ইসলাম ও জীবনবাংলা রচনা

বিশ্ব সভ্যতায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অবদান

1.8/5 - (26 votes)

বিশ্ব সভ্যতায় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবদান সম্পর্কে একটি রচনা লেখ।

বিশ্ব সভ্যতায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অবদান


ভূমিকা

প্রাক-ইসলামি যুগে আরবের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত লাজুক। গোটা সমাজ ডুবে ছিল যুদ্ধ, কলহ, হানাহানি, মারামারি, সামাজিক বিশৃঙ্খলার নৈরাজ্য পূর্ণ অবস্থার মধ্যে। গোটা সমাজ যখন এইসব পাপাচারে লিপ্ত ছিল ঠিক তখনই আবির্ভাব হল বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা) বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মহামানব। মহান প্রভু তাঁর অপার করুণায় বিশ্বনেতা হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ তথা নিখিল বিশ্বের করুণার ছবি হিসেবে প্রেরণ করেছেন। মানবীয় চরিত্রে যত মহৎ গুণ বৈশিষ্ট্য হতে পারে, অনিন্দ্য সুন্দরতম যা কিছু মহৎ গুণের কথা মানুষ কল্পনা করতে পারে, বিশ্বনবীর (সা) পূত জীবন চরিত্রে তার পূর্ণ সমাবেশ ঘটেছিল। বিশ্বনবী ছিলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাগুরু এবং শ্রেষ্ঠতম সংস্কারক। পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁর মত সকল ক্ষেত্রে এমন সফল সংস্কারক আর কাউকে দেখা যায় না। মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি বিশ্ব মানবতার জন্য অনিন্দ্য সুন্দর অনুসরণীয় শিক্ষা ও আদর্শ রেখে গেছেন। যা প্রতিটি যুগ ও শতাব্দীর মানুষের জন্য মুক্তির দিশারী হিসেবে পথ দেখাবে।

হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জীবনাদর্শ

হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জীবনাদর্শ

বিশ্বনবীর (সা) চরিত্রের সর্বোৎকৃষ্ট ভূষণ ছিল আল্লাহতে প্রগাঢ় বিশ্বাস এবং যাবতীয় বিপদে-বিষাদে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহতে নির্ভরতা ও ভরসা। মহানবীর (সা) জীবনাদর্শই ছিল আল-কুর’আন। হযরত আয়েশার (রা) ভাষায় : “তিনি ছিলেন আল-কুরআনের মূর্ত প্রতীক।” তিনি তাঁর জীবনে আল-কুরআনের প্রতিটি অনুশাসনের রূপায়ন ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। এ জন্য তাঁকে জীবন্ত কুরআনও বলা হয়।

বিশ্বনবীর (সা) ছিলেন ন্যায় পরায়ণ। তাঁর (সা) চোখে সকলেই ছিল সমান। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে তিনি যে অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর জীবনের মিশন। বিচারে তিনি ধনী-নির্ধন, আত্মীয়-অনাত্মীয়, শত্রু-মিত্র, স্বজাতি-বিজাতি, অভিজাত-ইতর, নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত প্রভৃতির মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করেননি। চুরির অপরাধে অভিজাত কুরাইশ বংশীয়া এক রমণীর হাত কাটা নিয়ে কথা উঠলে তিনি কঠোর ভাষায় ঘােষণা করলেন : “যদি আমার মেয়ে ফাতিমা (রা) চুরি করতাে, আল্লাহর শপথ! আমি তার হাতও কেটে দিতাম।”

হযরত মুহাম্মদ (সা) ছিলেন মহান আমানতদার ও বিশ্বস্ততার মূর্তপ্রতীক। তাঁর অকৃত্রিম বিশ্বস্ততার গুণে বিমুগ্ধ আরব তাঁর নিকট তাদের ধন-সম্পদ, সােনা-দানা গচ্ছিত রাখতাে। এবং চাহিবামাত্র তার মালিককে যথার্থভাবে প্রত্যার্পণ করতেন। এ মহতী গুণের কারণেই মানবতার চরম দুর্দিনেও তিনি শক্ৰমিত্র সকলের নিকট ‘আল-আমীন’ ও ‘আল-সাদিক’ এর দুলর্ভ উপাধিতে বিভূষিত হন। ওয়াদা ও অংগীকার পালন ওয়াদা পূরণ বা অংগীকার পালন করা নবী চরিত্রের (সা) অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রতিশ্রুতি বা অংগীকার পালন না করা তিনি জঘন্যতম পাপ বলে অভিহিত করেন। তিনি ঘােষণা করেন- “যে অংগীকার পালন করেনা তার ধর্ম নেই।” 

