ইসলাম ও জীবনরমজান

শবে কদর নামাজের নিয়ম, আমল ও এর ফজিলত

4.1/5 - (8 votes)

বারটি মাসের মধ্যে ফযিলতপূর্ণ মাস হল রমজান মাস। সিয়াম সাধনার মাস হচ্ছে রমজান। এই মাসে আল্লহ তায়ালা একটি বিশেষ রাত রেখেছেন যে মাসের ইবাদত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। আর সে রাত হল লাইলাতুল কদর বা শবে কদর। আল্লাহ তায়ালা সূরা আল কদর-এ এই রাত সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি এই মহিমান্বিত রাতটিকে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম বলে অভিহিত করেছেন। 

শবে কদরের অর্থ কি

শব শব্দের অর্থ হলো রাত বা রজনীকদর শব্দের অর্থ হলো মর্যাদা, সম্মান, ভাগ্য ইত্যাদি। অর্থাৎ শবে কদর অর্থ হলো মর্যাদার রাত বা ভাগ্যরজনী। শবে কদর শব্দটি মূলত ফারসি শব্দ। এর আরবি শব্দ হচ্ছে লাইলাতুল কদর। শবে কদরের আরবি হল লাইলাতুল কদর । এই রাতেই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল-কুরআন নাজিল করেছেন। শবে কদরকে নিয়ে আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে একটি সূরা নাযিল করেছেন। সূরাটির নাম হল আল-কদর

শবে কদর কবে বা কখন

শবে কদর কবে তা নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। তবে রমজানের শেষ ১০ দিনের যেকোন বিজোড় রাতে শবে কদর হতে পারে বলে হাদিসে জানা যায়। আমাদের বাংলাদেশসহ আরো কিছু কিছু দেশে রমজান মাসের ২৭ তারিখকেই শবে কদর হিসেবে বিবেচনা করা হয় ও পালন করা হয়। আমাদের দেশে এই দিনেই কেবল ইবাদত পালন করে। আসলে রমজানের ২৭ তারিখই যে শবে কদর হবে তা কিন্তু নয়। আমাদের হযরত মুহাম্মহ (সা) বলেনঃ

তোমরা রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদর অনুসন্ধান কর।

অর্থাৎ রমজান মাসের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখ রাতে আমাদের এই মহিমান্বিত রাত শবে কদর অনুসন্ধান করতে হবে। আয়িশা (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেনঃ

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেনঃ তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর। (সহীহ বুখারী)

আমাদের দেশে যারা ইতিকাফ এ বসে, তারা কিন্তু রমজান মাসের শেষ ১০ দিন এটা করে। তারা বিজোড় রাতগুলোতে বেশি বেশি করে ইবাদত করে ও বিশাল পরিমাণ সাওয়াবের অংশীদার হয়। 

ইমামে আজম আবু হানিফা (রঃ) এর মতে রমজানের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতি শবে কদর তিনি সুন্দর ভাবে বুজাইয়া দিয়াছেন যে সুরা কদরে لَيْلَةُ الْقَدْر শব্দটি মোট এসেছে ০৩ বার।لَيْلَةُ الْقَدْر লেখতে হরফ লাগে ০৯ টি । এখন ৩ দ্বারা ৯ কে গুন করলে ২৭ হয় । তাই শবে কদর হবে ২৭ শে রমজান। অন্য এক হাদিসে এসেছে, আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসুল(স) এর সাথে রমযান মাসের মধ্যম দশকে ইতিকাফ করেছিলাম। তিনি বলেনঃ

আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছিল; পরে তা আমাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাতসমূহে তা অনুসন্ধান করো। (সহীহ আবু দাউদ, বুখারী, মুসলিম)

তাই আমাদের সকলকে রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাতগলোর প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে ও ইবাদত করতে হবে।

শবে কদরের আলামত সমূহ

হাদিসে শবে কদরের অনেক আলামত সম্পর্কে বলা হয়েছে। যার মাধ্যমে মুসলিমরা শবে কদরকে চিনতে পারে। আলামতগুলো হলঃ 

  • রাসূল (সাঃ) বলেছেন: লাইলাতুল কদরের রাত উজ্জ্বল। অন্য এক বর্ণনায় আছে, নাতিশীতোষ্ণ; না ঠাণ্ডা, না গরম।” (মুসনাদ আহমদ, ত্বাবারানী, ইবনে খুযাইমাহ)
  • হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, “আমরা আল্লাহর রাসূল (সা) উপস্থিতিতে লাইলাতুল কদর নিয়ে আলোচনা করছিলাম অতঃপর তিনি (সাঃ) বললেন, তোমাদের মধ্যে কে (ঐ রাত) মনে করতে পার যেদিন ‘চাঁদ অর্ধ থালার মত উঠেছিল? (মুসলিম)
  • “লাইলাতুল কদরের রাতে উল্কা ছুটে না।” (মুসনাদ আহমদ, ত্বাবারানী, ইবনে খুযাইমাহ)
  • ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “লাইলাতুল কদর বা কদরের রাত্রিটি হল প্রশান্ত ও আনন্দময়, না গরম আর না ঠান্ডা এবং ভোঁরে সূর্য উদিত হয় দূর্বল ও লাল হয়ে।” (ইবন খুযাইমাহ – হাদিসটি হাসান)
  • আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “সে রাতের প্রভাতের সূর্য উপরে না উঠা পর্যন্ত অনুজ্বল থাকবে ।” (মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ)।

শবে কদরের ফজিলত

শবে কদর বা লাইলাতুল কদর মুসলিম উম্মাহের জন্য অধিক ফযিলতপূর্ণ একটি রজনী। এই রাতে আল্লাহ তায়ালা আল-কুরআন নাজিল করেছেন। মহান আল্লাহপাক বলেনঃ

নিশ্চয়ই আমি একে (পবিত্র কুরআনকে) নাযিল করেছি শবে কদরে।  (সূরা আল-কদর, আয়াত ১)

আরও পড়ুনঃ সূরা কদর বাংলা উচ্চারণ অর্থসহ

শবে কদরের ফজিলত ও মহাত্ম সম্পর্কে কুরআন পাকের সূরা আল কদরের বর্ণনাই যথেষ্ট। এ কারণে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কদরের রজনীর ফযিলত সম্পর্কে তেমন কিছু বলেন নাই। 

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে কদরের রাতে ইবাদত করে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারী ও মুসলিম)

শবে কদরের ফজিলত
শবে কদরের ফজিলত

এই রাতে পৃথিবীতে ফেরেশতাগণ নেমে আসেন ও এই রাতে রহমত-বরকত ও মাগফিরাত নাজিল হয় দুনিয়ার মানুষের মধ্যে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এই রাতের ইবাদত  হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। আমরা জানি রমজান মাসের প্রত্যেক ইবাদতে সাধারণ মাস অপেক্ষা ৭০ গুণ বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়। আর এই রাতের সকল ইবাদতেও তার ব্যতিক্রম হয় না। এই দিন আল্লাহ তায়ালা তার অফুন্ত ভাণ্ডার থেকে শুধু রহমত বর্ষণ করতে থাকেন। 

শবে কদরের নামায ও আমল

শবে কদরের নির্দিষ্ট কোন নামায নেই। তবে এ রাতে বেশি করে নফল সালাত ও জিকির করার কথা হাদিসে এসেছে।কদরের এক রাতের ইবাদত এক হাজার মাসের থেকেও উত্তম। তাই এই রাতটি ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করাই হবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য। হযরত আয়েশা (রা) বলেন:

নবী (স) রমযানের শেষ দশ দিন যিকির ও ইবাদাতের এমন ব্যবস্থা করতেন যা অন্য সময়ে করতেন না। (সহীহ মুসলিম)

এ রাতে বেশী বেশী নামায বন্দেগী, যিকির, তাসবিহ ইত্যাদির প্রেরণা দান করে নবী (স) বলেন:

যখন লায়লাতুল কদর আসে, তখন জিবরাঈল অন্যান্য ফেরেশতাগণের সাথে যমীনে নেমে আসেন এবং প্রত্যেক ঐ বান্দাহর জন্যে রহমত ও মাগফেরাতের দোয়া করেন যে দাঁড়িয়ে বসে আল্লাহর ইয়াদ ও ইবাদাতে মশগুল থাকে। (বায়হাকী) 

শবে কদরে হজরত জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট একদল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে তাঁদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। শবে কদরের রাতে কি কি আমল করবেন তা দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে। (ক) নফল নামায (খ) দোয়া ও যিকির।

নফল নামায

কদরের রাতে বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করা. বিশেষ করে বিজোড় রাত্রিতে। কমপক্ষে ১২ রাকাত থেকে যত সম্ভব পড়া যায় ততই উত্তম। অনেকে মনে করেন কদরের নামাযের জন্য বিশেষ নিয়ম বা দোয়া রয়েছে। আসলে বিশেষ কোন নিয়ম নেই। ইশার নামাযের পর থেকে নিয়ে ফযর পর্যন্ত যে নফল নামায পড়া হয়, তাকে বলা হয় কিয়ামুল-লাইল বা তাহাজ্জুদ। অতএব কদরের রাতে ইশার পর থেকে ফযর পর্যন্ত যত নামায পড়া হবে সে গুলোকে নফলও বলা যাবে অথবা তাহাজ্জুদও বলা যাবে। লাইলাতুল কদর উপলক্ষে নামাযের জন্য বিশেষ কোন নিয়্যাত নেই। এ জন্য সাধারণ সুন্নতের নিয়মে দুই রাকাত নফল পড়ছি। এ নিয়তে নামাজ শুরু করে শেষ করতে হবে। এ জন্য সূরা ফাতেহার সাথে আপনার জানা যেকোনো সূরা মিলাইলেই চলবে। এ ছাড়া সালাতুল তওবা, সালাতুল হাজত, সালাতুল তাসবিহ নামাযও আপনি পড়তে পারেন। নফল সালাতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সালাত হল তাহাজ্জুদের সালাত। আমরা অবশ্যই চেষ্টা করব রাতের শেষভাগে তাহাজ্জুদের সালাত পড়ার।

দোয়া ও যিকির

ইবাদাতের মধ্যে যিকির খুবই ফজিলতপূর্ণ। যিকিরের মাধ্যমে বান্দা এবং আল্লাহর মধ্যে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। আল্লাহপাক বলেনঃ

অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ো না।সূরা আল-বাকারাহ : ১৫২।

যেসব যিকির ও তাসবীহ তাহলীল  করা যেতে পারে না নিচে দেওয়া হলঃ

  • ইস্তেগফার করা
  • দুরুদ শরীফ পাঠ করা। 
  • আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নি (অর্থ- হে আল্লাহ্‌! নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করাটা আপনি পছন্দ করেন। এ দোয়াটি বেশি বেশি পাঠ করা। 
  • বেশি করে কুরআন পাঠ করা। (বিশেষ বিশেষ সূরা পাঠ করা। যেমনঃ সূরা আল-কদর, সূরা আল-মুদ্দাসির, সূরা রহমান, সূরা- ইয়াসিন, সূরা ত্ব-হা, সূরা ওয়াকিয়াহ ইত্যাদি)
  • অধিক দান-সদকা করা।
  • অতীতের সকল গুন্নাহ ও পাপকাজের জন্য লজ্জিত হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া।
  • আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করা। যেমন: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্ হামদু ল্লিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আস্তাগফিরুল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুউআতা ইল্লা বিল্লাহ
  • কুরআন তিলাওয়াত করা। নবী (সাঃ) বলেনঃ
    যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি অক্ষর পড়বে, সে তার বিনিময়ে একটি নেকী পাবে… আমি একথা বলছি না যে, আলিফ,লাম ও মীম একটি অক্ষর; বরং আলিফ একটি অক্ষর লাম একটি অক্ষর এবং মীম একটি অক্ষর। 

কিছু জিজ্ঞাসা

প্রশ্নঃ শবে কদর  কত তারিখে?
উত্তরঃ শবে কদর ঠিক কবে তার সঠিক কোন তারিখ কুরআন ও হাদিসে উল্লেখ নেই। তবে হাদিসে এসেছে রমজানের শেষ ১০ দিন বিজোড় রাত্রিতে শবে কদরকে তালাশ করতে।

প্রশ্নঃ শবে কদরে নামাজ কত রাকআত?

উত্তরঃ শবে কদরের নির্দিষ্ট কোন নামাজ নেই। তবে এই রাত্রিতে বেশি করে নফল নামাজ পড়ার কথা বলা হয়েছে। যে যত খুশি তত রাকআত নামাজ পড়তে পারবে।

প্রশ্নঃ শবে কদরের নামাজের নিয়ম ও দোয়া কীভাবে পড়তে হয়?
উত্তরঃ অনেকে ভেবে থাকেন শবে কদরের নামাজের নিয়ম ও দোয়ার জন্য আলাদা নিয়ম রয়েছে। আসলে তা সঠিক নয়। অন্যান্য নফল নামাজের মতই শবে কদরের নামাজ। যেকোন সূরা দিয়ে কদরের নামাজ পড়া যায়।

প্রশ্নঃ শবে কদরের নামাজ মসজিদে নাকি বাসায় পড়ব?
উত্তরঃ
শবে কদরের নামাজ বাসায় পড়া উত্তম। তবে বাসায় যদি নামাজের পরিবেশ না থাকে তাহলে মসজিদে গিয়ে পড়া যাবে। 

যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত রইলো সে সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল এবং এ রাত থেকে সে-ই বঞ্চিত থাকে যে প্রকৃতপক্ষে বঞ্চিত। (ইবনে মাজাহ)। আল-কোরআনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি লাইলাতুল কদর কোন রাত। তবে কুরআনের ভাষ্য হল লাইলাতুল কদর রমজান মাসে। কিয়ামত পর্যন্ত রমজান মাসে লাইলাতুল কদর অব্যাহত থাকবে। এবং এ রজনী রমজানের শেষ দশকে হবে বলে সহি হাদিসে এসেছে। মহানবি (সাঃ) বলেছেন, ” যারা রমজান পেয়ে নিজেদের গুনাহ মাফ করাতে পারলো না, তারা ধ্বংস হয়ে যাক”। তাছড়া পরকালে ভোগ করতে হবে কঠিন শাস্তি। তাই আমরা শবে কদরের ফজিলতপূর্ণ রাতে ইবাদত করবো ও নিজেদের গুনাহ মাফ করিয়ে কুরআন ও হাদিস মোতাবেক জীবণ গঠণ করবো ইনশাআল্লাহ।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button