বাংলা রচনা

বাংলার ষড়ঋতু – রচনা (১৫ পয়েন্ট) (SSC HSC)

4.5/5 - (1086 votes)

বাংলার ষড়ঋতু পৃথিবীর যেকোন সৌন্দর্য পিপাসু মনকে আকৃষ্ট করে। আজকের রচনায় জানব ষড়ঋতু কি, ঋতুভেদে তারতম্য, প্রভাব এবং আরও অনেক পয়েন্ট নিয়ে। রচনাটি ৬ ৭ ৮ ৯ ১০ ১১ ১১ শ্রেণি সকল শিক্ষার্থীদের উপকারে আসবে। 

অনুরূপ রচনা ঃ রুপসি বাংলা, বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র

সূচনা

সুজলা-সুফলা, শস্য- শ্যামলা বাংলাদেশের রুপময় সৌন্দর্য  ও ঐশ্বর্য চিরকালের গর্বের বিষয়। একদিকে এই সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধতা এবং অন্যদিকে তার ঐশ্বর্যের প্রতি লালসা বহু প্রাচীনকাল থেকে এই দেশটি বহু বিদেশিকে আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশর ষড়ঋতু যেন মনকে ছুঁয়ে যায়। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋতু বৈচিত্রে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন – 

ওমা, ফাগুনে তাের আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায়রে-  ওমা, অঘ্রানে তাের ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি মধুর হাসি।

ঋতুরঙ্গময়ী রূপসি বাংলা। বঙ্গ-প্রকৃতির ঋতুরঙ্গে তার কী ছন্দোময়, সংগীতময় অনুপম-রূপ বদল! ঋতু পরিবর্তনের বর্ণ বিচিত্র ধারাপথে নিয়ত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার অন্তহীন রূপের খেলা, রঙের খেলা, সুরের খেলা। অনুপম বৈচিত্রময় ঋতুরঙ্গোর এমন উজ্জ্বল প্রকাশ বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায় না। তাই রূপমুগ্ধ পুলকিত কবি তার আবেগ-স্নিগ্ধ উচ্চারণে বাংলাকে বলেছেন- ‘রূপসি বাংলা’। ছয় ঋতুর দেশ এই রূপসি বাংলাদেশ। ছয় ঋতুর ছয় রূপ। প্রতিটি ঋতু এখানে আসে তার স্বাতন্ত্রের অনুপম রূপসজ্জায়। রূপের ঐশ্বর্যে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে বাংলার পথ-প্রান্তর। এরপর বেজে ওঠে তার অশ্রুবিধুর বিদায়ের করুণ রাগিণী। সে তার রূপ বিস্তারে অন্তিম স্মৃতিচিহ্নটুকু নিঃশেষে মুছে নিয়ে চলে যায় কালের অনন্ত যাত্রাপথে। এক ঋতু যায়, আসে অন্য ঋতু।

ঋতুভেদে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার ঋতুবৈচিত্র্যের মধ্যে চমৎকারভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। বার মাসে ছয় ঋতুর এদেশে প্রতিটি ঋতু তার অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে আগমন করে এবং নিজের অনাবিল সৌন্দর্য উপহার দিয়ে বিদায় নেয়। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এদেশে ঋতুর আবির্ভাব ঘটে এবং সেগুলাে পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও বায়ুপ্রবাহের তারতম্যে ঋতুগুলাে একটি থেকে অপরটি পৃথক। তেমনি প্রতিটি ঋতুর ভিন্ন ভিন্ন রং ও সৌন্দর্য।

পল্লী প্রকৃতির দৃশ্য

বাংলাদেশের সবুজ পল্লী প্রকৃতির রূপ কতই মনোহরী, যেন সৌন্দর্যের হাট বসে গিয়েছে। যে দিকেই তাকানো যায় বিচিত্রবেশী প্রকৃতির হাতছানি প্রত্যক্ষ করা যায়। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাংলাদেশের এই পল্লী প্রকৃতিকে ভুলতে পারেননি। পল্লী প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে লিখেছিলেন – 