জীবনের কোন কঠিন অবস্থায়ও তাকে মিথ্যার ছোঁয়া স্পর্শ করতে পারেনি। সেই শৈশব হতে তিনি বর্বর আরবের বুকে সততার গুণে ‘আল্-সাদিক’ বলে সকলের প্রিয় ও আস্থাভাজন ছিলেন। তিনি সত্যবাদিতা সম্পর্কে বলেন- “সত্য মানুষকে মুক্তি দেয়, মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে।”

ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা ছিল মহানবীর (সা) চরিত্রের অলংকার। ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিন বহু বাধা-বিঘ্ন, অত্যাচার, লাঞ্ছনাগঞ্জনা ও অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করেছিলেন। চরম বিপদের মুহূর্তেও তিনি এতটুকু ধৈর্য হারা হননি। তিনি মহান প্রভুর ওপর অটল বিশ্বাস ও ভরসা রেখে অবিচল ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে চরম কঠিন মুহূর্তের মােকাবেলা করেছেন। তিনি ধৈর্যের ব্যাপারে ঘােষণা করেন – “ধৈর্যের চেয়ে অধিক উত্তম-অধিকতর কল্যাণকর জিনিস আর কিছুই কাউকে দান করা হয়নি।”

তিনি (সা) সকলের সাথে অতীব কোমল ব্যবহার করতেন। জীবনে কোন দিন তিনি কারাে সংগে রূঢ়-আচরণ কিংবা কটু বা শক্ত কথা দিয়ে এতটুকুন কষ্টও দেননি। দাসদাসী এমনকি, চরম শত্রুরও তাঁর বিনম্র ব্যবহারে বিমুগ্ধ ছিলাে।

মূলত হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গুণাবলী দিয়ে সকলের মন জয় করেছেন। আর এটার দরকার ছিল কারণ মানুষের মন জয় করার মধ্য দিয়ে তিনি (সা) সকলের কাছে প্রিয় ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিলেন। 

হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর ধর্মীয় শিক্ষা

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাগুরু এবং শ্রেষ্ঠতম সংস্কারক। ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়। বিশ্বনবীর (সা) আবির্ভাবকালীন সময়ে এবং তার পূর্বে বিশ্বের সর্বত্র চলছিল ধর্মীয় অবস্থার দুর্দিন। কোথাও তাওহীদের শিক্ষা ছিল না। ব্যক্তিপূজা, প্রকৃতিপূজা, জড়পূজা এবং কল্পিত দেবদেবীর পূজার তাণ্ডব লীলায় সর্বত্র মানবতার চির উন্নত শির নত হচ্ছিল তুচ্ছ জিনিসের পাদমূলে। মানবতা ও ধর্মের এহেন শােচনীয় দুরাবস্থার সন্ধিক্ষণে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা বিশ্বগুরু ও সংস্কারক হিসেবে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে আবির্ভূত করেন। ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে তার সংস্কার ও অবদান বিশ্বের ইতিহাসে চিরঅম্লান হয়ে থাকবে।

সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে বিশ্বস্রষ্টা মহান একক সত্তা আল্লাহ তা’আলার তাওহীদ বা একাত্ববাদের শিক্ষা পৃথিবীর কোথাও ছিলনা। মহানবী (সা) সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে আহ্বান করলেন মহান স্রষ্টার একত্ববাদের দিকে। ঘােষণা করলেনঃ

আল্লাহ তা'আলার তাওহীদ বা একাত্ববাদের শিক্ষা

আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা

এ মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, আইনদাতা ও নিয়ন্তা একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বল আলামীন। তিনিই সর্বময় ক্ষমতা ও নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী। একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহরই রয়েছে সার্বভৌম ক্ষমতা ও প্রভূত্ব। মহানবী (সা) কে আল্লাহ তার সার্বভৌমত্ব ঘােষণা করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন : “সার্বভৌমত্বের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ নেই।” তিনি মহানবীকে (সা) আরাে ঘােষণা করতে বলেনঃ 

আল্লাহর সার্বভৌমত্ব

শিরকতন্ত্রের অবসান

মহানবী (সা) যুগ যুগ ধরে লালিত পৌত্তলিকতা ও শিরকতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত হানেন। অসংখ্য দেব-দেবতা ও মূর্তি রক্ষিত পবিত্র কা’বা গৃহ আবার পুতপবিত্র হয়ে মহান আল্লাহর তাওহীদের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করলেন। বহুকালের ওহীজ্ঞান বর্জিত নিরক্ষর, বর্বর আরব জাতি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তাওহীদের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তাদের শিক্ষাগুরু মানবতার মূর্ত প্রতীক মহানবীর (সা) আদর্শে অনুপ্রাণীত হয়ে তাওহীদে উজ্জীবিত জাতিতে পরিণত হলাে। জাহিলী যুগে লােকদের বিশ্বাস ছিল, সমাজে যারাই প্রভাবশালী ক্ষমতাবান ও বিত্তশালী তারাই শ্রেষ্ঠ তারাই সম্মানিত। হযরত মুহাম্মদ (সা) তাদের এহেন ভ্রান্ত ধারণার চির অবসান ঘটিয়ে আল কুরআনের ঘােষণা শােনালেনঃ

