বাংলা রচনা

রচনাঃ চরিত্র (১৫ পয়েন্ট) JSC SSC HSC

4.1/5 - (52 votes)

চরিত্র / জীবনগঠন ও চরিত্র / চরিত্র ও মানব-জীবন / চরিত্রই সম্পদ / সৎ চরিত্র
বিষয়ঃ রচনা
শ্রেণিঃ
৬ ৭ ৮ ৯ ১০ ১১ ১২ / SSC HSC JSC

ভূমিকা

কোনাে ব্যক্তির আচরণ ও আদর্শের উৎকর্ষবাচক গুণ বােঝাতে চরিত্র শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ‘চরিত্র’ বলতে আমরা বুঝি কথাবার্তায়, কাজ-কর্মে এবং চিন্তা-ভাবনায় একটি পবিত্র ভাব। মানুষকে তা ন্যায়পথে, সৎপথে পরিচালিত করে। মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট গুণাবলির মধ্যে চরিত্র অন্যতম। এর মধ্যে মানুষের প্রকৃত পরিচয় নিহিত। চরিত্রই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। তাই বিখ্যাত ইংরেজ লেখক স্যামুয়্যাল মাইলস তাঁর ‘Character‘ প্রবন্ধে বলেছেনঃ

“The crown and glory of life is character.”


চরিত্র ভালাে হলে মানুষ ভালাে জানে। আর চরিত্র খারাপ হলে মানুষ খারাপ বলে। একজন মানুষের চরিত্র তার জীবনের সবকিছুকে প্রতিফলিত করে এবং সবকিছুর আয়নাস্বরূপ। চরিত্র ঠিক তাে জীবনের সব ঠিক এ কথা সবাইকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে।

চরিত্র কি

চরিত্র শব্দটি ইংরেজি ‘Character’ শব্দের প্রতিশব্দ হলেও মূলত তা এসেছে গ্রিক থেকে। আদিতে এর অর্থ ‘চিহ্ন’ হলেও প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে থেকে শব্দটি ব্যক্তির আচরণ ও আদর্শের উৎকর্ষবাচক গুণ বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। একজন মানুষের আচরণ ও আদর্শগত বৈশিষ্ট্যকে চরিত্র বলে। মানুষের চরিত্রের দুটি বিপরীত বৈশিষ্ট্য রয়েছে কেউ সচ্চরিত্র, কেউ দুশ্চরিত্র। যে মানুষের চরিত্র নানা মহৎ ও সৎগুণের আধার, তিনি সচ্চরিত্র। আর কারও চরিত্র লুকানাে পশুত্বের আধার হলে সেই চরিত্রই দুশ্চরিত্র। সচ্চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি সমাজের শ্রেষ্ঠ অলংকার। চরিত্রকে জীবনের মুকুট বলা হয়।

মুকুট যেমন সম্রাটের শােভা বর্ধন করে, তেমনি চরিত্রও মানবজীবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। সততা, নীতিনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, সহৃদয়তা, সংবেদনশীলতা, ক্ষমা, উদারতা, ধৈর্য, কর্তব্যপরায়ণতা, গুরুজনে ভক্তি, মানবিকতা, আত্মসংযম ইত্যাদি সচ্চরিত্রের লক্ষণ। যিনি চরিত্রবান তিনি কখনাে ন্যায়-নীতি, আদর্শ ও সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হন না, দুর্নীতি ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না। তিনি সযত্নে ক্রোধ, অহংকার, রূঢ়তা ইত্যাদিকে পরিহার করেন। তিনি হন সত্যবাদী, সংযমী ও ন্যায়পরায়ণ। যাবতীয় মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে বলে চরিত্রবান মানুষ জাতির সম্পদ।

চরিত্রের উপাদান বা বৈশিষ্ট্য

সততা, সত্যনিষ্ঠা, প্রেম, পরােপকারিতা, দায়িত্ববােধ, শৃঙ্খলা, অধ্যবসায় ও কর্তব্যপালন হল চরিত্রের মৌলিক উপাদান। এগুলাে মানুষ যখন সহজে নিজের মধ্যে বিকশিত করে তােলে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার প্রতিটি কথা ও কাজের মাধ্যমে তা ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়, তখন উত্তমচরিত্র তার স্বভাবের সঙ্গে সমীভূত হয়ে যায়। ফলে, দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক আচরণেও উত্তমচরিত্রের বৈশিষ্ট্যাবলি প্রকাশ পেতে থাকে। আর এ-পর্যায়ে গিয়ে ব্যক্তি তার চরিত্রকে একটি সম্পদ হিসেবে আবিষ্কার করে। সর্বোপরি ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলি বিকাশের ক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলাে গুরুত্ব পাওয়া প্রয়ােজন।

  • মানবিক গুণাবলির সমাহার হিসেবে ধৈর্য, সাহস, আনুগত্য, সততা, সৌজন্য, নির্ভরযােগ্যতা, কৃতজ্ঞতাবােধ, সহজ ( অমায়িকতা, পরহিতব্রত ইত্যাদি)। 
  • শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার ইত্যাদি সামগ্রিক আচার-আচরণ-অভ্যাস ।
  • দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবােধ, আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব, মানবপ্রেম ইত্যাদি সংগঠিত ভাবাবেগ।
  • হিংসা, বিদ্বেষ, কুটিলতা ইত্যাদি মানসিকতা পরিহার এবং বদ অভ্যাস বা প্রবৃত্তি দমন।
  • ন্যায়বিচার, মানবকল্যাণ, পরহিতব্রত ইত্যাদি মানবিক গুণাবলিকে জীবনের চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রহণ। 

সচ্চরিত্রের লক্ষণ

নামমাত্র নৈতিকতা বা ন্যায়নিষ্ঠাই চরিত্র নয়, চরিত্রের মধ্যে সমন্বয় ঘটবে মানুষের যাবতীয় মানবীয় গুণাবলি ও আদর্শের। চরিত্রবান ব্যক্তি জাগতিক মায়া-মােহ ও লােভ-লালসার বন্ধনকে ছিন্ন করে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় অবিচল থাকেন। যিনি চরিত্রবান তিনি কখনাে সত্য থেকে বিচ্যুত হন না, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না, ক্রোধে কিংবা আনন্দে আত্মহারা হন না, গর্বে গর্বিত হন না, কারাে সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করেন না। তিনি সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয়, ভক্তি ও ন্যায়পরায়ণ হয়ে থাকেন এবং মানুষকে ভালােবাসার চোখে দেখেন। তাই প্রতিটি মানুষের সাধনা হওয়া উচিত চরিত্র গঠনের সাধনা। 

সচ্চরিত্রের ফল

চরিত্রের মাধ্যমেই ঘােষিত হয় জীবনের গৌরব। চরিত্র দিয়ে জীবনের যে গৌরবময় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় তা আর কিছুতেই সম্ভব নয় বলে সবার ওপরে চরিত্রের সুমহান মর্যাদা স্বীকৃত। যার পরশে জীবন ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয় এবং যার বদৌলতে মানুষ জনসমাজে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হিসেবে আদৃত হয়ে থাকে, তার মূলে রয়েছে উত্তম চরিত্র। যিনি সৎ চরিত্রের অধিকারী তিনি সমাজের শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার ও প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা। তার মধ্যে যাবতীয় মানবীয় গুণাবলির বিকাশ ঘটে বলে’ চরিত্রবান মানুষ জাতির সম্পদ।

চরিত্র গঠনের সময় ও উপায়

চরিত্র গঠনের কাজ শিশুকাল থেকে মরণের পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকে। তাই চরিত্রের ওপর পরিবার, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক সামাজিক বিধি-ব্যবস্থা প্রভাব বিস্তার করে। দেশ ভেদে কাল ভেদে চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষায় ধারণা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পার্থক্য দেখা যায়। তা সত্ত্বেও বলা যায়, সুপ্রাচীন কাল থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় চরিত্র গঠনের উপর বিশেষ গরুত্ব আরোপ করা হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে গুরুত্ব পায় : ন্যায়নীতি শিক্ষা, নৈতিক মান গঠন; কাজ, সততা, সৌন্দর্য, সৌজন্য, কৃতজ্ঞাবোধ ইত্যাদি গুণাবলির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি; পশুপাখির প্রতি মমত্ব ও পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি। সামগ্রিকভাবে প্রত্যক্ষ পদ্ধতির লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলি ও সুঅভ্যাস গড়ে তোলায় সহায়তা দান। চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষার পরোক্ষ পদ্ধতি হচ্ছে ইতিহাস, জীবন ও সাহিত্য থেকে পাঠের মাধ্যমে দৈনন্দিন আচরণ ও মূল্যবোধ সৃষ্টি। এভাবে মহৎ চরিত্র সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মনে আদর্শ ধারণা সৃষ্টি করা হয়।
চরিত্র গঠনে বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীর ভূমিকা ছাড়াও বয় স্কাউট, গার্ল গাইড, রেডক্রস ইত্যাদি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা গুরুত্বপূর্ণ। স্বেচ্ছা সংগঠনের মাধ্যমে মানুষ যৌথ কাজের গুরুত্ব ও আনন্দ অনুভব করতে পারে।

চরিত্র গঠনে পরিবারের ভূমিকা

শিশুকাল ও শৈশবকালই হচ্ছে চরিত্র গঠনের উৎকৃষ্ট সময়। তাই বাসগৃহকে চরিত্র গঠনের উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিশুকে সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহিত করা হলে তাতে সৃজনী প্রতিভা বিকশিত হয়। প্রত্যেক শিশুই নিস্পাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করে। শিশুরা স্বভাবতই অনুকরণপ্রিয়। তাই শৈশবে শিশুর কোমল হৃদয়ে যা প্রবিষ্ট হয় তা চিরস্থায়ী রূপ পরিগ্রহ করে। তাই শিশুর পরিবার যদি সৎ ও আদর্শবান হয় তবে সেও সৎ ও আদর্শবান হতে বাধ্য। শিশুর জীবনে মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটাতে হলে চাই সৎ সঙ্গ। আজকাল শিশুর ভালাে-মন্দ চরিত্র গঠনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখছে টেলিভিশন ও স্যাটেলাইট চ্যানেলের মতাে গণমাধ্যম। স্যাটেলাইটের বিভিন্ন চ্যানেলে যেসব অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় তার মধ্যে এমন অনেক অনুষ্ঠান রয়েছে যা শিশুদের জন্যে অনুপযােগী। তাই অভিভাবককে এদিকে লক্ষ রাখতে হবে। 

চরিত্র গঠনে সামাজিক প্রভাব

মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন থেকে আরম্ভ করে পাড়া-প্রতিবেশীর পরিবেশের মধ্য দিয়েই শিশুর চরিত্র গঠিত হয়। শিক্ষাজীবনে বিদ্যালয়ে বা সমবয়স্কদের সঙ্গে খেলাধুলায় এবং সঙ্গ-প্রভাবে শিশুরা আসল চরিত্ররূপ পরিগ্রহ করে। সেজন্যে অভিভাবক ও শিক্ষকদের লক্ষ্য রাখা উচিত, লেখাপড়ার ভেতর দিয়ে শিশুদের চরিত্র গঠন হচ্ছে কিনা।

চরিত্র গঠনে পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাব ও সঙ্গ নির্বাচন

মানবচরিত্র গঠনে পরিপার্শ্বের গুরুত্ব অপরিসীম। সে যেরুপ পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে বাস করে, সাধারণত তার চরিত্র সেভাবেই গঠিত হয়। সেজন্যে সে যাতে পরিবারের বাইরে কুসংসর্গে মিশতে না পারে অথবা কুকার্যে লিপ্ত হতে না পারে, সেদিকেও অভিভাবকদের লক্ষ্য রাখা উচিত। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে তাকে অন্যের সান্নিধ্য গ্রহণ করতে হয়, বন্ধু নির্বাচন করতে হয়। শেখ সাদীর (রহ.) বিখ্যাত উক্তি রয়েছে, 
“সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।” 

একজন উত্তম বন্ধু যেমন জীবনের গতি পাল্টে দিতে পারে, তেমনি একজন অসৎ বন্ধু জীবনকে পৌছে দিতে পারে ধ্বংসের চূড়ান্ত সীমায়। এ জন্যে প্রবাদ রয়েছে, ‘সঙ্গদোষে লােহা ভাসে’। পরশমণির ছোঁয়ায় লােহা যেমন সােনা হয়ে ওঠে তেমনি সৎ চরিত্রের প্রভাবে মানুষের পশুপ্রবৃত্তি ঘুচে যায়, জন্ম নেয় সৎ, সুন্দর ও মহৎ জীবনের আকাঙ্ক্ষা। আবার সঙ্গদোষে মানুষ তার চরিত্রকে হারিয়ে পশুর চেয়েও অধম হয়ে যায়। এ জগতে যত লােকের অধঃপতন হয়েছে অসৎ সংসর্গই এর অন্যতম কারণ। মানুষ সতর্ক থাকলেও কুসংসর্গে পড়ে নিজের অজ্ঞাতে পাপের পথে পরিচালিত হয়। প্রবাদ রয়েছে ‘দৃর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য’। তাই সঙ্গ নির্বাচনে আমাদের সতর্ক হতে হবে। বন্ধু নির্বাচনে তিনটি গুণ থাকা চাই :
১. তাকে হতে হবে জ্ঞানী,
২. চরিত্র হতে হবে সুন্দর ও মাধুর্যময়,
৩. হতে হবে নেককার, পূণ্যবান।

