বাংলা রচনা

রচনা – যখন সন্ধ্যা নামে

Rate this post

বাংলা রচনা যখন সন্ধ্যা নামে

ভূমিকা

রূপসী বাংলার বুকে সন্ধ্যা নামার দৃশ্য খুবই মনোরম। সন্ধ্যায় বাংলার প্রকৃতি সাজে এক অপরূপ রুপে। কবির ভাষার-

সজল কাজল করুণ নয়ন অধরে মধুর হাসি।
মালিন বসনা সন্ধ্যা দাঁড়ায় গগন কিনারে আসি।

কবির এই কথায় সন্ধ্যার স্বরূপ সুস্পষ্ট। দিন আর রাত্রির মিলনটাকেই আমরা সন্ধ্যা বলি। সন্ধ্যা দিনও নয়, রাত্রিও নয়, এ দুয়ের ক্রান্তিকাল। এত স্পষ্ট করে চিহ্নিত করা যায় না বলেই বােধ হয় সন্ধ্যা বড় রহস্যময়। আর এজন্যই এর প্রতি আমাদের এত আকর্ষণ। কিছু জানা কিছু অজানার, কিছু দেখা কিছু অদেখার পরিবেশ বড় মনােরম লাগে। কবির কথায়- 

দিনের আলােক রেখা মিলিয়ে দূরে ,
নেমে আসে সন্ধ্যা ধরণীর পুরে।
তিমির ফেলেছে ছায়া ,
ঘিরে আসে কাল মায়া।
প্রান্তর কানন গিরি পল্লি বাট-মাঠ,
অন্ধকার হয়ে আসে আকাশ বিরাট।

সন্ধ্যার আগমনে প্রকৃতি

আবির রাঙা পুরবি। পশ্চিমের আকাশ যখন সন্ধ্যা নামে তখন মনে হয় তার গায়ে সিঁদুর মাখিয়ে দিয়েছে। জীবন আর প্রকৃতি স্থবির হয়ে যায় সাঁঝের মায়ার আবেশে। জননন্দিত নায়কের বিদায় অভিষেকে জীবন যেমন স্থবির হয়ে যায় সুখ-দুঃখের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় অধীর হয়ে ওঠে- সঁঝের মায়ার আলােতে মানবমনেও ঠিক তেমনি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সন্ধ্যা আবেশে এই লগন যেন ভাবুক মনের কল্পনা সুন্দর আবাহন, বঞ্চিতার চাপা নিঃশ্বাস, প্রকৃতির ব্যথাবিহ্বল অনুরাগ। সন্ধ্যার আগমনে পশ্চিম আকাশ যেন অপরূপ রূপাঞ্জলিতে ছেয়ে ওঠে। মনে হয় কোনাে নিপুণ চিত্রকর তার রঙের ভাণ্ডার উজাড় করে পরম যত্নে অঙ্কন করেছেন মনােলােভা আল্পনা। চোখ ধাঁধানাে লাল রঙা ওই আপনার শীর্ষ দেশ বিলীন হয়ে যায় হলুদ রঙা আঁচলের তলায়। গাছের ছায়াগুলাে লম্বা হয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় সবুজ মাঠের পূর্ব দিকে। পশ্চিম আকাশের চাহনি থরে থরে রুপের পশরা সাজায় বনরাজির অবয়বে। এ যেন বনরাজির অধরে বিদায়ী সবিতার সােহাগ চুম্বন। প্রকৃতি বার বার আপ্লুত হয়ে অপরিমেয় কলহাস্যে, নদীর তীরে, সাগর পাড়ে, প্রাসাদ-চূড়ায়, সে দৃশ্য কত যে মনােহর, তা একমাত্র অবলােকনকারী উপলব্ধিই করতে পারে, কিন্তু বর্ণনা করতে পারে না। 