 যাযকতন্ত্রের অবসান

অন্ধকার যুগে একশ্রেণীর লােকদের ধারণা ছিল, ভাল কাজ করলেই স্বর্গে যাওয়া যাবে না, বরং স্বর্গের চাবিকাঠি একমাত্র ধর্মর্যাযকদের হাতে। তাদের খুশী করতে পারলে স্বর্গে যেতে কোন অসুবিধা হবেনা- যত পাপই করা হােকনা কেন । এহেন অলীক ধারণার অবসান ঘটিয়ে নবী করীম (সা) কুরআনের বাণী শােনালেন – “সেদিন কেউ কারাে কোন উপকারে আসবেনা; একে অন্যের কোন বােঝাও গ্রহণ করবেনা। এমনকি, কেউ কারাে জন্য কোনরূপ সুপারিশ করলেও তা গ্রহণ করা হবেনা।” 

মুক্তির দিশারী নবী মুহাম্মদ (সা) অজ্ঞ যুগের আরেকটি অন্ধ বিশ্বাস- ‘জন্মান্তরবাদ’ (মানুষ মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হয়ে পৃথিবীতে পূর্বকৃত কর্মফল ভােগ করার জন্য আবার আগমণ করবে) বিদূরিত করে ঘােষণা করলেন- “কোন মানুষই মৃত্যু বরণের পর পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসবেনা। বরং শেষ বিচার দিবসে হিসেব নিকেশ দিতে পুনরুত্থিত হবে এবং স্বীয় কর্মফল অনুসারে জান্নাত বা জাহান্নামে অনন্তকাল অবস্থান করবে।” 

পারলৌকিক জীবনে বিশ্বাস

মহানবীর (স) আগমন পূর্ব যুগে মানুষেরা মৃত্যুর পর হাশর, পুনরুত্থান, কিয়ামত, বেহেস্ত, দোযখ, তথা পারলৌকিক জীবনে বিশ্বাস করতাে না। মহানবী (সা) শিক্ষা দিলেন, এ দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়। এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। মৃত্যুর পর সবাই পুনরুত্থিত হবে এবং কৃতকর্মের ফলাফল ভােগ করতে হবে।

সকল নবী-রাসূলের প্রতি বিশ্বাস

মহাবনী (সা) শিক্ষা দিলেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ও সৎ পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অগণিত নবীরাসূল প্রেরণ করেছেন। সকল নবী-রাসূলের প্রতি সমানভাবে ঈমান আনতে হবে; কারাে ব্যাপারে কোন পার্থক্য করা চলবে । কুরআনের ভাষায় তিনি ঘােষণা করেনঃ

সকল নবী-রাসূলের প্রতি বিশ্বাস

আল্লাহর ইবাদত

মহানবী (সা) মানব জাতিকে শিক্ষা দিলেন আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকারের সাথে সাথে আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়ােগ করতে হবে। যাবতীয় গাইরুল্লাহর ইবাদত থেকে মানব জাতিকে তিনি এক আল্লাহ ইবাদতের দিকে নিয়ে আসলেন। মহানবী (সা) মহান স্রষ্টার ইবাদত-বন্দেগীতে যেন জীবনব্যাপী ব্যাপৃত থাকতে পারে সে ব্যাপারে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। ইসলামী শরীয়তের মূল শিক্ষা কালিমা, নামায, রােযা, হজ্জ, যাকাত সম্পর্কে তাদের এমনিভাবে শিক্ষা দিলেন- যা প্রতিটি বিশ্বাসীর জীবনকে এক নতুন আলাের পথের সন্ধান দিলাে।

নামাযের শিক্ষা

মহানবী (সা) নামাযের মাধ্যমে অত্যন্ত বিনয়াবনতভাবে মহান স্রষ্টার সমীপে তারই সৃষ্টিজীব হিসেবে আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করার শিক্ষা দিয়েছেন। নামায মানুষকে যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার ও পাপাচার থেকে রক্ষা করে সত্যের পথে পরিচালিত করতে সহায়তা করে।

রােযার শিক্ষা

মহানবী (সা) মানবীয় কু-প্রবৃত্তিগুলাে দমন করার জন্য এবং আল্লাহর প্রতি ভালবাসা ও তাকওয়া জাগ্রত করার লক্ষ্যে একমাসের দীর্ঘ সিয়াম সাধনার শিক্ষা দান করেন। এ সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে খােদাভীতি পরস্পর হামদরদী এবং দায়িত্বানুভূতি সৃষ্টি হয়।

