
সূরা আন নছর পবিত্র কুরআনের ১১০ তম সূরা। সূরাটির আয়াত সংখ্যা ৩টি। সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ হয় তাই সূরাটি মাদানী সূরার শ্রেণীভুক্ত। সূরাটির অন্য নাম হল “তাওদী” যার অর্থ হল “বিদায় করা”। এই সূরায় রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর ওফাত নিকটবর্তী হওয়ার ইঙ্গিত আছে বিধায় এর নাম “তাওদী” হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত “সূরা আন নছর পবিত্র কুরআনের সর্বশেষ পূর্ণ নাজিলকৃত সূরা” অর্থাৎ এরপর আর কোন সূরা একদফায় অবতীর্ণ হয় নি। বরং অন্যান্য সূরার আয়াত নাজিল হয়েছিল।
সূরাটি ঠিক কখন নাজিল হয়েছিল তা নিয়ে ভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) বলেনঃ সূরা আন নছর বিদায় হজ্বে অবতীর্ণ হয়েছে। এরপর “আলইয়াওমা আকমালতু লাকুম দিনাকুম” আয়াত অবতীর্ণ হয়। এর পর রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) মাত্র আশি দিন জীবিত ছিলেন। রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর জীবনের পঞ্চাশ দিন বাকি ছিল তখন কামালার আয়াত নাযিল হয়।এরপর মৃত্যুর পঁয়ত্রিশ দিন বাকী থাকার সময় “লাকাদ যা-আকুম রাসূলুম মিন আনফুছিকুম আযীযুন আলাইহি …” আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং একুশ দিন বাকী থাকার সময় ইত্তাক্বু ইয়াওমান তুরযাউনা ফিহী …” আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। এ থেকেই পরিলক্ষিত হয় সূরা আন নছর এর পর আর কোন পূর্নাঙ্গ সূরা নাজিল হয় নি।
সূরা আন নছর শানে নুযূল
সূরা আন নছর রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কে উদেশ্য করে অবতীর্ণ হয়। মক্কা বিজয় এবং রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর আগমন ও অবস্থানের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সূরাটি নাজিল হয়। এই সূরাটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য হল এই যে, মৃত্যু নিকটবর্তী প্রতীয়মান হলে একজন মুসলমানকে বেশি বেশি তাসবীহ ও ইস্তেগফার করতে হবে। আয়িশা (রা:) থেকে বর্ণিত যে, সূরা আন নছর নাজিল হওয়ার পর থেকে রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) প্রত্যেক নামাজের পর ‘সুবহানাকা রাব্বানা ওয়া বেহামদিকা আল্লাহুম্মাগ ফিরলি’ দুয়াটি পাঠ করতেন।
উম্মে সালমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, সূরা আন নছর নাযিল হওয়ার পর থেকে রাসুল (সা:) সর্বাবস্থায় ‘সুবহানাল্লাহে ওয়া বেহামদিহি আস্তাগফিরুল্লাহা ওয়া আ তুউবু ইলাইহি’ দুয়াটি পাঠ করতেন এবং, অতঃপর, এই দুয়া পাঠের যুক্তিস্বরূপ সূরাটি তিলাওয়াত করতেন।
৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গোত্রীয় প্রতিনিধিদল মদীনায় আসতে থাকে এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। এই সূরায় মূলত মক্কা বিজয় এবং সাফল্যের জন্যে আল্লাহর সাহায্যের উপর গুরুত্বআরোপ করা হয়েছে। বিজয় মানুষের শক্তিমত্তার উপর নির্ভর করে না। শক্তিশালী দলও যুদ্ধে পরাজিত হয় অন্যদিকে দুর্বল দল হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর সাহায্যে জয়ী লাভ করতে পারে। বদর যুদ্ধ তার প্রমাণ । সেকথা বলা হয়েছে প্রথম দু’টি আয়াতে। অতঃপর উক্ত অনুগ্রহ লাভের শুকরিয়া স্বরূপ রাসূলের উচিত আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করা এবং বেশী বেশী তওবা-ইস্তেগফার করা, একথাগুলি বলা হয়েছে তৃতীয় অর্থাৎ শেষ আয়াতে।
সূরা আন নছর বাংলা উচ্চারণ
সূরা আন নছর অডিও
কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা
১. এই সূরাতে প্রথম আয়াতে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের কথা বলা হয়েছে। কথাটি আপাতত দৃষ্টিতে ছোট দেখালেও এর তাৎপর্য অনেক বেশি। এখানে আল্লাহর সাহায্য বলতে, কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধসমূহে আল্লাহর সাহায্যকে বুজানো হয়েছে। যেমন বদর, ওহোদ, খন্দক, খায়বার প্রভৃতি যুদ্ধে। পরবর্তীতে বিজয়ের (মক্কা) কথা বলা হয়েছে। সুতরাং, আমরা যখন সাহায্য চাইবো আল্লাহর কাছেই চাইবো। কারণ আপনি যতই শক্তিশালী হন না কেন, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আপনি জয়ী লাভ করতে পারবেন না।
