প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের কয়েকটি গােত্র ছাড়া প্রায় সকল স্থানের আরবগণই ছিল অশিক্ষিত ও সভ্যতা বর্জিত। তাদের জীবন ছিল বর্বরতায় পূর্ণ। তবে তাদের জীবনে কিছু কিছু প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য ছিল। যার বিবরণ নিম্নরূপঃ
প্রাক-ইসলামী যুগের আরবগণ ছিল কষ্ট-সহিষ্ণু, নির্ভীক ও চির সংগ্রামী। মরুময় রুক্ষ আরবে জীবন-যাপন উপযােগী খাদ্য ও পানীয়ের বড় অভাব ছিল। বাঁচার জন্য তারা প্রকৃতির সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করত। তারা আরব সীমানা পেরিয়ে ব্যবসায়-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল। এভাবে তারা নিজেদের এবং পরিবারের সকলের জীবিকা অর্জনের সুব্যবস্থা করত।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবগণ সমবায় ভিত্তিতে ব্যবসায়-বাণিজ্য করত। তাই সে সময়ে উত্তর ও দক্ষিণ আরবে বিপুল বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের ফলে সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল। তারা দীর্ঘ দু’হাজার বছর বিশ্বের বিভিন্ন সভ্য জাতির সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্য চালিয়েছিল। প্রাক-ইসলামী যুগে ব্যবসায়-বাণিজ্যের এরূপ প্রসার নিঃসন্দেহে প্রশংসাযােগ্য।
প্রাক-ইসলামী যুগের আরবগণ ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ। ক্ষুধার্তকে অন্নদান, আশ্রয় প্রার্থীকে আশ্রয়দান এবং অত্যাচারিতকে রক্ষা করা তারা তাদের কর্তব্য বলে মনে করত। আশ্রিত ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য তারা নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিত। পরবর্তীকালে তাদের এ গুণাবলীকে লালন করার জন্য মহানবী (স) বলেন, “অন্ধকার যুগের আদর্শ গুণাবলীর প্রতি লক্ষ কর এবং সেগুলােকে ইসলামের কাজে লাগাও। অতিথিকে আশ্রয় দাও, এতিম শিশুর প্রতি সদয় হও এবং আশ্রিতদের সাথে সদয় ব্যবহার কর”।
প্রাক-ইসলামী যুগের আরবগণের একটি প্রশংসনীয় গুণ ছিল অতিথিপরায়ণতা। তাছাড়া তাদের সরলতা এবং উদারতাও বিশেষ প্রশংসাযােগ্য ছিল। অতিথির থাকা-খাওয়া এবং মর্যাদা রক্ষার জন্য তারা সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও কুষ্ঠিত হত না। ইসলাম-পূর্ব যুগে একমাত্র আরবদের উদ্যোগে এশিয়ার সঙ্গে ইউরােপের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য শুধুমাত্র উৎপন্ন পণ্যদ্রব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা নিজেদের পণ্যদ্রব্য আফ্রিকা ও ভারতে রপ্তানি করত। সেখান থেকেও অনেক পণ্যদ্রব্য তারা আমদানি করত।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবগণ কবিতা রচনা ও বক্তৃতায় বিশেষ পারদর্শী ছিল। কবিতার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য প্রতিভার প্রকাশ পেত। সে যুগে কবির মর্যাদা ছিল অসাধারণ। অধ্যাপক নিকলসন বলেন, ‘কবিতা কেবল সে যুগের কিছু সংখ্যক লােকের কাছে বিলাসিতার বস্তুই ছিল না, বরং তা ছিল তাদের সাহিত্য প্রতিভা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম’। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, ‘কাব্যপ্রীতিই ছিল বেদুঈনদের সাংস্কৃতিক সম্পদ”। তাদের কবিতাগুলাে কাসিদা’ নামে খ্যাত ছিল। তিনি আরাে বলেন, “এ কাসিদাগুলাে ছন্দ এবং বিশদ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ‘ইলিয়ড’ ও ‘অডিসি’কেও অতিক্রম করেছিল’।
আরবের অধিকাংশ লােক যদিও নিরক্ষর ও মূর্খ ছিল, তবুও তাদের স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। এ গুণের মাধ্যমে তারা প্রাচীন যুগের লােকগাঁথা, প্রবাদ, লােকশ্রুতি ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের পূর্বপুরুষদের নাম তথা বংশ বৃত্তান্ত তারা বিশেষভাবে স্মরণ রাখত। এছাড়া তারা অনায়াসে অসংখ্য কবিতা কণ্ঠস্থ করে রাখতে পারত।
প্রাক-ইসলামী যুগে প্রতিবছর নির্ধারিত সময়ে মক্কার অদূরে উকা নামক স্থানে একটি বাৎসরিক মেলা বসত। এখানে খ্যাতনামা আরব কবিদের মধ্যে কবিতা পাঠের আসর বসত। বিজয়ী কবিদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হত। ঐতিহাসিক হিট্টি, উকাযের মেলাকে প্রাচীন আরবের ‘একাডেমিক ফেঞ্চাজ’ বলে অভিহিত করেছেন।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রাক-ইসলামী যুগের আরবদের আগ্রহ ছিল সীমাহীন, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। সাহিত্যিকগণ প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সাহিত্য আসরের আয়ােজন করতেন। হিট্টির মতে, ‘পৃথিবীতে সম্ভবত অন্য কোন জাতি আরবদের ন্যায় সাহিত্য চর্চায় এত বেশি প্রাণঢালা আগ্রহ প্রকাশ করেনি এবং কথিত বা লিখিত শব্দ দ্বারা এত আবেগাপ্লুত হয়নি’।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবগণ তাদের আবাস শিল্প ও মুদ্রাকে যথেষ্ট উন্নত করেছিল। আবাস গৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে সে যুগে কিছু কিছু গ্রানাইট ও মারবেলের ব্যবহারও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সানার মুসকানের ২০ তলা দুর্গ এবং দক্ষিণ আরবে অবস্থিত বিশাল বাঁধ আরবদের স্থাপত্য শিল্পের পরিচয় বহন করে।
এই রকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন। এর পাশাপাশি গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন।