শরৎকাল বা, শরতের সকাল বা, শারদীয় প্রভাত - রচনা। পৃথিবীর সকল দেশে ঋতুবৈচিত্র্যের নানা স্বাদ। বাংলাদেশের ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু হলাে শরৎ
শরৎকাল বা, শরতের সকাল বা, শারদীয় প্রভাত - রচনা
সূচনা
পৃথিবীর সকল দেশে ঋতুবৈচিত্র্যের নানা স্বাদ। কতক ঋতু সকল দেশেই বিরাজমান। যেমন- বর্ষা, শীত, গ্রীষ্ম- কিন্তু শরৎকাল সর্বত্র নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা প্রায়ই দুঃসাধ্য। বাংলাদেশের শরৎকাল এদিক থেকে বিরল ব্যতিক্রম, তার মােহন উপস্থিতি গােটা প্রকৃতি ও মানব সমাজকে লক্ষণীয়ভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষত শারদীয় প্রভাতের স্নিগ্ধ ও মনােমােহিত রূপ মানবচিত্তে গভীর প্রভাব ফেলে। শিশির মেখে প্রকৃতি শুচি শুদ্র হয়ে ওঠে, যেন কলুষমুক্ত এক জগতের জন্য সকলকে সে উদ্বুদ্ধ করতে চায়। M.K. Rawlings বলেন,
কালগতভাবে শরৎকাল
বাংলাদেশের ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু হলাে শরৎ। ভাদ্র, আশ্বিন- এ দুমাস শরৎ কাল। এর ঠিক আগের ঋতু হলাে বর্ষা। তাই বর্ষার কিছু প্রভাব শরতের প্রথম মাসটিতে কম-বেশি থেকে যায়। তবে বর্ষার অবিরল ধারা নামার প্রবণতা কিছুটা শিথিল হয়। বাতাসের প্রবাহের অনেকটা দিক পরিবর্তন ঘটে। উত্তর-পশ্চিম থেকে বাতাস প্রবাহের ফলে তাপমাত্রার আধিক্য কিছুটা কমে আসে। আশ্বিনে শরতের আসল প্রকৃতিটা ধরা পড়ে। সাদা মেঘ আকাশে ভেলার মতাে ভেসে বেড়ায়। সকালে উঠেই চোখে পড়ে ঘাসের ওপর ভােরের হালকা শিশির বিন্দু ঝলমল করছে। শিউলি তলায় অজস্র ঝরা শিউলিফুলের মেলা। শরতের সকালের সঙ্গে যেন কোনাে ঋতুর সকালের তুলনা চলে না। শরতের প্রভাত এক অনির্বচনীয় আনন্দের ডালি নিয়ে অত্যন্ত ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। তার আগমন উজ্জ্বলতায় বিদীর্ণ করে না। চারপাশ, আড়ম্বরের বর্ণিল মেলায় সজ্জিত করে না।
প্রকৃতিকে রাতের অন্ধকার ক্রমশ ফিকে হয়ে যায়, ভােরের নরম আলােয় জগৎ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। হালকা কুয়াশা আর বিন্দু বিন্দু শিশির, শারদীয় সকালের সলজ্জ উপহার। বিরহী চিত্তের জমাট বাধা শােক যেন মুক্তো দানার মতাে জমে ওঠে ঘাসের ডগায়। শরতের সকাল তাই স্নিগ্ধতার প্রতিমূর্তি। শারদীয় শিশিরের এই রূপ পৃথিবীর আর কোনাে ভূখণ্ডে এমনরূপে আবির্ভূত হয় কিনা কে জানে। বর্ষার চিহ্ন প্রকৃতিতে তখনও বিরাজিত, তাই নদীগুলাে, খরস্রোতা। শরতেই পদ্ম ফোটে, ফুটন্ত পদ্মের ওপর শিশির ও কোমল সূর্যরশ্মির যুগপৎ আদুরে স্পর্শ। নদীর কোল ঘেঁষে ফুটে থাকা কাশবনে শারদীয় সকাল বুলিয়ে দেয় তার অনুপম সােহাগ। মন্দ-সমীরণে দুলে ওঠে কাশবনের সাদা মাথা- যেন ক্ষিরােদ সাগরে ঢেউ ওঠেছে। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে আকাশ। আকাশ যেন সাগর, তার বুকে ভাসমান হালকা মেঘগুলাে যেন ভেলা। এই নীল-সাদা আসমানের ছায়া পড়ে নদীর বুকে। বর্ষার উন্মত্ততা নেই নদীতে, ছােট মাছের ঝাঁক হঠাৎ লাফিয়ে উঠে নিস্তব্ধতা ভাঙে অকস্মাৎ। হাঁটু জলে বক দাঁড়ানাে, বক ধার্মিকের অবিকল উদাহরণ। রাতের শিকারি শিয়াল ফেরে আস্তানায়, পাখিরা নীড় ছেড়ে বাইরে ডানা মেলে।
রূপ বৈশিষ্ট্য
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতায় বাংলাদেশের শারদীয় প্রভাতকে অমর করে রেখেছেন। হৃদয়ের সশ্রদ্ধ অর্ঘ্য ঢেলে তিনি শরতের অনিন্দ্য সকালকে আহ্বান করেছেন ।
সমগ্র প্রকৃতির মাঝখানে দাঁড়ানাে এই বঙ্গমূর্তি শরৎ-প্রভাতের নিজস্ব সৃষ্টি। ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ বাংলা, কিন্তু শরৎ-প্রভাতের এই বাংলাদেশ আশ্চর্য রূপ সুষমায় লালিত এক অনবদ্য উদাহরণ। শারদীয় সকালের শিশিরসিক্ত শেফালি আর এমনি করে ফোটে শরতের ঐশ্বর্য এই শিউলি ফুল এবং প্রভাতই হলাে সেই সময় যখন শিউলি তার নিজস্ব মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বেড়ে ওঠা ধান চারার স্নিগ্ধ সবুজের ওপর সকালের সূর্য যখন সােহাগ চুমুতে আদর জানায়, সে দৃশ্য বর্ণনাতীত। কেবল ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তা উপলব্ধি করা যায়। কবির অনুভব শক্তি সাধারণ মানুষের নেই, কিন্তু একটি নিটোল সৌন্দর্য যে প্রকৃতির সর্বত্র তার করুণকোমল স্পর্শ বুলিয়ে চলেছে, এটা বােঝা যায়। শীতের সকালে যে রােদ হবে পরম প্রাপ্তি তার প্রস্তুতি ইতােমধ্যেই শুরু হয়ে যায়। আকাশে বজ্র-বিদ্যুতের যৌথ ভয়াবহতা নেই, নদীতে বানের তােলপাড় নেই, গােমড়ামুখাে আকাশে সীসার মতাে ভারী মেঘ নেই।
উপসংহার
শারদীয় সকাল বাংলার নিজস্ব রূপবৈচিত্র্যের স্মারক। বসন্ত যদি ঋতুরাজ, শরৎ তবে ঋতুরানি। এ দেশের কবিতায় ও জীবনে শরতের সকাল এক বিশেষ মর্যদায় অধিষ্ঠিত। নির্মলতা শারদীয় সকালের মূল কথা, স্নিগ্ধতা এ সৌন্দর্যের প্রাণ। কোথাও উগ্রতা নেই, কোথাও আড়ম্বর নেই অথচ সর্বত্র সব আছে। বাঙালি কবির চিত্তে শরৎ সর্বদা কোমলতার প্রতিমূর্তি হিসেবে বিধৃত। আজকের বিজ্ঞাননির্ভর যান্ত্রিক যুগে প্রাকৃতিক শােভাদর্শন ও তার মূল্যায়ন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৌন্দর্য সম্পর্কিত প্রাচীন মূল্যবােধগুলাে এখন অবলুপ্তির পথে, নাগরিক চেতনার ক্রম অগ্রসরমান থাবায় পিষ্ট হচ্ছে মানুষের সৌন্দর্য চেতনা। তবু এর মধ্যেও শরৎ-প্রভাত স্বমহিমায় ভাস্বর। তাই কবি বলেন-
শরতের প্রভাব বাঙালি জীবনে প্রকৃতির এক অনুপম আশীর্বাদ, রুদ্ধশ্বাস জীবনে মুক্তির খােলা বাতায়ন।
মন্তব্যগুলো দেখান