বাংলা রচনা

গ্রাম্য মেলা : রচনা || বাংলা ২য়

1/5 - (1 vote)
গ্রাম্য মেলা  রচনা
গ্রাম্য মেলা  রচনা

গ্রাম্য মেলা রচনা

প্রিয় শিক্ষার্থী, আজকে বাংলা ২য় পত্রের রচনা বিভাগ থেকে “গ্রাম্য মেলা রচনা” নিয়ে আলোচনা করব। আজকের রচনাটি থেকে আমরা জানতে পারবোঃ গ্রাম্য মেলা কী, মেলার প্রচলন কীভাবে হল, মেলার তাৎপর্য, উপকারিতা, অপকারিতা ইত্যাদি।

ভূমিকা

বসেছে আজ রথের তলায়।
স্নানযাত্রার মেলা –
সকাল থেকে বাদল হল
ফুরিয়ে এল বেলা
—- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘মেলা’ শব্দের মূল অর্থ মিলিত হওয়া। সাধারণত গ্রামাঞ্চলের মানুষ যেসব উৎসব-অনুষ্ঠানে মিলিত হয়ে আনন্দ উপভোগ করে তাকে গ্রাম্য মেলা বলা হয়। বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ। গ্রাম্য মেলা আবাহমান কাল থেকে বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এদেশের অধিকাংশ মানুষই গ্রামে বাস করে। গ্রামবাসীর কাছে তাই গ্রাম্য মেলা অতি পরিচিত একটি সামাজিক অনুষ্ঠান।

মেলার প্রচলন

মেলার প্রচলন মানব জাতির ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। এমনকি প্রাগৈতিহাসিক যুগেও বিভিন্ন উত্স থেকে জানা যায় যে উৎসবের সময় মেলা বসে। প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের বিভিন্ন মেলার কথা ইতিহাসে রয়েছে। উপমহাদেশের মধ্যেও হাজার বছরের পুরনো লোক-ঐতিহ্য হিসেবে মেলা স্বীকৃত। প্রাচীন রোম, পারস্য ও চীনেও মেলার প্রচলন ছিল বলে পুঁথি-পুস্তকে প্রমাণ পাওয়া যায়। বিশেষ কোন পর্ব উপলক্ষে মেলার প্রচলন হলেও এখন গ্রামীণ-জীবনে এটি একটি স্বাভাবিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। সাধারণত বছরের শেষে অথবা বছরের শুরুতে এই মেলা বসে অথবা বিশেষ কোন পূর্ব উপলক্ষেও মেলার আয়ােজন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল গ্রামবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনে সেই প্রাচীনকাল থেকে আজও বহাল তবিয়তে টিকে আছে মেলা।

মেলার উৎপত্তি

আদিম যুগে মানুষ অদৃশ্য দেবতা-পুরুষকে বিশ্বাস করতাে, যা আদিমতম ধর্ম বিশ্বাস বা ‘এনিমিস্টিক’ (Animistic) নামে পরিচিত। তৎকালীন সময়ে মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা এবং আরাে অধিক পরিমাণ ফসল ও খাদ্য প্রাপ্তির জন্য দেবতা-পুরুষের সহায়তা কামনা করতাে। এ বিশ্বাস থেকে তারা যেদিন বার্ষিক ফসল পেতাে, সেদিন কোনাে পাহাড়-পর্বতের পাদদেশে, নদীর তীরে বা সুবৃহৎ বৃক্ষের শীতল ছায়ায় সমবেত হতাে। এসকল স্থানে তারা নব ফসল সম্ভার, জীবজন্তু বা গৃহে প্রস্তুত দ্রব্য সামগ্রী উপঢৌকন দিতাে। নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, এ জমায়েত বা মিলন থেকে আধুনিক গ্রাম্য মেলার উৎপত্তি হয়েছে।

মেলার উপলক্ষ

মেলা অনুষ্ঠানের জন্য সাধারণত বিশেষ উপলক্ষ কাজ করে। আবহমানকাল ধরে আয়ােজিত গ্রাম্য মেলাগুলাে সাধারণত দুই ধরনের উপলক্ষ নিয়ে আয়ােজন করা হয়। যেমনঃ

ধর্মীয়

ধর্মীয় মেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে। যেমন – চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, রথযাত্রা মেলা, অষ্টমী মেলা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা মেলা, মাঘী পূর্ণিমা মেলা, কোনাে লৌকিক দেবতা, দরবেশ, পীর বা সন্ন্যাসীর নামে মেলা ইত্যাদি।

ধর্ম নিরপেক্ষ বিভিন্ন লােকায়ত মেলা

নববর্ষ, পৌষ মেলা, নৌকা বাইচের মেলা, ঘােড়া দৌড়ের মেলা, লাঠিখেলার মেলা, পশু প্রদর্শনীর মেলা, ঘুড়ি উৎসব মেলা, কুটির শিল্পের মেলা, বিভিন্ন খেলাধুলার মেলা, কুস্তি প্রতিযােগিতার মেলা ইত্যাদি। তা ছাড়া কোনাে বিশেষ ব্যক্তি, কবি, সাহিত্যিকের নামেও মেলার আয়ােজন করা হয়। যেমন- কবি জসীমউদ্দীন মেলা, লালন শাহ্ মেলা, মাইকেল মধুসূদন মেলা, বনলতা সেন মেলা ইত্যাদি। তা ছাড়া উপজাতিরা গ্রামের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসারে গ্রাম্য মেলার আয়ােজন করে থাকে।

তবে যে উপলক্ষেই গ্রাম্য মেলার আয়ােজন করা হােক না কেন মেলা বাঙালি সমাজ ও মানুষের নিকট খুব জনপ্রিয় ও আনন্দের দিন। বাংলাদেশে প্রচলিত মেলাগুলাের কোনােটি একদিন কোনােটি এক সপ্তাহ, কোনটি পনের দিন আবার কোনাে কোনাে মেলা মাসব্যাপী চলতে থাকে।

মেলার স্থান

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের মেলা বসে। মেলা বসার জন্য হাট-বাজারের ন্যায় নির্দিষ্ট কোনাে স্থান নির্ধারিত থাকে না। সাধারণত গ্রামের কেন্দ্রস্থলে খােলা মাঠে, মন্দির প্রাঙ্গণে, নদীর তীরে অথবা বড় বৃক্ষের নিচে গ্রাম্য মেলা বসতে দেখা যায়। পূর্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী এসব স্থানে মেলার আয়ােজন করা হয়। মেলার স্থানে সাময়িকভাবে দোকানপাট বসার মত চালা নির্মাণ করা হয়। মেলা শেষ হওয়ার পর এগুলাে ভেঙে ফেলা হয়। বছরের শেষে মেলার আনন্দে আবারও মুখরিত হয়ে ওঠে মেলার সে স্থান।

মেলার প্রস্তুতি

কোন দিন মেলা বসবে তা এলাকার লােকেরা আগে থেকেই জানে এবং সে অনুসারে তাদের প্রস্তুতি চলে। গ্রামের ছােট ছােট ছেলে-মেয়েরা আগে থেকেই মেলায় খরচ করার জন্য তাদের পিতা-মাতার নিকট থেকে টাকাপয়সা জমা করতে থাকে। এছাড়া আশেপাশের কারিগরেরা মেলায় বিক্রির জন্য আগে থেকেই বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করতে থাকে। তবে মেলায় বিক্রির জন্য ছােট ছােট ছেলেমেয়েদের পছন্দের রঙ-বেরঙের খেলনা তৈরিতেই বেশি মনােযােগ দেয় কারিগররা। যারা মেলার মূল আয়ােজক তারাও দীর্ঘদিন ধরে মেলার জন্য প্রস্তুতি নেয়। মেলার জন্য নির্ধারিত স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, মেলার পরিবেশ সুশৃঙ্খল রাখার জন্য স্বেচ্ছাসেবক নিয়ােগ করা, দোকান বরাদ্দ দেওয়া, আগত অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করাসহ নানা ধরনের প্রস্তুতি তারা পূর্ব থেকেই নিয়ে থাকে।

