ভূমিকা
সকলের সঙ্গে মিলেমিশে জীবনধারণ এবং সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ানাের মধ্যেই জীবনের যথার্থ সার্থকতা নিহিত। নিজের স্বার্থের জন্যেই কেবল জীবন নয়। এ প্রসঙ্গে ডা. লুৎফর রহমান বলেন : “প্রকৃত সুখ কোথায়? পরকে ফাঁকি দিয়ে নিজের সুখটুকু ভাগ করে নেওয়াতে কি সত্যিকারের সুখ আছে? আত্মার সাত্ত্বিক তৃপ্তির কাছে জড় দেহের ভােগ সুখের মূল্য কিছুই না। যতদিন না মানুষ পরকে সুখ দিতে আনন্দবােধ করবে ততদিন তার যথার্থ কল্যাণ নাই।” মানুষ সমাজবদ্ধ, সহানুভূতিশীল জীব বলেই আত্মস্বার্থে মগ্ন থাকা তার স্বভাব-বিরুদ্ধ। মানুষ হয়ে জন্মালেই মানুষ হয় না। চাই মনুষ্যত্ব অর্জনের দীক্ষা। জনসেবা সামাজিক মানুষের সেই দীক্ষার যথার্থ মন্ত্র। সমাজের সহায় সাহায্যহীন সর্বহারা হতাশাগ্রস্তকে প্রাণবন্ত করে তােলাই মানুষের ধর্ম। আর তাই নিজের স্বার্থত্যাগ করে অপরের সেবায় আত্মনিয়ােগ করার নামই জনসেবা।
জনসেবার অর্থ
জনসেবা কথাটি ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ একটি শব্দ। এর দ্বারা শুধু আর্ত-পীড়িত, দুঃখী-দরিদ্রকে সাহায্য করা বুঝায় না বরং সকল মানুষের কল্যাণ সাধনকেও বুঝিয়ে থাকে। মানুষমাত্রই সামাজিক জীব। একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ভেতরে বাইরে এক অদৃশ্য যোগসূত্রে গ্রথিত। সমাজস্থ মানুষের কল্যাণে যেকোনাে কাজই জনসেবা হিসেবে স্বীকৃত। এ প্রসঙ্গে কবি কামিনী রায়ের কবিতার চরণ দুটি স্মরণযােগ্য –
জনসেবার বৈশিষ্ট্য
পৃথিবীর ভালাে-মন্দ, সুখ-দুঃখ, মঙ্গল-অমঙ্গল তার হৃদয়মন স্পর্শ করে না। সে নিজেকে নিয়েই বিব্রত থাকে। মানবধর্মের অবমাননাকারী ব্যক্তি পৃথিবীর জঞ্জাল। সে কখনােই সুখকর জীবনযাপনের স্বাদ পায় না। এ ধরনের স্বার্থপর মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সে সমাজের কোনাে উপকারে আসে না। আর মানুষ যদি মানুষের উপকারেই না আসে তবে তাঁর জীবন ব্যর্থ। সেজন্যে সত্যিকারের ভালােমানুষ বলতে তাকেই বােঝায় যে নিজের স্বার্থের কথা বিবেচনা না করে পরােপকারে নিয়ােজিত থাকে। সেই মহৎ মানুষ যে নিজের জন্য নয়, সে বিশ্বমানবের জন্যে নিবেদিত তাই বলা হয়েছে –
জনসেবার ক্ষেত্র
জনসেবার কথাটি যেমন ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি এর প্রয়ােগ ক্ষেত্রও বিস্তৃত। সারাবিশ্বে এমন কোনাে কাল ও সমাজ নেই বা ছিল না যে সমাজে বা কালে আর্ত-পীড়িত, দুঃখী-দরিদ্র অসহায়-সম্বলহীন, অনাথ-প্রতিবন্ধী মানুষ ছিল না। এসব মানুষদের সেবা করা জনসেবা বলে স্বীকৃত হয়ে আসছে। সমাজের কেউ না কেউ এসব অসহায় মানুষদের সেবা করে আসছে। তাছাড়া রাস্তা-ঘাট, পুল-সাঁকো নির্মাণ, পুকুর-দিঘি খনন ইত্যাদিও জনসেবার পর্যায়ভুক্ত। সুতরাং জনসেবার ক্ষেত্র কোনাে বিশেষ কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
জনসেবার পদ্ধতি