চরিত্র গঠনে স্বীয় সাধনা

চরিত্রলাভের প্রধান উপায় স্বীয়-সাধনা। চরিত্র সাধনার ধন। বহুদিনের সাধনার বলে তা অর্জন ও রক্ষা করতে হয়। সংসার প্রলােভনময়। পাপের হাজার প্রলােভন মানুষকে বিপথে চালিত করতে সততই সচেষ্ট। আপনার আত্মিক শক্তির বলে সেই সব প্রলােভনকে দমন করে আপনাকে সত্যের পথে অবিচল রাখতে হবে। এর জন্যে সর্বাগ্রে দরকার নিজের শক্তিতে দৃঢ় আস্থা স্থাপন। যে দুর্বল সে চরিত্রলাভের উপযােগী নয়। যে বলহীন, নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করে, সংসারের যাবতীয় প্রলােভনকে জয় করার মতাে মনােবল যার নেই, সে কখনাে চরিত্ররূপ অমূল্য ধনের অধিকারী হতে পারে না। সে মানবসমাজে অধম।

শিশু বয়সে চরিত্র গঠন

শিশুর চরিত্র যেন নির্মল ও স্বচ্ছ হয় সেজন্যে উপযুক্ত শিক্ষাদানে অভিভাবকদের পাশাপাশি তৈরি করতে হয় অনুকূল পরিবেশ। শিশুকে সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহিত করা হলে তাতে সৃজনী প্রতিভা বিকশিত হয়। শিশুর জীবনে মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটাতে হলে চাই সৎ সঙ্গ। পিতামাতা, সঙ্গীসাথী, আত্মীয়-পরিজন সৎ চরিত্রের অধিকারী না হলে এদের সাহচর্যে শিশুর মধ্যে সচ্চরিত্রের গুণগুলো সুদৃঢ় ভিত্তি পেতে পারে না। পারিবারিক পরিবেশ ছাড়াও শিশুর নৈতিক বিকাশে বিদ্যালয় জীবন ও শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রভাব গরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের কাজ শিশুকে সুশিক্ষা দেওয়া। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটানোর গুরুদায়িত্ব তাঁদেরই। আজকাল শিশুর ভালো-মন্দ চরিত্র গঠনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখছে টেলিভিশন ও স্যাটেলাইট চ্যানেলের মতো গণমাধ্যম। স্যাটেলাইটের বিভিন্ন চ্যানেলে যেসব অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় তার মধ্যে এমন অনুষ্ঠানও থাকে যা শিশুর জন্যে অনুপযোগী। শিশুস্বভাবতই টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাই অভিভাবককে অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে যাতে তাদের শিশুদের চরিত্রের ওপর অপকৃষ্ট অনুষ্ঠানের কুপ্রভাব না পড়ে। এ কারণে খুন-জখম, মারামরি ও স্থুল বিকৃত রুচির বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান শিশুর চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই এ ধরণের অনুষ্ঠান দেখা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে। তবে সর্বোপরি যে জিনিসটির ওপর অভিভাবককে বিশেষ সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে তা হলো সৎ সঙ্গ। কুসঙ্গের পাল্লায় পড়ে অনেক সম্ভাবনাময় প্রতিভা অকালে ঝরে পড়ে, হারিয়ে যায় অন্ধকারে। এ সম্পর্কে প্রবাদ আছে- ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ তাই শিশুর সঙ্গী ও বন্ধু নির্বাচনে অভিভাবকের সতর্ক বিবেচনা দরকার।

চরিত্র গঠনে মহামানবদের উদাহরণ

পৃথিবীতে আজ যারা স্বীয় কর্মবলে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন বা সমাজের মনুষ্য মহাকল্যাণ সাধন করে গিয়েছেন, তাদের জীবন-কাহিনী পড়লে দেখতে পাওয়া যায়, তাঁরা সকলেই ছিলেন চরিত্রবান এবং আদর্শ মহাপুরুষ। এরূপ মহামানব হযরত মােহাম্মদ (স), হযরত ঈসা (আ)(Jesus in Islam) , হাজী মােহাম্মদ মহসীন (Muhammad Mohsin), স্যার সলিমুল্লাহ (Khwaja Salimullah), মুহম্মদ আলী (Muhammad Ali) ও শওকত আলী, সােহরাওয়ার্দী (Huseyn Shaheed Suhrawardy), এ. কে. ফজলুল হক (A. K. Fazlul Huq), মহাত্মা গান্ধী (Mahatma Gandhi), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (Ishwar Chandra Vidyasagar) প্রমুখ মহাপুরুষগণ চরিত্রবলে জগতে অসাধ্য সাধন করে গিয়েছেন। অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। তাদের অদম্য কর্মশক্তিতে মানবজাতির মহাকল্যাণ সাধিত হয়েছে। বস্তুতপক্ষে চরিত্রের মতাে কোনাে মহৎগুণ পৃথিবীতে নেই। যিনি চরিত্রবান তিনি মানবশ্রেষ্ঠ, সমগ্র মানবজাতির তিনি ভূষণস্বরুপ। তিনি সর্বজাতির কাণ্ডারী। তাদের জীবনের মহিমা স্মরণ করেই কবি লিখেছেন
‘এমন জীবন হবে করিতে গঠন।
মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’ 

চরিত্রহীন ব্যক্তি ঘৃণার পাত্র

চরিত্র মানবের একমাত্র সম্পদ । চরিত্রহীন লােক পশুর চেয়েও অধম। স্বাস্থ্য, অর্থ এবং বিদ্যাকে আমরা মানবজীবনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করি। কিন্তু জীবনক্ষেত্রে এগুলাের যতই অবদান থাক না কেন, এককভাবে এগুলাের কোনােটিই মানুষকে সর্বোত্তম মানুষে পরিণত করতে সক্ষম নয়, যদি না সে সচ্চরিত্রবান না হয়। কারণ সমৃদ্ধিময় জীবনের জন্যে চরিত্র প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। মানুষ তার মৌলিক দৈহিক আরও আকর্ষণীয় ও মধুময় করতে সুন্দর সুন্দর পােশাক ও অলঙ্কার ব্যবহার করে এক অনুপম সৌন্দর্যের বিকাশ সাধন করে, কিন্তু সে যদি চরিত্রবান না হয়, তা হলে এ-সবই বৃথা।

চরিত্র গঠনের গুরুত্ব

‘তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপাখি সহজেই পশুপাখি, কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ।’ তাই এ সাধনা বা প্রয়াসের প্রথম পদক্ষেপ হলাে তার চরিত্র গঠনের সাধনা। চরিত্র গঠনের গুরুত্ব এতই ব্যাপক যে, জীবনের যাবতীয় সফলতার পূর্বশর্ত হিসেবে একে বিবেচনা করা হয়েছে। ব্যক্তি জীবনে সুখী, সফল, আত্মপ্রত্যয়ী এবং জয়ী হওয়ার জন্য উত্তম চরিত্রের কোনাে বিকল্প নেই। যিনি সৎ চরিত্রের অধিকারী তিনি সমাজের শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার ও প্রজ্বলিত দীপশিখা। এ জন্যই চরিত্রকে জীবনের মুকুট বলা হয়। চরিত্রের শক্তিতে ও প্রভাবে মানুষ হতে পারে বিশ্ববরেণ্য ও চিরস্মরণীয়। তাই চরিত্রের বিকাশ সাধনই মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

উপসংহার

চরিত্রের কাছে পার্থিব সম্পদ ও বিত্ত অতি নগণ্য। প্রাচুর্যের বিনিময়ে চরিত্রকে কেনা যায় না। মানবজীবনে চরিত্রের মতাে বড় অলঙ্কার আর নেই। চরিত্র মানবজীবনের এক অমূল্য সম্পদ। এ প্রসঙ্গে ইংরেজি প্রবাদটি প্রণিধানযোগ্য,
“When money is lost nothing is lost,
When health is lost, something is lost,
But if character is lost, everything is lost.”
বর্তমান বিশ্বে সর্বত্র বাড়ছে মূল্যবােধের অবক্ষয়। সততা, ন্যায়নীতি হচ্ছে বিপর্যস্ত। চরিত্রের মহিমাকে উপেক্ষা করতে বসেছে মানুষ। লােভ-লালসা, ঈর্ষা-হিংসা, অন্যায়-দুর্নীতি ক্রমেই আচ্ছন্ন করছে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে। হীনস্বার্থ হাসিলের অনৈতিক পন্থায় চালিত হচ্ছে একশ্রেণির লােক। এ অবস্থায় জাতীয় জীবনে চাই চরিত্রশক্তির নবজাগরণ। চরিত্র হরানাে প্রজন্মকে শােধরানাে কঠিন। সুতরাং নতুন প্রজন্মকে বেড়ে উঠতে হবে চরিত্রের মহান শক্তি অর্জন করে। আর তা করতে পারলেই আমাদের ভবিষ্যৎ হয়ে উঠবে সুন্দর ও সার্থক।


Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

2 Comments

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button