হজ্জের শিক্ষা

একজন ভক্তপ্রাণ বান্দা মহান আল্লাহর প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে তাঁর দরবারে হাজির হওয়ার মানসে পবিত্র কা’বা গৃহের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করার মহড়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহ ও বান্দার সাথে সুনিবিড় সম্পর্কের প্রমাণ দেয়। তা ছাড়া এ মহাসম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের অনুপম বন্ধনের সৃষ্টি করে আর সকলকে শিক্ষা দেয় একতা, ঐক্য, সাম্যের মূলমন্ত্র-যা চির অক্ষয়, চির-অবিনশ্বর।

যাকাতের শিক্ষা

মহানবী (সা) যাকাতের শিক্ষা দিয়ে একদিকে যেমন ধন-সম্পত্তিকে পূতঃপবিত্র ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করার ব্যবস্থা করেছেন তেমনি অভাবী ও নিঃস্ব মানুষের অভাব মােচনের মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে সম্পর্কে সেতু বন্ধন সৃষ্টি করে অভাবনীয় শান্তি-শৃংখলা ও সম্প্রীতির সমাজ গড়ার ব্যবস্থা করেছেন।

ইসলামই মানবতার মুক্তি সনদ

মানবতার মহানবী (সা) মানব জাতিকে শিক্ষা দিলেন ইসলামই বিশ্ব মানবতার একমাত্র মুক্তি সনদ। মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত সকল দিক ও বিভাগে ইসলামী দিক-নির্দেশনা রয়েছে। যার অনুসরণের মাধ্যমে মানুষ পেতে পারে স্বর্গীয় সুখ-শান্তিরধারা এ ধূলির ধরণীতে থেকেই। মহানবী (সা) ধর্মীয় শিক্ষা ও সংস্কারের ক্ষেত্রে যে অতুলনীয় অবদান রেখে গেছেন যার নজীর বিশ্ব ইতিহাসে আর কারাে জীবনে মিলেনা। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যার ধর্মীয় শিক্ষা চির সুন্দর, নিত্য-সত্য নির্ভেজাল ও অম্লান দীপ্তিতে সদা দেদীপ্যমান- যা সর্বকালের সর্বদেশের বিশ্ব মানবতার একমাত্র মুক্তির গ্যারান্টি দিতে পারে।

হযরত মুহাম্মদ (সা) এর অর্থনৈতিক শিক্ষা

ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে খ্রিস্টীয় ৬শ’ শতাব্দী বিশ্ব-মানবতার এক দুর্যোগপূর্ণ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়। গােটা বিশ্বসহ আরবের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট অত্যন্ত শােচনীয় অবস্থায় নিপতিত ছিল। মরুময় আরবে কৃষির মাধ্যমে আয়-উপার্জন ছিল প্রয়ােজনের তুলনায় নেহায়েত সামান্য। মরুবাসী আর বেদুইনরা তাই পশুচারণ, লুটতরাজ এবং শহরাঞ্চলে ছােটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবন ধারণ করত। জাতীয় সম্পদের বেশীরভাগই বিত্তশালী ও সুদখাের ইহুদীদের হাতে পুঞ্জীভূত ছিল। তাদের চড়া ও চক্রবৃদ্ধিহারের সুদ ব্যবস্থার কারণে সর্বস্বান্ত আরববাসীরা যখন দিশেহারা এমনি এক যুগ সন্ধিক্ষণে হযরত মুহাম্মদ (সা) নবী ও মানবতার মুক্তির দিশারী হিসেবে আবির্ভূত হন। মহানবী (সা) অর্থনীতির ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করে একটি চিরকল্যাণমুখী সুষম অর্থব্যবস্থা চালু করেন। যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক শােষণ-নির্যাতন বন্ধ হয়ে একটি আদর্শ সমাজ সভ্যতা গড়ে ওঠে।

অর্থোপার্জন নিয়ন্ত্রণ

মহানবী (সা) আল্লাহর নির্দেশ সর্বপ্রথম সম্পদ উপার্জনের পন্থাকে নিয়ন্ত্রণ করলেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর নির্দেশ :

অর্থোপার্জন নিয়ন্ত্রণ

এ ঘােষণা দ্বারা অর্থ-আয়ের অবৈধ উৎসমূহকে যেমন অপহরণ, চুরি, ডাকাতি, লুটতরাজ, হাইজাক, প্রতারণা দ্বারা অর্থ উপার্জন ইত্যাদি বন্ধ করে দিলেন। ঘুষকে অবৈধ ঘােষণা করে নবীজি (সা) বলেন – “ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামী।” শুধু তাই নয়, যারা প্রতারণা করে অন্যের সম্পদ লুট করে তারা মহানবী (সা) এর উম্মত নয়। 

