গ্রীষ্মের দুপুর বা চৈত্রের এক দুপুরে রচনা। প্রকৃতির রুদ্র রূপ প্রকাশ পায় গ্রীষ্মের দুপুরে। বাংলা ঋতুচক্রে চৈত্র মাসকে কে যে বসন্তের অন্তর্ভুক্ত করেছি
গ্রীষ্মের দুপুর / চৈত্রের এক দুপুরে - রচনা
সূচনা
শহর থেকে গ্রামের বাড়ি চলেছি একটি জরুরি কাজে। তখন চৈত্রের মাঝামাঝি। মফস্সলের স্টেশনে নেমে মাইল চারেকের মধ্যে আমাদের বাড়ি। তবে এই আধুনিক যুগেও যােগাযােগের তেমন ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ সময়ই শ্রীচরণ ভরসা। চার মাইল রাস্তা হাঁটতে আর কি-ই বা কষ্ট। কিন্তু বিপদ বাঁধালাে লােকাল ট্রেনটা। প্রায় তিন ঘণ্টা লেটে বেলা এগারােটায় এসে পৌছলাে আমাদের ছােট স্টেশনে। সূর্য এবং প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে একটু ঘাবড়েই গেলাম। কাছে ছাতা নেই। চেষ্টা করেও কোনাে যানবাহনের ব্যবস্থা করা গেল না। বাধ্য হয়ে তাই পদযুগলকেই ভরসা করতে হলো।
চৈত্রের রুক্ষতা
বাংলা ঋতুচক্রে চৈত্র মাসকে কে যে বসন্তের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন জানি না। তবে যে-ই করুক না কেন, তাকে যে কখনাে মধ্য চৈত্রের মধ্যাহ্নে কোনাে দীর্ঘ প্রান্তর পাড়ি দিতে হয়নি সে-কথা হলপ করে বলতে পারি। উঃ কী প্রচণ্ড রােদের তেজ। সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে শরীর বেয়ে তা গড়িয়ে পড়ছে এবং দেহ-মনে একটা অস্বস্তির জন্ম দিচ্ছে। বসন্তকে তাে এমনভাবে দেখিনি কখনাে, সে যে আসলে ছদ্মবেশে গ্রীষ্মের অনুচর তা-ও কখনাে বুঝিনি। অবশ্য শহরে মানুষ হয়েছি বলে গ্রামের মানুষের মতাে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে প্রকৃতির পরিবর্তনের দৃশ্য নিবিড়ভাবে দেখার সুযােগ আমার হয়নি। তাই চৈত্রের যে এতখানি রুক্ষতা থাকতে পারে তা এতদিন বুঝিনি। কবির ভাষায়-
চৈত্র মাসে গ্রামের মাঠ
বাংলাদেশের গ্রাম বললেই সবুজ-শ্যামলে জড়াজড়ি করা একটা ছবি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। কিন্তু কিছু কিছু গাছে নতুন গজিয়ে ওঠা কচি পাতা ছাড়া সবুজের কোনাে চিহ্নই প্রায় কোথাও চোখে পড়ছে না। এবার শীতে এক ফোটা বৃষ্টিও হয়নি। রুক্ষতা বােধ করি সে কারণেই বেশি। মাঠ এখন ফসল-রিক্ত। প্রান্তরে চলেছে রােদের খেলা। সে দিকে তাকালেই চোখে ভিরমি লাগে। মাইল টাকের মধ্যে অবস্থিত দুটো গ্রাম পেরিয়ে একটি বড় মাঠে পড়লাম। মাঠটি পাড়ি দিলেই আমাদের গ্রাম। কিন্তু পাড়ি দেওয়ার কথাটা যত সহজে বললাম কাজটা আদৌ ততটা সহজ নয়। এ এলাকার মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি। এ সময়টায় মাঠে তাই কোনাে ফসল থাকে না।
