রচনা – একটি নির্জন দুপুর
গ্রীষ্মের নির্জন দুপুর যেন প্রকৃতি ও মনে অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করে। আজকের রচনায় একটি নির্জন দুপুর নিয়ে অভিজ্ঞতা শেয়ার করব।
ভূমিকা
জলশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায়
মধ্যাহ্ন বাতাসে স্নিগ্ধ অশথের ছায়
ক্লান্ত বৃদ্ধ ভিখারিনি জীর্ণ বস্ত্র পাতি
ঘুমায়ে পড়েছে যেন রৌদ্রময়ী রাতি
ঝাঁ ঝাঁ করে চারিদিকে নিস্তব্ধ নিঝুম।
গ্রীষ্মের আগমনে বাংলার প্রকৃতি রুক্ষ, বিবর্ণ ও নিষ্প্রাণ হয়ে ওঠে। গ্রীষ্ম যখন আপন ভাবমূর্তি নিয়ে প্রকৃতিতে ধরা দেয়, তখন বাংলার প্রকৃতি হারাতে বসে বসন্তের পত্র-পল্লবের সমারােহ, অশােক, পলাশ, শিমুল আর কৃষ্ণচূড়ার লাল আগুন নিভে যায়। কোকিলের ডাক শােনা যায় না। ভ্রমরের গুঞ্জরন, প্রজাপতির ব্যস্ততা সব যেন হারিয়ে যায় কোথায়। হারিয়ে যায় অপরূপ শ্যামল প্রকৃতির সবুজ শােভা। আর এই রুক্ষতা ও বিবর্ণতার যথার্থ বিমূর্ত রূপ ফুটে ওঠে গ্রীষ্মের দুপুরে। এ এক অনন্য রূপ। গ্রীষ্ম ছাড়া অন্য কোনাে ঋতুতে ঠিক দুপুরে সেই ঋতুর চরিত্র এমন সুন্দরভাবে ধরা দেয় না।
গ্রীষ্মের রূপ
বঙ্গ-প্রকৃতির ঋতুরঙ্গাশালায় প্রথম ঋতু-নায়ক গ্রীষ্ম। বর্ষচক্রের প্রথম দৃশ্যেই ক্রুধ দু’চোখে প্রখর বহ্নিজ্বালা নিয়ে আবির্ভাব ঘটে এই মহাতাপসের। নির্দয় নিদাঘ-সূর্য কঠিন হাতে ছুঁড়ে মারে তার নিদারুণ খরতপ্ত অগ্নিবাণ । প্রখর তাপদাহে জীবদাত্রী ধরিত্রীর বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যায়, চৌচির হয়ে যায় তার তৃষ্ণার্ত প্রান্তর। তাই কবি বলেছেন,
ঘাম ঝরে দরদর গ্রীষ্মের দুপুরে
মাঠ-ঘাট চৌচির, জল নেই পুকুরে।
গ্রীষ্মের মরু-রসনায় ধরিত্রীর প্রাণ-রস শােষিত হয়ে কম্পিত শিখা উঠতে থাকে মহাশূন্যে। এই দারুণ দহন-জ্বালা বন্ধ করে দেয় সকল পাখ-পাখালিকে, জীব-জানােয়ারকে। সর্বত্রই এক ধূসর মরুভূমির ধু-ধু বিস্তার। সমগ্র জীবজগতে নেমে আসে এক প্রাণহীন, রসহীন বিবর্ণতা। তারই মধ্যে একদিন কালবৈশাখীর আগমন ঘটে। গ্রীষ্ম ফুলের ঋতু নয়, ফুল ফোটাবার তাড়া নেই তার। শুধু ফলের ডালা সাজিয়েই সে নিঃশব্দে বিদায় নেয়।
বিশেষ একটি দুপুর বা গ্রীষ্মের দুপুরের অভিজ্ঞতা
কোনাে কোনাে নিঃসঙ্গ দুপুর এক সাগরের একাকীত্ব নিয়ে কারাে কারাে হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। তেমনি এক দুপুরের অভিজ্ঞতার কথা আজ দীর্ঘদিন পরে আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় ভেসে উঠছে। সময়টা জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি। গ্রীষ্মের এক তপ্ত দীর্ঘ দুপুরকে খুব কাছে থেকে পেলাম। কর্মব্যস্ত সকাল এক সময় ঝিমিয়ে এল। আকাশ থেকে আগুন ঝরছে। সেই আগুনে পুড়ছে গাছপালা, পশুপাখি, মানুষজন। বাতাসে আগুনের ছোঁয়া। রাস্তায় কোনাে লােকজন নেই। আমি গ্রাম-বাংলার মাটির কুঠিতে একা। এ কুঠিবাড়ির চারপাশে আম, কাঠাল, জাম, হিজল, পেয়ারা, নারিকেল গাছের সমারােহ। মাঝে মাঝে তপ্ত হাওয়ার ছােটাছুটি। পাতায় পাতায় শিহরণ-ধ্বনি। তপ্ত হাওয়া মাটিতে লুটিয়ে থাকা শুকনাে পাতার দলকে উড়িয়ে নিয়ে যায় কোন সুদূরে। শুকনাে পাতার মর্মর আওয়াজ দুপুরের নিস্তদ্ধতাকে আরও বেদনাবিধুর করে তােলে। এই নির্জন দুপুর ধীরে ধীরে আমাকে আচ্ছন্ন করল। জানালার পাশে মুখ রাখতেই চোখে পড়ল পুকুরের ধারে রৌদ্রতপ্ত দাঁড়কাক পানিতে পাখা মেলে পড়ে আছে, মনে হয় যেন মরে পড়ে আছে। এরকম দৃশ্য দেখে চোখে ভেসে উঠল রবি ঠাকুরের ‘মধ্যাহ্ন’ কবিতার কয়েকটি চরণ-
বেলা দ্বিপ্রহর!
ক্ষুদ্র শীর্ণ নদীখানি শৈবালে জর্জর
স্থির স্রোতহীন । অর্ধমগ্ন তরী- পরে
মাছরাঙা বসি, তীরে দুটি গােরু চরে
শস্যহীন মাঠে। শান্তনেত্রে মুখ তুলে
মহিষ রয়েছে জলে ডুবি । নদীকূলে
জনহীন নৌকা বাঁধা। শূন্যঘাট-তলে
রৌদ্রতপ্ত দাঁড়কাক স্নান করে জলে।
পাখা ঝটপটি।
এ নির্জনতারও এক জাদু আছে। আমার সামনে রূপকথার সেই ঘুমন্ত নির্জন রাজপুরীর ছবি ভেসে ওঠে। আমি তখন এক নির্জন তেপান্তরের মাঠের ওপর দিয়ে ছুটে চলছি। এই নির্জন দুপুর ধীরে ধীরে আমাকে আচ্ছন্ন করছিল। হঠাৎ ভিখারির হাঁক আমার কানে যেন আরও গভীর কথা বলে গেল। জীবন হয়তাে এরকমই লড়তে লড়তে বাঁচা । বা বাঁচতে গিয়ে লড়া। আমার চোখে ঘুম নেই। পড়ার তাড়াও নেই। নেই কোথাও যাওয়ার উৎসাহ। এই নির্জনতা আমাকে ঘুমাতে ঘুমাতে দেয় না। কত কি মনে পড়ে। গা ছমছম করে। আগুন ঝরা এই নির্জন দুপুর আমাকে যেন কোথায় নিয়ে চলছে। আমি চেয়ে আছি। কিন্তু কিছুই দেখছি না। কেমন এক নির্জনতার গায়ে গায়ে মাখা। শব্দ কোলাহলময় পৃথিবী যেন আমার কাছে চিরকালের মতন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ভেতর মহলের কপাট খুলে যাচ্ছে একটার পর একটা। এই নীল নির্জন দুপুরে আমি রূপকথার অন্দরমহলে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। কক্ষে কক্ষে থরে থরে সাজানো কত হাসি কান্না, কত দীর্ঘশ্বাস। আমাকে পেয়ে কথার জেগে ওঠে। জেগে ওঠে বেঙ্গমা-বেঙ্গমী, ঘুমন্তপুরীর রাজকন্যে, রাক্ষস-খোক্ষসের দোল।
এমনি তন্দ্রাচ্ছন্নের মধ্যে কতক্ষণ কাটালাম জানি না। কুকুরের চিৎকারে একসময় ঘোর কাটল। রোদের রং বদলাতে শুরু করছে। নির্জন দুপুর আবার সরব হতে চায়। অনুভব করি নির্জনতা কোন বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়। নির্জন দুপুর দিনরাত্রিরই এক অখণ্ড রূপ। কোলাহল ব্যস্ততারই এক ভিন্ন চেহারা। নির্জন দুপুর আজ আমার কাছে এক পূর্ণতার রূপ নিয়েই হাজির। এক অখণ্ড সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি হিসেবেই উদ্ভাসিত। এই স্তব্দ, শান্ত দুপুর আমাকে মনে করিয়ে দেয় ধরিত্রীর সঙ্গে আমার জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্কের কথা। তখন আরও কত কি ছায়াছবির মতন ভেসে চলে মনের ওপর দিয়ে। এক মহৎ উপলদ্ধি ভাস্বর হয়ে ওঠে নিসর্গলোকের এই খণ্ডমূহুর্তটিতে। এই প্রথম আমার সামনে উদঘাটিত হল নির্জন দুপুরের সত্য রূপটি।
গ্রীষ্মের দুপুরের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য
নিঝঝুম দুপুরের তলা ভেঙে দেয় ভয়াল কালবৈশাখী। যদিও বিকেলের দিকেই সাধারণত কালবৈশাখী হয়। তবে মাঝে মাঝে দুপুরেও আকাশ কালাে করে কালবৈশাখীর তাণ্ডব শুরু হয়। তছনছ করে দিয়ে যায় সবকিছু।
শহরে গ্রীষ্মের দুপুর
শহরে গ্রীষ্মের দুপুরের নির্জনতার অবকাশ নেই। কর্মকোলাহলময় শহরের যান্ত্রিক বাস্তবতায় গ্রীষ্মের দুপুর একরকম উপেক্ষিত হয় বলা চলে। যারা বিলাসবহুল জীবন-যাপন করে তাদের কাছে গ্রীষ্মের দুপুরের কোনাে অস্তিত্ব নেই। কেননা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আভিজাত্য তাদের গ্রীষ্মের প্রখরতা অনুভব করার সুযােগ দেয় না। তবে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশার অন্ত থাকে না। জীবনের তাগিদে তাদের বাধ্য হয়েই কাজে নামতে হয়। ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালার কষ্টের সীমা থাকে না। শহরে তাে গাছের ছায়ায় দু’দণ্ড জিরিয়ে নেয়ার উপায় নেই। গ্রীষ্মকালে পানির ঘাটতির কারণে বিদ্যৎসংকট দেখা দেয়। সে কারণে শিল্প এলাকাগুলােতে বিদ্যুৎপ্রবাহ সচল রাখতে আবাসিক এলাকায় প্রায়ই বিদ্যুতের লােডশেডিং হয়। প্রচণ্ড গরমে মধ্য-দুপুরে এই লােডশেডিং যেন অভিশাপ হয়ে আসে।
উপসংহার
বাংলাদেশের বিচিত্র ঋতু, মাসের সীমারেখা মেনে চলে না। তাই গ্রীষ্ম একটু আগেভাগেই শুর হয়। চৈতালি দুপরেই গ্রীষ্মের দুপরের আমেজ পাওয়া যায়। প্রকৃতির রুদ্র ভয়ংকর রূপের নির্মম প্রকাশ ঘটে গ্রীষ্মের দুপুরে। চারদিকে কেবল। উষ্ণতা রক্ষতা আর বিবর্ণতা। প্রকৃতিতে নেমে আসে চরম অস্থিরতা। তবে দুপুরের স্থায়িত্ব কম হওয়াতে কিছটা স্বস্তিও থাকে। বস্তুত প্রতিটি ঋতু এখানে আসে তার বিচিত্র-বিলাসিত স্বাতন্ত্রের অনুপম রূপসজ্জায়। রূপের ঐশ্বর্যে কানায় কানায় পর্ণ হয়ে ওঠে বাংলার পথ-প্রান্তর। এরপর বেজে ওঠে তার বিদায়ের করুণ রাগিনী। সে তার রুপ বিস্তারে অন্তিম স্মৃতিচিহ্নটুকু নিঃশেষে মুছে নিয়ে চলে যায় কালের অনন্ত যাত্রা পথে। এক ঋতু যায়, আসে অন্য ঋতু। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর রূপ বৈচিত্রে বাংলাদেশ যেমন সৌন্দর্যময়ী তেমনি আকর্ষণীয়। এ জন্যই কবি বলেছেন –
এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ রঙ্গে ভরা