বাংলা রচনা

খাদ্যে ভেজাল ও তার প্রতিকার | রচনা | ২৫ পয়েন্ট

4/5 - (41 votes)
খাদ্যে ভেজাল বর্তমান সময়ে মারাত্মক একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বাজারে এমন কোন পণ্য নেই যে তাতে ভেজাল মিশানো হচ্ছে না। দেশের জনগণের স্বার্থে অতি দ্রুত এর প্রতিকার করা উচিত।

ভূমিকা

মানুষকে আল্লাহ্ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের ভালো-মন্দ মানুষের ভালোমন্দের ওপরই নির্ভর করে। শুধু নিজের কল্যাণ সাধন নয় বরং অপরের কল্যাণে মনােনিবেশ করাই হচ্ছে মানবতার আদর্শ এবং মনুষ্যত্বের দাবি। কেবল নিজের সুখের জন্যে অন্যের অধিকার খর্ব করা, হীন স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতায় মানবতা অপমানিত ও কলংকিত হয়। অর্থের লোভ মানুষকে আজ হিংস্র করে তুলেছে। অর্থের লোভ লালসার ফল মানবজাতির জন্যে যে কত বড় ভয়াবহ হতে পারে তা খাদ্যে ভেজালের পরিণাম দেখলেই উপলব্ধি করা যায়। যে কোন পণ্য দ্রব্যে ভেজাল দেয়া একটি কলঙ্কিত বিষয়। ভেজাল একটা ঘৃণিত সামাজিক অপরাধ। 

খাদ্যে ভেজাল ও তার প্রতিকার | রচনা | ২৫ পয়েন্ট
খাদ্যে ভেজাল ও তার প্রতিকার | রচনা | ২৫ পয়েন্ট

ভেজাল কী?

উৎকৃষ্ট পণ্যের সাথে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের পণ্যদ্রব্য মিশিয়ে দেয়াকে ভেজাল বলে। ভেজাল অর্থাৎ গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করা ভাল দ্রব্যের সাথে খারাপ দ্রব্য মিশিয়ে ক্রেতাকে ঠকানাে। বর্তমানে নকল পণ্যে বাজার ভরে গেছে। একেতো দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি সেই সাথে যোগ হয়েছে খাদ্যে ভেজাল। বাজারে খাঁটি শব্দটাই এখন হাস্যরসে পরিণত হয়েছে। বাজারে অনেক পণ্যেই খাঁটি শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়। আসলে নকল-ভেজালের দৌরাত্ম্যে খাঁটি কথাটাই কথার কথায় পরিণত হয়েছে। সকলেই জানে খাঁটি মোটেও খাঁটি নয়।

ভেজাল একটি অপরাধ

ভেজাল গর্হিত সামাজিক অপরাধ। ভেজালের ফলে খাদ্যদ্রব্য দৃষিত হতে পারে। ভেজাল খাদ্যদ্রব্য আহার করে অনেক সময় জীবন বিপন্ন হয়। যে কর্মকাণ্ড সমাজের অধিকাংশ মানুষের জন্যে ক্ষতিকর জনগণ যেটাকে ক্ষতিকর হিসেবে মনে করে, জনগণ যার দ্বারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে এবং যে কর্মপ্রক্রিয়া মানুষের জন্যে ক্ষতিকর সেটাই সামাজিক অপরাধ।

পণ্যদ্রব্য ও ভেজাল

বাংলাদেশের পণ্যের সাথে ভেজালের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কারণ আমরা বিবেক-বােধের স্বাভাবিক স্তর থেকে অনেক নীচে নেমে এসেছি। তাই ভেজাল ছাড়া বাংলাদেশের মানুষ যেন আর কিছুই বােঝে না! ভেজাল ছাড়া পণ্যদ্রব্য পাওয়াই আজ মুশকিল হয়ে পড়েছে। দি ইন্সস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ’-এর খাদ্যদ্রব্য পরীক্ষাগারের এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, ১ ৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ২৬,৮৪৩টি খাদ্যদ্রব্যের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে ৪৩%-ই ভেজাল অর্থাৎ ১১,৩১৭টি দ্রব্যই ভেজালপূর্ণ। এসব ভেজালের কারণে বিভিন্ন অর্থকরী পণ্য আন্তর্জাতিক বাজার দারুণভাবে মার খাচ্ছে এবং দেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে চরমভাবে।

খাদ্যে ভেজালের ইতিহাস

খাদ্যে ভেজাল কখন থেকে শুরু হয়েছে এর সঠিক সন ও তারিখ নির্ধারণ করে বলা সম্ভব নয়। যতদূর জানা যায়, দুই সহস্রাধিক বছর পূর্বে প্রাচীন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ভেজালকারীদের তৎপরতার কথা উল্লেখ আছে। ব্রিটিশ শাসনামলে তাে বটেই, বিগত তিরিশ দশকেও ভেজালের তৎপরতা ছিল। সে সময় এমন এক শ্রেণির ব্যবসায়ীগােষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছিল, যারা ভেজালকেই ব্যবসায়ের কৌশল বলে জ্ঞান করতাে। ভেজাল করতে গিয়ে তারা সরিষার তেলে শিয়ালকাটা মিশাতে থাকে। এতে দেশজুড়ে বেরিবেরি কৌশল বলে জ্ঞান করতাে। এরপর থেকে সরকারিভাবে ভেজাল প্রতিরােধের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় ভেজালবিরােধী বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু নীতি-নৈতিকতাহীন কতিপয় কর্মকর্তার কারণে আজও ভেজাল প্রতিরােধ করা সম্ভব হয়নি। বরং ভেজালের পরিধি ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। বাজারে এমন কোনাে দ্রব্য নেই যাতে ভেজাল মিশানাে হয় না। ফলে সাধারণ মানুষ তাদের পরিশ্রমলব্ধ অর্থ দিয়ে মনের অজান্তে বিষ কিনছে এবং তা খেয়ে ক্রমেই জীবনীশক্তি হারাচ্ছে।

ভেজালের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও চালচিত্র

বর্তমানে বাংলাদেশে ভেজালের চিত্র ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। মানুষের দৈনিক চাহিদার এমন কোন পণ্য নেই যে যা ভেজাল মুক্ত। ভয়ের কথা যে ভেজালের আওতার মধ্যে প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য। মূলত নিত্য নতুন প্রক্রিয়া ও উপাদান বা পদার্থ ব্যবহার করে যেভাবে খাদ্যদ্রব্য ভেজাল করা হচ্ছে তা নির্ণয় করার ব্যবস্থা ও উদ্যোগ না থাকায় প্রকৃত ভেজালের পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা প্রতিনিয়ত বাজার থেকে কিনে যেসব খাদ্যদ্রব্য খেয়ে থাকি এদের মধ্যে কত শতাংশ ভেজাল তা নির্দিষ্ট করে বলা বেশ মুশকিল। তবে ভয়ের কথা যে ভেজাল মিশানোর পদ্ধতি কৌশলগত ও আধুনিক যে তা অনুমান করাও মুশকিল। 

ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের এক সূত্র থেকে জানা যায়। রাজধানীতে বিক্রীত খাদ্যসামগ্রীর শতকরা ৮০ শতাংশ ভেজালযুক্ত। অন্যদিকে ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ-এর সূত্র মতে, দেশের ৭০ শতাংশ খাদ্যদ্রব্যই ভেজাল মিশ্রিত করে বিক্রি করা হয়। তবে ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বাইশ হাজার সাতশ উনিশটি খাদ্যদ্রব্য বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা করে তারা দেখেছে যে, ওই সব খাদ্যদ্রব্যের প্রায় পঞ্চাশ (৪৯.২২%) শতাংশ ভেজাল। এদিকে কনজুমার এসােসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর হিসেবেও বাজারে বিক্রয় হচ্ছে এমন খাদ্যদ্রব্যের পঞ্চাশ শতাংশ ভেজাল।

