বাংলা রচনা

বাংলাদেশে শিল্প ও শিল্পায়নঃ রচনা

3.5/5 - (80 votes)

ভূমিকাঃ

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্প খাতের ভূমিকা অপরিসীম। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতি অর্জনের জন্য ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন অপরিহার্য। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি মূলত সেই দেশের শিল্প ও শিল্পায়নের উপর নির্ভর করে। বিশ্বায়নের কারণে বর্তমান বিশ্ব-অর্থনীতি মুক্ত-অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছে। তাই প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার্থে শিল্পের অগ্রগতি অপরিহার্য।

বাংলাদেশের শিল্প ব্যবস্থাঃ

বাংলাদেশের শিল্প কাঠামো অনুন্নত ও দুর্বল। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন এবং ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন পর্যন্ত ভঙ্গুর। ফলে শিল্পায়নের ব্যাপক প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়নি। শিল্প বলতে সাধারণত কারখানায় যন্ত্রপাতির সাহায্যে কাঁচামালকে চূড়ান্ত দ্রব্যে পরিণত করা বোঝানো হয়। উপযুক্ত কাঁচামাল, মূলধনের স্বল্পতা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব শিল্পোয়নের পথে প্রধান সমস্যা বা বাধার সৃষ্টি করছে। তবে বর্তমানে শিল্প ব্যবস্থায় আগের চেয়ে অনেক অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩ অনুযায়ী ২০১২-১৩ অর্থবছরে শিল্প খাতের অবদান ৩১.৯৮ শতাংশ।

বাংলাদেশের শিল্পনীতিঃ

শিল্পায়ন বা শিল্প খাতকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসাবে বিবেচনা করে শিল্পায়নের গতিকে বেগবান করতে ২০১১ সালে ‘শিল্পনীতি-২০১০’ ঘোষণা করা হয়। উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার মূলধারায় নারীদের নিয়ে আসা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ এ নীতির মূল উদ্দেশ্য। শিল্পনীতি ছাড়াও ‘ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০১১-২০১৫ এ সমৃদ্ধ ও আধুনিক শিল্পখাত গড়ে তোলার মাধ্যমে বেকারত্ব, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য পীড়িত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা বিধৃত হয়েছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পসমূহঃ

বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোর একটি। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১২-১৩ অনুযায়ী এদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ৯২৩ মার্কিন ডলার। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ২২ মে প্রথম আলো’র হিসাব অনুযায়ী মাথাপিছু আয় ১১৯০ মার্কিন ডলার। এদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অগ্রগতির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরণের শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। নিম্নে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শিল্পসমূহ আলোচনা করা হলো-

পোশাক শিল্পঃ

দেশের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে পোশাক শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ৩৫০০ এর বেশি কারখানা এবং ১৬ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছে যাদের ৬৬ শতাংশের বেশি নারী। বাংলাদেশ বিশ্বের ২০টির অধিক দেশে পোশাক রপ্তানি করছে। পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয়। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীন প্রথম। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রে, যা মোট রপ্তানির ৫৬%। পোশাক শিল্পের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তৈরি পোশাক শিল্প থেকে মোট রপ্তানি আয় ছকের মাধ্যমে নিম্নে দেখানো হলো-
সাল ২০১০-১১ ২০১১-১২ ২০১২-১৩রপ্তানি আয় ৮৪৩২ মিলি. মার্কিন ডলার ৯৬০৩ মিলি. মার্কিন ডলার ১২০৪০ মিলি. মার্কিন ডলারউৎসঃ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৩

পাট শিল্পঃ

পাট বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। অতীতে প্রধান রপ্তানি পণ্য হিসাবে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো পাট থেকে। বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ লোক পাট চাষাবাদের কাজে এবং ২ লক্ষ শ্রমিক পাট শিল্পে নিয়োজিত আছে। পাটজাত দ্রব্যসমূহ হতে রপ্তানি আয় ছকের মাধ্যমে দেখানো হলো-
সাল ২০১০-১১ ২০১১-১২ ২০১২-১৩পাটজাত দ্রব্য ৭৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ৭০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ৪৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারকাঁচাপাট ৩৫৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ২৬৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ১৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারউৎসঃ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৩

চিনি শিল্পঃ

চিনি বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫টি চিনিকল আছে। বাংলাদেশের প্রধান চিনিকল হলো দর্শনার কেরু এন্ড কোং। দেশে বর্তমানে চিনির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৪.০০ লক্ষ মেট্রিক টন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৯৪,৭৪০ মেট্রিক টন চিনি বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়েছে।

চা শিল্পঃ

চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম একটি শিল্প। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৫৮টি চা বাগান রয়েছে। চা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ১০৩টি কারখানা ও ২০ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছে। সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল ও চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা চা চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। বাংলাদেশের চা আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।

