বাংলা রচনা

দারিদ্র্য সমস্যা ও এর প্রতিকার || রচনা

4.9/5 - (41 votes)
দারিদ্র্য সমস্যা ও এর প্রতিকার / দারিদ্র্য বিমোচন || রচনা

ভূমিকা

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়,
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানাে রুটি

দারিদ্র্য মানবজীবনের এক অভিশপ্ত যন্ত্রণা। দারিদ্রের দুঃসহ দহনে মানুষের স্বভাবসুন্দর জীবনধারা ব্যাহত হয়ে পড়ে, দারিদ্র্যের দৌরাত্মে মানুষের স্বপ্ন ও আশা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায়। দারিদ্র মানুষকে হতাশাগ্রত করে তােলে। তাই দারিদ্র্য সমস্যা ও এর প্রতিকারের প্রচেষ্টা মানুষের জীবনধারায় এক প্রাণান্তকর সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার বিখ্যাত ‘দারিদ্র্য’ কবিতায় দারিদ্রের বীভৎস রূপের বর্ণনা দিয়েছেন। দারিদ্র ব্যক্তিজীবন বিকাশের ক্ষেত্রে যেমন চরম বাধা হয়ে দাঁড়ায় তেমনি জাতীয় সমৃদ্ধির ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। দারিদ্র্যের কারণে মানুষ অনেক সময় মৃত্যুর মুখােমুখি গিয়ে দাঁড়ায়। মােট কথা, একটি জাতিকে বিপর্যস্ত এবং বিধ্বস্ত করার পেছনে দারিদ্র্য চরম অভিশাপ হিসেবে কাজ করে থাকে। তাই দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য দারিদ্র্য বিমোচনআবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দারিদ্র্য কী?

দারিদ্র্য এমন একটি অর্থনৈতিক অবস্থা, যখন একজন মানুষ জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান অর্জনে এবং স্বল্প আয়ের কারণে জীবনধারণের অপরিহার্য দ্রব্যাদি ক্রয় করতে অক্ষম হয়। দারিদ্র্যের দৃশ্যমান প্রতীক হচ্ছে অপুষ্টি, ভগ্নস্বাস্থ্য, জীর্ণশীর্ণ বাসস্থান, নিরক্ষরতা এবং বেকারত্ব অথবা আধা বেকারত্বে নিপতিত রুগ্ন-দুর্বল মানুষ।

Poverty is relatively cheap to address and incredibly expensive to ignore.
Clint Borgen, President of The Borgen Project

বর্তমানে দারিদ্র্য পরিমাপে ‘দারিদ্র্যসীমা’ ধারণাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এই হিসাবে যারা দৈনিক ২১২২ কিলাে ক্যালরির কম খাবার পায় তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করে। আর যারা ১৮০৫ কিলাে ক্যালরি কম খাবার পায় তারা চরম দারিদ্র্যের শিকার।

দারিদ্র্যের স্বরূপ

যদিও বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রণীত সকল নীতি পরিকল্পনায় দারিদ্র্য বিমােচনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিগত প্রায় সব সরকারই বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে এবং দারিদ্র্য বিমােচনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, তবু বাংলাদেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতি এখনাে উদ্বেগজনক। বিভিন্ন তথ্য মতে, দেশে দারিদ্র্য ক্রমহ্রাসমান হলেও এখনাে দারিদ্র্যের উপস্থিতি সুবিস্তৃত ও গভীর।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলাের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এমন কোনাে দিক নেই, যেদিক থেকে আমাদের আশানুরুপ অগ্রগতি হয়েছে। শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, খাদ্য-স্বাস্থ্য, আবাসন, জীবনমান ইত্যাদি সকল দিক থেকেই দারুণভাবে পেছনে পড়ে আছি আমরা। এদেশের মােট জনসংখ্যার সিংহভাগ লােক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। ঠিকমত দু’বেলা খেতে পায় না, পােশাক-পরিচ্ছদের সংস্থান নেই, চিকিৎসা গ্রহণের সুযােগ নেই, স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান নেই অর্থাৎ জীবনমানের দিক থেকে তারা শূন্যের কোঠায় অবস্থান করছে। এর প্রধান কারণ দারিদ্র্য। তাই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে-

অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো
দেখি এ দেশে অন্ন নেইকো কারাে।
অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার
দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার।
হিসেবের খাতা যখনই নিয়েছি হাতে
দেখেছি লিখিত ‘রক্ত খরচ তাতে’।

দারিদ্র্যসীমার নিচে যারা বাস করে তাদের মধ্যে প্রথমেই আসে কৃষকদের কথা। আমাদের মােট জনসংখ্যার ৮০% কষক। জাতীয় আয়ের ৩৫% জোগানদাতা এই শ্রেণী মানবেতর অবস্থায় জীবন যাপন করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং তথ্য ও প্রযুক্তি উন্নয়ন কিছুটা সাধিত হলেও দরিদ্র শ্রেণীর জীবনাবস্থা উপেক্ষিত রয়ে যায়, থেকে যায় অপরিবর্তিত।

দারিদ্র্য সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেবার কথা বলা হলেও মূলত তা দয়া-দাক্ষিণ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে সংশ্লিষ্ট মানব সম্পদ উন্নয়ন সূচকের বিবেচনায় বাংলাদেশ ২০০০ সালে বিশ্বের ১৩২তম দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত থানা আয় ও ব্যয় নির্ধারণ জরিপ ২০২১ সালের সালের মার্চ পর্যন্ত – এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দরিদ্র শ্রেণির সংখ্যা জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত যা ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ। জরিপে দেখা গেছে গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি।

সমাজে দারিদ্র্যের প্রভাব

বাংলাদেশের মােট জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ বর্তমানে দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে জর্জরিত হবার কারণে এ দেশের আর্থ-সামাজিক জীবনে দারিদ্র্য অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদুরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে। এ দেশের প্রতিটি সমস্যার সঙ্গেই প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে দারিদ্র জড়িত।

If poverty is a disease that infects the entire community in the form of unemployment and violence, failing schools and broken homes
– President Barack Obama

সমাজে দারিদ্র্যের প্রভাব কিরূপ তার কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলঃ

  • দারিদ্র্যের ব্যাপকতার ফলে দেশের একটি বিশাল জনগােষ্ঠী অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও চিত্তবিনােদনসহ তাদের জীবনের কোনাে মৌলিক চাহিদাই সঠিকভাবে পূরণ করতে পারছে না।
  • দারিদ্র্যের প্রভাবে দেশে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিহীনতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বার্ধক্য, অকালমৃত্যু, অন্ধত্ব, দুর্বলতা, অসুস্থতা প্রভৃতি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
  • দারিদ্র্যের ব্যাপকতার কারণেই বাংলাদেশে কৃষিখাত, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত উন্নতি ঘটছে না।
  • ‘যত মানুষ তত রােজগার’ – এই ধারণার বশবর্তী হয়ে দরিদ্র জনগণ অধিক সন্তান জন্ম দেয় বলে দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
  • দারিদ্র্যের কারণে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারায় দেশে বেকারত্বের হার বেড়েই চলছে।
  • দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক ভাঙন, আত্মহত্যা, যৌতুকপ্রথা, পতিতাবৃত্তি, অপরাধপ্রবণতা প্রভৃতি দারিদ্র্যের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
  • দারিদ্রের প্রভাবে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় অগ্রগতি অর্জন করা যাচ্ছে না।
  • দারিদ্র্যের প্রভাবে দেশে সামাজিক অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে শ্রমিক অসন্তোষ, যুব অসন্তোষ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, হরতাল , ধর্মঘট প্রভৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এক কথায় বলা চলে, দারিদ্র হলাে সকল সামাজিক সমস্যার মূল উৎস এবং আমাদের দেশে জাতীয় উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়।

দারিদ্র্যের কারণসমূহ

দারিদ্র্য প্রতিটি দেশের জন্য অভিশাপস্বরূপ। যে দেশের বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমা নিচে অবস্থান করে, সে দেশে অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়। তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সবার আগে দারিদ্র্যের কারণগুলো জানতে হবে। নিচে কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হলঃ

জনসংখ্যা বৃদ্ধি

উচ্চ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাংলাদেশের দারিদ্র্যের একটি প্রধান কারণ। অধিক জনসংখ্যার ফলে তা মাথাপিছু আয়ের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। এতে করে মাথাপিছু আয় কমে যায়। সম্পদের সীমাবদ্ধতা ফলে দেশের জনসংখার বড় একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে।

দ্রব্যমুল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি

নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের লাগামহীন বৃদ্ধির ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমিত আয় দিয়ে দৈনিক ব্যয় চালিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হয় তাদের। এতে তাদের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। ফলশ্রুতিতে দারিদ্র্যকে মেনে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

নিরক্ষরতা

কথায় আছে, নিরক্ষর জাতি দেশের জন্য অভিশাপস্বরূপ। সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ ১ হাজার। এখনও ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। অর্থাৎ দেশের প্রায় ৪ কোটি সাড়ে ১২ লাখ মানুষ নিরক্ষর। সরকারের চরম উদাসীনতার ফলে জাতীয়ভাবে আমাদের শিক্ষার হার বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। বর্তমান সময়ে হার বৃদ্ধি পেলেও তা শুধু কাগজে কলমে।

কর্মদক্ষতার অভাব

অদক্ষ শ্রমিকরা প্রতিদিনের কঠোর পরিশ্রমের পরেও খুব কম বেতন পায়। মালিকরা তাদের শ্রমিকদের জীবনযাপনের উপায় এবং তাদের উপার্জনের পরিমাণ নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাদের উদ্বেগের ক্ষেত্রটি কেবল ব্যয় হ্রাস এবং আরও লাভ। দেশে যেহেতু বেকার অদক্ষ লোকের সংখ্যা বেশি তাই অদক্ষ শ্রমিকদের কম টাকায় কাজ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

বেকারত্বের হার বৃদ্ধি

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে হুহু করে বেড়ে চলছে বেকারত্বের হার। দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ হল বেকারত্ব। সল্পআয়ের দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। দেশে শিল্পায়নের প্রচুর অভাব রয়েছে। ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না।

সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের জাঁতাকলে বাংলাদেশ প্রায় দু’শ বছর নির্যাতিত হয়েছে। তারা এ দেশকে শাসন করেছে শােষণের উদ্দেশ্যে। এ দেশের সম্পদকে তারা লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে তাদের দেশে। শুধু তাই নয়, কৃষকদের ওপর ঋণের বােঝা চাপিয়ে দিয়ে, নীল চাষের মাধ্যমে এদেশের কৃষিব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এদেশের কষক শ্রমিকদের ওপর চালিয়েছে অমানবিক নির্যাতন। ব্রিটিশ শাসনের পর নেমে আসে পাকিস্তানি শাসন-শােষণ। ফলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে গেলে কিছুই হয় নি।

অনুন্নত শিল্পব্যবস্থা

দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ পরাধীন থাকার কারণে উন্নত বা আধুনিক শিল্পব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে নি। এর পেছনেও সাম্রাজ্যবাদী শাসনের কালাে হাতের স্পর্শ রয়েছে। যেমন- এদেশের তাঁতিরা মূল্যবান মসলিন পোশাক তৈরি করত বলে ইংরেজরা তাদের আঙুল কেটে দিয়েছিল। এমনকী সমুদ্রতীরের লবণ চাষীদের ওপর তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল । এভাবে তারা বস্ত্র এবং লবণ উৎপাদন বন্ধ করে দিয়ে এদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে বিধ্বস্ত করে দেয়। ফলে কোটি কোটি মানুষকে বেকার জীবনযাপন করতে হয়।