খাদ্যে ভেজালের নমুনা

বর্তমান যুগে মানুষ একদিকে যেমন উন্নত হচ্ছে অন্যদিকে বিচার বিবেকর অবনতি ঘটছে। যে খাদ্য খেয়ে মানুষ জীবন ধারণ করছে, সে খাদ্যে মিশানো হচ্ছে মরণঘাতি কেমিক্যাল। নিচে ভেজালের কিছু নমুনা তুলে ধরা হলঃ

মাছ ও সব্জিতে ফরমালিন

সামান্য কিছু বাড়তি মুনাফার আশায় ইউরিয়া, ফরমালিনসহ নানা কেমিক্যাল মিশিয়ে মাছকে বিপজ্জনক বিষে পরিণত করা হচ্ছে। বর্তমান বাজারে কেমিক্যালমুক্ত মাছ পাওয়া অনেকটাই কঠিন এর মধ্যেই ক্ষতিকর পিরহানা মাছ, রাক্ষুসে মাগুর, জীবনহানিকর পটকা মাছের দেদার বাজারজাত চলছে। শুধু মাছ নয় অবাধে  কেমিক্যাল মেশানাে হচ্ছে সবুজ সবজিতেও।

বেকারির অস্বাস্থ্যকর খাদ্যপণ্য

শহরের গলিতে গলিতে ব্যাঙের ছাতার মধ্যে গড়ে উঠছে অস্বাস্থ্যকর বেকারি কারখানা। কারখানার ভেতরে-বাইরে কাদাপানি, তরল ময়লা-আবর্জনাযুক্ত নােংরা পরিবেশ। আশপাশেই নর্দমা ময়লার স্তুপ। মশা-মাছির ভনভন আর একাধিক কাঁচা-পাকা টয়লেটের অবস্থান। দম বন্ধ হওয়া গরম থাকে রাত-দিন গরমে ঘামে চুপসানাে অবস্থায় খালি গায়ে বেকারি শ্রমিকরা আটা-ময়দা দলিত মথিত করে। সেখানেই তৈরি হয় ব্রেড, বিস্কুট, কেকসহ নানা লােভনীয় খাদ্যপণ্য। ভেজাল আটা, ময়দা, ডাল, তেল, পচা ডিমসহ নিন্ম মানের উপাদান দিয়ে এইসব খাদ্য প্রস্তুত করা হয়। 

এনার্জি ড্রিংক ও জুসে বিষাক্ত কেমিক্যাল

বাজারে নিত্য নতুন অনেক এনার্জি ড্রিংক ও জুস দেখা যায়। যার অধিকাংশই বিএসটিআই কর্তৃক অনুমােদন দেয় না। অনেক কারখানা অনুমতি পেলেও মানছে না উৎপাদনের নিয়ম। যে কোনাে ড্রিংকস উৎপাদন ও বােতলজাতের ক্ষেত্রে প্রথম শর্তই হচ্ছে অটো মেশিনে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। নির্ধারিত ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল উপকরণগুলাে ফুটিয়ে নিয়ে তা রিফাইন করার মাধ্যমে সংমিশ্রণ ঘটানাে এবং বােতলজাত করা থেকে মুখ লাগানাে পর্যন্ত সবকিছুই অটো মেশিনে ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু কথিত জুস কারখানাগুলােতে সবকিছুই চালানাে হচ্ছে হাতুড়ে পদ্ধতিতে।

মসলায় রঙ, ইট ও কাঠের গুড়া

মানুষ যে পণ্যটি সবচেয়ে বেশী ব্যাবহার করে সেটি হল খাবারের মসলা। অধিক মুনাফার আশায় একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী মসলায় কাপড়ে ব্যবহৃত বিষাক্ত রঙ, দুগন্ধযুক্ত পটকা মরিচের গুঁড়া ধানের তুষ, ইট ও কাঠের গুঁড়া, মটর ডাল ও সুজি ইত্যাদি মেশাচ্ছেন।  অসাধু চক্র প্রথমে গােপন কারখানায় ভেজাল মসলা উৎপাদন করে। পরে তা প্যাকেটজাত করে খােলাবাজারে সরবরাহ করে। তারা কিছু প্যাকেট ছাড়া, কিছু সাধারণ প্যাকেটে এবং কিছু নামিদামি কােম্পানির লেভেল লাগিয়ে মসলাগুলাে তিনি করেন।