  • সুদকে হারাম ঘোষণাঃ সুদ একটি জঘন্য সামাজিক অর্থনৈতিক অপরাধ। এর মাধ্যমে ধনী আরাে ধনী হয় এবং গরীব আরাে গরীব হয়। আল্লাহ তায়ালা তাই এ অমানবিক অর্থ-উপার্জনের কু-প্রথাকে হারাম ঘােষণা করে বলেনঃ “আর আল্লাহ তায়ালা সুদকে  হারাম ঘোষণা করেছেন”
  • হালাল উপার্জনকে উৎসাহিতকরণঃ হালাল ও বৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনকে উপৎসাহিত করা হয়। সৎভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যকে হালাল ঘােষণা করা হয়। যেমন মহান আল্লাহর বাণীঃ
    মহানবী (সা) কায়িক পরিশ্রম করে কিংবা নিজ চিন্তা-ভাবনা ও মস্তিষ্ক খাটিয়ে বৈধভাবে অর্থ উপার্জনকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি ঘােষণা করেনঃ “নিজ শ্রমে ব্যবসায়ী কিয়ামতে শহীদদের সাথে অবস্থান করবেন।” মহানবী (সা) শ্রমের মর্যাদা এবং শ্রমিকের অধিকার স্বীকার করে ঘােষণা করেনঃ “যারা কাজ করে জীবিকা উপার্জন করে তারা তােমাদের ভাই। তােমরা যা খাও, তাদেরকে তাই খেতে দেবে। তােমরা যা পরিধান কর তাদেরকেও তাই পরিধান করতে দেবে।”  মহানবী (সা) আরাে ঘােষণা করেনঃ  “সর্বোত্তম আমল হলাে বৈধ পন্থায় উপার্জন করা।”

অর্থ-ব্যয় নিয়ন্ত্রণ

মহানবী (সা) অর্থোপার্জনের উৎসগুলাে নিয়ন্ত্রণ করার পর অর্থ ব্যয়ের খাতগুলােও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেন।

  • অপব্যয় রােধঃ মহানবী (সা) ঘােষণা করলেন- বৈধভাবে উপার্জিত অর্থ-সম্পদও নিজের খেয়াল খুশীমত ব্যয় করা যাবে না। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ  “তােমরা পরিমিতভাবে খাও ও পান কর; কিন্তু অপব্যয় করাে না।” কারণ, অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। এ ঘােষণার সাথে সাথে আমােদ-প্রমােদ ও বিলাস-ব্যসনে অর্থ ব্যয় করা নিষিদ্ধ হয়ে গেল। সে সময় মদ-জুয়া ইত্যাদি গহিত ও সমাজ বিরােধী কাজে অর্থ ব্যয় করে তারা অর্থনৈতিক অবকাঠামাে ভেঙ্গে দিয়েছিল। মহানবী (সা) এ সকল অবৈধ খাতে অর্থ ব্যয়কে নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। এ মর্মে কুরআনে ঘােষিত হয়েছে “হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী এবং ভাগ্য নির্ণায়ক বাজি (লটারী) ঘৃণ্য শয়তানের কাজ। সুতরাং তােমরা এ সকল বর্জন কর- যাতে তােমরা কল্যাণ লাভ করতে পার।”
  • অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের নির্দেশঃ সমাজে যারা অর্থনৈতিকভাবে অক্ষম, দুঃস্থ ও বিপন্ন, যেমন গরীব-মিসকিন, দুঃখী, ইয়াতীম পথিকদেরকে যথাসম্ভব অর্থনৈতিক সাহায্য-সহযােগিতা করতে বলা হয়েছে। সদকায়ে জারিয়াহ বা জনকল্যাণমূলক খাতে যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, স্কুল, কলেজ, চিকিৎসালয়, সেতু, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি নির্মাণে অর্থ ব্যয় করার জন্যও মহানবী (সা) উৎসাহিত করেছেন।

অর্থসঞ্চয়ে নিষেধাজ্ঞা

মানবতার দরদী বন্ধু নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর অথনৈতিক বিপ্লবের উল্লেখযােগ্য আরাে একটি দিক হচ্ছে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বিপন্ন মানবতার কল্যাণে তথা আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় না করে কেবল সঞ্চয় তহবিল গড়া যাবেনা। কৃপণের মত সম্পদ কুক্ষিগত করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তােলা যাবে না। আল্লাহর পথে ব্যয় না করে সম্পদকে যারা সঞ্চয় করে তাদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ মর্মে মহান আল্লাহর বাণী- “আর যারা সােনা-রুপা , অর্থ, ধন-সম্পদ সঞ্চয় করে রাখে অথচ আল্লাহর পথে খরচ করে না তাদেরকে পীড়াদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন।”

অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ন

মহানবী (সা) আল-কুরআনের শিক্ষার আলােকে একটি কল্যাণমূলক ও সুষম অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করেছেন। এ ইসলামী অর্থনীতিকে পাঁচটি চিরন্তন বিভাগে রূপদান করা হয়েছে। যেমনঃ

১) যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনঃ যাকাত হচ্ছে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। এটা মুসলিম ধনীদের ওপর ধার্যকৃত দরিদ্র-কর। যাকাতের অর্থ আল্লাহ নির্দেশিত ৮টি খাতে ব্যয় করা হয়। খাত আটটি হচ্ছে (ক) দারিদ্র দূরীকরণ (খ) মিসকিনদের (নিঃস্ব) অভাব মােচন, (গ) ঋণ মুক্তি, (ঘ) নও মুসলিম পুনর্বাসন, (ঙ) বিপন্ন প্রবাসী মুসাফিরের সাহায্য, (চ) প্রশাসনিক ব্যয়, (ছ) দাসত্বের শৃংখল মুক্তি, (জ) আল্লাহর পথে যুদ্ধ-জিহাদে।

২) খারাজ ও উশরঃ ভূমি কর ও ফসল কর ব্যবস্থা চালু : খারাজ বা ধার্যকৃত ভূমিকর যা সাধারণত সামরিক বিভাগে ব্যয় করতে হয় আর উশর বা ফসলকর যাকাতের খাতে ব্যয়িত হবে। 

৩) গণিমাত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদঃ যুদ্ধলব্ধ অর্থ-সম্পদ, যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক উপায় উপকরণ এবং স্থাবর অস্থাবর সম্পদ যা পাঁচভাগে বণ্টিত হবে। এর চার ভাগ মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টিত হবে এবং এক ভাগ বায়তুল মালে জমা হবে। যা রাষ্ট্রীয় প্রয়ােজনে ব্যয়িত হবে।

৪) জিযিয়া কর চালুঃ অমুসলিম নাগরিকদের উপর ধার্যকৃত নিরাপত্তা কর যা সামরিক বিভাগের খরচ হবে। 

৫) আল-ফাইঃ এটা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি থেকে উৎপাদিত আদায়কৃত কর, যা অভাবী জনসাধারণ ও দেশের কল্যাণকর কাজে ব্যয় করা হবে।
৬) সাদকাহ ও ফিতরাঃ রামযান মাসে সামর্থ্যবান মুসলিমের ওপর “সাদাকাতুল ফিতর” বাধ্যতামূলক করে দিয়ে অভাবীদের আনন্দ উৎসবের খরচ যােগান দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এবং সাদকা বা সাধারণ দান করার প্রতিও মুসলিমদেরকে অনুপ্রাণিত করা হয়। যাতে দরিদ্রতার অভিশাপ হতে সমাজ-সভ্যতা বাঁচতে পারে ।

হযরত মুহাম্মদ (সা) এর রাজনৈতিক শিক্ষা

পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালােচনা করলে প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, রাসূলুল্লাহর আবির্ভাবের পূর্বকালীন যুগে গােটা বিশ্বসহ আরবের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত নৈরাজ্যমূলক, বিশৃংখলাপূর্ণ এবং ভয়াবহ। গােত্ৰতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জোর যার মুল্লুক তার এ সন্ত্রাসবাদী নীতিতেই তদানীন্তন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ হত। গােত্রকলহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারামারি, হানা-হানি লেগেই থাকত। কেন্দ্রীয় শাসন বা নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু ছিল না। রাজনৈতিক এমনি শােচনীয় দুর্দিনে আবির্ভূত হলেন মানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ (সা)। তিনি নৈরাজ্যপূর্ণ আরব ভূমিতে যে অবিস্মরণীয় রাজনৈতিক বিপ্লব সাধন করেছিলেন তা বিশ্বের ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

মানব গড়া আইনের অবসান ঘটিয়ে আল্লাহ্‌র আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা) গোটা আরব উপমহাদেশে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন। আল্লাহ্‌র বিধান অনুযায়ী শাসনকার্য প্রণয়ন করেছিলেন। মহানবী (সা) আল-কুরআনকেই ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি ঘােষণা করেন। তিনি এরই নীতি ও আদর্শের নিরিখে রাষ্ট্র পরিচালনার বিধি-বিধান প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেন। লিখিত সংবিধান বা সনদ প্রণয়ন মহানবী (সা) আল-কুরআনের নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে একটি লিখিত শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। ইসলামের ইতিহাসে একে বলা হতাে ‘মদীনার সনদ’। আর এটাই পৃথিবীর প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র । এ সনদে ৪৭টি ধারা ছিল। এসনদে ধর্ম বর্ণ-গােত্র নির্বিশেষে সকলের ন্যায্য অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। মহানবী (সা) কুরআনের বিধান, স্বীয় সুন্নাহ এবং সাহাবীগণের পরামর্শ অনুসারে রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।

