ইসলাম ও জীবন

ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষা, জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চা

Rate this post
ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষা, জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চা

 শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। মুসলমানগণ শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃথিবীকে আলােকিত করেছে। মুসলমানদের রয়েছে গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাস। শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নে মুসলমানদের অবিস্মরণীয় অবদানের বিষয়ে  আলোচনা করব। ইনশাআল্লাহ্‌।

১. শিক্ষা বিস্তারে মহানবি (স.) এর পদক্ষেপঃ

হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তিনি নবুওয়াত লাভের পর থেকে তাঁর গৃহকে শিক্ষালয় হিসেবে ব্যবহার করেন। তাঁর স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.) ও হযরত আয়েশা (রা) ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। মহানবি (স.) এর মৃত্যুর পর তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণের গৃহ ছিল নারীদের শিক্ষা কেন্দ্র। হযরত হাফসা (রা) ও উম্মে সালমা (রা.) নারী শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। 

নবুওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়ে মক্কার নিরিবিলি স্থানে হযরত আরকাম (রা.) এর বাড়িটি বিদ্যা শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়। এখানে মুসলিমগণ একত্রিত হয়ে শিক্ষা লাভ করতেন। তাছাড়া মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) ইসলাম গ্রহণকারী নও মুসলিমদের শিক্ষা দানের জন্য গােত্রে গােত্রে শিক্ষক সাহাবিদের পাঠাতেন। আর সেখানে সাহাবিদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষায়তন গড়ে উঠত। 

মক্কা থেকে হিজরতের পর তিনি মসজিদে নববিকে শিক্ষার মহাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তােলেন। তিনি মসজিদে নববির প্রাঙ্গণে “সুফফা” নামে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তােলেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মানুষ এখানে শিক্ষা গ্রহণের জন্য আসতেন। অনেক সাহাবি “সুফফা” বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন ছাত্র ও শিক্ষকের ভূমিকায় ব্যাপৃত ছিলেন। 

মহানবি (স.) নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও শিক্ষা বিস্তারে এত গুরুত্ব দিতেন যে, বদরের যুদ্ধে শিক্ষিত যুদ্ধ বন্দীদের মুক্তিপণ নির্ধারণ করে ছিলেন কয়েক জন নিরক্ষর মুসলিমকে শিক্ষাদান করার মাধ্যমে। হযরত মুহাম্মদ (স.) এর শিক্ষার প্রভাবে ও প্রত্যক্ষ প্রেরণায় আরবরা এক সুসভ্য শিক্ষিত জাতিতে পরিণত হয়।

২. শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানে খুলাফায়ে রাশেদিনের অবদান

মানব জাতির মহান শিক্ষক মহানবি (স.) এর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষার বুনিয়াদ খুলাফায়ে রাশেদিনের আমলে ব্যাপক ও বিস্তৃতি লাভ করে। খুলাফায়ে রাশেদিনের চার খলিফা শিক্ষা বিস্তারে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেন। মহানবি (স.) এর আমলের পর এ যুগে পরিকল্পিত উপায়ে মসজিদ কেন্দ্রিক শিক্ষা শুরু হয়। এ সময়ে তাফসিরুল কুরআন, হাদিস, ফিকহ শাস্ত্র ও প্রাক-ইসলামি যুগের কবিতা পঠন-পাঠন হতে থাকে। হযরত আবু বকর (রা.) পবিত্র কুরআন একত্রে গ্রন্থাকারে সংকলনের মহান দায়িত্ব পালন করেন। আর পরবর্তীতে হযরত উসমান (রা.) একই পঠন রীতিতে পবিত্র কুরআনের সংকলন করেন। হযরত আবুবকরের (রা.) আমলে মসজিদে নববি ছিল প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র। খুলফায়ে রাশেদিনের আমলে রাষ্ট্রিয়ভাবে ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে শিক্ষা বিস্তারের জন্য ব্যাপক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা হয়। খলিফা হযরত আলী (রা.) নিজেই একজন অসাধারণ পন্ডিত ও বিজ্ঞানী ছিলেন। হযরত আলী (রা.) নিজেই দর্শন, ইতিহাস, ন্যায়শাস্ত্র, ব্যাকরণ, হাদিস, কাব্য ইত্যাদির উপর সাপ্তাহিক মজলিসে বক্তৃতা দিতেন। তাঁর শাসনামলে রাষ্ট্রের বিখ্যাত শিক্ষা নগরীগুলাের ঔজ্জ্বল্য দেদীপ্যমান হয়ে সাম্রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। 

চার খলিফার মধ্যে হযরত উমর (রা) শিক্ষা বিস্তারে বেশি কাজ করেন। তিনি শিক্ষা বিস্তারের অংশ হিসেবে দামেশক, সিরিয়া, বসরা, কুফা প্রভৃতি বিখ্যাত শহরে পাঠ দান করার জন্য বিদ্বান ব্যক্তিদের প্রেরণ করেন। তখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের অধীনে প্রায় ৪০০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করত। কুফা নগরীতে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ২৪ জন সাহাবিসহ সহস্রাধিক সাহাবির জ্ঞানের স্পর্শে কুফা নগরী আলােকিত হয়েছিল। 

৩. শিক্ষার উন্নয়ন ও জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশে উমাইয়া খলিফাদের অবদান

উমাইয়া যুগের শিক্ষার বিষয়বস্তু আরাে ব্যাপকতা লাভ করে। এই যুগের শিক্ষা ব্যবস্থায় হালাল-হারামের বিষয়াদি, আরবি ব্যাকরণ, ইসলামের বিজয় ইতিহাস নতুন আঙ্গিকে পাঠদান করা হয়। এ ছাড়া দেশপ্রেম, সামরিক বিভাগে যােগদানের জন্য উৎসাহমূলক বক্তৃতা, তীর নিক্ষেপ, ঘােড়দৌড়, শিক্ষা, সফর এবং সাঁতার কাটা শিক্ষা দেয়া হয়। উমাইয়া খলিফা উমর ইবনে আবদুল আযিযের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় হাদিস সংকলনের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। উমাইয়া শাসনামলে কুফা, বসরা, দামেশক, মক্কা ও মদিনায় অনেক বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। উমাইয়া আমলে ধর্মীয় আইন-কানুন ফিকহ শাস্ত্র প্রণীত হয় এবং বিধিবদ্ধ মাযহাব সৃষ্টি হয়। এ সময়ে ভূগােল, জ্যোর্তিবিদ্যা, অনুবাদ ও চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রতি মনােযােগ দেওয়া হয়। উমাইয়া যুগের বৈজ্ঞানিক খালেদ বিন ইয়াজিদ ছিলেন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রবর্তক। জাফর আস সাদিক রসায়ন বিজ্ঞানের জনক জাবির আল হাইয়ানের উস্তাদ ছিলেন।

৪. শিক্ষা বিস্তার ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে আব্বাসীয় খলিফাদের অবদান

আব্বাসী যুগকে শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণ যুগ বলা হয়। শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখাই তাঁদের অবদানে সমৃদ্ধ হয়। আব্বাসী আমলে সাম্রাজ্যের সর্বত্র অসংখ্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাগদাদ, কায়রাে ও কর্ডোভাতে উচ্চ পর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক জ্ঞান চর্চা হত। আব্বাসী আমলে শিক্ষাকে জনগণের দোর গােড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য অসংখ্য পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ সকল পাঠাগারে গবেষণা বিভাগ ও অনুবাদ বিভাগ থাকত। খলিফা আল-মামুনের শাসনামলে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গভীর গবেষণা ও অন্য ভাষায় রচিত মূল্যবান গ্রন্থ অনুবাদের জন্য ‘বাইতুল হিকমাহ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়। বায়তুল হিকমাহ ইতিহাস বিখ্যাত ছিল। আব্বাসী শাসনামলে সাহিত্য কলা ও সংস্কৃতির বিপুল উৎকর্ষ সাধিত হয়। ভাষাতত্ত্ব, অলংকার শাস্ত্র , উপন্যাস, কবিতা প্রভৃতি শাস্ত্র এ আমলে ব্যাপক উৎকর্ষতা লাভ করে। এ যুগে প্রাচীন আরবি কবিতাসমূহ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। 

ইসলামি জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন-হাদিস, তাফসির, ফিকহ, আকাইদ প্রভৃতি বিষয়সমূহের চর্চা ও গবেষণা ব্যাপকভাবে চলতে থাকে। ফিকহকে বিধিবদ্ধ শাস্ত্র হিসেবে এ যুগেই সম্পাদনা করা হয়। তাছাড়া ছিহাহ সিত্তার হাদিস গ্রন্থ সমূহ আব্বাসী শাসনামলেই সম্পাদিত হয়।

বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে এ যুগের মনীষী পন্ডিতদের সৃজনশীল অবদান আধুনিক কালেও বিস্ময়কর বলে মনে হয়। আব্বাসী যুগে চিকিৎসা শাস্ত্র, গণিত শাস্ত্র, উদ্ভিদ বিদ্যা, জ্যোর্তিবিদ্যা, ভূতত্ত্ব বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়। আব্বাসী আমলে মুসলমানগণ গ্রিক, সংস্কৃত, পারসী, সিরীয় ভাষা হতে অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থ অনুবাদ করেন। ফলে, বিপুল সংখ্যক মুসলিম পন্ডিত, মনীষী ও বিজ্ঞানীর ছোঁয়ায় দুনিয়া ভরে উঠে। স্পেনে জ্ঞান বিজ্ঞানের সম্প্রসারণে মুসলমানদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালি থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে এসে ভীড় জমাত। স্পেনের কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় তত্ত্বালে শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। স্পেনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির যে বিপুল উন্নতি সাধিত হয়েছিল তা বুঝা যায় সেখানকার শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানীদের ঐতিহাসিক কার্যকলাপ এবং বিশ্বখ্যাত লাইব্রেরি সমূহের কার্যক্রম দেখে। শুধু কর্ডোভাতেই ১৭০ জন শিক্ষাবিদ বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছিল।

প্রাচীন মিশরে ও মুসলমানগণ জ্ঞান বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিলেন। গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মিশরে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। ফাতেমী আমলে মিশরে প্রচুর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মহিলা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। খলিফা আল হাকাম জ্ঞান চর্চার জন্য দারুল্ল হাকাম প্রতিষ্ঠা করেন। এই ভবন থেকে কবিতা, আইন, ব্যাকরণ, সমালােচনা, আয়ুর্বেদ, জ্যোতির্বিদ্যা, শব্দ বিজ্ঞান প্রভৃতি পাঠদান করা হত।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button