নৌকা ভ্রমনের একটি অভিজ্ঞতা – রচনা
সূচনা
ভ্রমণ শিক্ষার একটি বড় অংশ। অতীতকালে কোনাে কোনাে দেশের মনীষীরা ভ্রমণের মাধ্যমেই জ্ঞান লাভ করতেন। বর্তমানেও জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে ভ্রমণকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। আমিও ভ্রমণ করতে ভালােবাসি। আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণও ভ্রমণের প্রতি আমাদেরকে উৎসাহ প্রদান করেন। আমাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার ডাকাতিয়া নদীর তীরে। যদিও বর্তমানে আমি রাজধানী ঢাকায় থাকি। আমার জীবনে অনেকবার নৌকাভ্রমণে গিয়েছিলাম। তবে যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন মা-বাবা ও অন্যদের সাথে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেই ভ্রমণের কথা এখনাে আমি মাঝে মাঝে মনে করে পুলকিত হই।
ভ্রমণের বর্ণনা
নৌকায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে একটু আগে আগেই রওয়ানা দিতে হয়। আমাদের বেলায়ও তাই হয়েছে। আমরাও খুব সকালে রওয়ানা দিয়েছিলাম। নৌকা ভাড়া করা হয়েছিল আমাদের এক দূর-সম্পর্কের জ্যাঠার। সকাল আটটার দিকে আমরা নৌকায় গিয়ে উঠলাম। প্রথমদিকে মায়ের কড়া শাসনে আমি চুপচাপ ছইয়ের মধ্যে বসে থাকলাম। কারণ আমি তখনও তেমন ভালাে করে সাঁতার জানি না। কিছুটা ভয়ও লাগছে। তবে শরতের নদী বলে বেশ শান্ত। ছােট ছােট ঢেউয়ে নৌকা দুলছিল। শুয়ে শুয়ে ছইয়ের ফাঁক দিয়ে নীল আকাশ দেখতে থাকলাম। শরতের আকাশ যে এত নীল হয়, তা আজই আমি প্রথম অনুভব করলাম। সাদা সাদা তুলাের মতাে হালকা মেঘ ভেসে যাচ্ছে। দূরে উড়ে যাচ্ছে গাঙচিল, মাছরাঙা, বকের সারি। মাঝে মাঝে ভট ভট শব্দ করে ঢেউ তুলে ছুটে যাচ্ছে পাশ দিয়ে লঞ্চ ও ট্রলার। বড়মামা আইপডে সতীনাথ মুখখাপাধ্যায়ের গান শুনছেন
“মরমিয়া তুমি চলে গেলে, দরদিয়া আমার …।”
বড়ই দরদ দিয়ে গাওয়া গানের সুর আমাকেও ক্ষণিকের জন্য তন্ময় করে ফেলেছে। ছােট বােন মিলি মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মাঝে মাঝে হাত ডুবিয়ে দিচ্ছে নদীর পানিতে। আমারও ইচ্ছে হচ্ছে নদীর পানিতে হাত ডুবিয়ে খেলা করতে। কিন্তু মাকে বলতেই মা প্রচণ্ড এক ধমক দিলেন। আমাকে ধমক দিতে দেখে মামা মহাকৌতুকে হেসে উঠলেন। আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম। মা মনে করে আমি তখনাে ছােট্টটি রয়ে গেছি।। নৌকার মাঝি দুজন। বেশ দক্ষ মাঝি তারা। খালি গা, কোমরে গামছা বাঁধা।
মাথায় একটা পুরানাে কাপড় পেঁচানাে। নৌকাখানাও বেশ বড়সড়। দুইপাশে চ্যাপটা গলুই। মাঝখানে ছবির মতাে ছই উঠানাে। কাঠের পাটাতনের ওপর হােগলা বিছানাে, তার ওপর একটা পাতলা কাঁথা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে একাধিক বালিশ পাতা আছে। একপাশে একটা মাটির চুলা। সম্ভবত মাঝিরা এখানে রান্না করে খায়। নৌকা তখন মাঝনদীতে কুলুকুলু ঢেউ, ছলাৎ ছলাৎ শব্দে গলা মিলিয়ে গান ধরল একজন মাঝি