সন্ধ্যায় মানবজীবন

সন্ধ্যা জীবনকে ফিরিয়ে আনে ঘরে। দিনের কর্মব্যস্ততা শেষ হতেই সন্ধ্যার আবির্ভাব, নাকি সন্ধ্যাই কর্মবহুল দিনের যবনিকা টেনে দেয়, কে বলবে? তবে দিনের ক্লান্তির শেষে সন্ধ্যা আসে শান্তির ললিত বাণী নিয়ে একথা সত্যি। ধীর পদক্ষেপে তখন বাড়ির দিকে ফিরি। চারদিকটা দেখতে পাই, রং বদলাচ্ছে। বাড়িটার আধখানা ছায়ায় ঘেরা আর আধখানায় তির্যকভাবে হাল্কা রৌদ্রালােক পড়েছে। গাছের মাথায় পরিপূর্ণ মহিমায় বিলীয়মান রবি-রশ্মি এক অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। তা দেখে মনের মধ্যে গুনগুন করে ওঠে –

এই তাে ভালাে লেগেছিল আলাের নাচন পাতায় পাতায়

ক্ৰমে পশ্চিম আকাশে সূর্য লাল হয়ে ওঠে বিদায়ের ইঙ্গিত জানায়। ক্রমে ম্লান হয়ে আসে আলাের রেখা। হালকা আঁধার ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। দূরের দৃশ্যাবলি ক্ৰমে অস্পষ্ট হতে থাকে। একসময় আঁধারের সঙ্গে তা মিশে হয় একাকার। মাথার ওপরে উড়ে যাচ্ছে পাখিরা। ওরা নীড়ে ফিরছে। পাখিরা চরাভূমি ছেড়ে ফিরে আসে বাসায়। আবছা আলােয় বকের উড়ন্ত মিছিল যেন ঘরে ফেরার এক অনাবিল প্রশান্তি। বাঁশবনে বসে শালিকের মেলা। তাদের কলকাকলিতে সন্ধ্যা পরিবেশ। মুখর হয়ে ওঠে। রাখাল মাঠ থেকে গরু নিয়ে পা ফেলে কিষানির গােয়ালে। কিষাণী তাড়াহুড়া করে আয়ােজন করে রাতের . খাবারের। দুষ্টু খােকার সন্ধানে পল্লি মায়ের সেকি ডাকাডাকি। জুতাে খড়ম হাতে নিয়ে ছেলে বুড়াে সবাই পুকুর বা নদীর ও ঘাটে জমায়েত হয়, নামাজিরা ছুটে যায় নামাজের ঘরে। ঘণ্টা নেড়ে, শাঁখ বাজিয়ে পুরােহিত শােনায় সন্ধ্যার আগমনী। বারুদ মাখা পাটখড়ির মাথা তুষের তাওয়ায় ঢুকিয়ে গ্রাম্য বধু জ্বালায় সন্ধ্যার দীপালি। ভাবতেই কেমন যেন মনে হয় ছুটে চলি আমাদের মায়ের গ্রামে, ছবির মতাে গ্রামে। যেখানে দিনের আলাের গন্ধ আছে। রাতের আলাের সুবাস আছে। আর সন্ধ্যার আছে এই বাংলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, যার মধ্যে ধরা পড়ে এটা আমার সােনার বাংলা, বাংলা মায়ের কোল। 

