বাংলা রচনা

রচনা: বসন্তকাল / আজি এ বসন্তে

3.4/5 - (14 votes)

রচনা বসন্তকাল  আজি এ বসন্তে


বসন্তকাল অথবা, আজি এ বসন্তে সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ রচনা।

ভূমিকা

ওগো দখিনা মলয়, আজি তব পরশনে
কার কথা পরে মনে।
মধুপ হয়েছে আজি পাগল পারা
কুসুমে কুসুমে তাই জেগেছে সাড়া।

কবিতার এ দখিনা মলয় ইঙ্গিত দেয় প্রকৃতিতে বসন্তের আগমনের। ঋতুচক্রের পালাবদলে সবশেষে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। প্রকৃতিতে রূপের মাধুরী সৃষ্টি করে, ফুলে ফলে চারদিক সুশােভিত করে শীতল পরশের মােহনীয়তায় আবির্ভাব ঘটে তার। ঋতুরাজের আগমনে প্রকৃতির পাশাপাশি মানবমনেও জাগে আনন্দের জোয়ার। প্রকৃতিতে প্রাণের স্পন্দন আর মানবমনে ভালােলাগার এক বিমূর্ত অনুভূতি জাগায় ঋতুরাজ বসন্ত। তাই এ ঋতু সবার কাছে পরম কাঙিক্ষত।

বসন্তের আগমনক্ষণ

বাংলাদেশে ষড়ঋতুর যে পালাবদল ঘটে তার পরিক্রমায় সবশেষে আগমন ঘটে চির কাঙ্ক্ষিত ঋতুরাজ বসন্তের। ফাল্গুন ও চৈত্র এ দুমাস মিলে বসন্তের ব্যাপ্তিকাল স্থায়ী হয়। আর ঋতুচক্রে ভগিনী রিক্ত শীতের পরে আগমন ঘটে বর্ণিল ঋতু বসন্তের। নিঃস্ব প্রকৃতিকে তার অফুরন্ত ধনভাণ্ডার থেকে অপরিসীম ঐশ্বর্য দান করে এ ঋতুরাজ। তাই প্রকৃতিও তার কাছে হয়ে যায় চির ঋণী। তাই বুঝি তার উদ্দেশ্যে অপেক্ষমান প্রকৃতি গেয়ে ওঠে।

ভালােবাসি ভালােবাসি তােমায় যে ভালােবাসি
শূন্য এ জীবনে তােমার এ হাসি।

বসন্তকে ভালােলাগার কারণ

ঋতুরাজ বসন্ত ঋতুচক্রের পালাবদলে সবশেষে আগমন করলেও মানবমন তার জন্য সব সময় প্রতীক্ষারত থাকে। কেননা, বর্ণিল ঋতু বসন্তে মানবমন কোনাে কিছুর অভাব উপলব্ধি করে না। রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধে সুশােভিত হয়ে ঋতুরাজ আসে প্রকৃতির বুকে। শীতের রিক্ততায় প্রকৃতি হয়ে পড়ে শ্রীহীন। তাই প্রকৃতিও ফিরে পেতে চায় তার অনুপমা রূপ বসন্তের ছোঁয়ায়। বসন্তের পরশ পেয়ে গাছপালাও সজীব হয়ে ওঠে। প্রকৃতি গুনগুনিয়ে গায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত চরণ-
বসন্তের হাওয়া সবে আরণ্য মাতায়
নৃত্য উঠে পাতায় পাতায়। 
এই নৃত্যে সুন্দরকে অর্ঘ্য দেয় তার,
‘ধন্য তুমি’ বলে বার বার।
প্রকৃতির এ সিদ্ধতা এসময় মানুষকেও আপ্লুত করে। দখিনা মলয়, আম্রমুকুল তার পুষ্পশােভিত বৃক্ষরাজি তাদের মনে দেয় শান্তির পরশ। তাই বসন্তকে ভালাে না লেগে উপায় নেই। ঋতুরাজের আগমন সার্থক হয় তার নামের মতােই। রাজার মতাে ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার নিয়ে দীন প্রকৃতিতে আগমন করে সে এবং ভরিয়ে দিয়ে যায় প্রকৃতির নিবাস। এ কারণেই সবার কাছে বসন্ত এত প্রিয়।

বসন্তের প্রকৃতি

বসন্তের প্রকৃতি স্নিগ্ধ ও পবিত্রতার মােহনীয় আবেশে পরিপূর্ণ থাকে। রিক্ততার দৈন্য বেশভূষা পরিধান করে প্রকৃতি বসন্তের ছোঁয়ায় সিক্ত হওয়ার প্রতীক্ষায় বিভাের থাকে। কেননা, বসন্তের আগমনে ধরাতলে ফুল ফোটে, পাখি গান গায়। নব পল্লবে সুশােভিত হয় বৃক্ষরাজি। দখিনের হাওয়া, আম্র মুকুলের ঘ্রাণ সব মলিয়ে প্রকৃতিতে জাগে প্রাণের জোয়ার। প্রাণের জোয়ার, মৃদুমন্দ হাওয়া আর পুষ্পশােভিত প্রকৃতি মানুষের মনকে আন্দোলিত করে। মানবমনের চিরায়ত আবেদন আর প্রকৃতির মােহনীয় পরিবেশের রূপ-রস-গন্ধ মিলে একাকার হয়ে যায়। প্রকৃতির যেদিকে চোখ পড়ে সেদিকেই অনুভূত হয় স্বস্তির নিঃশ্বাস। কোকিলের সুমধুর সঙ্গীত আর বর্ণিল প্রকৃতি এক হয়ে সৃষ্টি করে এক স্বপ্নের মায়ালােক। তাই বুঝি বসন্তের প্রকৃতিতে আগমন ঘটায় মন গুনগুনিয়ে ওঠে বিদ্যাপতির মধুর সুরে-
আএল ঋতুপতি রাজ বসন্ত
ধাওল অলিকুল মাধবি-পন্থ