মাঝির গান গাওয়ার দৃশ্য দেখে আমি খুবই প্রীত হলাম। ততক্ষণে পালে হাওয়া লেগেছে। দূরে ছােট ছােট দোকানপাট, হাটবাজার, দালান-ঘর, বাড়ি, গাছপালা দেখতে পেলাম। পিছনে আবছা ছায়ার মতাে দিগন্ত। নদীর ঘাটে কেউ কাপড় ধুচ্ছে, মেয়েরা ঘােমটা মাথায় থালাবাসন মাজছে, কেউ-বা শিশুকে গােসল করাচ্ছে, ভরা কলসি কাঁখে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে গ্রামের নারীরা। কিশাের দামাল ছেলেরা নদীর ঘােলা জলে লাফালাফি করছে, কেউ-বা সাঁতার কাটছে। জেলেরা জাল বাইছে। কেউ গরু-ছাগল বা মহিষকে গােসল করাচ্ছে নদীর জলে। এক জায়গায় দেখলাম একসাথে অনেকগুলাে সারিবাধা নৌকা। কোনাে কোনাে নৌকা থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ছইয়ের ওপর রােদে দেওয়া শাড়ি-জামা-লুঙ্গি। বড়মামা বললেন, ওগুলাে বেদের নৌকার বহর। বেলা এগারােটার দিকে আমরা আত্মীয়দের বাড়ির ঘাটে গিয়ে পৌছালাম। তাদের বাড়ির পাশে একটা বড় বাজার আছে। ওই বাজারটা ঘুরে দেখা আমার খুব শখ। সবাই আত্মীয়দের বাড়িতে উঠার পর খাওয়াদাওয়া করে বাজারের দিকে গেলাম। বাজারে বেশ মজা পেলাম। সেখানে পাশেই পুরানাে দিনের একটি মঠ দেখা গেল। মামাসহ মঠের কাছে গিয়ে ঘুরে এলাম। মঠটি মূলত বৌদ্ধমঠ। আগে এখানে বৌদ্ধদের আবাস ছিল। যদিও এখন তারা কেউই নেই। বাজারে একটা ভাঙাচোরা চায়ের স্টলে চা খেলাম। গরুর খাঁটি দুধের চা। আমার কাছে ওই চা খুবই স্বাদের মনে হলাে। কেননা, সচরাচর ওরকম চা পাওয়া যায় না। বাজারে ঘুরাফিরা শেষে আমরা আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়ে তাদের সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললাম। এরপরে আমরা আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
উপসংহার
বাড়ি ফিরার সময় তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলাে। সন্ধ্যাকালীন নৌকাভ্রমণ কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এসময় নদীতে ডুবন্ত সূর্যের রং খেলা করে, যা দেখতে চমৎকার লাগে। সন্ধ্যার সময়ও নদীতে পানকৌড়ির আনাগােনা ছিল চোখে পড়ার মতাে। মাঝে মাঝে লঞ্চ ও ইঞ্জিনের নৌকাও দেখা গেল। অনেকে গঞ্জ থেকে বাজার করে বাড়িতে ফিরছে। সন্ধ্যা বেলায় দূরের গ্রামগুলােতে দু-একটা আলাে দেখা গেল। এ দৃশ্য এক অপূর্ব শিহরন জাগিয়ে তােলে মনের মাঝে। কাছের গ্রামগুলােকেও তখন কেন জানি অনেক অনেক দূরের মনে হয়। একটা সময় আমাদের বাড়ির ঘাটে এসে নৌকা ভিড়ল। শেষ হলাে আমাদের নৌকাভ্রমণ। এ ভ্রমণের কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে।
এই রকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন। এর পাশাপাশি গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন।