বাংলাদেশের মেলার অতীত ঐতিহ্য

বাংলাদেশের মেলার ঐতিহ্য বহুকালের। কিন্তু তা যে কতাে পুরানাে, কবে এবং কীভাবে এর সৃষ্টি সেসব তথ্য অজ্ঞাত। ইতিহাসও এ বিষয়ে নীরব। মেলার আদিবৃত্তান্ত না জানা গেলেও ধারণা করা চলে যে ধর্মীয় উপলক্ষ্যেই এ দেশে মেলার জন্ম। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষ্য। মেলার সমাবেশ ও বিকিকিনির প্রাথমিক ধারণা সম্ভবত গ্রামীণ হাট থেকেই এসেছিল। সেই অর্থে হাটই মেলার আদিরূপ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন মেলা

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মেলাই ধর্মীয় উপলক্ষ্যে প্রবর্তিত। হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রা, দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা, দুর্গাপূজা, কালীপূজা, জন্মাষ্টমী, পৌষ সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি, শিবরাত্রি, সাধু-সন্তের জন্ম-মৃত্যুর স্মারক দিবস ইত্যাদি উপলক্ষ্যে মেলা বসে। চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় জগন্নাথ দেবের স্নান উপলক্ষ্যে যে মেলার আয়ােজন হয় তাও যথেষ্ট প্রাচীন ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। লাঙ্গলবন্ধের মেলা আয়ােজন ও ঐতিহ্যে সবার সেরা। দোলপূর্ণিমায় বসে অনেক মেলা। এই তিথি সাধুসঙ্গের সবচেয়ে বড়াে তিথি। দোলের সঙ্গে বাংলার লৌকিক সাধন-জগতের রয়েছে নিগূঢ় সম্পর্ক। এই দোলপূর্ণিমাতেই ছেউড়িয়ায় লালনের সমাধি প্রাঙ্গণে হয় বিশাল বাউল মেলা। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে চড়ক পূজার মেলার ঐতিহ্যও বহুকালের। কিছু বীভৎস ব্যাপার এই মেলার স্মৃতির সঙ্গে জড়িত-পিঠে বড়শি গেঁথে চরদান কিংবা বাণবিদ্ধ জিহ্বা।

মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎসবকেন্দ্রিক মেলার মধ্যে দুই ঈদ আর মহরম প্রধান। এছাড়াও মুসলমান সমাজের পির-ফকিরদরবেশের ওরশ মেলার আকর্ষণীয় উপলক্ষ্য। ঈদ উপলক্ষ্যে প্রাচীন যে মেলার সন্ধান পাওয়া গেছে তার বয়স সাকুল্যে একশাে বছরের বেশি নয়। মুনশি রহমান আলী তায়েশের ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’ গ্রন্থের বরাত দিয়ে ড. মুনতাসীর মামুন জানাচ্ছেন, উনিশ শতকের শেষের দিকে ঢাকার ধানমন্ডির ঈদগাহে ঈদের নামাজের পর মেলার আয়োজন হতো। অবশ্য এরপর বিশ শতকে প্রথম থেকেই ঢাকায় নিয়মিত ঈদের মেলা বসত চকবাজার আর রমনা ময়দানে। ঢাকার আজিমপুরের মহরমের মেলার দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। এরপরেই নাম করতে হয় কুষ্টিয়ার চক দৌলতপুরের মহরমের মেলার। এই সঙ্গে আসে মানিকগঞ্জের গড়পাড়ার মেলার কথা।

