
সূচনা
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপট
![]() |
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের প্রতীকী ছবি |
তদানীন্তন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী পূর্ববাংলার জনগণের ওপর সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার করার পথ বেছে নেয়। তারা ঘােষণা করে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবে না, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাবে উর্দু, যা কি না ছিল মাত্র ৭ শতাংশ লােকের মাতৃভাষা। এই অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হয় সমগ্র পূর্ববাংলা। বাঙালি ঘােষণা করেছিল, সকল মাতৃভাষাই সমান মর্যাদা লাভের অধিকারী। তাই উর্দুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাকেও দিতে হবে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাঙালির ন্যায্য দাবি নস্যাৎ করার জন্যে আন্দোলনরত ছাত্রজনতার ওপর গুলি চালায়। এতে শহিদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকে। আন্দোলন আরও প্রচণ্ড হয়, গর্জে ওঠে সারা বাংলা। আতঙ্কিত সরকার বাধ্য হয়ে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে শহিদের স্মরণে প্রতিবছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস হিসেবে পালিত হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারির চেতনাই বাঙালিকে স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে। এই সংগ্রামের পথ ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর সর্বসম্মতভাবে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, “১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে মাতৃভাষার জন্যে অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং সেদিন যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের স্মৃতির উদ্দেশে দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘােষণার প্রস্তাব করা হচ্ছে।” আজ ভাষা দিবস কেবল আমাদের একার নয়, বিশ্বের দেশে দেশে পালিত হয় এই দিন। ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে কোন এক কবি লিখেছেন-
একুশের ইতিহাস
ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। অতঃপর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘােষণা দেন: ‘Urdu only, and Urdu shall be the state language of Pakistan.’ এর তিনদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা জোরের সঙ্গে ঘােষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন্নাহ এতে কোনাে কর্ণপাত করেন নি। ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘােষণা দিলে ছাত্রসমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
![]() |
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মুহূর্ত। ছবিঃ ইন্টারনেট |
এর প্রতিবাদে ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ সমগ্র পূর্ব বাংলায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের কর্মসূচি প্রদান করলে ছাত্র-জনতার মাঝে অভূতপূর্ব সাড়া জাগে। ২০ ফ্রেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু পূর্বসিদ্ধান্ত মােতাবেক একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারার বিধি-নিষেধ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে।
মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা অংশ নেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তা উত্তাল জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করে। মিছিলের ভয়াল রূপ দর্শন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার নির্দেশ দেন। পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, সফিউরসহ নাম না জানা আরাে অনেকে। এতে সারা বাংলায় প্রতিবাদের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সমগ্র জাতি সম্মিলিতভাবে গর্জে ওঠে সিংহের মত। পরিশেষে, শাসকগােষ্ঠী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও জাতিসংঘ
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদযাপন
আমি কি ভুলিতে পারি।
মাতৃভাষা ও সাহিত্য
একুশকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অনেক গল্প কবিতা উপন্যাস। এক কথায় সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনের পিছনে হাতিয়ার ছিল ভাষা আন্দোলন। তৎকালীন সময়ে সাহিত্য কিছুটা হলেও ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
![]() |
মাহবুবুল আলম চৌধুরি নিজ হাতে লিখা। ছবিঃ ইন্টারনেট। |
একুশ নিয়ে প্রথম রচিত কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ রচিয়তা ছিলেন মাহবুবুল আলম চৌধুরি। কবিতাটি রচিত হয় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধে ৭টায়। ১৭ পৃষ্ঠার দীর্ঘ এ কবিতাটি ছাপা হয় কোহিনুর প্রেস, আন্দরকিলা থেকে। কবিতাটি চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে পাঠ করেন চৌধুরি হারুন উর রশিদ। সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা তৎকালীন সময়ে উৎসাহ দিয়েছিলো ভাষা আন্দোলনের।
একুশের স্মৃতি
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে সারাদেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের আন্দোলন জোরদার করা হয়। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকগণ ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের মিটিং-মিছিল ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানে প্রত্যয়ী ছাত্রসমাজ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। পুলিশ মিছিলে এলােপাথারি গুলিবর্ষণ করে। এতে সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকে নিহত হন। এ হত্যাযজ্ঞ আর দমননীতির ফলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
মাতৃভাষা ও বর্তমান বাংলাদেশ
বিষ্ণু দে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে একটি কাব্যের নাম রেখেছেন ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ!’ বাংলা ও তৃতীয় বিশ্বের শত শত মাতৃভাষার দুরবস্থা দেখে বিষ্ণু দে–র অনুসরণে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে জাগে— ‘২১শে ফেব্রুয়ারি, তুমি কি শুধু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস?’ বর্তমান আধুনিক সভ্যতা আর পশ্চিমা সংস্কৃতির করাল গ্রাসে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা ভাষার মর্যাদা। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন জাতিসত্তার মাতৃভাষা নিয়ে নতুন সম্ভাবনার উৎস হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এমন প্রত্যাশা ছিল আমাদের। কিন্তু তার পর থেকে এশিয়া–আফ্রিকা–অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন দেশে বহু ভাষা মরে গেছে, চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেছে। আর এর সাথে সাথে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে আমাদের ভাষায়। বর্তমান অভিবাবকরা তাদের ছেলে মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করতে রীতিমতো যুদ্ধ করে। অথচ অবজ্ঞা করে বাংলা ভাষার যা অর্জিত হয়েছে তাজা প্রাণের রক্তের বিনিময়ে। কত বুক খালি হয়েছে শুধু ভাষার জন্যে। কিন্তু আফসোস আমরা তার দাম দিতে পারিনি। পৃথিবী জুড়ে সাত হাজার ভাষার মধ্যে প্রায় চার হাজার ভাষাই এখন বিপন্ন। বিগত দুই বছরে তিনশোর বেশি ভাষা চিরতরে হারিয়ে গেছে। একুশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিপন্ন হাজার তিনেক ভাষা চিরতরে হারিয়ে যাবে বলে ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন।
একুশের চেতনা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
১৯৫৩ সালে শহীদ দিবস উদযাপন করতে গিয়ে তখনকার প্রগতিশীল কর্মীরা কালাে পতাকা উত্তোলন, নগ্নপায়ে প্রভাতফেরি ও সমবেত কণ্ঠে একুশের গান, শহীদদের কবর ও মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। সেই থেকে এসব কর্মসূচি বাঙালির জাতীয় চেতনার নবজাগরণের প্রতীক হয়ে দাড়িয়েছে। এখন এসবই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এছাড়া ১৯৫৪ সালে বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠা এবং তারপর থেকে একুশ উপলক্ষে বাংলা একাডেমী প্রতি বছর অমর একুশের যেসব অনুষ্ঠানমালা এবং বইমেলার আয়ােজন করে তার। সবকটিই একুশের চেতনার ফল।
মাতৃভাষার বিকৃতি ও অবজ্ঞা
২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর প্রাচীন ভাষাগুলোর একটি বো ভাষায় কথা–বলা বোয়া সিনিয়র নামের একমাত্র মানুষটির মৃত্যু হয়েছে। আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারে বোয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হারিয়ে গেল বো ভাষা। আগামী ৪০-৫০ বছরের মধ্যে এমনি হারিয়ে যাবে শত শত ভাষা। বাংলা ভাষাকে বিভিন্ন দেশে যেভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে, যেভাবে টিভি, রেডিওতে বাংলা–ইংরেজি মিলিয়ে জগাখিচুড়ি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে, তাতে বাংলা ভাষার উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আজকাল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান যেন ছাত্রদের ইংলিশ শিখাতেই নির্মিত হয়েছে। অভিবাবকরা বেশি ঝুঁকে যাচ্ছে বাচ্চাদের ইংরেজি শিখানোর প্রতি। সেই কারণেই দোকানের বাংলা নাম ইংরেজিতে লেখা হয়, গ্রাহকের ইংরেজি জ্ঞান থাকুক আর না থাকুক ব্যাঙ্ক–বিমার কাগজপত্র ইংরেজিতেই লেখা হয়। বিপণি বিতানের পরিবর্তে আমরা দেখি শপিং মল, আদর্শ শহরের পরিবর্তে পাই মডেল টাউন। ইংরেজি অথবা হিন্দি ভাষা সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনে বাঙালির মাতৃভাষা কতটা নিরাপদ?
আপনাকে ধন্যবাদ।
thank for you.❤️❤️❤️
ধন্যবাদ।
Thanks
Thanks
রচনাটি আমার কাছে বেস্ট লেগেছে। অনেক তথ্য দিয়ে সুন্দরভাবে লিখা হয়েছে।
অসাধারণ হয়েছে। ধন্যবাদ রিমন ভাই
রিমন ভাইয়ের লিখা সবসময় ভালো লাগে।