কাগজ শিল্পঃ

বাংলাদেশ কাগজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ১৯৫৩ সালে ‘কর্ণফুলী পেপার মিলস’ এর মাধ্যমে এদেশে কাগজ শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল, পাকশী কাগজ কল, আদমজী পার্টিকেল বোর্ড সহ অনেক ব্যক্তি মালিকানাধীন কাগজকল স্থাপিত হয়েছে। প্রতিবছর আমাদের দেশের কাগজ ও কাগজজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা অর্জিত হয়।
চামড়া শিল্পঃ বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে চামড়া শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। চামড়া দ্বারা জুতা, ব্রিফকেস, হাতব্যাগ, শপিং ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, মানি ব্যাগ, হাত ঘড়ির ফিতা, বেল্ট ইত্যাদি উৎপাদন করা হয়। ২০১৪ সালের ১৯ মে প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার প্রায় ২১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। কিন্তু চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারে দশমিক ৪৬ শতাংশ দখল করতে পেরেছে। বাংলাদেশ যে সকল দেশে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানি করে তার মধ্যে চীন, জাপান, ইতালি, ব্রাজিল, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য।

পর্যটন শিল্পঃ 

পর্যটন শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বিশেষ খাত। পর্যটন শিল্পের এক অপার সম্ভাবনাময় দেশ প্রাকৃতিক সম্পদের লীলাভূমি বাংলাদেশ। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, হিমছড়ি ঝরনা, নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওর, জাফলং, মহাস্থানগড়, ময়নামতি, লালবাগ কেল্লা, ষাটগম্বুজ মসজিদ, বরেন্দ্র জাদুঘর, প্রভৃতি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থান। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী ২০০১ সালে বাংলাদেশে পর্যটকদের সংখ্যা ছিল ২,০৭,১৯৯ জন এবং ২০০৮ সালে এ সংখ্যা দাড়ায় ৪,৬৭,৩৩২ জন। ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ২৭ লাখ লোকের।

ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পঃ

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গ্রামের লোকেরা নিজগৃহে বসে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করে থাকে। যেমন হস্তচালিত তাঁতের মাধ্যমে তৈরি করা হয় শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি, গামছা, বিছানার চাদর ইত্যাদি। মৃৎশিল্পের মধ্যে রয়েছে মাটির হাঁড়ি, কলস, পুতুল, ফুলদানি ইত্যাদি।

বাংলাদেশে শিল্পের সমস্যাঃ

কাঁচামাল, প্রাকৃতিক সম্পদের সহজলভ্যতা এবং সস্তা শ্রমিক থাকা সত্ত্বেও শিল্পক্ষেত্রে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। বিরাজমান শিল্পের সমস্যার মধ্যে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ আমলে এদেশের কাঁচামাল দ্বারা শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছিল ইংল্যান্ডে। পাকিস্তান আমলে যে কয়েকটি কারখানা ছিল তা স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান সৈন্যদের নির্মম ধ্বংসযজ্ঞে সেগুলো বিনষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশের জনগণের মাথা পিছু আয় কম হওয়ার কারণে মূলধন গঠন সেভাবে হয়নি যা শিল্পায়নের পথে বাধার সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসের ফলে বহু শ্রমিক নিহত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে। যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব অন্যান্য শিল্পের উপর পড়তে পারে। তাছাড়া শ্রমিকের কারিগরি জ্ঞানের অভাব, খনিজ ও শক্তি সম্পদের অভাব, বৈদেশিক সাহায্যের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শিল্প ঋণের অভাব, সুষ্ঠু পরিকল্পনা, শিক্ষার অভাব প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের শিল্প নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

বাংলাদেশে শিল্পায়নের উপায়ঃ

অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের জন্য শিল্পায়নের বিকল্প নেই। শিল্পায়নের ফলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয়। বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অন্যতম। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে উৎপাদনের প্রাণশক্তি বলা হয়। তাই এ খাতের উন্নয়ন জরুরি। তাছাড়া কারিগরি জ্ঞানে জনশক্তির জন্য কারিগরি বিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও কৃষি কলেজ স্থাপন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ঋণের ব্যবস্থা, অবকাঠামোর উন্নয়ন, পরিকল্পিত শিল্পায়ন, বিদেশে বাজার সৃষ্টি, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে বাংলাদেশে শিল্পায়নের পথ প্রশস্ত হবে।

উপসংহার:

সর্বোপরি বাংলাদেশের শিল্প সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। শিল্প ব্যবস্থার উন্নতি হলে দেশের সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়ন সাধিত হবে। শিল্প সমস্যা দূরীকরণের মাধ্যমে টেকসই শিল্প ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এতে শিল্প কাঠামো স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপ লাভ করবে। যা আমাদের জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button