অবারিত মাঠ, গগন, ললাট চুমে তব পদধূলি
ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।

বাংলাদেশের ষড়ঋতু

বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। রূপসি বাংলার ছটি ঋতু যেন তার ছটি সন্তান। ছটি রঙের ছটি সুরের পাখি। দুই মাস মিলে এক একটি ঋতু
ক) বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস গ্রীষ্মকাল
খ) আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল
গ) ভাদ্র-আশ্বিন এই দুই মাস শরৎকাল
ঘ) কার্তিক-অগ্রহায়ণ এই দুই মাস হেমন্তকাল
ঙ) পৌষ-মাঘ এই দুই মাস শীতকাল
চ) ফাল্গুন-চৈত্র এই দুই মাস বসন্তকাল
স্বভাবেও এক একটি ঋতু এক এক রকম। তাই আমাদের দেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হয়ে থাকে। 

ঋতুবৈচিত্ৰ্য

বিশেষভাবে লক্ষ করার বিষয় যে, রূপসী বাংলাদেশের যেরূপ বৈচিত্ৰ্য তা প্রায় সম্পূর্ণ ঋতুভিত্তিক। যদিও বাংলাদেশের প্রকৃতিতে স্থায়ী রূপের পরিচয় আছে কিন্তু তার বৈচিত্র্য প্রায় সম্পর্ণ ঋতু নির্ভর। ঋতু পরিবর্তনের অর্থই প্রকৃতির নতুন নতুন রূপ ধারণ। ঋতু এখানে আসে নবরূপে।  তাই বাংলাদেশের রূপ সুষমার কথা বলতে গেলে এর ঋতুবৈচিত্র্যের কথাও এসে যায়।

গ্রীষ্মকাল

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। সময়ের চাকা ঘুরেই ঘটে প্রকৃতির পট পরিবর্তন। ষড়ঋতুর মধ্যে প্রথমেই আসে গ্রীষ্মকাল। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল মাসের মধ্যভাগ থেকে জুন মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত) এই দুই মাস গ্রীষ্মকাল। নির্দয় নিদাঘ-সূর্য কঠিন হাতে ছুঁড়ে মারে তার নিদারুণ খরতপ্ত অগ্নিবাণ । প্রখর তাপদাহে জীবধাত্রী ধরিত্রীর বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যায়, চৌচির হয়ে যায় তার তৃষ্ণার্ত প্রান্তর। ফটিক পাখির মতো সমগ্র উদ্ভিদ ও জীবজগৎ আকণ্ঠ আকাশের করুণা ভিক্ষা করে।  তাই কবি বলেছেন-

ঘাম ঝরে দর দর গ্রীষ্মের দুপুরে
মাঠ-ঘাট চৌচির, জল নেই পুকুরে

গ্রীষ্মের মরু-রসনায় ধরিত্রীর প্রাণ-রস শােষিত হয়ে কম্পিত শিখা উঠতে থাকে মহাশূন্যে। এই দারুণ দহন-জ্বালা স্তব্ধ করে দেয় সকল পাখ-পাখালিকে, জীব-জানােয়ারকে। সর্বত্রই এক ধূসর মরুভূমির ধু-ধু বিস্তার। সমগ্র জীবজগতে নেমে আসে এক প্রাণহীন, রসহীন, পাণ্ডুর বিবর্ণতা। তারই মধ্যে একদিন কালবৈশাখীর আগমন ঘটে।

গ্রীষ্মকাল
গ্রীষ্মকাল

গ্রীষ্ম ফুলের ঋতু নয়, ফুল ফোটাবার তেমন কোনাে তাড়া নেই তার। শুধু ফলের ডালা সাজিয়েই সে নিঃশব্দে বিদায় নেয়। এই ঋতুতে আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, লিচু, তরমুজ, আমড়া প্রভৃতি সুস্বাদু ফল জন্মে। গােলাপ, বকুল, বেলি, টগর, জবা প্রভৃতি সুগন্ধি ফুলও এ সময়ে ফোটে। এই ঋতুতে দিন বড় আর রাত ছােট হয়। গ্রীষ্ম দিয়েই শুরু হয় বাংলা বর্ষ। গ্রীষ্মের প্রথম দিনে পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে উদযাপিত হয়। বৈশাখের বড় আনন্দ এবং বড় উৎসবই হচ্ছে বৈশাখি মেলা। মেলায় চলে নান রঙের খেলা। এ যেন আনন্দের মেলা। 

বর্ষাকাল

বাংলাদেশে বর্ষা আসে বিধাতার করুণারধারা নিয়ে। বাংলা বর্ষের দ্বিতীয় ঋতু বর্ষা এবং এর স্থিতি আষাঢ় ও শ্রাবণ (জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত) এই দুই মাস। এই ঋতুতে আবহাওয়া সর্বদা উষ্ণ থাকে। কবি সুফিয়া কামাল বর্ষার আগমন নিয়ে লিখেছিলেন – 

আমি বর্ষা, আসিলাম গ্রীষ্মের প্রদাহ শেষ করি
মায়ার কাজল চোখে, মমতায় বর্মপুট ভরি।

গ্রীষ্ম পিপাসার্ত বাংলাদেশকে বর্ষার হাতে তৃষ্ণা নিবারণের ভার দিয়ে বিদায় নেয়। দূর-দিগন্তে ধূসর আকাশের বুকে স্তরে স্তরে জমে ওঠে নবীন মেঘের ভূপ। এক অপূর্ব সমারােহে আকাশ-বাতাস ব্যাপ্ত করে আসে শ্যামল, সুন্দর, নয়নাভিরাম বর্ষা। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ ও গুরুগম্ভীর বজ্রনিনাদের ‘অতি-ভৈরব হরষে’র মধ্যে সূচিত হয় তার শুভাগমন। সেই সঙ্গে পৃথিবীর ধূসর বুকে ঘনিয়ে আসে স্নিগ্ধ-শীতল ছায়াঘন দিন। আকাশে নিবিড়-কালাে মেঘরাজির আনাগােনায়, নিচে বন-প্রকৃতির বুকে মেঘমেদুর ছায়া-বিস্তারে বর্ষা প্রকৃতি অপরুপ সাজে সজ্জিত হয়। সুদূর দিগন্ত থেকে দুরন্ত বায়ু ছুটে আসে শোঁ-শোঁ শব্দে। শুরু হয় শীতল ধারা-বর্ষণ। বহুদিন পরে বাংলার শুষ্ক প্রান্তরে, নদী-নালায় ও খাল-বিলে জাগে কল-মুখর প্রবল প্রাণােচ্ছ্বাস; বহুদিন পর বাংলার বুকে আবার শােনা যায় নানা সংগীতমুখর সুধাকণ্ঠ পাখির কল-কূজন। মাটির কঠিন শাসন ভেদ করে নবীন শস্য-শিশুর দল বেরিয়ে পড়ে নবজীবনের জয়যাত্রায়। কদম্ব, কেয়া, জুঁই, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের উৎসবে বঙ্গ-প্রকৃতির হৃদয়ের দ্বার যেন খুলে যায়। তাই কবি কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে,

গুরু গুরু ডাকে দেয়া, ফুটিছে কদম কেয়া,
ময়ূর পেখম তুলে সুখে তান ধরছে
বর্ষার ঝরঝর সারাদিন ঝরছে।

এ সময় গ্রামাঞ্চলে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে নৌকা। বর্ষায় নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুর-ডােবা কানায় কানায় ভরে ওঠে। বিলে বিলে হেলেঞ্চা, কলমিলতা আর শাপলার সমারােহ দেখা যায়। বর্ষাকালে কেয়া, কদম, কামিনী, জুঁই, গন্ধরাজ প্রভৃতি সুগন্ধি ফুল ফোটে। এ ঋতুতে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। তারপর আকাশে আকাশে বেজে ওঠে বর্ষা বিদায়ের বিষন্ন মাদল। বার্ষিক মােট বৃষ্টিপাতের ৮০ ভাগেরও অধিক বর্ষাকালেই সংঘটিত হয়।

প্রবল বর্ষায় প্লাবিত একটি বাড়ির চিত্র
প্রবল বর্ষায় প্লাবিত একটি বাড়ির চিত্র

প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে অধিকাংশ প্লাবনভূমিই বর্ষাকালে প্লাবিত হয়। ডুবে যায় ফসলের মাঠ, শহরের বস্তি। ভেঙে পড়ে কাঁচা ঘরবাড়ি। ঘরে ঘরে শুরু হয় জ্বরজারি আর পেটের পীড়া। এভাবে সুখে-দুঃখে-আনন্দে একসময় আষাঢ় শ্রাবণের দিন ফুরােয়। শুকনাে মাটির বুকে রসের জোয়ার এনে বর্ষা বিদায় নেয়। ধুয়ে যায় যত সব আবর্জনা। বর্ষার অঢেল দানের মধ্যে কিছু কষ্টের স্মৃতিও রেখে যায় আমাদের মনের গভীরে।

শরৎকাল

ঋতুচক্রের আবর্তনে বর্ষার পরেই আসে শরৎ। বাংলা তৃতীয় ঋতু হল শরৎকাল। শরৎ এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে আবির্ভূত হয়। ভাদ্র ও আশ্বিন (আগস্ট মাসের মধ্যভাগ থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত) মিলে শরৎকাল। শরৎ ঋতুকে বলা হয় ঋতুর রাণী। ‘আজি তােমার মধুর মুরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে’ – বাংলার রুপের রঙ্গমঞ্চে এভাবেই শরতের আবির্ভাব। বর্ষণ-ক্ষান্ত লঘুভার মেঘ অলস-মন্থর ছন্দে নিরুদ্দেশে ভেসে চলে। বর্ষণ-ধৌত, মেঘমুক্ত আকাশের সুনীল রূপ-কান্তি, আলােচ্ছায়ার লুকোচুরি শিউলি ফুলের মন-উদাস-করা গন্ধ, নদীতীরে কাশফুলের অপূর্ব শুভ্র সমারােহ, প্রভাতে তৃণ-পল্লবে নব-শিশিরের আলিপন, তাতে প্রভাত-সূর্যের রশ্মিপাত এবং শুভ জোছনা-পুলকিত রাত্রি এই অনুপম রূপরাশি নিয়ে বাংলাদেশের পথে – প্রান্তরে রূপসি শরতের ঘটে আনন্দময় আবির্ভাব। তখন রুপালী জোছনার অপরুপ রথে চড়ে সৌন্দর্যের নানা উপহার ছড়াতে ছড়াতে যখন শরতের আগমন ঘটে, তখন চারদিকে রূপের দুয়ার যেন খুলে যায়। বাংলাদেশের অনির্বচনীয় রূপ-মাধুরী যেন পূর্ণ হয়ে ওঠে কানায় কানায়। কবি অভিভূত হয়ে গেয়ে ওঠেন – 

শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি

মুড়িয়ে গেছে ছাপিয়ে মোহন অঙ্গলি

শরৎ তোমার তোমার শিশির ধোয়া কুন্তলে

বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে

আজ প্রভাতে হৃদয় ওঠে চঞ্চলি

শরৎকালে বনে-উপবনে শিউলি, গােলাপ, বকুল, মল্লিকা, কামিনী, মাধবী প্রভৃতি ফুল ফোটে। বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা আর নদীর ধারে কাশফুল। এ সময়ে তাল গাছে তাল পাকে। হিন্দুদের দুর্গাপূজাও এ সময় অনুষ্ঠিত হয়। 