মানবমনে বসন্তের আবেদন

মানবমনে বসন্তের আবেদন চিরন্তন। ঋতুরাজ বসন্ত প্রকৃতির পাশাপাশি মানবমনেও রঙের জোয়ার আনে। রঙিন প্রকৃতি আর বর্ণিল মানবচিত্তের মধ্যে এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটায় এ চপলা ঋতু। আবালবৃদ্ধবনিতা বসভের রঙে রাঙিয়ে নেয় আপন ভুবন। তাই তাে লেখক শংকর বলেছেন, “খেলােয়াড়, অভিনেত্রী এবং নর্তকীর জীবনে মাত্র একটি ঋতুই আছে, তার নাম বসন্ত ঋতু”।মানুষের মনের চিরায়ত আবেদন যেন ভাষা পায় বসন্তের আলিঙ্গনে। মানবমনে বিরাজ করে উচ্ছলতা আর উচ্ছাসের চঞ্চলা ভাবাবেগ। ঘরের কোণে মুখ লুকিয়ে বসে থাকার সময় নেই এ বসন্তে। এ ঋতু আনন্দের বারতা নিয়ে আসে এবং মানবমনকেও ভাসিয়ে নেয় আনন্দের জোয়ারে। তাই বেগম সুফিয়া কামাল বলেন-
আবার বসন্ত রাত্রি আমাদের দুয়ারে দিল হানা ।
উন্মনা ছিলাম আমি তবু সে আমারে ভুলিল না।
মানবমনে তাই বসন্তের আবেদন এক ভিন্ন মাত্রায় পরিমেয়। চিত্তের দোদুল্যমানতা শতগুণ বাড়িয়ে মানব-মানবীর মনের সংশয়কে ভাষাদানে বসন্তের চেয়ে উৎকৃষ্ট সময় আর নেই। মানবচিত্ত তাই বসন্তের ছোঁয়া পেতে আকুল থাকে সর্বক্ষণ। 

বসন্তকে বরণে আয়ােজন

বসন্তকে বরণ করে নিতে এখন চলে নানা আয়ােজনের বাহার। প্রতি বছর পহেলা ফাল্গুন’-এ বসন্তকে স্বাগত জানাতে রঙিন সাজে সেজে ওঠে চারপাশ। বর্তমান সময়ে বসন্তবরণ উৎসব যেন এক সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাঙালির ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধায়নে এ উৎসব যােগ করেছে এক ভিন্ন মাত্রা। বাসন্তী রঙের শাড়ি, খোঁপায় বেলী ফুলের মালা, রং-বেরঙের চুড়ি আর অপরূপ সাজে সুন্দরী ললনারা দলে দলে বেরিয়ে আসে বসন্তের টানে। চারুকলার বকুলতলা, রবীন্দ্র সরােবর ইত্যাদি সাংস্কৃতিক মঞ্চ লােকের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে এদিন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, চুড়ির হাট সব মিলিয়ে চারদিকে সাজ সাজ রব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে দিগ্বিদিক ধ্বনিত হতে থাকে-
ওরে ভাই ফাল্গুন লেগেছে বনে বনে,
ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে,
আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে।
বসন্তের আগমনে প্রকৃতি সাজে অপরূপ সাজে। প্রকৃতি ও মানবের একাত্মতা চিরন্তন। এ কারণেই প্রকৃতির রঙ্গে রঙ্গিন হয়ে মানুষের মনও বর্ণিল হয় ওঠে, ঘরে যেন আর মন মানতে চায় না। “আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে” এ নিষেধাজ্ঞা যেন এ সময় মানবমনকে আরও বেশি অধীর করে তােলে।কোকিলের সুমধুর সুর, পুষ্পশােভিত বৃক্ষরাজি বসন্তের আগমনী বার্তা ঘােষণা করে। বসন্তকে ভালােবেসে আলিঙ্গন করে নিতে ভােলে না আবেগী মানুষ। তারাও সাড়ম্বরে গানে গানে, আর উষ্ণ ভালােবাসায় আনন্দিত চিত্তে বসন্তকে আপন করে নেয়। বর্তমানকালে বসন্তবরণ উৎসব বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যকে পুনর্জীবিত করে। বাঙালির মনে বর্ষবরণের মতােই খুশির আমেজ জাগায় এ বসন্তের উপস্থিতি। তাই বুঝি বসন্তবরণের আয়ােজন বাণীরূপ পায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভাষায়-
আয়রে বসন্ত তাের ও 
কিরণ মাখা পাখা তুলি। 
নিয়ে আয় তাের কোকিল পাখীর
গানের পাতা গানের ফুলে।

উপসংহার

বসন্তের আবেদন অপরিমেয় ও অকৃত্রিম। কালের পরিক্রমায় এ আবেদন আরও প্রগাঢ় হয়েছে। বসন্তকে বরণ করে নিতে এখন চলে নানা আয়ােজন। প্রকৃতির সজ্জা আর মানুষের ভালােবাসায় সিক্ত হয়ে বসন্তের আগমন তাই ধন্য হয়ে। ওঠে। বসন্তের স্পর্শে তাই প্রশান্ত মন গেয়ে ওঠে-

আহা আজি এ বসন্তে
এত ফুল ফোটে,
এত বাঁশি বাজে, 
এত পাখি গায়।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button