মহানবী (সা) অমুসলিম নাগরিকদের জান-মাল, মান-সম্মান এবং নিজস্ব ধর্মাচার পালনের পূর্ণ অধিকার ও নিরাপত্তা বিধান করেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলের জন্য রাষ্ট্রীয় মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করেন। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লােকদের নিয়ে এক সাথে শান্তিতে বসবাস করার প্রচেষ্টা মানব ইতিহাসে এই প্রথম। পাশ্চাত্য মনীষী স্মীথ যথার্থই বলেছেন, “পৃথিবীতে যদি কেউ অমুসলিমদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠার গৌরব দাবী করতে পারে, তবে তিনি একমাত্র হযরত মুহাম্মাদ (স) ছাড়া আর কেউ নন।”

জাহিলী যুগে অন্যায়-অবিচার, যুলুম ও অপরাধ প্রবণতার গঠনমূলক কোন বিচার বা শাস্তির ব্যবস্থা ছিলনা। দুর্বলরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছিল। হযরত মুহম্মদ (সা) সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে সমাজ হতে অপরাধ প্রবণতা চিরতরে বিলােপ করেন।

প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে শান্তিতে বসবাস করার লক্ষ্যে সম্পূর্ণ সৎ ও নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেন। “যুদ্ধ নয় শান্তি” এ ছিল তার পররাষ্ট্র নীতি। এ লক্ষ্যে তিনি বিশ্বের ছােট বড় রাষ্ট্র এবং গােত্রের সাথে সন্ধি ও চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন। ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’‘মদীনা সনদ’ ইত্যাদি এর প্রমাণ।

হযরত মুহাম্মদ (সা) এর সামাজিক শিক্ষা

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবের পূর্ব যুগে গােটা বিশ্বসহ আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত জঘন্য ও শােচনীয়। গােত্র-কলহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারামারি, হানাহানি, সামাজিক বিশৃক্মখলার নৈরাজ্যপূর্ণ অবস্থার মধ্যে নিপতিত ছিল গােটা সমাজ। সামাজিক সাম্য, শৃক্মখলা, ভদ্রতা, সৌজন্যবােধ, নারীর মর্যাদা বা মানব মর্যাদার কোন বালাই ছিল না। জঘন্য দাসত্ব প্রথা, সুদ, ঘুষ, জুয়া, মদ, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, পাপাচার, অন্যায়-অনাচারের চরম তাণ্ডবতায় সমাজ কাঠামাে ধ্বসে পড়েছিল। এমনি এক দুর্যোগপূর্ণ যুগ সন্ধিক্ষণে মহানবী (সা)-এর আবির্ভাব। মহানবী (সা) ঐ সকল যাবতীয় অরাজকতার মূলােৎপাটন করে যে বৈপ্লবিক সামাজিক সংস্কার সাধন করে একটি সুন্দর শান্তিময় আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা সত্যি বিস্ময়ের উদ্রেক করে। বিশ্বের ইতিহাসে তাঁর মত এমন সংস্কারক আর দৃষ্ট হয় না। বিশ্বের বড় বড় মনীষীগণ মহানবী (সা) প্রবর্তিত সামাজিক সংস্কারসমূহকে এক অতীব স্মরণীয় বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সামাজিক সংস্কারে মহানবীর (সা) বৈপ্লবিক কর্মসূচী ছিল নিম্নরূপঃ
  • ধর্মীয় ক্ষেত্রে নানা অনাচার-পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কারের মূলােৎপাটন করে সমগ্র সমাজকে এক আল্লাহতে বিশ্বাসী তাওহীদের আদর্শে সমাজকে নবরূপে রূপায়িত করেন। সকল ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বের উৎস একমাত্র আল্লাহকে মেনে নিয়ে সমাজের সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার ব্যবস্থা করেন। 
  • সামাজিক সাম্য, অকৃত্রিম ভ্রাতৃত্ব এবং বিশ্ব মানবতার ভিত্তিতে তিনি যে উন্নত আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোন নজীর নেই। তিনি অন্ধ আভিজাত্যের গৌরব ও বংশ মর্যাদার মূলে কুঠারাঘাত করেন। তিনি মানুষে মানুষে সকল প্রকার অসাম্য ও ভেদাভেদ দূরীভূত করে মানবতার অত্যুজ্জ্বল আদর্শে সমাজ বন্ধন সুদৃঢ় করেন।
  • তৎকালীন আরব সমাজে বিভিন্ন গােত্রে গােত্রে দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগেই থাকত। সামান্য অজুহাতে ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা বেজে উঠত। আর তা দীর্ঘকাল যাবত দাবানলের মত জ্বলতে থাকত । রক্তপাত ও লুণ্ঠন ছিল তাদের নিত্য পেশা। মহানবী (সা) এ সকল অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রাক-নবুয়ত হিলফুল ফুযুল এবং পরে মদীনা সনদের মাধ্যমে সমাজে শান্তি আনয়নে সক্ষম হন।
  • শুধু জন্মগত, বংশগত কিংবা ভাষাগত বা আঞ্চলিকতার বিচারে কোন মানুষের মর্যাদা ও প্রাধান্য মহানবী (সা) স্বীকার করতেন না। তাঁর ভাষায়- “সকল মানুষ সমান। মানুষের মধ্যে উৎকৃষ্ট এবং শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি যিনি আল্লাহর প্রতি সর্বাধিক অনুগত এবং মানুষের সর্বাধিক কল্যাণকামী।” এ নীতির ভিত্তিতে মহানবী (সা) সমাজকে ঢেলে সাজান।
  • ঘৃণ্য দাস প্রথার মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেন। জাহিলী যুগে পণ্য দ্রব্যের মত দাসদাসীও হাটে বাজাতে বেচাকেনা হত। তাদের কোন স্বাধীনতা ও মর্যাদা ছিল না। মহানবী (সা) বহু যুগ ধরে প্রচলিত এ অমানবিক প্রথা উচ্ছেদ করে তাদেরকে সামাজিক মর্যাদা দান করেন। তিনি কৃতদাস আযাদ করে পুত্র বরণ করেন এবং পরবর্তীতে যায়েদকে মুসলিমদের সেনাপতিত্ব দান করেন। তিনি হাবশী কৃতদাস বিলালকে ইসলামের প্রথম মুয়াযযিন নিযুক্ত করেন। তিনি ঘােষণা করেন “দাস দাসীদের মুক্তিদানের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কার্য আল্লাহর কাছে আর কিছুই নেই।”
  • মহানবী (সা)-এর গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংস্কারের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি। ইসলাম পূর্ব যুগে নারীর কোন সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার ছিল না। মহানবী (সা) সর্বপ্রথম নারীজাতির আর্থ-সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করে সম্মান ও গৌরবের আসনে সমাসীন করেন। তিনি মহান আল্লাহর সাম্যের বাণী প্রচার করে বলেনঃ “পুরুষের নারীর ওপর যতটা অধিকার আছে, নারীরও পুরুষের ওপর ততটা অধিকার রয়েছে।” স্ত্রীদের প্রতি তিনি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দেন। মায়ের মর্যাদা বৃদ্ধি করে তিনি বলেন- “মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।” এভাবে তিনি নারী জাতির মুক্তির অগ্রনায়ক হিসাবে বিশ্বের বুকে খ্যাতিমান হয়ে আছেন।
  • মহানবী (সা) ভিক্ষাবৃত্তি মােটেই পছন্দ করতেন না। তিনি মানবতার শ্রেষ্ঠ হাতকে খাট করার ঘাের বিরােধী ছিলেন। সকলকে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করার পরামর্শ দেন। “নবীর শিক্ষা করােনা ভিক্ষা মেহনত করাে সবে”-এ ছিল তাঁর উদাত্ত আহ্বান।
  • মহানবী (সা) সমাজ থেকে যাবতীয় সামাজিক অশ্লীলতা, অনাচার, পাপাচার, ব্যভিচার, মদ, জুয়া, সুদ, ঘুষ, তথা যাবতীয় চরিত্র বিধ্বংসী কার্যকলাপ উচ্ছেদ করে এক সুস্থ কল্যাণময় পবিত্র সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।
  • মহানবী (সা) আর্থ-সামাজিক অসাধুতা, প্রতারণা, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, হঠকারিতা, মজুদদারী, কালােবাজারী, ইত্যাকার যাবতীয় অনাচার হারাম ঘােষণা করেন। তিনি এগুলাে সমাজ থেকে উচ্ছেদ করেন এবং একটি সুন্দর পবিত্র সমাজ ব্যবস্থা উপহার দেন।

উপসংহার

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা)- এর প্রতিটি বাণী, কাজ-কর্ম, কথা-বার্তা, আচরণ এবং তার জীবনের প্রতিটি ঘটনা ও তৎপরবর্তী বিশ্ববাসীর জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ, উৎকৃষ্ঠতম অনুসরণীয়, অনুকরণীয় আদর্শ। একটি অনুপম আদর্শ ও চরিত্রে যতগুলাে মহৎগুণ প্রয়ােজন মহানবীর (সা) চরিত্রে তার সবগুলােরই অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি তার উৎকৃষ্টতম আদর্শের মাধ্যমে বিশ্ব মানবতাকে সত্যের দিকে আকৃষ্ট করেছেন। তাঁর অনুপম আদর্শে বিমুগ্ধ মানুষ দলে দলে ইসলামের স্নিগ্ধ শীতল পতাকাতলে সমবেত হয়ে তার আদর্শে নিজেদের জীবনকে স্বর্ণোজ্জ্বল করে গড়ে তুলেছিল। মানব জীবনের প্রতিটি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি বিশ্ব মানবতার জন্য শ্রেষ্ঠতম ও অনিন্দ্য সুন্দর অনুসরণীয় আদর্শ উপহার দিয়ে গেছেন, যা প্রতিটি যুগ ও শতাব্দীর মানুষের জন্য মুক্তির দিশারী হিসেবে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button