
ভূমিকা
বাঙালি আর বাংলা ভাষা যেন একে অপরের পরিপূরক। আর তাইতো ভাষার কারণে পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি জাতির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার সুপ্তবীজ মন্ত্রটি প্রকৃতপক্ষে বপন হয়েছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার ইতিহাসে ৫২’র ভাষা আন্দোলন একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। হাজার বছর ধরে পূর্বসূরিদের বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা, সাধনা ও দুস্তর পথ পাড়ি দিয়ে বাংলা ভাষাকে ৫২’র দোর গোড়ায় আসতে হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এই ফেব্রুয়ারি মাসেই দেশের আপামর জনতা নেমে এসেছিল রাজপথে। রাজপথে পুরুষদের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে এসেছেন নারীরাও। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাই বলেছেনঃ
কোনো কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়েছে সাহস দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।
– কাজী নজরুল ইসলাম
ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমি
কোনাে ঘটনাই বিচ্ছিন্ন মুহূর্তের স্মারক নয়, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তার একটি নিজস্ব অবস্থান থাকে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যে মর্মান্তিক ঘটনা বিশ্বাবাসীকে স্তম্ভিত করেছিল, তারও পূর্ব ইতিহাস ছিল। ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষ ভেঙে মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলাের সমন্বয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল এলাকা হলেও শুরু থেকেই পাকিস্তানি শাসকচক্রের বৈষম্যমূলক নীতির শিকার হয়। অধিকাংশ মানুষের মুখের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করার হীন ষড়যন্ত্র শুরু হয়। পাকিস্তানের জনক বলে কথিত মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৭ সালের ২১ মার্চ কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে ঘােষণা দেন এবং প্রবল প্রতিবাদের মুখে পতিত হন। এরপর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রসমাজের জোর প্রতিবাদে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-ধর্মঘট, ১১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী প্রস্তুতি দিবস এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশের সর্বত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। গণআন্দোলনের উত্তাল রূপ দেখে কর্তৃপক্ষ আতঙ্কিত হলাে, ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকায় জারি হলাে ১৪৪ ধারা।
এদেশের প্রগতিশীল চেতনার ও আন্দোলনের পুরােধা ছাত্রসমাজ ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে রাজপথে নামল। গ্রেফতার, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস এবং অবশেষে গুলি। অগণিত মানুষ আহত, শহিদের সংখ্যাও কম নয়। অনেকের লাশ গুম করে দিল কর্তৃপক্ষ। যাদের পরিচয় উদ্ঘাটিত হলাে, তারা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আদর্শ ও ত্যাগের প্রতিমূর্তি হয়ে বেঁচে রইলেন। সালাম-রফিক-জাব্বার-বরকতের রক্তে পূর্ব বাংলার পলিমাটিতে জন্ম নিল নতুন অধ্যায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সীমা পেরিয়ে জাতীয়তাবাদের নবপর্বের সূচনা করল।
ভাষা আন্দোলনে নারী
ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীদের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। মাতৃভাষা রক্ষার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিকসহ অনেকেই। ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার এই আন্দোলনে ও এই উত্থানে এমন কোনো মিটিং, মিছিল, সংগ্রাম নেই যাতে নারীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেননি। ভাষা আন্দোলনে পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে মিছিলে নেমেছিল নারী সমাজ। যা ভাষা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করেছিল।
তমদ্দুন মজলিস ও নারী
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে বাংলাভাষার দাবিকে চাঙ্গা করতে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠিত হয়। সংগঠনটির নাম ‘তমদ্দুন মজলিস’।‘তমদ্দুন মজলিস’ ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগঠক। এই সংগঠন ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে ১৮ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয় । পুস্তিকাটির নাম ছিল ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা – বাংলা না উর্দু’। সেই সময়ে বাংলাভাষাকে পূর্বপাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করার দাবি জানানাে হয়। সংগঠনের কর্মী ও আন্দোলনকারীদের আজিমপুরের বাসায় দীর্ঘ দিন রান্না করে খাইয়েছিলেন আবুল কাশেমের স্ত্রী রাহেলা, বোন রহিমা এবং রাহেলার ভাইয়ের স্ত্রী রোকেয়া।
১৯৫২ সালের ২৩ জানুয়ারি গভীর রাতে পুলিশ আবুল কাশেমের বাসা ঘিরে ফেলে। তখন আবুল কাশেম ও আব্দুল গফুরসহ অন্যরা ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র ‘সৈনিক’ পত্রিকা প্রকাশের কাজে ব্যস্ত। পুলিশ বাসায় ঢুকতে চাইলেও রাহেলা কাশেম সেইদিন বুদ্ধিমতী নারীর ভুমিকায় অবতীর্ণ হন এবং পুলিশের সাথে তর্ক করে তাদের প্রতিহত করেন। এবং এই সুযোগে আবুল কাশেমসহ অন্যরা পেছনের দেয়াল টপকে পালাতে সক্ষম হন। এরপর পুলিশ ভিতরে ঢুকে কাউকে দেখতে না পেয়ে চলে যায়। ভাষা আন্দোলন শুরুর দিকে অন্দরমহলে নারীর এই অবদান আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিগুলো এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কারণ সেই রাতে আবুল কাশেমসহ অন্যরা গ্রেপ্তা হয়ে গেলে প্রচারপত্র হয়তো থেমে যেত।
১৪৪ ধারা ভঙ্গ
১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ভাষা আন্দোলন পুনরজ্জীবিত হয়। পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ২৭ জানুয়ারি (১৯৫২) এক জনসভায় ঘােষণা দেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তার এই ঘােষণায় ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী মহলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ জানুয়ারি (১৯৫২) ছাত্র ধর্মঘট ও সভা আহবান করে। ৩০ জানুয়ারির সভায় ৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) ঢাকা শহরে ছাত্রধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল ও ছাত্রসভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিক্ষোভ ঠেকাতে সমস্ত ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সরকারি ঘােষণায় ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং তাঁরা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
১৪৪ ধারা ভাঙার পন্থা হিসেবে দশজন দশজন করে ছাত্র রাস্তায় মিছিল বের করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অনেকেই এদিন গ্রেফতার হন। অনেক ছাত্ররা ব্যারিকেডের ওপর ও নিচ দিয়ে লাফিয়ে চলে যায়।পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার মূল কাজটা করেছিলেন তৃতীয় দলে বেরিয়ে আসা রওশন আরা বাচ্চুসহ আরও অনেক ছাত্রীরা। পুলিশ ছাত্রীদের উপর বেপরােয়া লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এরমধ্যে রওশন আরা বাচ্চু, সারা তৈফুর, বোরখা শামসুন, সুফিয়া ইব্রাহীম, সুরাইয়া ডলি ও সুরাইয়া হাকিম ছিলেন।
ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের নাম
ভাষা আন্দোলনে নারীরা ছিলেন পুরুষের অগ্রভাগে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ হয়ে ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি- এ এক দীর্ঘ ইতিহাসের কাব্যগাঁথা। এই কাব্যগাঁথা সাহসী নারীদের ভূমিকা ছিল অনেক। ৫২’এর ভাষা আন্দোলনে নারীদের সাহসিকতা পুরুষদেরকে আরও বেশি শক্তি জোগিয়েছিল।
মমতাজ বেগমঃ মহান বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগ্রামী নারী ছিলেন মমতাজ বেগম। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে তিনি চরম ভাবে লাঞ্চিত ও নির্যাতিত হন, এমনকি দীর্ঘ প্রায় দেড়বছর পর্যন্ত কারাভোগ শেষে ১৯৫৩ সালের মে মাসে কারাগার থেকে মুক্তি পান। শুধু তাই নয়, কারানির্যাতনের একপর্যায়ে সরকারের চাপে স্বামী তাকে তালাক দেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দলোনের সময় তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলার মর্গান হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ‘৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মর্গান হাইস্কুলের নিকটস্থ রহমতুল্লাহ মুসলিম ইনস্টিটিউট মাঠে একটি বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে মর্গান স্কুলের ছাত্রীসহ মহিলাদের প্রথম মিছিল নিয়ে উপস্থিত হন মমতাজ বেগম। ২০১২ সালে ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরুপ বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