২. মক্কা বিজয় তৎকালীন আরবে খুবই অপরিহার্য ছিল। মক্কা বিজয়ের পরের বছর অর্থাৎ ৯ম ও ১০ম হিজরীকে ইতিহাসে ‘প্রতিনিধি দলসমূহের আগমনের বছর’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিনিধি দলসমূহের সংখ্যা ৭০ এর অধিক। ঐ সময়ে আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা দলে দলে মদিনায় এসে ইসলাম কবুল করেছিল। মক্কা বিজয়ের পরে দলে দলে ইসলাম কবুলের অন্যতম কারণ ছিল বিশ্বাসগত। কারণ লোকেরা তখন বলতে থাকলো, যে হারাম শরীফকে আল্লাহ্ হস্তীওয়ালাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন, সেই হারামের তত্ত্বাবধায়ক তার কওমের উপর যখন মুহাম্মাদ জয়লাভ করেছেন, তখন তিনি অবশ্যই সত্য নবী।
৩. সূরাটির শেষ আয়াতটি খুবই গুরুত্ব বহন করে। এই আয়াতে পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনাকে একত্রিত করা হয়েছে। এটি হল আল্লাহর প্রথম নির্দেশ। অতঃপর দ্বিতীয় নির্দেশটি হল, ইস্তিগফার কর। ইস্তিগফার’ অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা করা। উক্ত আয়াতে আল্লাহ রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) পবিত্রতা ও প্রশংসা এবং ইস্তিগফার করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং আমাদের উচিত আল্লাহর যিকির ও বেশি বেশি ইস্তিগফার করা।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,
لَنْ يُنَجِّىَ أَحَدًا مِنْكُمْ عَمَلُهُ. قَالُوا وَلاَ أَنْتَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ وَلاَ أَنَا، إِلاَّ أَنْ يَتَغَمَّدَنِىَ اللهُ بِرَحْمَتِهِ
‘তোমাদের কেউ তার আমলের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ছাহাবীগণ বললেন, আপনিও নন হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, না। যদি না আল্লাহ আমাকে তাঁর রহমত দ্বারা আবৃত করেন’।
উক্ত হাদিস থেকে বুঝা যায়, আমাদের আমল না বরং আল্লাহর রহমতই আমাদেরকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। আর আল্লাহর রহমত পেতে হলে আমাদের বেশি করে আল্লাহর জিকির – প্রশংসা এবং ইস্তিগফার করতে হবে। কারন উক্ত আয়াতে আল্লাহ বলেছেন তিনি তওবা কবুলকারী এবং ক্ষমাশীল ।
৪. প্রশ্ন হল যিনি নিষ্পাপ (রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)) তাকে কেন আল্লাহ তাআলা ইস্তিগফার করতে আদেশ দিলেন? একবার আয়েশা (রাঃ) এরূপ প্রশ্ন করলে তার জওয়াবে রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন ‘আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না’?
ইমাম কুরতুবী বলেন, ক্ষমা প্রার্থনা হ’ল দাসত্ব প্রকাশ করা, যা আল্লাহর নিকটে পেশ করা ওয়াজিব। ক্ষমার জন্য নয় বরং দাসত্ব প্রকাশের জন্য’ (কুরতুবী)। অর্থাৎ রাসূল (সাঃ)-এর ক্ষমা প্রার্থনার অর্থ আল্লাহর প্রতি অধিকহারে বিনয় ও দাসত্ব পেশ করা।
তিনি বলেন, এর মধ্যে তাঁর উম্মতের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যেন তারা শংকাহীন না হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা ছেড়ে না দেয়। তিনি বলেন, নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও যখন আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দিয়েছেন, তখন অন্যদের কেমন করা উচিত? (কুরতুবী)।
অন্য হাদীছে এসেছে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) দৈনিক একশো বার তওবা- ইস্তেগফার করতেন ও নিম্নের দো‘আটি পাঠ করতেন-
أَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِيْ لآ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّوْمُ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ
‘আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূমু ওয়া আতূবু ইলাইহে’ (আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্বচরাচরের ধারক এবং আমি তাঁর দিকেই ফিরে যাচ্ছি (বা তওবা করছি)।
আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো