বাংলা রচনা

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কুটির শিল্পের গুরুত্ব || রচনা

3.2/5 - (36 votes)
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কুটির শিল্পের গুরুত্ব || রচনা
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কুটির শিল্পের গুরুত্ব || রচনা

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কুটির শিল্পের গুরুত্ব

প্রিয় সুহৃদ, আজ তোমাদের বাংলা ২য় পত্রের রচনা বিভাগ থেকে “বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কুটির শিল্পের গুরুত্ব” রচনাটি নিয়ে হাজির হয়েছি। অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট দিয়ে রচনাটি লিখা হয়েছে। এই রচনাটির অনুরূপ রচনা লিখা যায়। যেমনঃ কুটিরশিল্প, বাংলাদেশের কুটির শিল্পের সম্ভাবনা। 

ভূমিকা

ঘরে বসে হাতের সাহায্যে বা ছােটখাট যন্ত্রপাতির মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীকে কুটির শিল্প বলে। এর জন্য বড় ধরনের কোনাে যন্ত্রপাতির প্রয়ােজন হয় না। তাই বৃহদায়তন কলকারখানায় যন্ত্রের সাহায্যে অল্পসময়ে ও অল্পব্যয়ে যে প্রচুর পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব, কুটিরশিল্পের দ্বারা তা সম্ভব নয়। তবে কুটিরশিল্পের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। যন্ত্রশিল্প যেসব পণ্য উৎপাদন করে তা ছকবাঁধা। কিন্তু কুটির শিল্পী তার উৎপাদিত পণ্যে নিজের রুচি ও সৌন্দর্যবোধকে নানাভাবে রূপ দিতে পারে। এর জন্য তার উৎপাদিত দ্রব্যাদি যন্ত্রশিল্পের মতাে সব একই চেহরার বা বৈশিষ্ট্যের হয় না।

কুটির শিল্প কী

কুটির শিল্প বলতে বােঝায় পরিবারভিত্তিক বা পরিবারের ক্ষুদ্রাকার ও সামান্য মূলধনবিশিষ্ট শিল্প-কারখানা যার উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রধানত স্থানীয় কাঁচামাল এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কারিগরি দক্ষতা ও সহজ দেশজ প্রযুক্তিনির্ভর দ্রব্যাদি। কুটির শিল্প গ্রাম ও শহর উভয় এলাকাতেই বিদ্যমান। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উন্নয়ন ও তত্ত্বাবধানের নিমিত্তে স্থাপিত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা

কুটির শিল্পের বৈশিষ্ট্য

কুটির শিল্পের কতকগুলাে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এতে অল্প খরচে দ্রব্য উৎপাদন করা যায় বলে পুঁজিও কম লাগে এবং খরচ কম বলে উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যও কম। তাছাড়া ঘরে বসেই কুটির শিল্পজাত দ্রব্য তৈরি করা যায়। কুটির শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে শিল্পপ্রতিভার ছাপ মেলে। শীল্পপণ্যে বিভিন্ন বৈচিত্র্য আনয়ন করতে পারে। তাছাড়া শিল্পীর স্বহস্তে তৈরি দ্রব্য দেখতে সুন্দর এবং টেকেও বেশি দিন।

উল্লেখযােগ্য কুটির শিল্পের নাম

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা ১৯৮১ সনে একটি জরিপ কাজ চালায়। এই জরিপের ফলস্বরূপ দেখা যায় যে, শিল্পের শ্রেণীকরণ পদ্ধতির আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩,২২,০০০টি কুটির শিল্প আটটি শ্রেণীতে বিভক্ত। ১৬০ রকমের সামগ্রী উৎপাদনে নিয়ােজিত।

প্রথম শ্রেণীর কুটির শিল্প

প্রথম শ্রেণীর (খাদ্য, পানীয় ও তামাক শিল্প) অন্তর্ভুক্ত কুটির শিল্পগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল দুগ্ধজাত খাদ্যশিল্প, আইসক্রিম, ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও টিনের কৌটায় সংরক্ষণ, মৎস্য প্রক্রিয়াজাত ও টিনজাতকরণ, বিভিন্ন রকম ডাল ভাঙার জাঁতা, ময়দার কল, ধান কল, তেলের কল, রুটি, বিস্কুট, গুড় ইত্যাদি তৈরির কারখানা, পানীয়, চুরুট ও বিড়ির কারখানা।

দ্বিতীয় শ্রেণীর কুটির শিল্প

দ্বিতীয় শ্রেণীর (বস্ত্র ও চামড়া) কুটির শিল্পগুলাের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল সুতা ও সুতি বস্ত্র, রেশম, তাত, সুচিশিল্প, গেঞ্জি, মােজা, পশমি কাপড়, পাটকাঠির সামগ্রী, দড়ি তৈরি, জাল বােনা, লেপ, টুপি তৈরি, নকশা চিত্রণ শিল্প, জামদানি শিল্প, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, পাদুকা নির্মাণ, বুনন কাজ, পুতুল তৈরি, বিছানার চাদর, রঞ্জন ও চিত্রণ ইত্যাদি।

তৃতীয় শ্রেণীর কুটির শিল্প

তৃতীয় শ্রেণীর (কাঠ ও কাঠের আসবাবপত্র) কুটির শিল্পগুলাের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল কাঠের তৈরি খেলনা, খাট, বেত ও বাঁশের দ্রব্যাদি, বাদ্যযন্ত্র তৈরি, কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি তৈরি, গৃহসজ্জার সামগ্রী ইত্যাদি। পরবর্তী শ্রেণীভুক্ত বিভিন্ন রকম কুটির শিল্পের মধ্যে রয়েছে বর্জ্য কাগজের প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং এগুলাে থেকে নানা সামগ্রী তৈরি, বই বাঁধানাে, কাগজের ফুল তৈরি, কাগজভিত্তিক অন্যান্য হস্ত শিল্প , আয়ুর্বেদিক ঔষধ, সাবান কারখানা, মােমবাতি, প্রসাধনী, পলিথিন ব্যাগ, মাটি ও কাদামাটির সামগ্রী, চুনাপাথর ও শামুকের চুন শিল্প , আলাে জ্বালানাের . সজ্জা-সামগ্রী, কাঠ মিস্ত্রি ইত্যাদি। সর্বশেষ শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে হস্তশিল্পজাত নানাবিধ দ্রব্য ও অন্যান্য কুটির শিল্প।

কুটির শিল্পের শৈল্পিক গুরুত্ব

বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে কুটির শিল্পের শৈল্পিক গুরুত্ব বর্ণনাতীত। উন্নয়নশীল এদেশ নিজস্ব শক্তি নিয়ে এখনাে পুরােপুরি দাড়াতে পারেনি। পরাধীন পরিধির মধ্যে দেশের বৃহৎ শিল্পগুলাে গড়ে উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানে। আজকের বাংলাদেশ তখন শিল্প উন্নয়নের কোন সুযােগ পায়নি। বর্তমান সময়েও যে তেমন কোনাে শিল্পবিকাশ হয়েছে এমনও নয়। এখনাে বিদেশ থেকে পণ্য দ্রব্য আমাদানি করে আমাদের সিংহভাগ চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে। এশিয়ার সিংহ বলে পরিচিত জাপান কুটিরশিল্প সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে। আমরাও যদি কুটিরশিল্পকে যথাযথভাবে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে ভােগ্যপণ্য তৈরির শিল্পে রূপান্তর করতে পারি, তবে বাংলাদেশও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।

অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে কুটিরশিল্প অত্যন্ত মূল্যবান ভূমিকা রাখতে পারে। কুটিরশিল্পের প্রসারে দেশে কর্মসংস্থানের পথও উন্মুক্ত হয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে বেকার সমস্যা বাড়ছে। কৃষিও নানা প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতায় মার খাচ্ছে। সে প্রেক্ষিতে কুটিরশিল্পে অধিক শ্রমশক্তি নিয়ােগ করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিমান রাখতে সক্ষম। প্রয়ােজনে কুটিরশিল্পজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গতি আনতে পারে।

কুটির শিল্পের অতীত অবস্থা

বাংলাদেশের কুটিরশিল্প একদা সমগ্র পৃথিবীতে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল। সে সময়ে বাংলাদেশের গ্রামগুলােতে স্বর্গসুখ বিরাজ করতো। প্রতিটি গ্রাম ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষকেরা মাঠে প্রচুর ফসল ফলাতো। আর কারু শিল্পীরা ঘরে ঘরে উৎপাদন করত নানা ধরনের বিচিত্র রকমের কুটিরশিল্পজাত দ্রব্য। তাঁতিরা বুনত কাপড়-গামছা। কুমোরেরা তৈরি করত হাঁড়ি-কলসি প্রভৃতি। কামারেরা নির্মাণ করত নানারকম কাঠের জিনিস। কাঁসারিরা গড়ত থালা-গ্রাস ইত্যাদি । আর শাঁখারিরা তৈরি করত শখের জিনিস। বাংলার মসলিনের একদা সারা দুনিয়াজোড়া খ্যাতি ছিল। এগুলো চড়া মূল্যে বিদেশে রপ্তানি হতাে। রাজা-রানী প্রভৃতি উচ্চ শ্রেণীর লােকদের নিকট এর কদর ছিল অত্যাধিক। বাংলার মসলিনকে স্মরণ করেই কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেনঃ

বাংলার মসলিন বােগদাদ রােম চীন।
কাঞ্চন তৌলেই কিনতেন একদিন।

কিন্তু আজ তা কেবলই স্মৃতি। শিল্পবিপ্লবের আশীর্বাদপুষ্ট প্রবল ইউরােপীয় জাতিগুলাের হাতে নির্মমভাবে পরাজিত হল এ দেশের কুটিরশিল্প। অসম প্রতিযােগিতায় এদেশের কুটিরশিল্পজাত পণ্যসামগ্রী ইংরেজদের কলকারখানাজাত পণ্যের কাছে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়।

কুটির শিল্পের বর্তমান অবস্থা

বৃহদায়তন শিল্পের ব্যাপক প্রসারের ফলে কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। যন্ত্রের সাহায্যে কম সময়ে বেশি দ্রব্য উৎপাদন করা যায় বলে মূল্যও কম পড়ে। তাছাড়া কারখানায় তৈরি পণ্য নিখুঁত হয়। তার জন্যে কারখানায় তৈরি পণ্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের রুচিরও পরিবর্তন ঘটেছে। তাঁতের মােটা কাপড় ও খদ্দর এখন আর মানুষ পরতে চায় না। তাই কারখানায় তৈরি পণ্যের কাছে কুটিরশিল্পজাত পণ্যসামগ্রীর আজ পরাজয় ঘটেছে। সুতরাং বলা যায় শীতল পাটি, তালের পাখা , মৃৎশিল্প , বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসপত্র তাদের অস্তিত্বকে আংশিক টিকিয়ে রাখলেও কুটিরশিল্পের সার্বিক অবস্থা বর্তমানে খুব একটা ভালাে নয়।

১৯৯৯-২০০০ বছরে মােট ৪,০৮৫ শিল্প প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থাতে নিবন্ধীকৃত হয় এবং এগুলাের মধ্যে ৩,২৪০টি ছিল কুটির শিল্প এবং বাকি ৮৪৫টি ছিল ক্ষুদ্রাকৃতির শিল্প। ১৯৯৯-২০০০ বৎসরে কুটির শিল্পে শিল্প উদ্যোক্তা এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা উভয়ের মােট বিনিয়ােগ দাড়িয়েছিল ৫০ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা এবং এইসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ৪২,০০৫ জন লােকের চাকরি হয়।

ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সংখ্যা ও জিডিপিতে অবদান

বর্তমানে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জনপ্রিয়তা নিন্মমুখী। প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি ও আধুনিক কলকারখানা স্থাপনের দরুন জনপ্রিয় শিল্পটি আজ তার নাম হারাতে বসেছে। কুটির শিল্প এতো সীমাবদ্ধতার পরেও দেশের জিডিপিতে অবদান রেখে চলছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৭ এর অনুসারে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের একটি পরিসংখ্যান ছকে উপস্থাপন করা হলঃ

কুটির শিল্পের সংখ্যা (জুন ২০১৭ পর্যন্ত)৮.৪৮ লক্ষ
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নিয়োজিত শ্রমশক্তি (জুন ২০১৭ পর্যন্ত)৩৭.৫৩ লক্ষ জন
জিডিপিতে শিল্প (ম্যানুফ্যাকচারিং) খাতের অবদান২১.৭৩%
স্থিরমূল্যে দেশজ উৎপাদনে ক্ষুদ্রায়তন শিল্পের অবস্থান৩.৭১%
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে প্রবৃদ্ধির হার৯.২১%
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৭

বর্তমান দুরবস্থার কারণ

আমাদের এককালের এই সমৃদ্ধ কুটিরশিল্প বর্তমানে কেন দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে তার পেছনে অনেকগুলাে কারণ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হলাে যন্ত্রশিল্পের প্রভাব। যন্ত্রের সাহায্যে অত্যন্ত অল্প সময়ে ও স্বল্পব্যয়ে অনেক দ্রব্য উৎপাদন করা যায়। ভারী শিল্পে প্রস্তুত মাল অপেক্ষাকৃত নিম্নমূল্যে বিক্রয় করলেও যথেষ্ট মুনাফা হয়। কিন্তু কুটিরশিল্পজাত দ্রব্যে এ সুবিধা নেই বলে যন্ত্রশিল্পের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় টিকে থাকা এই শিল্পের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। ইংল্যান্ডে উৎপাদিত বস্ত্রশিল্পের কাছে দেশের এককালের সমৃদ্ধ বস্ত্রশিল্প কিভাবে মার খেয়েছিল সে-তথ্য আমাদের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।

দ্বিতীয়ত যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের রুচিগত পরিবর্তন কুটিরশিল্পের অবনতির একটি অন্যতম কারণ। আমরা অনেক সময়ই কুটিরশিল্পজাত টেকসই দ্রব্যের পরিবর্তে যন্ত্রশিল্পজাত চকচকে কিন্তু হালকা ও ভঙ্গুর দ্রব্যদির প্রতি আকৃষ্ট হই। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, আজকাল কাঁসা ও পিতলের মজবুত বাসনকোসনের পরিবর্তে ভঙ্গুর কাচ ও চীনেমাটির বাসনকোসনের প্রতি আমরা অতিরিক্ত মাত্রায় আকর্ষণ বােধ করছি।

তৃতীয়ত দেশি শিল্পের উন্নতির জন্য যে পরিমাণ দেশাত্মবোধ ও স্বদেশপ্রেমের প্রয়ােজন, আমাদের মধ্যে দুঃখজনকভাবে তার অভাব রয়েছে। আমাদের নিজেদের প্রায় সমস্ত কিছুকেই আমরা যেন তুচ্ছ ভাবতে শিখেছি। কবি ঈশ্বরগুপ্ত লখেছিলেনঃ দেশের কুকুর ধরি বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া। কিন্তু আমাদের মধ্যে এর বিপরীত মনােভাব সক্রিয়। তাই আমরা দেশের কুটিরশিল্পের জন্য একটু বেশি মূল্য দিতে কুণ্ঠিত হই। আমরা মনে করি যে, দেশি দ্রব্য কিনলে ও ব্যবহার করলে আমাদের আভিজাত্য ক্ষুন্ন হবে। এ মনােভাব অত্যন্ত হীন ও বেদনাদায়ক।

চতুর্থত দেশের সরকারও দেশীয় দ্রব্য উৎপাদানে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করছেন না বলেই মনে হয়। দেশে তৈরি হচ্ছে এমন জিনিসও সরকার বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকেন। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই দেশের দ্রব্য প্রতিযােগিতায় টিকে থাকতে পারে না। এসব কারণই আমাদের কুটিরশিল্পের অবনতির জন্য দায়ী।

কুটিরশিল্পের ভবিষ্যৎ

এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে বাংলাদেশের কুটিরশিল্পের। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দরকার একটি নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিত্তিভূমি। একথা সবার জানা দুর্নীতি, জনসংখ্যা সমস্যা, বন্যা, প্রাকৃতির দুর্যোগ ইত্যাদি বাংলাদেশকে দৈন্যদশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ক্রমেই অবস্থা নাজুক থেকে নাজুকতর হচ্ছে। কেবল কৃষিভিত্তিক অর্থব্যবস্থা দিয়ে দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। প্রতিকারের জন্য প্রয়ােজন শিল্পোন্নয়ন। আমাদের দেশে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে বড় আকারের শিল্পকারখানা স্থাপিত হচ্ছে। এর কাঁচামালও আসে বিদেশ থেকে। এতে দেশের ভােগ্য চাহিদা মিটছে বটে কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দেশ ততটা সমৃদ্ধ হচ্ছে না। অথচ স্বল্পপুঁজি খরচ করে অধিক সংখ্যক কুটিরশিল্প গড়ে তুলে দেশি কাঁচামালের দ্বারা উৎপাদিত পণ্য দেশে-বিদেশে বিপণনের মাধ্যমে অর্থনীতি চাঙ্গা করা সম্ভব।

অন্যদিকে বেকার সমস্যা দূরীকরণেও কুটিরশিল্প ব্যাপক ভূমিকা নিতে পারে। তবে একথা মনে রাখতে হবে কুটিরশিল্পের সুদীর্ঘকালের সমস্যাগুলাে দূর করতে হবে সুচিন্তিত ও গঠনমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

কুটিরশিল্প পুনরুজ্জীবিত করার উপায় ও গৃহীত পদক্ষেপ

বাংলাদেশের কুটির শিল্পের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং কুটিরশিল্পের উপযােগিতা বিবেচনা করে কুটিরশিল্পের প্রয়ােজনীয় উৎকর্ষ বিধানের জন্যে ইতােমধ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক ) এর কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের ক্ষুদ্রায়তন ও বৈচিত্র্যময় কুটিরশিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে কারিগরদের প্রশিক্ষণ দান, উৎপাদন প্রক্রিয়ার উৎকর্ষ সাধন, বাজার ব্যবস্থাপনা, মূলধন সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দেশে কর্মরত অনেকগুলাে বেসরকারি সংস্থা বিভিন্নমুখী কুটির শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে দরিদ্র জনগণের অর্থনীতিকে সতেজ করার জন্যে কাজ করে যাচ্ছে।

বহুকাল চর্চার অভাবে লুপ্ত হয়ে যাওয়া কারিগরি দক্ষতা, শিল্প উৎকর্ষ ও উৎপাদন নৈপুণ্য ফিরিয়ে আনার জন্যে উন্নত যন্ত্রপাতি, উৎকৃষ্ট কাঁচামাল, শৈল্পিক দক্ষতা ও মূলধন সরবরাহের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে কুটির শিল্পে নব জোয়ারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের কুটির শিল্পের হারানো গৌরব পুনরায় ফিরিয়ে আনা যাবে বলে আশা করা যায়। তবে এক্ষেত্রে আরও একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, শুধু কুটির শিল্পের পুনরুজ্জীবনই সব নয়, প্রয়োজন পণ্য বৈচিত্র্য ও উৎপাদন উৎকর্ষের সাধনা।

কুটির শিল্পের প্রয়োজনীয়তা

আমাদের মতাে দরিদ্র দেশে কুটিরশিল্পের প্রয়ােজনীয়তা অত্যাধিক। কুটিরশিল্প তার নিজস্ব বেশিষ্ট্যের জন্যে বৃহদায়তন শিল্পের পাশে অস্তিত্ব রক্ষার অধিকার রাখে। হস্তশিল্পজাত দ্রব্যাদি যেমন জনসাধারণের চাহিদা পূরণ করতে পারে তেমনি বিদেশি দ্রব্যাদির আমদানি কমিয়ে দেশ স্বনির্ভর হতে পারে। তাছাড়া আমাদের দেশের শ্রমিকের অনুপাতে কলকারখানা কম থাকায় কুটিরশিল্প প্রসারে দেশের বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের পথ সুগম হবে। সমৃদ্ধ দেশ জাপানের রপ্তানির ষাট ভাগ কুটিরশিল্প থেকে আসে এবং সে দেশের শ্রমশক্তির শতকরা ত্রিশ ভাগ ক্ষুদ্রায়তন শিল্পে নিয়ােজিত রয়েছে। তাই দেশের আর্থিক সঙ্কট দূর করতে হলে আমাদের কুটির শিল্পের উন্নতির দিকে মনােযােগ দিতে হবে।

উন্নত দেশসমূহে কুটির শিল্প

উন্নত দেশগুলােতে কুটিরশিল্প যন্ত্রশিল্পের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় সগৌরবে টিকে রয়েছে। সেসব দেশের ব্যবসায়ীরা ছােট ছােট শিল্পের মেশিন বসিয়ে প্রচুর পণ্যসামগ্রী প্রস্তুত করে নিজের দেশের প্রয়ােজন মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করছে। তারা প্রায় নিত্য প্রয়ােজনীয় সব জিনিস নিজেরাই প্রস্তুত করে থাকে।

উপসংহার

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কুটির শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। তাছাড়া জনবহুল বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও কুটির শিল্পের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কুটির শিল্পের সঙ্গে আমাদের লাখ লাখ দরিদ্র জনগণের ভাগ্য জড়িত। তাই কুটির শিল্পের গৌরবময় ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে পারলেই আমাদের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ জন্যে দরকার সরকার ও জনগণের সম্মিলিত ঐকান্তিক চেষ্টা। মােট কথা, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দরিদ্র জনসাধারণের ভাগ্য পরিবর্তনে কুটির শিল্পের প্রয়ােজন ও গুরুত্ব অপরিসীম।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button