বাংলা রচনা

যৌতুক প্রথা একটি জাতীয় সমস্যা : রচনা

3/5 - (2 votes)
যৌতুক প্রথা একটি জাতীয় সমস্যা
যৌতুক প্রথা একটি জাতীয় সমস্যা

যৌতুক প্রথা একটি জাতীয় সমস্যা

প্রিয় শিক্ষার্থী, আজ বাংলা ২য় পত্রের রচনা বিভাগ থেকে “যৌতুক প্রথা একটি জাতীয় সমস্যা” সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে। রচনাটি এইচএসসি ও এসএসসি সকল শ্রেণিদের জন্য উপকারে আসবে।
অনুরুপভাবে লেখা যায়ঃ পণপ্রথা, নারী স্বাধীনতা ও পণপ্রথা, পণপ্রথার অভিশাপ।

ভূমিকা

যৌতুক প্রথা নারীর জীবনে এক কঠিনতম শব্দ। যার বিষবাস্পে মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায় সুন্দর সম্ভাবনাময় নারীর জীবন। যৌতুকের কারণে শুধু একজন নারী যে তার আপন সগৌরব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তা নয়, সেইসাথে পুরো পরিবার বিপদগ্রস্থ হয়ে পরে। আবাহমান বাংলায় যুগ যুগ ধরে পণপ্রথার প্রচলন হয়ে আসছে। বর্তমান সময়ে যৌতুক প্রথা একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী নির্যাতনের অন্যতম একটি কারণ সমাজে প্রতিষ্ঠিত ‘যৌতুক প্রথা’

যৌতুক কী?

যৌতুক বা পণ হল কনেপক্ষ বরপক্ষকে অর্থ প্রদান বা সম্পত্তির হস্তান্তর করে কন্যার বিয়ের ব্যবস্থা করা। যৌতুকের সমার্থক শব্দ হচ্ছে পণ। সাধারণ অর্থে যৌতুক বলতে বিয়ের সময় বরকে কনের অভিভাবক কর্তৃক প্রদেয় অর্থ বা মূল্যবান সামগ্রীকে বুঝায়। বিয়ের সময়, আগে, পরে কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে যে সকল অর্থ, সম্পদ, অলংকার, আসবাবপত্র, বিনোদনমূলক সামগ্রী দিয়ে থাকে তাকেই যৌতুক বলা হয়। বর্তমানে ধনী পরিবারগুলোতে বিয়ের উপটোকন হিসেবে বাড়ি-গাড়ি ও জায়গা জমিও আদান-প্রদান হয়ে থাকে।

যৌতুক প্রথার ইতিহাস

যৌতুক প্রথা হল হৃদয়হীন সমাজের নির্লজ্জ নারীপীড়নের অন্যতম হাতিয়ার। নারীর অধিকার হরণের চিত্র সর্বযুগের নয়। এই ঘৃণ্য মানসিকতার পরিচয় আছে ঋগবেদে কক্ষীবানের কন্যা-সম্প্রদানের ঘটনায়, মহাভারতে সুভ্রুর উপাখ্যানে। আমাদের বঙ্গভূমিতে রাজা বল্লাল সেনের আমল থেকে কৌলীন্য প্রথার ফলে কুলীন পাত্রের চাহিদা বিয়ের বাজারে বেড়েছিল অস্বাভাবিক রকম। কন্যা অরক্ষণীয়া হওয়ার আগে পাত্রস্থ করে সামাজিক নিপীড়ন থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইতেন পিতা-মাতা। মােটা অর্থ প্রাপ্তির চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ছাতনা তলায় টোপর মাথায় দাড়াতেন কুলীন বংশীয় তনয়। এছাড়া একটু নিচু বংশের মেয়েকে উঁচু বংশে বিয়ে দিতে হলে মেয়ের বাবাকে পাত্র পক্ষকে প্রচুর অর্থ সম্পদ দেয়াটা ছিল তখনকার দিনের নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। এছাড়াও মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যসহ অন্যান্য কাব্যে যৌতুক প্রথার ব্যাপক প্রচলন সম্পর্কে জানা যায়। এ হল আমাদের পণ ও যৌতুক প্রথার ইতিহাস

শ্ৰেণী ও ধর্মভেদে পণপ্রথার পার্থক্য

পণপ্রথা আমাদের দেশে বহুদিন আগে থেকেই প্রচলিত। সমাজে শ্রেণী ও ধর্মের মতপার্থক্য অনুযায়ী পণপ্রথা লক্ষণীয়। আমাদের মুসলমান সমাজে শরিয়ত অনুযায়ী ‘তালাক’ বা বিবাহ-বিচ্ছেদের সময় কন্যাপক্ষকে পণ বা ‘মােহরানা‘ হিসেবে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। হিন্দুদের মধ্যে পণপ্রথা খুবই প্রকট। কন্যার পিতাকে পণ না দিয়ে পাত্র তাকে বিয়ে করে বাড়িতে আনতে পারে না। হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণে বর-পণপ্রথা প্রচলিত। সেখানে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে বর-পণ মেটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হয়। অর্থসঙ্গতি না থাকলে সে সমাজে বিবাহ নিষিদ্ধ। আবার, অনেকক্ষেত্রে পণের অর্থ সংগ্রহ সময়সাপেক্ষ হলে অধিকাংশ পাত্রকে সঙ্গতি-অর্জনের পর অধিক বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য হতে হয়। এর ফলে সর্বশ্রেণীর হিন্দুর মধ্যে বর-কনের বয়সের তারতম্য অনেক সময় বিসদৃশ মনে হয়।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের যৌতুক প্রথার চিত্র

যৌতুক প্রথা অ‌তি প্রাচীন প্রথা। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে পণপ্রথাকে ঘিরে নারী-নির্যাতনই নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন ভারতবর্ষে নারীর মর্যাদা সকলের ক্ষেত্রে সমভাবে রক্ষিত হয় নি। হিন্দু সমাজে নারী উপেক্ষিত হতাে। তারা বহু-বিবাহ প্রথায় প্রশ্রয় দিয়ে নারী-নির্যাতনে ইন্ধন জুগিয়েছিল। বস্তুত নারীর এভাবে মর্যাদাহানির মধ্য দিয়েই পণপ্রথার উদ্ভব। বল্লাল সেনের সময়ে কৌলীন্য-প্রথার কারণে বরপণ দিতে বাধ্য পাত্রীর অভিভাবকরা অতিদ্রুত সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ত। অপরদিকে বরপণ দিতে অপারগ অভিভাবকদের কন্যারা শ্বশুর বাড়িতে অপরিসীম নির্যাতন ভােগ করতে থাকত। মধ্যযুগে মুসলমান আমল থেকে নারীকে ক্রমশ পর্দার অন্তরালে প্রবেশ করতে হয়। এর ফলে শিক্ষার প্রসার বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং নারীর মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। যৌতুকই ধীরে ধীরে পরিণত হল প্রথাচারে। শুরু হল পণপ্রথার ব্যভিচার। নারী হল বিকিকিনির পণ্যসামগ্রী।

যৌতুক প্রথার কারন

প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান সময় পযর্ন্ত যৌতুকের প্রথার প্রচলন ও বহাল তবিয়তে টিকে থাকার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। নিচে কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হলঃ

অর্থ লোভ

অ‌তি‌রিক্ত সম্পদ লা‌ভের মান‌সিকতা হ‌তে যৌতু‌কের সূত্রপাত হ‌য়ে‌ছে। অর্থ লাভের বশবর্তী হয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয় কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কাছ থেকে।

কৌলিন্য প্রথা

প্রাচীনকাল থেকে সচ্ছল মেয়েরা বরকে বিভিন্ন উপহার দিত। এই উপহারগুলি ছিল তাদের আভিজাত্যের প্রতীক। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই প্রথাটি বাধ্যতামূলক যৌতুকের রূপ নিয়েছে।

হিন্দু পারিবারিক আইন

হিন্দু পারিবারিক আইন অনুসারে, মেয়েরা পিতৃসম্পদের অধিকারী নয়। তাই বিয়ের সময় কন্যার পরিবার থেকে মোটা অংকের টাকা দাবি করার মনসিকতা তৈরি হয়, যা যৌতুক প্রথাকে আরও তীব্রতর করে।

নারী শিক্ষার অভাব

নারী শিক্ষার অনগ্রসরতা যৌতুক প্রথার জন্য অনেকটাই দায়ী। শিক্ষার অভাবে নারীরা নিজেদেরকে যৌগভাবে গড়ে তুলতে পারছে না। ফলে একদিকে যেমন নারীরা পিছিয়ে পড়ছে অন্যদিকে কম শিক্ষিত বলে পাত্রের পরিবার পাত্রীর পরিবার থেকে অর্থ সম্পদের চাহিদা পোষণ করতে দ্বিধাবোধ করে না।

ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়

কোন ধর্মেই যৌতুক বৈধ নয়। কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতি প্রভাবে ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণ সমাজে রন্দ্রে রন্দ্রে যৌতুক প্রথা মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে। ধর্মীয় অনুশাসনকে তোয়াক্কা না করে বরং অর্থ লিপ্সাকে বড় করে দেখছে কিছু লোভী শ্রেণীর মানুষ।

দারিদ্রতা

দারিদ্রতার নিষ্ঠুর বিষাক্ত ছোবল থেকে মুক্তির আশায় কন্যা দায়গ্রস্থ পিতা অনিচ্ছা সর্তেও যৌতুকের টাকা হাঁতে তুলে দেন পাত্রের পরিবারকে। দারিদ্র্যের ছোবল থেকে মেয়েকে রক্ষা করতে পিতাকে যৌতুকের আশ্রয় নিতে হয়।

নারী মর্যাদার অভাব

আইনের চোখে নারী পুরুষ সমান হলেও নারীদেরকে অনেক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাছাড়া অনেক পরিবার কন্যা সন্তানকে বোঝা মনে করেন। নারী‌কে নিম্ন সামা‌জিক মর্যাদার কার‌ণে সমা‌জে যৌতুক প্রথার বিস্তার ঘ‌টে‌ছে।

অত্যধিক ভালোবাসা

কণ্যা সন্তা‌নের প্র‌তি পিতা মাতার অত্য‌ধিক স্নে‌হের কার‌ণে মে‌য়ের সু‌খের জন্য জামাই‌কে অর্থ সম্পদ প্রদান ক‌রে যৌতুক বৃ‌দ্ধি‌তে সহায়তা ক‌রে।

উপযুক্ততার মানদণ্ড

কণ্যার দৈ‌হিক খুঁত, অ‌ধিক বয়স, সৌন্দ‌র্য্যের বা রু‌পের অভাব প্রভৃ‌তি কার‌ণে কণ্যাপক্ষ যৌতুক দি‌য়ে বি‌য়ে‌তে রা‌জি হন। কণ্যার চে‌য়ে বর বে‌শি উপযুক্ত হ‌লে মে‌য়ের অ‌ভিভাবক মোটা অং‌কের যৌতুক প্রদান ক‌রে মে‌য়ে‌কে পাত্রস্থ ক‌রে বিধায় যৌতু‌কের প্রসার ঘ‌টে।

একক কোন কার‌ণে যৌতুক প্রথার উদ্ভব ঘ‌টে‌নি। এর জন্য বহু‌বিধ কারণ‌কে দায়ী করা যায়।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারীমুক্তি আন্দোলন

ঊনবিংশ শতাব্দীতে এ উপমহাদেশে কতিপয় মনীষীর সমাজ-সংস্কার প্রয়াস আমাদের দেশের নারীমুক্তির আন্দোলনকে অনেকদূর এগিয়ে দেয়। এ সময়ে আমাদের জাতীয় জীবনে যে নবজাগরণের সূচনা হয় তা কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতায় দীর্ণ মুমূর্ষ সমাজকে, প্রবলভাবে নাড়া দেয়। ইউরােপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষার সংস্পর্শ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাহুলাংশে সাহায্য করে। ফলে বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিরােধে সমাজসেবীরা তৎপর হলে এসব প্রথা বন্ধ হয়। রাজা রামমােহনের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথার অবসান ঘটে। বিধবা-বিবাহ চালু করার প্রয়াস চলে এবং পণপ্রথার বিরুদ্ধে অনেকেই সােচ্চার হন। বিদ্যাসাগর নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। দেশহিতব্রতীদের অদম্য প্রয়াসে আইনসিদ্ধ হয় বিধবা বিবাহ। কিন্তু জাতির এই শুভ জাগরণের দিনেও কলঙ্কিত পণপ্রথার অবসান হল না।

যৌতুক প্রথার বিরুপ প্রভাব

নারীর অপ‌রিসীম অপ‌রি‌মেয় প্রেম, প্রী‌তি, ভা‌লোবাসা, স্নেহ-মায়া মমতা সব‌কিছুই যৌতুকের মত ভয়ংকর দান‌বের নিকট তুচ্ছ। যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। যৌতুকের লোভে তাদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে না করায় স্বামী-স্ত্রী প্রায়ই মিলবন্ধন হয় না। যৌতুকের পরিমাণ একটু কম হলেই দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে অসহনীয় নির্যাতন করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। প্রতিনিয়ত স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির চাহিদা মেটাতে গিয়ে অনেক দরিদ্র মেয়ের বাবা নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে পড়েছেন। যৌতুকের দাবি মেটাতে না পেরে অনেক নারীকে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি ফিরতে হয়। কখনও কখনও তালাক দেওয়া হয়। এভাবে প্রতিনিয়ত নির্যাতন ও নিপীড়ন সইতে না পেরে অনেক নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। যৌতুক প্রথা নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, নারীকে সামাজিক অবজ্ঞা ও পণ্যে পরিণত করেছে। যৌতুক শুধু নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে না, সামাজিক কাঠামোকেও ধ্বংস করে। এটি একটি জঘন্য ও অমানবিক সামাজিক প্রথা যা নারীর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে। যৌতুকের অভিশাপে অনেক দরিদ্র বাবা-মা তাদের মেয়েকে সানন্দে গ্রহণ করেন না। যৌতুকের বিরূপ প্রভাব নারীর জীবনের জন্য অবনতি ও অবমাননাকর।

সমাজে যৌতুক প্রথার বর্তমান অবস্থা

যৌতুক প্রথা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক সময় এটা একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল৷ কিন্তু এখন এটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে৷ উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত – সবার মধ্যেই এটা ছড়িয়ে আছে৷ তাছাড়া সকল ধর্ম-বর্ণের মধ্যে এই যৌতুক প্রথা এখন আসন গেড়ে বসেছে৷ আমাদের সমাজে যৌতুক প্রথা প্রবলভাবে প্রচলিত। রাষ্ট্রের যৌতুক বিরোধী আইন থাকা সত্ত্বেও কেউই এই আইনের তোয়াক্কা করছে না। যৌতুক একটি মেয়ের জন্য অত্যন্ত অসম্মানজনক। এতে মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে, মেয়ের বয়স যত বেশি হবে, যৌতুকের পরিমাণও তত বেশি। আমাদের ৮৭ ভাগ মেয়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে৷ এর সিংহ ভাগই হচ্ছে যৌতুকের কারণে৷

বাংলাদেশে যৌতুক প্রথার চিত্র খুবই ভয়ংকর। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যৌতুকের কারণে ২৩৬ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১৯৫ জন নারীকে নির্যাতন করা হয়েছে। পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যৌতুকের কারণে ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ১৯২টি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে শতকরা ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়।

ইসলাম ও যৌতুক প্রথা

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে যৌতুক একটি নিষিদ্ধ কাজ। ইসলাম নারীর ক্ষমতায়ন ও তাদের মর্যাদা রক্ষার উদ্দেশ্যে ‘মহর’ নির্ধারণ করেছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ

নারীদের তাদের মোহরানা সন্তুষ্টচিত্তে দিয়ে দাও।

মহানবী (সা.) বলেছেনঃ

যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর মোহরানা নির্ধারণ করল পরিমাণে যাই হোক; কিন্তু মনে মনে তা পরিশোধের ইচ্ছা পোষণ করেনি, সে কিয়ামতের দিন ব্যভিচারী হিসেবে উঠবে।

প্রচলিত যৌতুক প্রথার ক্ষেত্রে দেখা যায়, মোহরের স্থলে উল্টা কন্যাপক্ষকে স্বামীর অবৈধ আবদারের অর্থ ও সম্পদ পরিশোধ করতে হয়। ইসলাম এই অন্যায়কে অনুমোদন করে না। যৌতুক জুলুমের নামান্তর। নারীর অভিভাবকের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে যৌতুকের মাধ্যমে তার ওপর অবিচার করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সমস্ত জুলুম হারাম।’ যৌতুকও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হারাম।

যৌতুক প্রথা প্রতিরোধের উপায়

নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে যৌতুককে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারী ধর্মীয় ও আইনগতভাবে এই অবৈধ কুপ্রথার শিকার হয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাই অচিরেই এই প্রথাকে প্রতিরোধ করতে হবে। নিচে যৌতুক প্রথা প্রতিরোধের উপায় তুলে ধরা হলঃ

  • যৌতুক প্রথা প্রতিরোধে নারী শিক্ষার প্রসার সবার আগে প্রয়োজন। শিক্ষিত নারী নিজের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকে। সমাজ ও পরিবারের জন্য সে বোঝা না বরং দেশের সম্পদ।
  • বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে।
  • অর্থ ও সম্পদের লোভ-লালসা ত্যাগ করতে হবে।
  • যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া দুটোই সমান অপরাধ। তাই আমাদেরকে আইন মেনে চলতে হবে।
  • সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি অনেকাংশে যৌতুক প্রথাকে প্রতিরোধ করতে পারে। যৌতুকের খারপ দিকগুলো সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে হবে।
  • সকল ধর্মেই যৌতুকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই আমাদেরকে নিজ নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
  • যুব সমাজকে তাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। তাদের মনে করতে হবে যৌতুক এক প্রকার ভিক্ষা।
  • যৌতুক বিরোধী আইন থাকলেও তার সঠিক প্রয়োগ নেই। ফলে যারা যৌতুক নিচ্ছে ও দিচ্ছে তারা এটাকে অপরাধ মনে করছে না বা নিজেদেরকে অপরাধী মনে করছে না। তাই এই প্রথা প্রতিরোধে আইনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
  • ইসলামে যেহেতু যৌতুককে হারাম ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই ইসলামের অনুসারী, সেহেতু মসজিদের ইমাম এবং আলেম-ওলামার মাধ্যমে যৌতুকবিরোধী প্রচারণা চালাতে হবে এবং এ বিষয়ে তাদেরও সচেতন হতে হবে।
  • মানবাধিকার সংগঠন ও এনজিওগুলোও যৌতুকবিরোধী প্রচারণা চালাতে পারে।
  • কন্যা সন্তান বোঝা নয় বরং তারও হতে পারে দেশের সম্পদ, এরূপ ধ্যান-ধারণা প্রত্যেকটি পরিবারের অভিবাবকদের অন্তরে লালন করতে হবে।
  • দারিদ্র যৌতুক প্রথাকে আরও বেগবান করেছে। তাই সরকার ও এনজিও প্রতিষ্ঠান যদি আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পকে বাস্তবায়ন করতে পারে তাহলে যৌতুক প্রথাকে দমন করা সম্ভবপর হবে।
  • ঝরে পড়া মেয়ে শিশুদের পুনরায় স্কুলে ভর্তি করার সুযোগ করে দিতে হবে।
  • যৌতুক দিলে কন্যা শ্বশুরবাড়িতে ভালো থাকবে এরূপ চিন্তা থেকে কন্যার পরিবারকে বের হয়ে আসতে হবে।
  • পেপার প‌ত্রিকায় যৌতুক বি‌রোধী প্র‌তি‌বেদন ছাপাতে হবে।
  • পাঠ্যপুস্ত‌কে যৌতুক বিষয়ক প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

সমাজ থেকে যৌতুক প্রথা সহজে নির্মূল করা অনেকটাই কষ্টসাধ্য। প্রয়োজন সকলের সহযোগিতা। জাগতে হবে নারীদের। বদলাতে হবে নিজের চিন্তা শক্তি। পণ্যসামগ্রী হিসেবে নিজেদের না ভেবে অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটালে সমাজে পুরুষদের দৌরাত্ম বহুলাংশে কমে যেতে বাধ্য। প্রয়ােজনে দিকে দিকে নারীমুক্তি আন্দোলনের ডাক ছড়িয়ে দিতে হবে এবং লেখাপড়া শিখে সামাজিক মূল্য ও মর্যাদা অর্জন করতে হবে। এভাবে পণপ্রথার বিষাক্ত-ক্ষতের যন্ত্রণা ক্রমান্বয়ে শিথিল হয়ে পড়বে।

সাম্প্রতিককালে যৌতুক প্রথার রূপবদল

সাম্প্রতিককালে পণপ্রথা লাগামহীনভাবে প্রচলিত। শুধু তার রূপবদল হয়েছে মাত্র। ইতােপূর্বে পণের অর্থ হাতে হাতে আদায় করার ব্যবস্থা ছিল। বিয়ের আসরেই পাত্রপক্ষ সব যৌতুকসামগ্রী বুঝে নিত এবং দেনা-পাওনার ব্যাপারটা মিটে গেলে পাত্রকে বিয়ের আসরে আনা হতাে। এছাড়া, প্রাপ্য অর্থ বুঝে নেওয়ার সময় পাত্রীপক্ষের দিক থেকে চুক্তির কোনরূপ খেলাপ গর্হিত অপরাধ হিসেবে গণ্য হতাে এবং শুধু এই অপরাধে বিয়েবাড়ি থেকে বর উঠিয়ে নিয়ে যাওয়াটা ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা।

বর্তমানে আসল ব্যাপারটা প্রায় কিছুই বদলায় নি। শুধু সবকিছুর ওপর ভদ্রতার মুখােশ এঁটে দেওয়া হয়েছে। এখন অনেকেই শালীনতার দোহাই দিয়ে নগদ অর্থ নিতে চান না। এর পরিবর্তে প্রত্যাশা করে রঙিন টেলিভিশন, টেপ-রেকর্ডার, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, কম্পিউটার, মােটর সাইকেল, মােটর গাড়ি, ফ্ল্যাট বাড়ি কিংবা জমি-জায়গা ইত্যাদি। আমরা শিক্ষা-দীক্ষায়, সভ্যতায় আজ অনেক এগিয়ে। কিন্তু দুঃখের কথা, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সমাজে প্রাচীন মানসিকতার অনুবর্তন চলছে অদ্যাবধি। শুভ পরিণয়ের মধুর সম্পর্ক গড়ে-ওঠার আগেই শুরু হয় দোকানদারি দেনা-পাওনার দর-কষাকষি। যৌতুকের টাকার ওপর নির্ভর করে নববধূর গুণাগুণের মূল্যায়ন। আজকের সমাজব্যবস্থায় শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, শাসক-শােষক নির্বিশেষে সবাই কম বেশি এই হীন কাজটার সঙ্গে জড়িত।

যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে আইন ও গৃহীত পদক্ষেপ

আমাদের দেশে পণপ্রথা নিরােধে আইন রয়েছে ‘যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০’। এই আইনে বলা হয়েছে যে, পণ প্রদান অথবা গ্রহণ কিংবা দাবি করা একটি শাস্তিযােগ্য অপরাধ এবং এক্ষেত্রে শাস্তি হচ্ছে কারাদণ্ড কিংবা জরিমানা। কিন্তু স্বেচ্ছাপ্রণােদিত যৌতুক দানের নাম করে আইনের চোখে ধূলি নিক্ষেপের যে আয়ােজন হয়েছে তার বদৌলতে প্রায়শই দেখা যায় যে, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। আইনে অপরাধীর শাস্তির বিধান থাকলেও, কার্যক্ষেত্রে এর প্রয়ােগ হচ্ছে না। ফলে পণপ্রথাকে ঘিরে মনুষ্যত্বের যে নিদারুণ অবমাননা দীর্ঘদিন চলছিল, তা এখনও বলবৎ রয়েছে। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশােধিত ২০০৩); দ্রুত বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট ২০০২ রয়েছে।

উপসংহার

প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত পৃথিবীতে বহু পরিবর্তন ঘটেছে-সভ্যতার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের বর্বর চারএের তেমন রূপবদল হয়নি। সম‌য়ের পথ প‌রিক্রমায় যৌতুক প্রথা মাকড়শার মতোই আমাদের হৃদয়ে এবং আমাদের সমাজে শিকড় গেড়েছে। বর্তমানে তা জাতীয়সমস্যায় রুপ নিয়েছে। যৌতুক নারী নির্যাতনের উপলক্ষ হিসেবে বিবেচিত। আমাদের দেশে কত নারী যে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে তার হিসাব নেই। মানুষ যত দিন ভোগবাদী চিন্তার চূড়ান্ত স্তর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারবে, তত দিন যৌতুক নামক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই। সুতরাং, চিকিৎসা প্রয়োজন। আর সেই চিকিৎসা হতে হবে মানুষের চিন্তায়। মানবতার কল্যাণে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।

তথ্যসূত্র

১। যৌতুক প্রথা – প্রথমআলো।
২। যৌতুক রো‌গের কারণ ও প্র‌তিকার – Somewhereinblog
৩। ‘যৌতুক সামাজিক ব্যাধি, যারা নিচ্ছে তারা অপরাধী’ – ডিডাব্লিউ
৪। যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি – প্রতিদিনের সংবাদ

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button