অনুন্নত কৃষি-ব্যবস্থা

আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ। কিন্তু আমাদের কৃষি-ব্যবস্থায় এখনাে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে নি। প্রাচীন পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে উৎপাদনের হার নিম্নগতি অথচ উৎপাদন-ব্যয় হচ্ছে বেশি। এতে কৃষককুলের জীবনধারণ দিনের পর দিন দুঃসহ হয়ে উঠছে।

এছাড়াও মাথাপিছু সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ, সম্পদের বণ্টন ও ব্যবহার, পরিবশের অবক্ষয়, নারী নির্যাতন, বন ধ্বংস সাংস্কৃতিক সেচ্ছাচারিতা ও আগ্রাসন, অর্থনৈতিক দুর্দশা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা এবং বন্যা, জলােচ্ছাস, খরা ইত্যাদির মতাে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দারিদ্র্য সৃষ্টি করে।

দারিদ্র্য বনাম বাংলাদেশ (অতীত ও বর্তমান পরিস্থিতি)

১৯৭৪ সালে শস্যহানি এবং বৈদেশিক সাহায্যে ভাটা পড়লে বাংলাদেশ প্রায় দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। ১৯৭৫ সালে দেশের মােট জনসংখ্যার প্রায় ৮৩% দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতে থাকে। ১৯৮১-৮২ সালে তা ৭৪% এ নেমে আসে। ১৯৮৭-৮৮ সালের প্রলঙ্করী বন্যার ফলে বাংলাদেশ পুনরায় আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ১৯৯০ এর দশকে দেশের মানুষ অমানবিক দারিদ্র্যের শিকার হয়। মাথাপিছু মাত্র ৩৮৬ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ (১৯৯৯-২০০০) আয় নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি দরিদ্রতম, জনবহুল এবং অনুন্নত দেশের পরিচিতি লাভ করে।

সিপিডির এক গবেষণা উঠে এসেছে, দারিদ্র্যের হার ১৯৮১-৮৩ সালে ৬১.৩ শতাংশ থেকে ১৯৯৩-৯৪ সালে ৪১.৬ শতাংশে নেমে আসে। ১৯৯৮-২০০৩ সালে আরাে কমে হয়েছে ৩৪.৮ শতাংশ। ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৮ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে। একই গবেষণায় দেখা গেছে, গত তিন বছরে (২০০৫-০৮) নতুন করে প্রায় সােয়া এক কোটি অর্থাৎ মােট জনগােষ্ঠীর ৮.৫% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ এক গবেষণায় দেখা গেছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত জনগােষ্ঠীর পরিমাণ ৪০% থেকে বেড়ে ৪৩% এ দাড়িয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘উন্নয়ন সমুন্নয়ন’ বলেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি গত এক বছরে ৬২ লাখ লােক নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত জনগােষ্ঠী ৪৫.৮৬%। এ পরিস্থিতিতে গত কয়েক বছরে দারিদ্র্য বিমােচনের যে সাফল্য বা অগ্রগতি হয়েছে তা ম্লান হয়ে গেছে।

দারিদ্র্যের বর্তমান পরিস্থিতির চিত্র অত্যন্ত নাজুক। সম্প্রতি করোনা মহামারীতে যে বেকারের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সংখ্যা কত, এমন কোন হিসাব সরকারের কাছে নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ দুই বছর অন্তর অন্তর করার কথা থাকলেও ২০১৬ (২০১৭ এ প্রকাশিত) সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত (২০২২) নতুন করে কোন জরিপ করা হয় নি। ফলে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের আসল চিত্র সঠিকভাবে উঠে আসছে না।

দারিদ্র্য বিমোচনের উপায়

দারিদ্র্য একটি ভয়াবহ সমস্যা এবং উন্নতির প্রধান অন্তরায়। বিপুল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানব সম্পদে পরিনত না করতে পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে দেশের উন্নতির পথকে সুগম করার লক্ষে নিন্মলিখিত পদক্ষেপসমূহ নেওয়া যেতে পারে।