চারিদিকে এক রকম ধু-ধু প্রান্তর। কেবল দু-একটি ক্লান্ত গরু আতপ্ত মধ্যাহ্নে বৃথাই ঘাসের সন্ধানে ফিরছে। জনমানবহীন এই প্রান্তরে একাকী মনের মধ্যে কেমন একটা শিহরণ অনুভূত হয়। হতে পারে সে শিহরন ভয়ের। সামনে অনেক দূরে ছাতা মাথায় একজন লােক দেখা গেল। অনেক চেষ্টার বােঝা গেল সেও আমাদের গ্রামের দিকে চলেছে। তাড়াতাড়ি হেটে লােকটার কাছে যদি পেীছানাে যেত তাহলে কেবল যে ছায়ার শান্তিই জুটতাে তা নয়, আমার এই মুহূর্তের একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকেও রেহাই মিলতাে। একটু দ্রুত হাটলে পৌছানাে যাবে না লােকটার কাছে? কিন্তু চেষ্টা করে বােধ করি লাভ নেই। কেননা, দুজনের মধ্যে ব্যবধানটা কম নয়। তাছাড়া আমি প্রায় নিঃশেষিত শক্তি।প্রচণ্ড রােদের তাপ আর গরমে দরবিগলিত ধারায় ঘেমে ঘেমে আমি একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছি। পিপাসায় বুকের ছাতিটা ফেটে পড়বে বুঝি। আমার মতাে সূর্য নামের ঐ অগ্নিকুণ্ডটিও পিপাসার্ত। কাতর হয়ে সে-ও কি জল খুঁজছে। অতি দুঃখের মধ্যেও মনে পড়ে গেল একটা কবিতার কথা, কবি সমর সেনের লেখা
সমর সেনের নিজের কী আমার মতাে অভিজ্ঞতা হয়েছিল কোনােদিন? না হলে এমন সার্থক উপমা তার মাথায় এলাে কি করে? সামনে চোখ তুলে তাকাতেই একটি চারাগাছ নজরে এলাে। বছর তিনেক আগে যখন এসেছিলাম তখন সম্ভবত এটি ছিল না। দূর থেকে বােঝা যাচ্ছে না কী গাছ। কাছে গিয়ে দেখলাম আম গাছ। ডালপালা এখনাে তেমন বিস্তার করতে পারেনি। সামান্য একটু ছায়া। তবু তাে ছায়া! আহ, কী শান্তি! চোখ দুটো আপনিই বুজে এলাে। মাটির ওপর বসে চোখ বুজে ছায়ার শান্তি উপভােগ করছি। হঠাৎ একরাশ ধুলােবালি আমার চোখমুখ আর ঘামে ল্যাপটানাে জামাকাপড়ে তার বিচ্ছিরি পরশ দিয়ে গেল।
কষ্টে চোখ মেলে দেখলাম ঘূর্ণি হাওয়া। আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় ‘বাকড়ি’, কোথায় কোথাও ‘বাউড়ি’। বাল্যে গ্রামে এসে এই ঘূর্ণি হাওয়া সম্পর্কে অলৌকিক কত সব কথা শুনতাম। সেসব কখনাে বিশ্বাস না করলেও এই মুহূর্তে মনটা যেন একটু কেঁপে ওঠল। তাই ওঠে আবার চলতে শুরু করলাম। কিন্তু আমার শহুরে ননির পুতুল দেহটা তাে আর পারছে না। সারা শরীরে ঝালাপালা। মাথায় আবােল তাবােল ভাবনা। সেই অবস্থায়ও সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা করছি—‘সম্বর ও দৃষ্টি তব’। কিন্তু সূর্যদেবের বয়েই গছে আমার প্রার্থনা শুনতে। একপর্যায়ে নিজের অস্তিত্বের বােধই বােধ হয় নিজের কাছে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তারপর একসময় আবিষ্কার করলাম সামনেই আমাদের বাড়ি। মনে হলাে যেন, পেরিয়ে এলাম অন্তবিহীন পথ। সবার যত্নে সুস্থ হয়ে উঠতে দেরি হয়নি বটে, কিন্তু সেই প্রখর দুপুরটি আমার স্মৃতিতে তার তীব্র রােদের মতাে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
উপসংহার
প্রকৃতির রুদ্র রূপ প্রকাশ পায় গ্রীষ্মের দুপুরে। মানবজীবন ও প্রকৃতিতে সৃষ্টি হয় অস্বস্তিকর অবস্থা। গ্রীষ্মের দুপুরের খর রােদ আর কোনাে দুর্ঘটনা থেকে আত্মরক্ষার ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। জীবনানন্দাদাশ বলেন, "The austerity of the noon of chairta is unsustainable to the people of tropical area."
মন্তব্যগুলো দেখান