প্রকৃতির নবরুপ

যখন সন্ধ্যা নামে তখন মনে হয় পৃথিবী যেন জ্যোতির অলংকার পরেছে। পেছনে ফেলে আসা দিনকে মনে হয় অতি প্রবীণ, প্রাচীন আর বিষয়ী। দিনশেষে যে সন্ধ্যা আসে তাকে মনে হয় যেন অচেনা। সন্ধ্যা খানিকক্ষণের জন্য এসেই যাবার প্রস্তুতি নেয়। তাকে যে না গেলে চলবে না। কেননা যেখানে সে যাবে কেবল সেখানেই প্রেম জাগবে, স্নিগ্ধতা জাগবে। তাই সন্ধ্যা যেমন ধীর পায়ে আসে তেমনি ধীর পায়ে চলে যায়। সন্ধ্যাতারা আকুল নয়নে বিদায় জানাতে আসে সন্ধ্যাকে। সন্ধ্যা যায় কোমল আর গভীরে, উজ্জ্বল আর স্নানে। তার সৌন্দর্য এমন পূর্ণতা ব্যক্ত করে যার কোনাে তুলনা মেলে না। রবীন্দ্রনাথের ‘সন্ধ্যা বিদায়’ কবিতায় ধরা পড়েছে সন্ধ্যার বিদায়ের সেই রূপটুকু
সন্ধ্যা যায়, সন্ধ্যা ফিরে চায়, শিথিল কবরী পড়ে খুলে 
যেতে যেতে কনক-আঁচল বেঁধে যায় বকুলকাননে, 
চরণের পরশরাঙিমা রেখে যায় যমুনার কূলে
নীরবে বিদায়-চাওয়া চোখে, গ্রন্থি-বাঁধা রক্তিম দুকূলে
আঁধারের ম্লানবধুয়ায় বিষাদের বাসরশয়নে।
সন্ধ্যাতারা পিছনে দাঁড়ায়ে চেয়ে থাকে আকুল নয়নে। 

বিচিত্রবর্ণা বাংলার প্রতি প্রহরও বৈচিত্র্যে ভরা। বর্ষার সন্ধ্যা বড় গভীর। প্রকৃতির সঙ্গে হৃদয়ও এতে একাকার হয়ে মিশে যায়। আমাদের চোখ পলক ফেলারও সুযােগ হারায় হেমন্ত-সন্ধ্যায়। শীতের সন্ধ্যা বাতাসে কুয়াশার চাদর ছেড়ে দিয়ে আমাদেরও বলে যায়—তােমরা চাদর পর হে। 

সন্ধ্যার নির্জনতা

শান্ত সন্ধ্যা। ধরণীকে এক অপূর্ব মায়ায় আচ্ছন্ন করে সে নেমেছে আকাশ জুড়ে। চারদিকে রহস্যের প্লাবন। অস্পষ্টতা। এমন সময় প্রকৃতি যে অনেক কথাই বলতে চায়। সারা দিনের কর্মকোলাহলের মাঝে তার যে আর্তিগুলাে অবহেলায় চাপা পড়ে থাকে, সে যেন তার সবটুকু এক মধুর মৌনতার মধ্য দিয়ে এখনই প্রকাশ করতে চায়। হৃদয়ের তন্ত্রীগুলােও যেন স্ব স্ব সুর নিয়ে বেজে ওঠে আমার বুকের গভীরে। চোখ দুটোকে দিগন্তহীন আঁধারের বুকে ছেড়ে দিয়ে ‘আমি কান পেতে রই আমার আপন হৃদয় গহন দ্বারে’। শুনতে পাইনে কিছুই, শুধু অনুভব করি এক মৌন-মুখরতা। 

উপসংহার 

সন্ধ্যা দিবসের অবসান। বিদায় বেলায় এ সন্ধ্যা পৃথিবীকে দিয়ে যায় সুন্দরতম আবেদন। মধ্যাহ্নের হিসাব পুষিয়ে দেয়ার জন্যেই যেন সন্ধ্যার এমন আয়ােজন। পুরবির অনুরাগী প্রয়াস জীবনে দেয় বিশ্রামের ইঙ্গিত আর প্রকৃতিরাজ্যে বসায় মহামিলনের মাঙ্গলিক মহড়া। কর্মক্লান্ত দিবসের শেষে সন্ধ্যার শীতল বাতাস এনে দেয় মনে প্রশান্তি। রাতের শান্ত মধুর রূপটি মানুষের জন্য শান্তি, সুখ নিয়ে আসে। রাতের আঁধারেই সন্ধ্যার নির্বাসন।

আরক্ত সন্ধ্যার মুখে টেনে দিলে রাত্রির নেকাব ।
মৃত্যুঘন অন্ধকার। এখন যায় না দেখা তার
তারুণ্যের ক্ষণ বিভা, চিবুক নিটোল শুভ্রতার ।
মর্মরে খােদিত মুখ। প্রশ্ন আর পায় না জওয়াব।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button