হেমন্তকাল

বাংলা বর্ষপঞ্জিতে এর ব্যাপ্তিকাল কার্তিক ও অগ্রহায়ণ (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য ডিসেম্বর)। হেমন্ত শরতেরই বিলম্বিত রূপ। বঙ্গ-ঋতুনাট্যের সে চতুর্থ শিল্পী, উদাসীন, পৌঢ় এবং বিষন্ন। হেমন্তে নেই শরতের বনৈশ্বর্য, আছে সুদূর-ব্যাস্ত এক বৈরাগ্যের বিষন্নতা। রূপসি হেমন্ত ধূসর কুয়াশায় নয়ন ঢেকে ফসল ফলাবার নিঃসঙ্গ সাধনায় থাকে নিমগ্ন। ক্ষেতে-খামারে রাশি রাশি ভারা ভারা সােনার ধান উঠতে থাকে। চারদিকে অন্তহীন কর্মব্যস্ততা। ঘরে ঘরে চলছে নবান্ন উৎসব। প্রাচুর্যময়ী হেমন্তের ফুলের বাহার নেই, সৌন্দর্যের জৌলুশ নেই, রূপ-সজ্জারও নেই প্রাচুর্য। আছে মমতাময়ী নারীর এক অনির্বচনীয় কল্যাণী রূপশ্রী। সে আমাদের ঘর সােনার ধানে ভরে দিয়ে শিশিরের মতাে নিঃশব্দ চরণে বিদায় গ্রহণ করে।

শীতকাল

ষড়ঋতুর পঞ্চম এবং উষ্ণতর গ্রীষ্মের বিপরীতে বছরের শীতলতর ঋতু শীতকাল। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে পৌষ ও মাঘ (মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি) এই দুই মাস শীতকাল। শীতকাল প্রধানত শুষ্ক। কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে আসে শীত। শীতের রাত্রি হয় দীর্ঘ। শীতের মহিমায় কবি আপ্লুত হয়ে গেয়ে ওঠেন –

এল যে শীতের বেলা বরষ-পরে।
এবার ফসল কাটো, নাওগাে ঘরে।
করাে ত্বরা, কাজ আছে মাঠ-ভরা।

এ ঋতু জীর্ণতার ঋতু। তাই গাছের পাতারা জীবনের রঙ হারিয়ে ক্রমশ হলুদ হয়ে আসে, তারপর একদিন ঝরে যায়। প্রকৃতির মতো জীবনেও দেখা যায় বিষন্নতার একটি সুর। শীতকাল বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও আরামদায়ক ঋতু। শীতের কুয়াশা ঢাকা মিষ্টি সকাল যেন হৃদয় মনকে এক অন্য জগতে নিয়ে যায়। অনাবিল চিত্তে মনকে শিহরিত করে।

কুয়াশা ঢাকা শীতের সকালের একটি দৃশ্য। ছবিঃ Shutterstock
কুয়াশা ঢাকা শীতের সকালের একটি দৃশ্য। ছবিঃ Shutterstock

এ সময় তরিতরকারির প্রাচুর্য দেখা যায়। কপি, মুলা, বেগুন, পালংশাক, মটরশুটি ইত্যাদিতে হাটবাজার পূর্ণ থাকে। কই, মাগুর, শিংসহ অন্য মাছ এ সময়ে প্রচুর পাওয়া যায়। এই ঋতুতে গাঁদা ও সূর্যমুখী ফুল ফোটে। কমলালেবু, বরই এ ঋতুরই ফল। শীতকালে খেজুর রস পাওয়া যায়। ঘরে ঘরে ভাপা, চিতই, পাটিসাপটা, পুলি ইত্যাদি পিঠা তৈরি করা হয়। এই ঋতুটি দেশ-বিদেশের নানা জাতীয় পাখপাখালির উৎসবের কাল। বাংলাদেশের বিল-বাঁওড়-হাওড়  প্রভৃতি জলাশয় বিচিত্র বর্ণের পাখির সমাবেশে দর্শনীয় হয়ে ওঠে। 

বসন্তকাল

বাংলা বর্ষপঞ্জির সর্বশেষ ঋতু বসন্ত। ফাল্গুন ও চৈত্র মাস (ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ থেকে এপ্রিলের মধ্যভাগ পর্যন্ত) নিয়ে বসন্তকাল হলেও শুধু মার্চ মাসেই ঋতুটির সংক্ষিপ্ত অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। মাঘের সূর্য উত্তরায়ণে পাশ হয়ে চলে আসে ঋতুশ্রেষ্ঠ বসন্ত, আসে পুরতির পরম লগ্ন। 

বসন্তের সকালে একটি বাগানের ফুলের ছবি। ছবিঃ ইন্টারনেট।
বসন্তের সকালে একটি বাগানের ফুলের ছবি। ছবিঃ ইন্টারনেট।

বঙ্গ-ঋতুনাট্যের অন্তিম রূপশিল্পী সে। মৃদু-মন্দ দখিনা বাতাসের স্পর্শে বর্ণ-বিরল পৃথিবীর সর্বাঙ্গে লাগে অপূর্ব পুলক-প্রবাহ, বন-বীথির রিক্ত শাখায় জাগে কচি কচি কিশলয়ের অফুরন্ত উল্লাস। বাতাসের মৃদু মর্মর-ধ্বনি এবং দূর বনান্তরাল থেকে ভেসে-আসা কোকিলের কুহুগীতি পৃথিবীকে মায়াময় করে তােলে। অশােক-পলাশের রঙিন বিহ্বলতায় ও শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার বিপুল উল্লাসে, বিকশিত মধুমালতী ও মাধবী-মঞ্জরির গন্ধমদির উচ্ছল প্রগল্‌ভতায়-সারা গগনতলে বর্ণ, গন্ধ ও গানের তুমুল কোলাহলে লেগে যায় এক আশ্চর্য মাতামাতি। কবি গুরুর ভাষায় –

আজি দখিন-দুয়ার খোলা,
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো।
দিব    হৃদয়দোলায় দোলা,
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো॥

বসন্তকে বলা হয় ঋতুরাজ। এ সময়টি নাতিশীতােষ্ণ, তাই পরম সুখকর। এই ঋতুতেই হিন্দুদের বাসন্তী পূজা, দোলযাত্রা প্রভৃতি উৎসব মহাসমারােহে অনুষ্ঠিত হয়।

ষড়ঋতু ও সংস্কৃতি 

ষড়ঋতু ও সংস্কৃতি যে একই সূত্রে গাঁথা। হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে গড়া এ দেশ। এ দেশের সম্মৃদ্ধ সংস্কৃতি এর রূপমাধুর্যে যেন একটি স্বতন্ত্র মাত্রা যোগ করেছে। বাংলা বর্ষবরণ ও বসন্তবরণের মতো অনুষ্ঠানগুলো আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। 

বসন্তকে বরণের সময় তোলা একটি ছবি।
বসন্তকে বরণের সময় তোলা একটি ছবি। 

এগুলো রং, রূপ ও বৈচিত্রে সমকালীন প্রকৃতির অনুরূপ। ফলে সুপ্ত মনের পাতায় পাতায়, মনের অজান্তেই আমরা এঁকে যাই প্রকৃতির ছবি, লিখি কবিতা, গেয়ে উঠি  গান। মন হারিয়ে যায় অজানা ঠিকানায়।

সাহিত্যে ষড়ঋতুর প্রভাব 

বাংলা সাহিত্যে ষড়ঋতুর প্রভাব অনেক। কখনো কবি মনে সে স্থান করে নিয়েছে কখনোবা শিল্পীর কোমল তুলিতে ফুটে উঠেছে। ষড়ঋতুর প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অসংখ্য কবি  লিখে গেছেন শত শত কবিতা।  রচিত হয়েছে গান। আর বিভিন্ন ঋতুতে সেই কবিতা, গানগুলো স্থান পায়  সংস্কৃতি অঙ্গনে। সাহিত্যে এক এক ঋতু এক এক রূপে ফুটে উঠেছে। গ্রীষ্মকে বলা হয়েছে মৌন-তাপস, বর্ষাকে বলা হয়েছে সজল বর্ষা, শরৎ কে ডাকা হয়েছে শুভ্র নামে, হেমন্তকে ডাকা হয়েছে ধূসর, শীতকে ডাকা হয়েছে রিক্ত শীত আর বসন্তকে ডাকা হয়েছে ঋতুরাজ নামে। প্রতিটি ঋতুর ভিন্ন নামের অর্থই হল সবকটি ঋতুর ভিন্ন ভিন্ন রূপ। মোটকথা ষড়ঋতু বাংলা সাহিত্যকে করেছে পরিপূর্ণ।

গ্রাম ও শহর জীবনে ষড়ঋতুর প্রভাব 

রূপসী বাংলার বাংলাদেশ, রূপের যে তার নেইকো শেষ। 

বাংলার রূপ দেখার জন্য সবচেয়ে উত্তম স্থান হল গ্রাম। শহরে আধুনিকায়ন আর উঁচু উঁচু দালানের ভিড়ে যেখানে সূর্যের দেখামেলা ভার, সেখানে রূপসী বাংলার রূপ খুব কমই অবলোকন করা যায়।  কিন্তু গ্রামে এর চিত্র ভিন্ন। বাংলার রূপ যেন গ্রামের প্রতিটি পথে মিশে আসে। গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে গ্রামের মাটি ফেটে হয় চৌচির, বর্ষার কঠিন নিষ্ঠুরতা যেন  গ্রামেই বেশি। ঋতুর রানী শরৎকে ভালো করে দেখা যায় গ্রামে ফুঁটে ওঠা শিউলি, গোলাপ, বকুল, মল্লিকা ফুলে, নদীর তীরে কাশফুল দেখে। হেমন্তে নবান্ন উৎসব শহরে দেখা না গেলেও শীতের কিছুটা আমেজে দেখা যায়। শীতের সত্যিকারের রূপ গ্রামেই ভালো করে অবলোকন করা যায়। শহরের মোটা দালানের ভিতর দিয়ে শীতের হিমেল ছোঁয়া আমাদের মনে পৌঁছাতে পারে না। কিন্তু গ্রামে শীতের চাদর মুরি দিয়ে আগুন পোহানোর দৃশ্য  মনকে আন্দোলিত করে। বসন্তের চিত্র শহরে ভিন্ন। গ্রামের থেকে শহরে বসন্তবরণের উৎসব বেশি চোখে পরে। যায় হোক, রূপসী বাংলা বুঝে না কি শহর কি গ্রাম। সে আসে তার রূপ নিয়ে। রূপের পসরা সাজিয়ে রাখে সবার জন্যে। 

উপসংহার 

এমন দেশটি কোথাও খুজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি। 

শুধু জননী জন্মভূমি রূপেই নয়, রূপসি বাংলার এই ষড়ঋতু নানা বর্ণ-গন্ধ গানের সমারােহে নিত্য-আবর্তিত হয়ে চলে। কিন্তু শহরবাসী ও শহরমুখী বাঙালি আজ আর অন্তরে অনুভব করে না তার সাদর নিমন্ত্রণ। ঋতু-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি যখন বিবাহের কন্যার মতাে অপরূপ সাজে সেজে উঠবে বাঙালি তখন শুনবে কলকারখানার যন্ত্র-ঘর্ঘর-ধ্বনি কিংবা কম্পিউটারে অঙ্ক মেলাতে ব্যস্ত থাকবে সওদাগরি অফিসে। এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে ষড়ঋতুর রূপ বৈচিত্র্যের সমারােহ। বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা সামগ্রিক জীবনধারা ষড়ঋতুর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। বাংলার ষড়ঋতু পৃথিবীর যেকোন সৌন্দর্য পিপাসু মনকে আকৃষ্ট করে। এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি গেয়েছেন – 

কোন গগনে ওঠেরে চাঁদ  এমন হাসি হেসে
আঁখি মেলে তোমার আলো 
প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
এ আলোকেই নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button