বিশ্বের সব সমাজের প্রকৃতি যেমন এক নয় তেমনি সমস্যাও এক রকম নয়। সমাজের প্রকৃতি অনুসারে সমস্যার প্রকৃতি বিভিন্ন ধরনের হয় বলে জনসেবার পদ্ধতিও বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন- একজন ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেওয়া যেমন জনসেবার পর্যায়ে পড়ে তেমনি সংশ্লিষ্ট ভিক্ষকে ভিক্ষা না দিয়ে তাকে কোনাে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়াও জনসেবার পর্যায়ভুক্ত। তাছাড়া রুগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, মৃতদেহ সৎকারের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গঠন, অনাথ-আতুরদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন, দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান ইত্যাদিও জনসেবার পর্যায়ভুক্ত।
জনসেবার মানসিকতা অর্জনে সহায়তা
জনসেবা মূলত একটি মানবিক গুণ। এর জন্য কোনাে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়ােজন হয় না। তাছাড়া স্কুল-কলেজসমূহে অগ্নিকাণ্ড, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, মহামারি, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগে কীভাবে জনসেবা করা যায় তার একটি দিক-নিদের্শনা দেওয়া যায়। এতে ছাত্রজীবন থেকেই প্রত্যেকে জনসেবার মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে।
জনসেবা যুগে যুগে
পূর্বে আমাদের দেশে জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডসমূহ সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে তা পরিবর্তিত হয়ে সামষ্টিকরূপে উন্নীত হয়েছে। আগেকার দিনে জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল রাস্তা নির্মাণ, খাওয়ার পানির জন্য পুকুর বা দিঘি খনন, পথিকদের জন্য পান্থশালা নির্মাণ, অতিথিশালা নির্মাণ, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মধ্যে। কিন্তু বর্তমানে মানুষের প্রয়ােজনের দিকে লক্ষ রেখে জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি লাভ করেছে। এখন নানাভাবে জনসেবা চলছে। তন্মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে- যাত্রী ছাউনি, সংবাদপত্র কেন্দ্র, পাঠাগার, পার্ক, চিত্তবিনােদন কেন্দ্র নির্মাণ ইত্যাদি। বর্তমানে বিশ্বমানবতার কল্যাণে নানা আন্তর্জাতিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন রেডক্রস, রেডক্রিসেন্ট ইত্যাদি গড়ে ওঠেছে। কোনাে আকস্মিক বিপদ এসে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করলে আর্ত-মানবতার সেবায় এসব প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ সূচনা পালন করে।
জনসেবা ও ধর্মীয় চেতনা
জনসেবার গুরুত্ব
বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন : ‘পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না, পরের জন্য তােমার হৃদয়-কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও’ পরার্থে জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে মানবজীবন সার্থকতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ফুলের মতােই মানুষের জীবন। ফুল ফুটে সুবাস ছড়ায়। তার সৌরভে চারদিক আমােদিত হয়। এভাবে সৌরভ ছড়ানাের মধ্যেই সে তার সার্থকতা খুঁজে পায়। তদ্রপ, অপরের কল্যাণে নিজকে নিয়ােজিত করতে পারলেই জীবন সুখময় ও আনন্দময় হয়ে ওঠে। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যে জাতিতে খাটি জনসেবকের সংখ্যা যত বেশি সে জাতির ঐক্য, জাতীয়তাবােধ এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে তত বেশি। সমাজের উন্নতির মূলে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সেগুলাের মধ্যে শিক্ষা, সময়ােপযােগী চেতনা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ অন্যতম। কিন্তু সমাজের সচেতন এবং যােগ্য ব্যক্তিগণ এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন না করলে সাধারণ জনগণ তা যথাসময়ে যথাযােগ্যভাবে অর্জন করতে পারে না।
