আল্লাহ্ আমাদের সৃষ্টি করেছেন তার দাসত্ব ও ইবাদত করার জন্য। পিতা–মাতার খেদমত করা অন্যতম ইবাদত। মেরাজের রজনীতে আল্লাহপাক প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর নিকট যে চৌদ্দটি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন তার প্রথমটি হলো আল্লাহর সঙ্গে শরিক না করা ও দ্বিতীয় হলো পিতা–মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা।
বান্দার হকের মধ্যে সবার উপরে হল পিতা–মাতার হক। সুতরাং পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণ করাই তাদের হক আদায় করার শামিল।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
পিতা–মাতা হলো তোমার জান্নাত এবং জাহান্নাম অর্থাৎ তুমি ইচ্ছা করলে তাদের খেদমত করে উত্তম আচরণের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারো; আবার ইচ্ছা করলে তাদের অবাধ্য হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করতে পারো।’ (ইবনে মাজাহ)।
১) যদি মাতা-পিতার প্রয়ােজন হয় এবং সন্তান তাঁদের ভরণ-পােষণ দিতে সক্ষম হয়, তাহলে মাতা-পিতার ভরণ-পােষণ দেয়া সন্তানের উপর ওয়াজিব। এমনকি পিতা-মাতা কাফের হলেও তাদের ভরণ-পোষণ দেয়া ওয়াজিব।
২) প্রয়ােজন হলে মাতা-পিতার খেদমত করা দায়িত্ব। খেদমত নিজে করতে পারলে করবে নতুবা খেদমতের জন্য লােকের ব্যবস্থা করা দায়িত্ব। উল্লেখ্য, খেদমতের ক্ষেত্রে পিতার তুলনায় মাতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
৩) মাতা-পিতা ডাকলে তাদের ডাকে সাড়া দেয়া এবং হাজির হওয়া। এমনকি মাতা-পিতা যদি কোনাে অসুবিধায় পড়ে বা অসুবিধার ভয়ে সহযােগিতার জন্য ডাকেন আর অন্য কেউ তাদের সহযােগিতা করার মত না থাকে, তাহলে ফরয নামাযে থাকলেও তা ছেড়ে দিয়ে তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া ওয়াজিব। তবে জরুরত ছাড়া যদি ডাকেন তাহলে ফরয নামায ছাড়া জায়েয হবে না।
আর নফল বা সুন্নাত নামাযে থাকা অবস্থায় বিনা জরুরতে মাতা-পিতা ডাকলে তখনকার মাসআলা হল- যদি সে নামাযে আছে একথা না জেনে ডেকে থাকেন, তাহলে নামায ছেড়ে তাদের ডাকে সাড়া দেয়া ওয়াজিব। আর যদি নামাযে আছে একথা জেনেও বিনা জরুরতে ডাকেন, তাহলে সেরূপ ক্ষেত্রে নামায ছাড়বে না। দাদা-দাদী, নানা-নানীর ক্ষেত্রেও মাসআলা অনুরূপ।
৪) পিতা-মাতার হুকুম মান্য করা ওয়াজিব, যদি কোন পাপের বিষয়ে হুকুম না হয়। কেননা, পাপের বিষয়ে হুকুম হলে তা মান্য করা নিষেধ। মােস্তাহাব পর্যায়ের ইলম হাছিল করার জন্য সফর করতে হলে তাদের অনুমতি প্রয়ােজন । তবে ফরযে আইন ও ফরযে কেফায়া পরিমাণ ইলম হাছিল করার জন্য সফর করাটা তাদের অনুমতির উপর নির্ভরশীল নয়।
৫) পিতা-মাতার সঙ্গে সম্প্রীতি ও ভক্তির সাথে নম্রভাবে কথা বলা আদব। রূঢ়ভাবে ও ধমকের স্বরে কথা বলা নিষেধ।
৬) কথায়, কাজে ও আচার-আচরণে পিতা-মাতার আদব-সম্মান রক্ষা করা। এ জন্যই তাঁদের নাম ধরে ডাকা নিষেধ, চলার সময় তাদের পশ্চাতে চলা উচিত, তাঁদের সামনে নিম স্বরে কথা বলা উচিত, তাদের দিকে তেজ দৃষ্টিতে তাকানাে অনুচিত। উল্লেখ্য যে, সম্মানের ক্ষেত্রে মাতার তুলনায় পিতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
৭) কোনােভাবে তাঁদেরকে কষ্ট দেয়া হারাম। পিতা-মাতা অন্যায়ভাবে কষ্ট দিলেও তাদেরকে কষ্ট দেয়া যাবে না। এমনকি মৃত্যুর পরও তাদেরকে কষ্ট দেয়া নিষেধ, এ জন্যই তাদের মৃত্যুর পর চিৎকার করে কাঁদা নিষেধ। কারণ তাতে তাদের রূহের কষ্ট হয়।
এক সাহাবি (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আমার পিতা–মাতা ইন্তেকালের পরেও কি তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের কোনো কিছু দায়িত্ব অবশিষ্ট আছে?’ তখন নবী করিম (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, আছে। তা হলো তাঁদের জন্য দোয়া করা, তাঁদের গুনাহের জন্য তওবা–ইস্তিগফার করা, তাঁদের শরিয়তসম্মত অসিয়তগুলো আদায় করা, তাঁদের আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, তাঁদের বন্ধুবান্ধবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। এগুলো পিতা–মাতার মৃত্যুর পরও তাঁদের সঙ্গে উত্তম আচরণের শামিল।’ (আবু দাউদ)
৮) নিজের জন্য যখনই দুআ করা হবে, তখনই পিতা-মাতার মাগফেরাতের জন্য, তাঁদের প্রতি আল্লাহর রহমতের জন্য এবং তাঁদের মুশকিল আছান ও কষ্ট দূর হওয়ার জন্য দুআ করা কর্তব্য । তাদের মৃত্যুর পরও আজীবন তাঁদের জন্য এরূপ দুআ করতে হবে । জনৈক তাবিঈ বলেছেন, যে প্রতিদিন অন্তত পাঁচ বার পিতা-মাতার জন্য দুআ করল, সে পিতা-মাতার হক (অর্থাৎ, দুনিয়াবী হক) আদায় করল । পিতা-মাতার জন্য দুআ করার বিশেষ বাক্যও আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন। তা হল –
রাব্বির হাম-হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিরা।
অর্থঃ হে আল্লাহ, আমার পিতা-মাতাকে ভাল রেখ, শান্তিতে আদরে সুখে রেখ, যেভাবে তারা আমাদেরকে রেখেছের আমাদের শৈশবে।
এ দুআর মধ্যে পিতা-মাতার প্রতি আল্লাহর রহমত কামনা করা হয়। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, পিতা-মাতা অমুসলমান হলে তাদের জীবদ্দশায় এ রহমতের দুআ এই নিয়তে জায়েয হবে যে, তারা পার্থিব কষ্ট থেকে মুক্ত থাকুন এবং ঈমানের তাওফীক লাভ করুন। মৃত্যুর পর তাঁদের
জন্য রহমতের দুআ করা জায়েয নয়।
৯) পিতা-মাতার খাতিরে পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জনের সাথে এবং পিতা-মাতার ঘনিষ্ঠজনদের সাথে ভাল ব্যবহার করা, সম্মানের ব্যবহার করা এবং সাধ্য অনুযায়ী তাদের উপকার ও সাহায্য করা কর্তব্য।
১০) পিতা-মাতার ঋণ পরিশােধ করা এবং তাঁদের জায়েয ওছিয়াত পালন করাও তাঁদের অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
বি. দ্র. দুধমাতার সঙ্গেও সদ্ব্যবহার করতে হবে। তাঁর আদব তাজীম রক্ষা এবং যথাসাধ্য তাঁর ভরণ-পােষণ করতে হবে। আর বিমাতা নিজের আপন মাতা না হলেও যেহেতু সে পিতার প্রিয়জনের মধ্যে একজন, তাই তাঁর সঙ্গে সদ্ব্যবহার এবং যথাসাধ্য তার জানে মালে খেদমত করতে হবে ।
এই রকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন। এর পাশাপাশি গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন।
