ভাব-সম্প্রসারণঃ কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তি তার মেধা ও সামর্থ্য দিয়ে নিজের এবং অপরের মঙ্গল সাধন করতে পারে। কিন্তু কর্তব্যজ্ঞানহীন এবং বিবেকবর্জিত ও দায়িত্বহীন কোনাে ব্যক্তি যত যােগ্যতাসম্পন্নই হােক না কেন সে কারাে উপকারে আসে না। বস্তুত পরের মঙ্গল বা হিতসাধনের জন্য প্রভূত ধনসম্পদের প্রয়ােজন হয় না, সদিচ্ছা ও মহৎ হৃদয়ই এজন্য যথেষ্ট সহায়ক।
পৃথিবীতে প্রকৃতির দিকে যখন আমরা তাকাই তখন অনেক কঠিন সত্য উপলব্ধি করতে পারি। প্রকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে আছে এরকম অনেক দৃষ্টান্ত। সূর্য যখন অস্ত যায়, পৃথিবী যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে তখন এই ঘন তমসায় পৃথিবীর অন্ধকার দূর করার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসে নি। এসেছে একটি ক্ষুদ্র মাটির প্রদীপ। এই প্রদীপ সারা পৃথিবীকে আলােকিত করতে পারে না, দূর করতে পারে না বিশাল অন্ধকার। কিন্তু তার ক্ষুদ্র আলােকচ্ছটায় মানুষ দেখতে পায় আলাের রেখা। ক্ষুদ্র দীপশিখা তার সামান্য শক্তি দিয়ে যে দায়িত্বভার তুলে নিল তার মূল্য কম নয়। ক্ষুদ্র শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে সে মানুষের উপকারে এগিয়ে এসেছে এটাই বড় কথা। পৃথিবীতে, আমাদের সমাজব্যবস্থায় এরূপ দৃষ্টান্ত আমরা অনেক দেখতে পাই। যখন ধনশালী, প্রতিপত্তিশালী, ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা মানুষের দুঃখ-কষ্টে এগিয়ে আসেন না। তখন দেখা যায় লােকচক্ষুর আড়ালে থাকা কোনাে একজন সাধারণ মানুষ তার সামান্য সামর্থ্য নিয়ে সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে এগিয়ে আসেন। তার এ সাহায্য ক্ষুদ্র হতে পারে, কিন্তু তার এ কল্যাণকামী মনােভাব বড় ও অনেক মহৎ। বস্তুত সমাজে বিভিন্ন ধরনের লােক বাস করে। তাদের মধ্যে কেউ জ্ঞানী, কেউ মূর্খ, কেউ গুণী, কেউ সাধারণ, কেউবা অসাধারণ গুণাবলির অধিকারী। প্রত্যেককেই নিজ নিজ যােগ্যতা ও প্রতিভা অনুযায়ী সমাজের জন্যে, দেশের জন্যে কিছু না কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই যথাযথ যােগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তা এড়াতে চান। আর এর ফলেই পৃথিবীতে যুগে যুগে ঘটে মূল্যবােধের ব্যাপক অবক্ষয়। তবু কিছু কিছু ব্যক্তি তাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়েও অকৃত্রিম কর্তব্যনিষ্ঠার বলে বলীয়ান হয়ে সমাজের গুরুদায়িত্বকে নিজ কাঁধে তুলে নেন। তাদের এ সদিচ্ছা এবং মহান প্রচেষ্টাই কোনাে জাতির ঐতিহাসিক মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। অস্তগামী সূর্যের আলাে বিতরণ করার মহান দায়িত্ব যদি ক্ষুদ্র শক্তিসম্পন্ন ছােট্ট মাটির প্রদীপ শিখাটি নিজের কাঁধে নিয়ে তা নিজ সাধ্যমত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে পারে, তাহলে এটা নিশ্চিত, যে কোন মানুষও নিজের সাধ্যমত তার ঐতিহাসিক গুরুদায়িত্বটিও সঠিকভাবে পালন করতে পারবে। প্রকৃতপক্ষে দুরূহ কর্ম সম্পাদনে কিংবা পরের মঙ্গল ও হিতসাধনের জন্য মানুষের সদিচ্ছাটাই সবচেয়ে বড় কথা। মানব ইতিহাস পর্যালােচনা করলে আমরা দেখতে পাই মানব-সভ্যতার উত্থান-পতনে কখনাে কখনাে নেমে এসেছে গভীর নৈরাশ্য ও বেদনাদায়ক অবক্ষয়। সভ্যতার বিবর্তনে বহু সঙ্কটময় মুহূর্তে হযরত মুহম্মদ (স), যিশুখ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধের মতাে মহামনীষীদের আবির্ভাব ঘটেছে। লােকসমাজে তাদের উপস্থিতি মহাসূর্যের মতােই আলােকোজ্জ্বল। সাধারণ মানুষ সেই আলােকের সাহায্যেই পথ খুঁজে পেয়েছে। মানুষকে তারা দিয়ে গেছেন মহাজীবনের মন্ত্র। কিন্তু তাদের অনুপস্থিতিতে কি মানব-সভ্যতার অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যাবে? নিশ্চয়ই নয়। সে দায়িত্ব আমাদের সকলের।
অসাধারণ ব্যক্তিদের তুলনায় সাধারণ মানুষের কর্মক্ষমতা সীমাবদ্ধ। অসংখ্য প্রদীপ যেমন সূর্যের অভাবকে বিদূরিত করে, তেমনি অগণিত মানুষ সীমিত কর্মক্ষমতা নিয়েও মহামনীষীদের শূন্যস্থানকে পূর্ণ করে তুলতে পারে। শক্তি ও সামর্থ্যের ক্ষুদ্রতার কথা ভেবে হীনম্মন্যতায় পশ্চাৎপসরণ করলে সভ্যতাকে বিপন্ন করে তােলা হবে। প্রদীপের মতােই আত্মসত্তাকে আলােকিত করে তুলতে হবে।