  • জনসংখ্যা বৃদ্ধি রােধ করতে হবে।
  • ধনী-গরিবের মাঝে বিদ্যমান ব্যাপক বৈষম্য দূর করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
  • শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগােষ্ঠীর মধ্যে জাতীয় আয় বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য অধিক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে।
  • জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র বিমােচনের বাস্তবমুখী নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন করে তা স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে।
  • কৃষি, শিল্প প্রভৃতি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির বাস্তবভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
  • দেশে সকল খাতে বিদ্যমান দুর্নীতি দমন করতে হবে।
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায়র জন্য আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
  • রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে।
  • মুদ্রাস্ফীতি রােধ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রােধ করতে হবে।
  • আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
  • যােগাযােগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে।
  • প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পর্যাপ্ততা ও সহজলভ্যতা বৃদ্ধি করতে হবে।
  • বৈদেশিক বিনিয়ােগ বৃদ্ধি করতে হবে।
  • দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি কমাতে হবে।

দেশ থেকে দারিদ্র্য সমস্যা প্রতিকার করতে হলে উল্লেখিত উদ্যোগের পাশাপাশি সরকার ও জনগণকে একসাথে কাজ করতে হবে।

দারিদ্র্য সমস্যা প্রতিকারে গৃহীত উদ্যোগ

সরকার কর্তৃক ইতােমধ্যে বাস্তবায়িত দারিদ্র বিমােচন কার্যক্রমের মধ্যে গুচ্ছগ্রাম (১৯৮৮-৯৩), দুঃস্থ উন্নয়ন প্রকল্প (১৯৯০-৯২), উপজেলা সম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান প্রকল্প , রেশম উৎপাদন ও উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ এবং স্ব-কর্মসংস্থানের উদ্যোগে সহায়তা ও পৃষ্ঠপােষকতা দান উল্লেখযােগ্য। এছাড়া দারিদ্র্য সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দেশে বহু সখ্যক স্থানীয় ও বিদেশি এনজিও নানাবিধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। এর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা, প্রশিকা উল্লেখযােগ্য। দারিদ্র্য বিমােচনে সম্পৃক্ত সরকারি আনুকূল্য প্রাপ্ত সংস্থাগুলাের মধ্যে স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচি, ক্ষুদ্র চাষিদের জন্য ঋণদান প্রকল্প বহুল পরিচিত। এছাড়া বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও স্থানীয় উৎসের অর্থানুকূল্যে পরিচালিত বাংলাদেশের দারিদ্র বিমােচন প্রকল্পসমূহের মধ্যে রুরাল ফিন্যান্স এক্সপেরিমেন্টাল প্রজেক্ট , বাংলাদেশ-সুইস এগ্রিকালচারাল প্রজেক্ট এবং নরওয়েজীয় উন্নয়ন সংস্থা নােরাড – এর ক্ষুদ্র ব্যবসায় ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রকল্প বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

দারিদ্র্য বিমােচনের জন্য উল্লিখিত কর্মসূচী ব্যতীত আরও কিছু প্রচলিত কর্মসূচি কার্যকর রয়েছে তবে দারিদ্র্য বিমােচনের ক্ষেত্রে এ সকল উদ্দেশ্যভিত্তিক কর্মসূচীর অবদান কতখানি তার কোনাে নির্ভরযােগ্য খতিয়ান পাওয়া যায় না। এরুপ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে : কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) , শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য (শিবিখা) , বয়স্ক ভাতা, দরিদ্র ও গৃহহীনদের জন্য বাসস্থান, কীটনাশক ও উচ্চ জাতের বীজ সরবরাহ ইত্যাদি। অধুনা বাংলাদেশ সরকার দেশের দারিদ্র্য বিমােচনের জন্য যে সকল কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তার মধ্যে রয়েছেঃ

  • নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি
  • আবাসন প্রকল্প
  • দারিদ্র্য বিমােচন ও ছাগল উন্নয়ন প্রকল্প
  • বয়স্ক ভাতা
  • গৃহায়ন তহবিল
  • কর্মসংস্থান ব্যাংক
  • দুঃস্থ মহিলা ভাতা কর্মসূচি
  • দরিদ্র অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য গৃহায়ন কর্মসূচি
  • আশ্রায়ন প্রকল্প ইত্যাদি

এছাড়া উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরাসরি দারিদ্র্য বিমােচনে অবদান রাখার লক্ষ্যে আদর্শ গ্রাম, সমন্বিত মৎস্য কার্যক্রমের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমােচন, পশুসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমে আত্মকর্মসংস্থান, গ্রামীণ মহিলাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষি বহুমুখীকরণ ও নিবিড়করণ , তাঁতিদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমােচনে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, সামাজিক ক্ষমতায়ন, পল্লি অবকাঠামাে উন্নয়ন, পল্লি বিদ্যুতায়ন, গ্রামীণ স্যানিটেশন প্রকল্প , উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম , মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান, মসজিদভিত্তিক দারিদ্র্য বিমােচন, পল্লি মাতৃকেন্দ্রর মাধ্যমে জনসংখ্যা কার্যক্রম জোরদারকরণ, সমবায়িত পল্লিসমাজকর্ম , দরিদ্র, মহিলাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, যুব প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থান ইত্যাদি নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

দারিদ্র্য বিমােচনে ‘সার্ক’ কর্মসূচি

যেহেতু দারিদ্র্য একটি গুরুতর সমস্যা, তাই যৌথ উদ্যোগ ছড়া এ সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই এই সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৮৩ সালের ১০ জানুয়ারি কলম্বোতে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠিত হয়। এর নাম দেয়া হয় ‘সার্ক ‘SAARC’ অর্থাৎ সাউথ এশিয়ান অ্যাসােসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন। সার্কভুক্ত সাতটি দেশগুলাে হল ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে প্রথম থেকেই সংগঠনটি কৃষি, কর্মসংস্থান, গ্রামীণ উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা সমস্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে একে অপরকে সাহায্য করার চেষ্টা করে আসছে। ১৯৮৫ সাল থেকে, সার্ক এই অঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

দারিদ্র্য সমস্যা সমাধানে সফলতা

গত কয়েক দশকে, দারিদ্র্য সমস্যা সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টায় বেশ কিছু যুগান্তকারী সাফল্য এসেছে, যেমনটি ইউএনডিপির ফাইটিং হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০০০-এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।তাই এ সমস্যা সমাধানে পরস্পর সহযােগিতার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের সমন্বয়ে ১৯৮৩ সালের ১০ জানুয়ারি কলম্বোতে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করা হয়। যেমন- বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষানারীশিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে গমন ও উপস্থিতির হার বৃদ্ধি, সার্বিক স্বাক্ষরতার হার (বয়স্ক ও গণশিক্ষা) বৃদ্ধি, মহিলাপ্রতি উর্বরতার হার হ্রাস, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার হ্রাস, গড় আয় বৃদ্ধি, শিশু অপুষ্টি হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়নের পরিবেশ উন্নয়ন, দুর্যোগ মােকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি, সামাজিক পুঁজির উন্মেষ মানব উন্নয়ন সূচকে অগ্রগতি, জনসংগঠনের বিকাশ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অভ্যুদয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমস্যা ও অগ্রগতি উল্লেখযােগ্য।

উপসংহার

দারিদ্র্য একটি কঠিনতম জাতীয় সমস্যা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য সমস্যা সমাধান কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিরক্ষরতা দূরীকরণই দারিদ্র্য বিমােচনের ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অপরদিকে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জনসংখ্যার হার বৃদ্ধির তুলনায় উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ালেই দারিদ্র্য বিমােচন সম্ভব হবে এবং জীবনের মান বৃদ্ধি ও জাতীয় সমৃদ্ধি সম্ভবপর হতে পারে।

তথ্যসূত্র

১. দেশে এখনো ৪ কোটি ১২ লাখ মানুষ নিরক্ষর – যুগান্তর (প্রকাশ ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১)
২. দারিদ্র্য – উইকিপিডিয়া।
৩. কে বলবে বেকারত্বের হার কত – প্রথমআলো (প্রকাশ ২০ জানুয়ারি ২০১৯)

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button