ফলে কেমিক্যাল

ফলে কেমিক্যাল ও ফরমালিন ব্যাবহার করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। বাজারের কলা, আম, পেঁপে, পেয়ারা থেকে শুরু করে আপেল, আঙুর, নাশপাতিসহ সব ফলেই মেশানাে হচ্ছে বিষাক্ত ফরমালিন। অপরিপক্ক ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড এবং তা উজ্জ্বল বর্ণে রূপান্তর করার জন্য অধিক ক্ষার জাতীয় টেক্সটাইল রঙ ব্যবহার হচ্ছে অবাধে। ফল গাছে থাকা পর্যায় থেকে বাজারে বিক্রি করা মুহুর্ত পর্যন্ত এক একটি ফলে ছয় দফা কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়।

মুড়িতে ইউরিয়া

খাদ্যে ভেজালের তালিকায় মুড়িও রয়েছে। মুড়িতে লবণের পরিবর্তে মিশানো হচ্ছে ইউরিয়া। প্রতিযােগিতার বাজারে মুড়িকে লম্বা, সাদা, কাঁপানাে ও আকর্ষণীয় করতে মুড়ি বেপারি এবং আড়তদাররা শ্রমিকদের সার সরবরাহ করছেন। তাদের প্ররােচনায় না বুঝে ঘরে ঘরে মুড়ি শ্রমিকরা লবণের বদলে চালে ইউরিয়া মিশিয়ে মুড়ি তৈরি করছেন।

পানির বোতলে ভেজাল

জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পানি পর্যন্ত নিরাপদ থাকছে না। যত্র তত্র নকল কারখানা বানিয়ে পুকুর ডােবা এবং ওয়াসার পানি বিশুদ্ধকরণ ছাড়া বােতলজাত করেই বিশুদ্ধ মিনারেল পানি বলে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। 

নকল দুধ

শুধু ভেজাল দিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছেন না এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী, এবার নকল দুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন তারা। ছানার পানির সঙ্গে কেমিক্যাল মিশিয়ে সহজেই তৈরি করা হচ্ছে এমন ‘বিষ’। পরে ‘খাঁটি দুধ’ হিসেবে তা চালান হয়ে আসছে রাজধানীতে। দীর্ঘ সময় সতেজ রাখতে এতে মেশানাে হচ্ছে ফরমালিন। 

ব্যবসায়ে ভেজালের অনুপ্রবেশ

ব্যবসা একটা পবিত্র পেশা। একসময় এ পবিত্রতা রক্ষা হত পুরােপুরিভাবে। ব্যবসার ক্ষেত্রে সুন্দর নীতি ও আদর্শ ছিল। ব্যবসায় ভেজাল দেয়ার কথা মানুষ কল্পনাই করতে পারত না। ভেজালকে তারা পাপ বলে মনে করত। কিন্তু এ অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে ইংরেজ আমল থেকেই। ইংরেজরা এদেশে আসার পর থেকে সামাজিক জীবনে নানাভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়। তাদের শােষণ – নীতির ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে মানুষ দিশেহারা হয়ে নীতি-আদর্শ থেকে দূরে সরে পড়ে। ইংরেজরা এদেশে আগমনের পর থেকে মানুষের ধর্মবােধেও ক্রমশ আঘাত আসতে থাকে। ফলে এ দেশের কিছুসংখ্যক লােক তাদের নীতি ও আদর্শ থেকে আরও একধাপ নীচে নেমে আসে।

আর এ সুযােগে স্বার্থান্বেষী মহল এবং অসাধু ব্যবসায়ীরা ইংরেজদের সহায়তায় সমাজকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করে। অস্বাভাবিকভাবে সুদখাের মহাজন ও চোরাকারবারীদের দৌরাত্ম বৃদ্ধি পায়। জীবন ধারণের তাগিদে সাধারণ মানুষ জড়িয়ে পড়ে দুর্নীতির সাথে এবং এ দুর্নীতির ধারাবাহিকতায় পণ্যদ্রব্য বা ব্যবসায় ভেজালের অনুপ্রবেশ ঘটে।

নীতিবােধ ও অতীতে ব্যবসায়-বাণিজ্য

মানুষের জীবনে অমূল্য সম্পদ হল নীতিবােধ। এই নীতিবােধকে বিসর্জন দিয়ে মানুষ কখনও বড় হতে পারে না। চোরাপথে জীবনের যে সাফল্য তা ক্ষণস্থায়ী। নীতিবােধই মানুষের বড় আশ্রয়। তার রক্ষাকবচও বটে। ব্যবসায়-বাণিজ্যের সঙ্গে সমাজজীবনের সম্পর্ক নিবিড়। অতীতেও আমাদের দেশের সওদাগরেরা সপ্তডিঙা মধুকর সাজিয়ে বাণিজ্যের তরী ভাসিয়েছেন। বাণিজ্যের পশরা নিয়ে গেছেন দেশে-দেশান্তরে। এসেছেন অন্য দেশের বণিকের দল। সেদিনও সওদাগর তার সিন্দুক ভরেছেন লাভের মুদ্রায়। কিন্তু সেই মুনাফা নীতিবােধ বিসর্জন দিয়ে নয়। সেদিন বাণিজ্য ছিল তাঁদের কাছে সাধনার বিষয়। তারা নিষ্ঠা, নীতিবােধ নিয়ে ব্যবসায় করেছেন। আর ইসলামিক বিধি-ব্যবস্থায় ব্যবসায় হচ্ছে কল্যাণ। ‘চোরাবাজার’ শব্দটি সেদিন ব্যবসায়িক অভিধানে ছিল একেবারে অপরিচিত।

ভেজালের কারণ

ভেজাল কোনাে প্রাকৃতিক কিংবা দৈব দুর্যোগ নয়। এটি সম্পূর্ণরূপে মনুষ্য সৃষ্টি। সমাজের এক শ্রেণির স্বার্থপর হীনমানসিকতাসম্পন্ন মানুষের হীনম্মন্যতার ফসল এই ভেজাল। অল্প পুঁজিতে অনেক লাভ- এ মানব বিধ্বংসী লালসা থেকেই খাদ্যে ভেজাল মিশানাে হয়। আঠারাে শতকের শেষার্ধ থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ইউরােপের শিল্প-প্লব ক্রমান্বয়ে সারাবিশ্বে সঞ্চারিত হয়। এর প্রভাবে মানুষের জীবন-জীবিকায় সৃষ্টি হয় তীব্র প্রতিযােগিতা। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া এ প্রতিযােগিতাকে আরও তীব্রতর করে তুলছে। এ প্রতিযােগিতায় টিকে থাকার জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে। অর্থের জন্য মানুষ নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিতেও দ্বিধাবােধ করে না। এর প্রভাব পড়ে খাদ্যদ্রব্যেও। মানুষ এখন আর সৎপথ, সৎচিন্তা ও সততার কথা মােটেই ভাবে না। তাদের চাই টাকা, যেকোনাে উপায়েই হােক। এ ধ্যানধারণা সমাজের উঁচুস্তর থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত সর্বত্র বিরাজমান। ফলে সমাজে কোনটি আসল, কোনটি ভেজাল তা চেনার উপায় নেই। ফলে ভেজাল এখন আমাদের দেশে একটি জাতীয় সমস্যায় রূপান্তরিত হয়েছে।

ভেজালের ফলাফল

বর্তমান যুগকে তথ্যপ্রযুক্তির যুগ না বলে ভেজালের যুগ বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। অর্থের লালসা ব্যবসায়ীদের এমন অমানুষ করে তুলেছে যে, তাদের কাছে দেশ ও দেশের মানুষের ন্যূনতম মূল্যও নেই। ফলে ভেজাল খাদ্য খেয়ে অসংখ্য মানুষ কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। ভেজাল খাদ্য অনেকের দেহে মরণব্যাধি ক্যানসার সৃষ্টি করছে। ফলে মােট জনসংখ্যার দশভাগ মানুষও এখন আর পুরােপুরি সুস্থ নয়। এমন অনেক পরিবার আছে যে পরিবারের কর্মক্ষম লােকগুলাে খাদ্যে ভেজালের কারণে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কেউবা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। ফলে ঐসব পরিবার মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। ভেজালের কারণে কত মানুষ অকালে ঝড়ে পড়েছে, কত পরিবার পথে বসেছে তার ইয়ত্তা নেই। শুধু তাই নয়, খাদ্যে ভেজালের কারণে হৃদরােগ, ডায়াবিটিস, গলগণ্ড, পেটের পীড়া, টাইফয়েড প্রভৃতি দুরারােগ্য ব্যাধির বিস্তার ঘটে। ব্রমার নামক একজন বিজ্ঞানী খাদ্যে ভেজাল সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “ফসফরাসসমৃদ্ধ কীটনাশক শুধু যে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তাই নয়, এটি মানবজাতির জন্য বিরাট অভিশাপ। কারণ এসব কীটনাশকজাতীয় বিষ খাদ্যচক্র ও পরিবেশের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে মানুষের স্বাভাবিক বিবর্তন প্রক্রিয়াকে পরিবর্তিত করছে। তাদের প্রজনন ক্ষমতাকে করছে বিনষ্ট।”

ভেজালের প্রতিকার

খাদ্যে ভেজাল জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক এতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে খাদ্যে ভেজালের প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহ। ভেজাল মারাত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তাই ভেজালের প্রতিকারের জন্য  সুপরিকল্পিতভাবে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সমাজজীবন থেকে অপরাধমূলক ভেজাল প্রবণতা দূর করতে হলে প্রাথমিকভাবে যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার সেগুলো হল – 

  • সমাজবদ্ধ মানুষের মধ্যে আদর্শবাদিতা, ন্যায়-নীতিবােধ এবং মানবতাবােধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
  • অপরাধ প্রবণতা বন্ধ করার জন্যে সরকারিভাবে কঠোর আইন প্রয়ােগের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আদর্শ চরিত্র গঠনের শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
  • ধর্মীয় চেতনা সমৃদ্ধ শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে মানুষের হীনমন্যতার পরিবর্তন সাধন করতে হবে।
  • রাষ্ট্রের অর্থ ও খাদ্যব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।
  • বাজার ব্যবস্থায় যাতে মজুতদারদের একচেটিয়া প্রাধান্য না থাকে, সে বিষয়ে দেশের প্রকারকে সদা সতর্ক থাকতে হবে।
  • আদর্শ বাজার কমিটির মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
  • ভেজাল বিরোধী অভিযান আরও জোরদার করতে হবে। 
  • নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ যথযথ প্রয়োগ করতে হবে।

উপরােক্ত ব্যবস্থাবলি গ্রহণ করে যদি তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তবে সমাজ থেকে ভেজাল নামক অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পেতে পারে।

খাদ্যে ভেজাল রোধে বর্তমান অভিযান

স্বাধীনতার পর আমাদের প্রত্যাশা ছিল, আমরা ইংরেজ আমলে হারানাে মূল্যবােধ, ধর্মবােধ আর নীতিবােধকে আবার ফিরে পাব। ফিরে পাব বিধ্বস্ত সততা। কিন্তু দেশভাগের ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় আরও তীব্র হল। সংকট এল মূল্যবােধে। সমাজদ্রোহীরা দিনে দিনে পুষ্ট হয়েছে। ঘূণ্য ব্যবসায়ীর এখানে কঠোর শাস্তি হয় না।  দুর্নীতি দমনের জন্য গঠিত হয়েছে টাস্ক ফোর্স। কিন্তু তাও ভেজালের ছোঁয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। বস্তুত আইন দিয়ে কখনও মানুষের হৃদয়ের পরিবর্তন করা যায় না। বিবেকবােধকে পায়ে দলিত করেই তারা পার্থিব সুখের শিখরে ওঠে।

খাদ্যে ভেজাল ও তার প্রতিকার
ভেজালবিরোধী অভিযানের একটি চিত্র, সূত্র: ফেসবুক

খুব কম মানুষই আছে যারা অসচেতনভাবে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেয় তথা অন্যকে প্রতারণা করে। প্রায় সবক্ষেত্রেই জেনে-শুনে এবং সচেতনভাবেই এই গর্হিত ও সামাজিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযােগ্য ও নিন্দনীয় অপকর্মটি একশ্রেণীর ব্যাবসায়ী ও বিক্রেতা করে থাকে, এতে কোনাে সন্দেহ নেই। তাদের ওয়াজ-নসিহত করে বিরত রাখা যাবে না, শক্ত হাতে দমন করতে হবে।

দেশের সংবিধানের ১৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবে’। বাজার যেখানে ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্যে পূর্ণ সেখানে জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করতে হলেও রাষ্ট্রকে অবশ্যই সর্বাগ্রে ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্য এবং এসবের জোগানদাতাদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হতে হবে। জনগণকেও এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে।

বিশুদ্ধ খাদ্য বিল ২০০৫

সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘বিশুদ্ধ খাদ্য বিল ২০০৫’ নামে একটি আইন করা হয়েছে। এ আইনে সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা এবং সর্বোচ্চ ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ১১ জুলাই ২০০৫ প্রথমবারের মতাে ভেজাল ও অস্থায্যকর খাবার তৈরির জন্য হােটেল মালিককে সাজা প্রদান ও জরিমানা করা হয়।

নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩

নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ (২০১৩ সালের ৪৩ নং আইন) এর ৯০টি ধারা, ১৩টি অধ্যায়, ৩৩টি খাদ্য ভেজাল ও খাদ্য-সংক্রান্ত বিষয়ক সংজ্ঞা এবং নিরাপদ খাদ্য বিধিমালা ২০১৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য আইনে ‘নিরাপদ খাদ্য’ বলতে প্রত্যাশিত ব্যবহার ও উপযোগিতা অনুযায়ী মানুষের জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত আহার্যকে বুঝানো হয়েছে।

ভেজালবিরােধী অভিযান

জনস্বাস্থ্যের ওপর খাদ্যে ভেজালের প্রভাব উপলব্ধি করে সরকার ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছে। এ অভিযান জনমনে প্রত্যাশার আলাে জ্বালাতে সক্ষম হয়েছে। ইতােমধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে ভেজালবিরােধী অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও খাদ্য বিক্রেতাকে জরিমানা ও শাস্তির ব্যবস্থা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত এর গ্রহণযােগ্যতাকে আকাশচুম্বী করতে সক্ষম হয়েছে। তবে ভেজালের পরিধি এতটাই বিস্তৃত যে, ভ্রাম্যমাণ আদালতকে অনেক সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়তে হচ্ছে। এক্ষেত্রে অপরাধের পরিমাণের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কঠোর আইন প্রণয়ন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।

উপসংহার

খাদ্যে ভেজাল জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। আর এর সাথে জড়িত সমাজের এক শ্রেণির অসৎ ও অসাধু ব্যবসায়ী। সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে নিজেদের আখের গােছানােই এদের লক্ষ্য। এদের অশুভ তৎপরতায় সমাজের কত মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে বা হচ্ছে তার কোনাে ইয়ত্তা নেই। তাই এখনই এদের প্রতিরােধ করতে হবে- নিশ্চিত করতে হবে ভেজালমুক্ত খাদ্যের। এমতাবস্থায় সমাজের প্রতিটি মানুষের উচিত নিজ নিজ অবস্থানে থেকে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরােধে সূচনা রাখা।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button