মেলার সাধারণ চিত্র

প্রত্যেক মেলারই একটা সাধারণ চিত্র আছে। যেন চলমান এক ছবি। গ্রাম্য মেলা বার্ষিক বাজার হিসেবে বিবেচনার যােগ্য। মেলায় দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী নিয়ে দোকানদাররা আসে। মেলায় দোকানগুলাে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানাে থাকে। মেলায় কোথাও খেলনা, কোথাও ডালা-কুলা-চালুনি, কোথাও কাঠের জিনিসপত্র, কোথাও মাটির জিনিসপত্র, কোথাও ঘুড়ি এবং কোথাও খাবারের জিনিসের দোকান বসে। এ ছাড়া কোনাে কোনাে মেলার একপাশে নাগরদোলা, রাধাচক্র ও সার্কাস বসে। আবার অনেক কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে মেলায় হাজির হয়। আশেপাশের এলাকার বিভিন্ন শ্রেণির কারিগররা যেসব জিনিস তৈরি করে, তা তারা বিক্রয়ের জন্য মেলায় নিয়ে আসে। এভাবে সুন্দর সুন্দর জিনিসের সমারােহে মেলাঙ্গন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেই সাথে থাকে মিষ্টি বিক্রয়ের আয়ােজন। ছােট ছেলে-মেয়েদের জন্য থাকে নানা রকম খেলার জিনিস। তাদের মুখের বাঁশির শব্দে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। মেলা উপলক্ষে আরও বিচিত্র আনন্দের উপহার এখানে সমবেত হয়। ছােট ছেলেমেয়েরা সেসব আনন্দ উপভােগ করে থাকে। মেলায় কিছু খেলাধুলার প্রতিযােগিতাও চলে। এর মধ্যে হা-ডু-ডু ও কুস্তি প্রতিযােগিতা দর্শকদের বিশেষ আনন্দ দেয়।

গ্রাম্য মেলা
মেলার একটি ছবি

গ্রাম্য মেলার তাৎপর্য

গ্রামীণ জীবনে মেলার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ সারাবছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। এ অমানুষিক পরিশ্রম কখনাে কখনাে তাদের জীবনযাপনে ছন্দপতন ঘটায়। কিন্তু মেলা গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে অনাবিল আনন্দের উৎস হিসেবে উদযাপিত হয়। গ্রামে উৎপাদিত বা তৈরি পণ্যসামগ্রী, নানা শিল্প সম্ভার মেলায় প্রদর্শিত হয়ে গ্রামীণ জীবনের ছবি স্পষ্ট করে তােলে। গ্রামীণ জীবনের নানা ঐতিহ্যের পরিচয় রূপায়িত হয় গ্রাম্য মেলার মাধ্যমে। গ্রামের নানা খেলা ও আমােদপ্রমােদের উপকরণ দেখতে পাওয়া যায় গ্রাম্য মেলায়। মেলার মাধ্যমেই মূলত আমাদের প্রকৃত গ্রামীণ সংস্কৃতি আমাদের সামনে উন্মােচিত হয়। তা ছাড়া গ্রাম্য মেলাকে গ্রামীণ মানুষের মিলনের অন্যতম উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বার্ষিক এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন গ্রাম থেকে আগত নানা শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান হয়। ফলে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববােধ ও সৌহার্দ গড়ে ওঠে।

গ্রাম্য মেলার আকর্ষণ

মেলার জন্য বহুদিন থেকে চলে নানা উদ্যোগ, আয়ােজন। মেলায় আসা বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী মেলার অন্যতম আকষর্ণ। এ মেলা উপলক্ষে বিক্রেতারা তাদের বিচিত্র দ্রব্যের সমাবেশ ঘটায়। এখানে কুটির শিল্পজাত এবং মৃৎশিল্প, তাল পাতার পাখা, কাগজের তৈরি রকমারি খেলনা, শীতল পাটি, নকশী কাঁথা ইত্যাদি নানা সামগ্রীর সমাবেশ ঘটে। মেলাকে আরও আকর্ষণীয় করে তােলে বাঁশের বাঁশি, চামড়ার ঢােল ইত্যাদি। এছাড়াও মেলায় উপভােগ করার মত আছে সার্কাস, ম্যাজিক, যাত্রা, থিয়েটার ইত্যাদি বিনােদনমূলক উপাদান।

মেলার উপকারিতা

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গ্রাম্য মেলা শুধু চিত্তের খোরাক যোগায় না, বিত্তের শক্তিও যোগায়। গ্রাম্য মেলার অনেক উপকারিতা রয়েছে। মেলায় কৃষি ও কুটিরশিল্পজাত দ্রব্যাদি বেচা-কেনা হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামের কামার-কুমার, তাঁতি, সুতারদের মধ্যে বিভিন্ন জিনিস বানানাের হিড়িক পড়ে যায়। তাই দেখা যায়, মেলার মাধ্যমে গ্রামীণ অনেক মানুষের কিছু উপার্জনের পথও প্রশস্ত হয়। এ ছাড়া সার্কাস ও যাত্রাদলসহ আরাে অনেকেই তাদের রোজগারের পথ খুঁজে পায়। প্রসঙ্গত ডঃ কে. টি হােসাইন বলেছেন:

There are certain economic importance of the village fair which could improve the lot of the general people lying in the village.

মেলার অপকারিতা

গ্রাম্য মেলার অনেক উপকারিতা থাকলেও এর কিছু কিছু অপকারিতার কথা অস্বীকার করা যায় না। গ্রাম্য মেলায় অনেক সময় জুয়ার আড্ডা বসে। এতে গ্রামের সহজ-সরল লােকেরা সর্বস্বান্ত হয়ে বিষন্ন বদনে বাড়ি ফিরে আসে। তাছাড়া অনেক লােকের গমাগম হেতু পরিবেশও দূষিত হয়। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাসীসহ বিভিন্ন অসামাজিক ও অন্যায় অবৈধ কাজ মেলায় সংঘটিত হতে পারে বা হয়। তাছাড়া, যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগের ফলে ভীষণ দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। ফলে পরিবেশ দূষিত হয় এবং নানা রকম রােগের প্রাদুর্ভাব হয়। অনেক সময় পচা-বাসী খাবার খাওয়ার ফলে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

গ্রাম্য মেলার অর্থনৈতিক গুরুত্ব

গ্রাম্য মেলা পল্লি অঞ্চলের তথা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশে অনেক গ্রাম আছে যেখানে কোনাে হাট-বাজার নেই কিন্তু সেসব অঞ্চলে গ্রাম্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তখন পল্লি অঞ্চলের মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযােগ পায়। তারা গ্রামীণ মেলায় কেনাবেচা করে অর্থের আদানপ্রদান করতে পারে, যা তাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। গ্রাম্য মেলা গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতেও তাৎপর্যপূর্ণ সূচনা পালন করে। গ্রাম্য মেলা আয়ােজন করার সময় যে ইজারা ফি পাওয়া যায় তা সরকারি কোষাগারে জমা হয়। এছাড়া গ্রাম্য মেলায় দেশের দূরদূরান্ত থেকে অনেক ব্যবসায়ীর আগমন ঘটে যারা দেশের অর্থনীতিতে সূচনা রাখে।

গ্রাম্য মেলার সামাজিক গুরুত্ব

গ্রাম্য মেলা একটি সমাজের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেক গুরুত্ব বহন করে। গ্রাম্য মেলা গ্রামীণ মানুষকে আনন্দের উপলক্ষ এনে দেয়। এ মেলায় মানুষ একে অপরের সাথে ব্যতিক্রমী উপায়ে মিলিত হওয়ার সুযােগ পায় । গ্রাম্য মেলা অনেক সময় সামাজিক মিলন মেলায় পরিণত হয়। এ মেলার আয়ােজিত বিভিন্ন ধরনের আমােদ-প্রমােদমূলক। খেলাধুলা ও উৎসব গ্রামীণ সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নে সহায়ক। গ্রাম্য মেলার মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চলের তরুণতরুণীদেরকে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে পরিচিত করানাে যায়। ফলে তাদের জীবনে পরিবর্তন ঘটে। তাই বলা যায়, গ্রাম্যমেলার সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম।

গ্রাম্য মেলার সার্বজনীনতা

উপলক্ষ্য যাই থাকুক না কেন মেলার একটা সর্বজনীন রূপ আছে। মেলায় অংশগ্রহণে সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিন্নতা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কেননা মেলার আর্থসাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সবকিছু ছাপিয়ে প্রকাশিত। তাই মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগােনা। মৈত্রী-সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র মেলা। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশাের সকলেই আসে মেলায়। তাদের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা একটিই, তা হলাে মেলা আড়ং দেখা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বিকিকিনির আশা আর বিনােদনের টান।

গ্রাম্য মেলার বিনােদন

মেলায় আগত দর্শকদের মনােরঞ্জনের নানা ব্যবস্থা থাকে। নাগরদোলা, ম্যাজিক, লাঠিখেলা, কুস্তি, পুতুলনাচ, যাত্রা, কবিগান, বাউল-ফকিরি গান, জারিগান, বায়ােস্কোপ তাে থাকেই, কখনাে কখনাে সার্কাসের তাবুও গাড়ে। সঙ-এর কৌতুক-মশকরা সারা মেলাকে মাতিয়ে রাখে। মেলায় বিশেষ ব্যবস্থাপনায় বসে তাড়ি-মদ আর জুয়ার আসর। এনেশায় ডুবে সর্বস্বান্ত হতে হয় অনেককে।

মেলায় দিন বদলের হাওয়া

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেলার চিত্র-চরিত্রেও পরিবর্তন এসেছে। গ্রামীণ মেলা রূপে ও মেজাজে অনেকখানিই বদলেছে। হিন্দু-সম্প্রদায়ের পালা-পার্বণ উপলক্ষ্যে যেসব মেলা বসত তার মধ্যে অনেকগুলােই আজ বিলুপ্ত। এর প্রধান কারণ পৃষ্ঠপােষকতার অভাব আর হিন্দুদের দেশত্যাগ। কোনাে কোনাে মেলা রূপান্তরিত হয়ে এখনাে বেঁচে আছে।

উপসংহার

গ্রাম্য মেলা হচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচায়ক। মেলা লােক সংস্কৃতিরই এক বিশেষ ধমনী। এই ধমনীতেই জীবনের স্পন্দন। এরই মধ্যে বাঙালী খুঁজে পেয়েছে নিজেকে। মেলা তাে নিছক আনন্দ-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র নয়। এর সঙ্গে যুক্ত আছে তার দীর্ঘকালের ধর্ম-সাধনা। আছে তার জীবন-লীলার নানা তরঙ্গের ঘাত-প্রতিঘাত। এরই মধ্যে আছে তার অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার আশ্বাস। আছে জীবনের অফুরান প্রাণশক্তির প্রকাশ। মেলাই তার বেঁচে থাকার প্রতিশ্রুতি। তার অস্তিত্ব। তার দর্পণ।

পরিশেষে আমরা রবীন্দ্রনাথের কথায় শেষ করতে পারিঃ
বাংলাদেশে এমন জেলা নাই যেখানে নানা স্থানে বৎসরের নানা সময়ে মেলা না হইয়া থাকে- প্রথমতই এই মেলাগুলাের তালিকা ও বিবরণ সংগ্রহ করা আমাদের কর্তব্য। তাহার পরে এই মেলাগুলাের সূত্রে, দেশের লােকের সঙ্গে যথার্থভাবে পরিচিত হইবার উপলক্ষ্য আমরা যেন অবলম্বন করি। (আত্মশক্তি)।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button