বাংলা রচনা

ইভটিজিংঃ একটি সামাজিক ব্যাধি

1.7/5 - (24 votes)

ভূমিকা

আমাদের জীবনের এক প্রাতহিক দুষ্ট ক্ষত হয়ে দাঁড়িয়েছে ইভটিজিং।  দেশের হাজারো সমস্যা ছাপিয়ে ইভটিজিং এখন প্রধান সমস্যা। সাম্প্রতিককালে ভয়ংকর এ সমস্যার হিংস্র থাবার ক্ষত বিক্ষত ও অপমানের দহনে জ্বলতে থাকা বহু কিশোরী তরুণী আত্মহননের নির্মম পথ বেছে নেয়। সেই সাথে ইভটেজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে জাতি গড়ার কারিগর মহান শিক্ষক আর মমতাময়ী মা ও অভিভাবকের মৃত্যুতে সৃষ্টি হয়েছে গভীর উদ্বেগ। সামাজিক মুল্যবোধ, নীতি নৈতিকতা, আদর্শ ও জীবনবোধকে গিলে খাওয়া ভয়ানক এ ইভটিজিং সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া এখন সময়ের দাবি।

ইভটিজিং কি

ইভটিজিং শব্দটি যেন হয়রানির একটি অমার্জিত (Slang) ভাষা যাতে শিকার হন অনেক কিশোরী তরুণী। আমাদের উপমহাদেশে প্রচলিত ইভটিজিং শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ “নারীকে উত্ত্যক্ত করা বা জ্বালাতন করা” তবে শুধু উত্ত্যক্ত করার মধ্যে তা সীমাবদ্ধ নয়। ইভটিজিং প্রকাশ্যে যৌন হয়রানি, পথেঘাটে উত্ত্যক্ত করা বা পুরুষ দ্বারা নারীনিগ্রহ নির্দেশক একটি কাব্যিক শব্দ যা মূলত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালে ব্যবহৃত হয়। ইভটিজিং শব্দটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।  ইভ + টিজিং এখানে ‘ইভ’ বলতে বুঝায় নারী বা রমণী এবং টিজিং বলতে বুঝায় উত্ত্যক্ত বা বিরক্ত করা। একসময় সমাজে বখে যাওয়া তরুণের ক্ষুদ্র অংশ ইভটেজিংয়ের সাথে জড়িত থাকলেও উঠতি তরুণ, কিশোর যুবকরা তো আছেই সেই সাথে মধ্য বয়সীরাও এর সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। আধুনিক সমাজে সমাজে ‘ইভটিজিং‘ শব্দটি ‘যৌন হয়রানি’ (Sexual Harassment) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। “‘Oxford Dictionary“‘-তে এজন্য ‘ইভ টিজিং’ শব্দটির অর্থ করা হয়েছে “‘Harassment of,or sexually aggressive behavior toward women or girls”‘. যৌন হয়রানি হচ্ছে সেই ধরনের কর্মকাণ্ড ও আচরণ যা মানুষের যৌনতাকে উদ্দেশ্য করে মানসিক ও শারীরিকভাবে করা হয়।

ইভটিজিং এর ধরন:

Our society is suffering from many social evil’s at the moment. One of the worst evil’s is the Eve teasing. Eve teasing has been growing like an epidemic throughout the country. Time is changing and the world is moving forward day by day. In modern times women and men share the same facilities. They are equal. But sadly, in Bangladesh its a men’s world. ইভটিজিং এক ধরণের নারী নির্যাতন। স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী, শিক্ষিকা, পথচারী নারী, কর্মজীবী নারীসহ প্রতিটি নারী তার চলাচলের প্রায় সর্বত্রই কোনো না কোনো ভাবে ইভটেজিংয়ের শিকার হয়ে থাকে। মোবাইল ফোন,ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের অপকৌশলসহ  বাচনিক, অবাচনিক কিংবা শারীরিক উপায়ে বখাটেরা ইভটিজিং করে থাকে 
   ↪ বাচনিক: অশালীন মন্তব্য, শিস বাজানো, উদ্দেশ্যপূর্ণ যেন আবেদনময়ী গান গাওয়া, হুমকি ইত্যাদি।
  ↪ অবাচনিক: লম্পট চাহনী, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, উস্কানিমূলক তালি বাজানো, অশ্লীল ছবি বা ভিডিও দেখানো, পিছু  নেওয়া, মোবাইলে অশ্লীল ম্যাসেজ পাঠানো বা মিসকল দেওয়া, উড়ন্ত চুমুর  (Flying Kiss) ইঙ্গিত, চলার পথে প্রতিবন্দকতা সৃষ্টি করা ইত্যাদি।
  ↪ শারীরিক: ঘাড় ও কাঁধে হাত দেয়া, গা গেষে দাঁড়ানো, জড়িয়ে ধরা, শরীরে ধাক্কা দেয়া, ব্ল্যাকমেল বা চরিত্র হননের উদেশ্যে চলমানচিত্র ধারণ করা ইত্যাদি।

ইভটিজিংয়ের  কুপ্রভাব ও ক্ষতি

ইভটিজিং নারী জীবনের সবচেয়ে বাজে ভয়ানক অভিজ্ঞতা। ইভটিজিং নারীকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইভটিজিং নারীর অবাধ চলার স্বাধীনতায় বাধার সৃষ্টি করে। কেড়ে নেয় তার অফুরান প্রাণচঞ্চলতা। শুধু তাই নয়, ইভটিজিংয়ের শিকার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে অনেক তরুণী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ইভটেজিংয়ের  উৎপাত শুধু মেয়েটির উপর নয়, বরং তা আছড়ে পড়ে পুরো পরিবারের উপর। ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত নারী হারিয়ে যায় হতাশার অথৈ সাগরে, যার চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে নির্মম আত্মহননের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু ইভটেজিংয়ের  প্রভাব নারীর প্রাণের নির্মম বলি দানেই শেষ হয় না।  বরং তার বিষবাষ্পের বিষক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরো সমাজ। দেশের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে ইভটেজিংয়ের হার ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ। স্কুল ও কলেজগামী মেয়েরাই এ ক্ষেত্রে ইভটেজিংয়ের শিকার হয়। ফলে ইভটিজিং থেকে বাঁচতে শিক্ষাজীবন থেকে অকালে ঝরে পরে অনেক নারী শিক্ষার্থী। হয়তো ঝরে পড়া এইসব শিক্ষার্থীর মাঝে ছিল অনেক সম্ভাবনা ও স্বপ্ন। ফলে বেড়ে যায় বাল্য বিবাহ, যা আমাদের সমাজে ভয়ঙ্কর একটি সমস্যা। নারী শিক্ষার্থীর সাথে সাথে ইভটেজিংয়ের  শিকার হয় কর্মজীবী নারীরাও। চলার পথে কিংবা কর্মস্থলে সহকর্মীর টিজিংয়ের শিকার হন তারা। এরফলে অতিষ্ঠ হয়ে নারী বাধ্য হয় চাকরি ছাড়তে, যা নারীর  আত্মনির্ভরশীলতার পথকে ধ্বংস করে দেয়।  এভাবেই ইভটিজিং দেশের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধন করে চলছে।

ইভটিজিং এর কারণ 

ইভটিজিং আমাদের দেশে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগের মতো প্রকট আকার ধারণ করেছে। শহর গ্রাম সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে এর ব্যাপকতা  আধুনিক সমাজের মরণব্যাধি এ ইভটেজিংয়ের শিকার শুধু নারী নয়, শিকার হচ্ছেন নাটোরের মিজানুর রহমানের মতো প্রতিবাদী শিক্ষক, ফরিদপুরের চাঁপারানির মতো মমতাময়ী মা কিংবা অভিভাবক। দেশব্যপী ইভটেজিংয়ের ব্যাপকতার পিছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হচ্ছে:
  • সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোদের অবক্ষয়।
  • নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গির অভাব।
  • নারীকে পণ্য ও ভোগের সামগ্রী মনে করা। 
  • নারীর উগ্র পোশাক ও চলাফেরা।
  • পর্নোচিত্রের অবাধ ছড়াছড়ি।
  • ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার। 
  • স্যাটেলাইট টিভির অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত প্রদর্শন।
  • সুসংকৃতি চর্চার অভাব।
  • সন্তানের বেড়ে ওঠা তথা সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মাতা পিতার অসচেতনতা। 
  • অসৎ সঙ্গ , মাদকাসক্তি, বেকারত্ব ও শিক্ষার অভাব।
  • ইভটিজিং বিরোধী স্বতন্ত্র আইন না থাকা।
  • ইভটিজিং বিষয়ক অপরাধ বিষয়ে অজ্ঞতা।
  • শিক্ষা ব্যবস্থায়  সুচরিত্র গঠন উপযোগী যথাযত ধর্মীয় শিক্ষার বাস্তবায়ন না করা। 

ইভটিজিং ও আইন:

ইভটিজিং রোধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই।  তবে দেশে বিদ্যমান কয়েকটি আইনে এ সম্পর্কিত ধারা উল্লেখ আছে:
↪ আইন ও অধ্যাদেশ ধারা:
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (১০ ধারা)
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধন), ২০০৩ (৯ এর ক  ধারা)
দণ্ডবিধি (অপরাধ সংক্রান্ত প্রধান আইন) ২০৯-২৯৪, ৩৫৪, ৫০৯ ধারা। 
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ (৭৬ ধারা) 
↪ ইভটিজিং প্রতিরোধে সাম্প্রতিক আইনী পদক্ষেপঃ 
দেশব্যপী ইভটেজিংয়ের ভয়াবহতায় আতঙ্কিত সবাই বিশেষ করে নারী ও অভিবাবকগণ। তাই নারীর নিঃশঙ্ক ও নিরাপদ জীবন নিশ্চিন্ত করার লক্ষ্যে এবং সহসাই সামাজিক সন্ত্রাসে পরিণত হওয়ার ইভটিজিং নির্মূল ও প্রতিরোধকল্পে সরকার থেকে নেয়া হয়েছে নানা আইনী পদক্ষেপ।
যেমনঃ 
↪ ভ্রাম্যমান আদালতঃ  ইভটিজিং বন্ধে নির্বাহী মেজিস্ট্রেট এর বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে ভ্রামমান আদালত আইনে দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা সংযোজন করা হয়, যা ৯ নভেম্বর ২০১০ থেকে কার্যকর হয়। এ  আদালতের মাধ্যমে ইভটিজারদের তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় করতে পারেন।
↪ অভিযোগ নম্বর ৭৩৭৩: দিন দিন ইভটিজারদের দৌরাত্ম বাড়তে থাকায় বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের অভিযোগ  নম্বর “৭৩৭৩” চালু করেছে। এর মাধ্যমে ইভটিজিংয়ের শিকার নারীরা ফোন করে অভিযোগ করতে পারেন।
↪ প্রতিরোধ কমিটিঃ উত্তেক্তকরন বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে “ইভটিজিং প্রতিরোধ কমিটি” গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
↪ মোবাইল হেল্পলাইন: কোনো নারী ইভটিজিংয়ের শিকার হলে কিংবা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে মোবাইল হেল্পলাইনে  সরাসরি ফোন করে অভিযোগ করতে এবং আইনি সহায়তা নিতে পারবেন।
↪ উত্তেক্তকরণ প্রতিরোধ দিবসঃ ছাত্রীদের সর্বাঙ্গীন নিরাপত্তা বিধানের জন্য সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ার লক্ষে ১৩ জুন ২০১০ প্রথমবারের মতো সারা দেশে ছাত্রী উত্তেক্তকরণ প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। 

প্রতিরোধ ও করণীয়ঃ 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এ যুগে বিশ্বাস্তবতায় শঙ্কিত ও সুদূরপ্রসারী উন্নয়নে প্রেমই পারে ইভটিজিং বন্ধ করতে। এর সত্যিকারের উৎস খুঁজে বের করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। এছাড়া নারী আত্মহনন রোধে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন কল্পে নিতে হবে কার্যকরী পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে করণীয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:
সন্তানের বেড়ে ওঠা এবং সামাজিকীকরণে পরিবারের যথাযথ ভূমিকা পালন করা। 
  • ধর্মীয় মুল্যবোধ, সুনীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা।
  • সামাজিক আন্দোলন ও প্রতিরোধ জোরদার করা। 
  • ইভটিজারদের সামাজিকভাবে বয়কট করা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া।
  • মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির উপর কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করা। 
  • নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা।
  • নারীদের শালীন পোশাক পরিধানের মানসিকতা তৈরি করা এবং শালীনভাবে চলাফেরা করা। 
  • সুবিনোদন ও সসংস্কৃতি চর্চা বৃদ্ধি করা। 
  • সর্বত্র অশ্লীলতা , কুরুচিপূর্ণ সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও অপসংস্কৃতির আগ্রাসন রোধ করা। 
  • আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপর ভূমিকা পালন করা। 
  • বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, আড্ডাবাজি ও খারাপ সঙ্গ থেকে দূরে থাকা।
  • নারীদের সুরক্ষা ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার সাহস জোগানো।
  • ইভটিজিং রোধে আইন পাসসহ তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং জনসমক্ষে সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থা করা। 

উপসংহারঃ 

পরিশেষে ইভটিজিংয়ের আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়ে নারী ঘরে বাহিরে নিঃশঙ্ক ও নিরাপদ এবং খুঁজে পাক তার স্বপ্নমঙ্গলময় জীবনের সন্ধান এ প্রত্যাশায় তাই আসুন গড়ে তুলি ইভটিজিংসহ নারী নিযার্তন বিরোধী ব্যাপক প্রতিরোধ এবং প্রতিষ্ঠা করি সামাজিক মূল্যবোধের ও শৃঙ্খলাপূর্ণ এক ইভটিজিংমুক্ত পরিচ্ছন্ন সমাজ। 

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button