এ ক্ষেত্রে দেশ ও জাতির সার্বিক অগ্রগতির জন্যে কাউকে না কাউকে সমাজসেবার মহৎ ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জনসাধারণের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে এবং তাদের সাধ্যমত সাহায্য করতে হবে। দেশের চরম দুর্গতির সময় জনসেবার মহান ব্রতে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে । সর্বোপরি যে ব্যক্তি যেখানে, যে কর্মে নিয়ােজিত আছে তার সে অবস্থান থেকেই মানুষের সেবা করতে হবে। তবেই মানবজীবন থেকে দুঃখ দূরীভূত হবে।
জনসেবার পদ্ধতি ও জনসেবার চেতনা
সেবা প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দল
জনসেবায় রাজনৈতিক দলগুলাের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক দলগুলাে সংঘবদ্ধ শক্তি। এঁরাও, দুর্গতদের সাহায্যে প্রয়ােজনীয় ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন। তবে এদের মধ্যে অনেকের ধারণা জনসেবার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ কোনাে চিরস্থায়ী সমাধান নয়। সমাজের বুকে দীর্ঘদিনের যে হৃদয়হীন অন্যায়-অনাচারের পাহাড় সঞ্চিত হয়েছে, তার সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সর্বাত্মক সমাধানের জন্যে তারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু যতদিন সমাজে দারিদ্র্য, শােষণ, বৈষম্য থাকবে ততদিন জনসেবার প্রয়ােজনীয়তা অপরিহার্য। কিছু কিছু রাজনৈতিক দল জনসেবাকেই জীবনের একমাত্র মহৎ ব্রত মনে করেন না। ক্ষমতা দখল এবং অধিকৃত ক্ষমতা বজায় রাখার দিকেই তাদের প্রাণান্ত প্রয়াস। ফলে দুর্গত, বিপন্নের সেবাতেও দেখা যায় সংকীর্ণ, দলীয় মনােভাব। জনসেবা অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার ছদ্মবেশ মাত্র।
উপসংহার
জনসেবা প্রত্যেক মানুষেরই এক সৎ ও মহৎ হৃদয়বৃত্তি। এই হৃদয়-বৃত্তির জাগরণই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। মানুষ কেবল স্বার্থ আর সম্পদের যন্ত্র নয়। মানুষ সুন্দরের আরাধনা করে। বিরাট মহিমার উপলব্ধিতে সে জীবনকে সার্থক ও অর্থময় করে তুলতে চায়। যে মানুষ আপনার আত্মার মধ্যে অন্যের আত্মাকে ও অন্যের আত্মার মাঝে আপনার আত্মাকে জানে, সে-ই জানে সত্যকে। নিঃস্বার্থ সমাজসেবা মানুষের এক দুর্লভ গুণ। মানুষের জীবনে যদি মহৎ সেবাব্রতের পূর্ণ দীক্ষা থাকে, যদি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে সেই মহাপ্রাণতার অঙ্গীকার, তবেই এই ধূলার ধরণীতে একদিন প্রেমের দেবতার হবে অভিষেক। আজ দিকে দিকে যেখানে প্রমত্তের রণসাজ, যেখানে কপটতা-ভণ্ডামির ছদ্মবেশ, যেখানে আত্মসর্বস্ব ধ্যানধারণায় মানুষ নিয়ত কুণ্ঠিত, যেখানে হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী, সেই হিংস্র প্রলাপের মধ্যে এই সহায়-সম্বলহীন আর্ত, দুর্গতদের সেবাই যেন হয় সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।