারা ঐসব দেব-দেবীকে অর্থ দিতে আসত এবং দেবতাদের মনতুষ্টির জন্য নরবলি দিত। এ উপলক্ষে তারা উকায মেলা নামে বার্ষিক মেলায় যোগ দিত। তারা আল্লাহর একত্ব ও আখিরাতকে বিশ্বাস করত না। মৃত্যুকেই জীবনের শেষ মনে করত।
আরব বেদুঈনরা বিভিন্ন জড় বস্তু, বৃক্ষ, কূপ, প্রস্তর, গুহা, বালির স্তুপকে পূজা করত। উন্মুক্ত মরুপ্রান্তরে বসবাসের কারণে আরব বেদুঈনরা সৌর জগতের বিভিন্ন গ্রহ, নক্ষত্র, সূর্য ও চন্দ্রকে দেবতা স্বরূপ পূজা করত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল প্রকৃতিবাদী। অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যু যা কিছু পৃথিবীতে ঘটছে তা প্রকৃতির নিয়মেই হচ্ছে বলে বিশ্বাস করত।
অধিকাংশ আরবই পরকালের জীবন তথা কিয়ামত, আখিরাত, বেহেশ্ত, দোযখ ইত্যাদিতে অবিশ্বাসী ছিল। আরবগণ মানুষকে নবী-র রাসূল হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। কা’বা শরীফকে তারা দেবালয় বানিয়ে নিয়েছিল। কা’বা শরীফের ধর্মীয় গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত বেশি। নির্দিষ্ট সময়ে তারা তীর্থযাত্রায় কা’বায় আসত এবং এর প্রদক্ষিণ ও বলিদানের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুষ্ঠানও পালন করত। তাদের মধ্যে কোন কোন গোত্রের নারী-পুরুষ উলঙ্গ হয়ে কা’বা প্রদক্ষিণ করত।
তাদের মধ্যে একদল বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন, যাঁরা ছিলেন যাবতীয় কুসংস্কারমুক্ত। এঁরা এক আল্লাহতে বিশ্বাস করত এবং ইব্রাহীমের ধর্মের উপর তাদের আস্থা ছিল- এজন্য এদেরকে হানীফ বলা হত। যেমন- ওরাকা-ইবনে-নওফেল, আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাস, কবি জুহাইর, আবু বকর প্রমুখ। তারা স্বতন্ত্রভাবে ধর্মীয় জীবন যাপন করতেন এবং কোন প্রকারের মূর্তি পূজায় অংশগ্রহণ করতেন না।
সর্বোপরি আরবরা নানা ধর্মীয় গোঁড়ামী ও কুসংস্কারে নিপতিত ছিল। জীবজন্তু ও নরবলি, তন্ত্র-মন্ত্র, যাদু-টোনা, ভূত- প্রেত, ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাসী ছিল।
প্রাক ইসলামী যুগে আরবে ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্ম প্রচলিত ছিল। ইহুদি খ্রিস্টানরাও নানা কুসংস্কারে ও ধর্ম ব্যবসায় জর্জরিত ছিল । ইহুদিগণ অবজ্ঞাবশত জেহোবাকে বিশ্ব স্রষ্টা ও নিয়ন্তা মনে করত। নবী উযাইর (আ) কে খোদার পুত্র মনে করত। অপর দিকে খ্রিস্টানরা এক আল্লাহর একত্ববাদের পরিবর্তে ত্রিত্ববাদে বা তিন খোদায় বিশ্বাস করত। তাদের মতে ঈশ্বরের স্ত্রী ছিলেন বিবি মরিয়ম (মেরী) এবং ঈসা (আ) ছিলেন ঈশ্বরের পুত্র।
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ধর্মীয় জীবনে আরবরা ছিল অত্যন্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন। মূর্তি পূজা, বস্তু পূজা ও সর্ববিধ ধর্মীয় কুসংস্কার যখন আরবদের ধর্মীয় জীবনকে গভীরভাবে কলুষিত করে ফেলেছিল। ঠিক সে সময়ে হযরত মুহাম্মদ (স) একত্ববাদের বাণী নিয়ে আবির্ভূত হলেন। তিনি মহান আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী ঘোষণা করলেন- “আল্লাহ এক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মদ (স) তাঁর প্রেরিত রাসূল”। তাঁর অমোঘ বাণী যুগ যুগ ধরে লালিত পৌত্তলিকতার মূলে কুঠারাঘাত হানল । নিকৃষ্ট পার্থিব বস্তুর পূজা ত্যাগ করে মানুষ একত্ববাদের মন্ত্রে দীক্ষা নিল । ভুতখানায় পরিণত কা’বা গৃহ আবার আল্লাহর ইবাদত শুরু হল । মাত্র তেইশ বছরের মধ্যে তিনি ধর্মজ্ঞান বর্জিত আরব জাতিকে একটি আদর্শ ধর্মের অনুসারী জাতিতে পরিণত করলেন।