চেমন আরাঃ ভাষা সৈনিক চেমন আরা, ‘তমদ্দুন মজলিস’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। স্বামী শাহেদ আলীর অনুপ্রেরণায় তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করায় দাবীতে তমদ্দুন মজলিশের বিভিন্ন সভা-সমাবেশ সেমিনার, সাহিত্য সভায় যোগদান করা, বাংলা ভাষার জন্য পোস্টার লেখা সেগুলো স্কুল কলেজের দেওয়ালে লাগানো, প্রচার পত্র বিলি করা ইত্যাদি কাজে তিনি স্কুলে থাকা অবস্থায় সম্পৃক্ত ছিলেন। পুলিশের গুলিতে শহীদ আবুল বরকতের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে মিছিল বের করেন তাতে তিনিও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। একুশে ফেব্রুয়ারী আমতলায় ছাত্রসভা শেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে যে মিছিল হয় সেই মিছিলেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন।
রওশন আরা বাচ্চুঃ বায়ান্নর বাংলা ভাষা আন্দোলনের একজন সংগ্রামী সাহসী নারী ছিলেন রওশন আরা বাচ্চু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকা অবস্থায় তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সময় তিনি সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। রওশন আরা বাচ্চু তার দলের সবাইকে নিয়ে পুলিশের তৈরি ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলেন। এ সময় তিনি আহত হয়েছিলেন।
শাফিয়া খাতুনঃ ১৯৫২ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে যে প্রতিক্রিয়া হয় শাফিয়া খাতুন তাতে আন্দোলিত হন। এ সময় তিনি ভাষা আন্দোলনে ছাত্রীদের সংগঠিত করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং নারীদেরকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে শরিক হতে আহ্বান জানান। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে যে নারী দলটি প্রথম বেরিয়েছিল শাফিয়া খাতুন সে দলেই ছিলেন।চামেলি হাউসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বেশ কয়েকটি বৈঠক, সমাবেশ ও মিছিলে তিনি নেতৃত্ব দেন।
হামিদা রহমানঃ ভাষা সৈনিক হামিদা রহমান ছিলেন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যশোরের যুগ্ম আহবায়ক। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে নতুন রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হবে উর্দু এমন যুক্তিতে কোলকাতার আজাদ পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশিত হয় হলে প্রতিবাদস্বরূপ তিনি ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় একটি চিঠি লিখিছিলেন কোলকাতার আজাদ পত্রিকায় বিরুদ্ধে। সেই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হবে বাংলা। যশোরের অগ্নিকন্যা হামিদা রহমানের আন্দোলনে শাসক গোষ্ঠীরা এতটাই খ্যাপা ছিলেন যে, তার পুরাতন কসবার বাড়িতে একাধিকবার অভিযান চালায় পুলিশ। পরবর্তিতে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যশোর জেলার যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব নিয়ে পুরো দেশে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে দেন। তারই নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্রী মোমিন গালর্স স্কুল প্রাঙ্গণে যখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনি দিতে শুরু করে। পুলিশ হামিদা রহমানকে গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায়। তাকে গ্রেপ্তার করতে না পেরে বিভিন্ন থানায় তার নামে ওয়ারেন্ট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে তিনি আত্মগোপন করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে হামিদা রহমান প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকতে পারেননি।
জোবেদা খানম চৌধুরীঃ ৫২’র ভাষা আন্দোলনে জোবেদা খানম চৌধুরী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পূর্ববঙ্গের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে যে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল তাতে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার ছাত্র ও জনতার উপর পুলিশের নির্মম আক্রোশের প্রতিবাদে ২২শে ফেব্রুয়ারিতে সিলেটে বহু নারী একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। তিনি তাদের মধ্যে একজন ছিলেন।
ড. হালিমা খাতুনঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী ড. হালিমা খাতুন ছিলেন ভাষা আন্দোলনের এক সক্রিয় কর্মী। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের লক্ষ্যে তিনি প্রস্তুতিমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং একুশের সকালে তার দায়িত্ব ছিল পিকেটিং করা। আহত ভাষা সৈনিকদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করবার জন্য চাঁদা সংগ্রহ করতেন তিনি। ড. হালিমা খাতুন শিশু-কিশোরদের জন্য বহু বই লিখেছেন।
এছাড়া আরও অনেক নারী বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে আনোয়ারা খাতুন, সুফিয়া খাতুন, তোহফাতুন্নেছা আজিম, সৈয়দা হালিমা, সুলতানা বেগম, নুরুন্নাহার জহুর, আইনুনু নাহার, আনোয়ারা মাহফুজ, তালেয়া রহমান, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, আনোয়ারা বেগম, সাজেদা আলী, গুলআরা বেগম, সুলতানা চৌধুরী, নুরুন্নাহার বেলী, রওশন আরা শরীফ, নিলুফা আহমেদ, বেগম মালেকা আশরাফ, আফতাবুন্নেছা, ড. জাহানারা বেগম বেনু, মনোয়ারা বেগম বেনু, ডা. মহসিনা বেগম, ফিরোজা বেগম ফুনু, হাফিজা বেগম টুকু, হাসিনা বেগম ডলি, রওশন আরা, খুরশিদা বানু খুকু, আখতার বানু প্রমুখ ছিলেন অন্যতম।
নারী ভাষা সৈনিকদের অবজ্ঞা
‘রাষ্ট্র্রভাষা বাংলা চাই’ এই শ্লোগান এবং এই আন্দোলনে বাংলার নারীরা যে পুরুষের সহযোদ্ধা হয়ে সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবে মহান ভাষা আন্দোলনে নারীর উল্লেখযোগ্য অবদান থাকলেও ভাষা সৈনিকদের তালিকায় নারীর অবদান সেভাবে উঠে আসেনি ইতিহাসের পাতায়। যার জন্য ভাষাসৈনিক নারীদের অবদান বাংলার সিংহভাগ মানুষের কাছে অজানা। বিষয়টা দুঃখজনক এবং হতাশারও বটে। অথচ মায়ের মুখের ভাষা রক্ষা করতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরও রয়েছে অসামান্য অবদান। বাংলার সর্বস্তরের জনগণের কাছে যে ইতিহাস জ্বলজ্বল করে জ্বলছে চোখের সামনে; সেদিনের পুলিশ আর্মিদের ব্যারিকেড উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষার দাবিতে প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, রফির, শফিক, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা অসংখ্য ভাষাসৈনিক। কিন্তু সেইদিন পাকিস্তানি আর্মি ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নল উপেক্ষা করে ভাষার দাবি নিয়ে রাজপথে নামা মিছিলগুলোতে নারীরা ছিলো সামনের সারিতে! ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নারীরাই সর্বপ্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার সাহস দেখান।
পুরুষের পাশাপাশি এসকল বীর নারীর সক্রিয় আন্দোলনে আজ আমরা আমাদের মায়ের মধুর ভাষায় কথা বলতে পারছি। ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, ভাষা ও কৃষ্টির প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি বাংলা ভাষা ও বাঙালীর জন্য একটি বিরাট সম্মানের বিষয়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের এতগুলো বছর পরেও এই সকল বীর নারীদের প্রতি আমরা যথাযথ সন্মান দেখাতে পারিনি। তাদের অনেকের নামই হারিয়ে গিয়েছে বিস্মৃতির অতলে।তরুণ প্রজন্মের ভাষা তথা স্বাধিকার অর্জনের প্রকৃত সত্য জানা উচিত। একুশ মানে মাথা নত না করা।তাই, আমাদের প্রত্যয় থাকবে,আমরা ভাষার ব্যবহারে যত্নশীল হবো। তাই ভাষার বিকৃতি নয়, মাতৃভাষার সঠিক ব্যবহারই পারবে তাদের আত্মত্যাগকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে।
উপসংহার
ভাষা আন্দোলনে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি বক্তৃতা করেছেন গণজমায়েতে। নেতৃত্ব দিয়েছেন মিছিলে। সহ্য করেছেন পুলিশি নির্যাতনের সকল প্রক্রিয়া- কারাবরণ, হুলিয়া ভোগ, সাময়িক আত্মগোপনকারীদের আশ্রয় দিয়ে একথাও প্রকাশ করেছেন। জানা যায়- প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে গায়ের অলংকার খুলে দিয়েছেন অনেকেই। অথচ ইতিহাসে নারীদের উপস্থিতির কথা বলা এবং ভাষাসৈনিক নারীদের পূর্ণ তালিকা পাওয়া যায়নি। ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখায় অগণিত ভাষাসৈনিক একুশে পদক পেলেও, ভাষাকন্যারা আজও অবহেলিত রয়ে গেছেন।
ভাষা আন্দোলনে নারীদের ছিল প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অবদান, যা তাদের সাহসিকতাকে আরও সমৃদ্ধ করে। পরবর্তী সময়ে সেই চেতনা ধারণ করেই তারা এগিয়ে যায়, বাংলাদেশের মানচিত্রে লাল-সবুজের পতাকা আঁকতে। আজও নারীর অবদানে স্বয়ংসম্পূর্ণ আমরা। চেতনার সেই শক্তিকে ধারণ করে, আমাদের পথচলা হয়ে উঠুক পরিপূর্ণ। তাই আমরাও কবি নজরুলের ভাষায় বলতে চাই-
পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর