বাংলা রচনা

রচনাঃ নদীরতীরে সূর্যাস্তের দৃশ্য

Rate this post

নদীরতীরে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা সবারই কম বেশি আছে। একাকী নদীর তীরে হেঁটে বেড়ানোর মজাই আলাদা। আজকের রচনায় সেই রকমই একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করব।

sunset-view-on-the-river-bank

জীবনে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটে। দৈনন্দিন জীবনের গতানুগতিকতার মধ্যে এমন কিছু খণ্ডমুহূর্ত আসে, যেগুলাে স্বাতন্ত্র ও রসাস্বাদে স্মৃতির তালিকায় মােটা রেখায় চিহ্নিত হয়। একাকী সমুদ্র সৈকতের একটি সন্ধ্যাকে ঘিরে সেরকম রেখাঙ্কিত স্মৃতি আমার জীবনে মহার্ঘ সম্পদ হয়ে আছে। সেদিনের নদীতীরে সূর্যস্তের দৃশ্য আমার মনের মণিকোঠায় চিরদিনের জন্য গেঁথে আছে। এখনাে কোনাে নিঃসঙ্গ একাকী মুহূর্তে সে-স্মৃতি মনে হলে স্বপ্নিল হয়ে ওঠে মন, বয়ে যায় অনির্বচনীয় আনন্দের বন্যা। 

সময়টা ২০০৯ সালের মার্চ মাস। প্রকৃতিতে তখন বসন্তের আমেজ। চারপাশটা ফুলের রাজ্য। সুবাস মাখা বাতাস। ভাট ফুলের তীব্র গন্ধে মাতােয়ারা মেঠোপথ। আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে যাচ্ছি কুয়াকাটা, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখতে। সঙ্গে একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে নিয়েছি। বন্ধুদের মধ্যে তমাল ও ফটিক দুজনের বাড়িই পটুয়াখালী। কাজেই পথ চলতে আমাদের কোনাে চিন্তা নেই। তবে হাস্যকর বিষয় হল কুয়াকাটা ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা তমালের থাকলেও ফটিক কোনােদিন সেখানে যায় নি। তার চেয়েও অবাক কাণ্ড দুই বন্ধুর কেউই সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখে নি। কাজেই সে সম্পর্কে তাদের কোনাে অভিজ্ঞতা নেই। এ বিষয়ে ফটিককে প্রশ্ন করলে, ফটিক বলে ওঠল হ্যাঁ বন্ধু, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ কারণেই বলেছেন-

দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু । 
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, 
একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু।

কবিতার ছন্দের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে বলল, “তবে এবারের চান্সটা আর মিস হচ্ছে না বন্ধু”। আমরা সবাই হাসতে হাসতে লুটোপুটি। সে যাক, পথিমধ্যে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছি। তমাল আমাদের পটুয়াখালী-কুয়াকাটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল : পটুয়াখালী জেলার সর্ব দক্ষিণে কলাপাড়া থানার লতাচাপলী ইউনিয়নে কুয়াকাটার অবস্থান। সেখানে দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসকারী আদি নৃগােষ্ঠী রাখাইন সম্প্রদায়ের লােকেরা দাবী করে যে ‘কুয়াকাটা’ নামটি তাদেরই দেয়া। বর্মী রাজা রাখাইনদের মাতৃভূমি আরাকান দখল করে নিলে হাজার হাজার রাখাইন দেশ ত্যাগ করে। তাদের একটি দল বঙ্গোপসাগরের তীরে রাঙাবালি দ্বীপে এসে বসতি স্থাপন করে। সেখান থেকে কিছু রাখাইন পরিবার বনজঙ্গলকীর্ণ এলাকায় ঢুকে পড়ে তারা থানটির নাম দেয় ‘কানসাই’ অর্থাৎ ভাগ্যকূল, তারপর কুয়া খনন করে সুপেয় পানি পাওয়া গেলে এর নাম দেয় কুয়াকাটা। এসব মজার গল্প আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলাম। 

কুয়াকাটার সাগর সৈকত প্রায় ৩০ কিলােমিটার দীর্ঘ। সৈকতের গাঁ ঘেষে দাঁড়ালে বিশাল নারকেল বাগান, গঙ্গামােতির সংরক্ষিত বনাঞ্চল। দক্ষিণে দৃষ্টিসীমা যতদূর যায় শুধু নীল সাগরের জলরাশি। শীতকালে পূর্বপ্রান্তে গড়ে ওঠে অস্থায়ী জেলেপাড়া শুঁটকি মাছের কারখানা। গঙ্গামােতির চরের কাছে পূর্বদিকে ছােটো একটি খাল। তারও আগে কাউয়ার চর নদী- সবকিছুই গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। কুয়াকাটা সাগর সৈকতকে কেন্দ্র করে প্রায় দু’শ একর জমি জুড়ে গড়ে উঠেছে নারকেল বাগান। অনুমতি সাপেক্ষে বাগানের ভেতর পিকনিক করা যায়। নির্জন প্রকৃতির স্বাক্ষর কুয়াকাটা সাগর সৈকত। এসব গল্প করতে করতে কখন যে আমরা কুয়াকাটা পৌছে গেছি, বলতেই পারব না। পৌঁছতে রাত ১০টা বেজে গেল। রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা হল সেখানকার পর্যটল মােটেল ‘হলিডে হােমস’-এ। 

ঘুম থেকে ওঠতে দেরি হল বলে সূর্যোদয় দেখা সম্ভব হয় না। কী আর করা, আশেপাশের দৃশ্য দেখার জন্য দ্রুত সবাই বেড়িয়ে পড়লাম। সিদ্ধান্ত হল সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখব বিকেলে। তেলচিকচিক চিরল পাতার ঘন নারকেল বাগান পেরিয়ে হাজির হলাম রাখাইন পাড়া। কাছেই একটি মন্দির, এর ভেতর রয়েছে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড়ো, অষ্টধাতু নির্মিত ৩৭ মন ওজনের ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি। অবাক বিস্ময়ে মূর্তির দিকে চেয়ে থেকে আমি নিজেও কিছুক্ষণ ধ্যানমগ্ন না হয়ে পারলাম না। মন্দিরের নিচেই আছে ঐতিহাসিক কুয়া। রাখাইন সম্প্রদায়ের লােকেরা চারদিক বাঁধানাে পুরনাে এই কুয়ার পানি ব্যবহার করে। কথা ছিল কুয়াকাটা থেকে একটি বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল পাতরার বনও দেখতে যাব। সেখানে যেতে হয় জোয়ার-ভাটা হিসেব করে। ইঞ্জিনচালিত নৌকা ঢেউয়ের ধাক্কায় নাকি ৩/৪ফিট উপরে উঠে। এসব শুনে ভয়ে মুখ শুকিয়ে উঠল। ওইদিকে হাতেও সময় নেই। সব বিবেচনায় পাতরার বনে আর যাওয়া হল না। 

দিনের রৌদ্রোজ্জ্বল আলাে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। সূর্যের তাপও কমতে শুরু করেছে। আমরা রওয়ানা দিলাম সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার আশায়। ধূসর থেকে হালকা নীল হয়ে ক্রমশ গাঢ় নীল রঙে সমুদ্র সৈকতে মিশেছে। দৃষ্টিনন্দন এ জায়গায় দাঁড়িয়েই দেখা যাবে সূর্যাস্তের দৃশ্য। কিছুসময়ের মধ্যেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সূর্যের অস্তরশ্মিপাতে সারা পৃথিবী আগুনবরণ রূপ ধারণ করেছে। নদীর জলে সূর্যরশ্মি ছড়িয়ে সােনালি রঙে চিক চিক করছে। এক রঙিন খেলায় মেতে ওঠে নদীর জল আর সূর্যের রশ্মি। সূর্যরশ্মি যেন আকাশে আলাের মিতালি পাতিয়েছে। কোথাও সাড়া শব্দ নেই। নিস্তবদ্ধার মেধ্য সবাই সূর্যাস্ত দেখা নিয়ে ব্যস্ত। এক অপরূপ সৌন্দর্যে নদীর তীর আরও সৌন্দর্যময় হয়ে উঠেছে। পৃথিবী স্বতন্ত্র বৈচিত্র্য নিয়ে স্বপ্নিল হয়ে উঠল। সৃষ্টি যেন স্বপ্নে কথা বলার বাসনায় উন্মুখ। শুধু মানব মনে নয়, বিশাল ও বিপুল ধরিত্রীর সর্বত্রই অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ। অনির্বচনীয় আনন্দের বন্যা। আকাশের মেঘের ফাক দিয়ে মাঝে মাঝে সূর্যরশ্মি বিকীর্ণ হয়ে চোখে এসে পড়ছে। দিগন্তজুড়ে লালিমা আকাশের গায়ে আবির মাখিয়ে দিচ্ছে। আর সেই আবিরের রঙ লাগে নদীর জলে। ঝকঝক করে, চকচক করে ওঠে নদীর জল। চারদিক খুশিতে ঝলমল করে উঠল। প্রখরদীপ্ত সূর্যের এ এক অন্যরকম সাজে নতুন চেহারা। 

আমার বাহির ও অন্তর দৃষ্টির সামনে নেমে এল একটি সূর্যাস্তের দৃশ্য। সূর্যাস্তের সে দৃশ্য আমার সামনে এসে আমার অন্তরাত্মাকে প্লাবিত করে দিচ্ছে। সূর্যটা যখন নদীতীরে অস্ত যাচ্ছে তখন মনে হল সে যেন নদীর জলে ডুব দিচ্ছে। নিস্তেজ রক্তিম সূর্যটাকে বিশাল দেখাচ্ছে। অনেক বড়, গােল বৃত্তের মতাে। অস্তগামী সূর্যটাকে চাঁদের মতাে মায়া লাগছে। চাঁদের মতাে বলাটা ঠিক হয় নি। সূর্যের মতােই, তবে সূর্যের এটা মাতৃরূপ। তার কোলেই মাথা রেখে একসঙ্গে ডুবে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। অস্তগামী রক্তিম সূর্যের শেষ বিদায়রশ্মি পৃথিবীকে যেন বিদায়চুম্বন দিচ্ছে। তারই সােহাগে পৃথিবী রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে। প্রকৃতিতে তাই রঙের খেলা, গাছের পাতায় আলােছায়ার ছড়াছড়ি। বাড়ছে সেই মায়াবী সূর্যের সৌন্দর্য। মনে পড়ছে বেগম সুফিয়া কামালের অমর ‘সাঝের মায়া’ কবিতাটি-

ধীরে ধীরে ধীরে
প্রদীপ্ত ভাস্কর এসে বেলা শেষে দিবসের তীরে
ডুবিল যে শান্ত মহিমায়
তাহারি ক্লান্ত দিবাকর
তব অন্ত উৎসবের রাগে
হেথা হতে বনানীর পল্লবে পল্লবে দোলা লাগে। 

সূর্যের আলাে নিভে গিয়ে ক্রমে দেখা দেয় শান্ত সন্ধ্যা। পাখিরা সব ঘরে ফিরছে। ঘার ফিরিয়ে দেখি আমার সঙ্গে কেউ নেই। বিশাল এই সমুদ্র সৈকতে আমি একাকী ধ্যানমগ্ন এক বুদ্ধমূর্তি। মূর্তির মতাে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা নিয়ে ব্যস্ত। বন্ধুদের কাছ থেকে কীভাবে বিচ্ছিন্ন হলাম তাও বলতে পারছি না। বেশ ভালােই হল। কেন জানি মনে হচ্ছে আমিও একাকীই থাকতে চাচ্ছি। সূর্যাস্তের এই সন্ধ্যা আমার সমস্ত প্রয়ােজনের অতীত, কেবল অকারণ আনন্দের জন্য। সমস্ত কর্মচাঞ্চল্যের অবসান। সমস্ত জগৎ সংসার থেকে আমি যে বিচ্ছিন্ন তা যেন নতুন করে উপলদ্ধি করলাম। সূর্যের রক্তিমাভার সঙ্গে ধোঁয়াটে রঙ এসে মিশছে। প্রকৃতির এই দুই পরম মুহূর্তে মহামিলনের লগ্নে আমি যেন এক দ্ৰষ্টা! উদার আকাশ আমাকে সঙ্গী করে নিয়েছে, প্রকৃতির অংশের মতােই আমিও বিশাল হয়ে গেছি। দূরে আবছায় দু-একটি বাতি জ্বলে। উঠছে। মনে হল সেটা আরেক জগৎ। আমি সন্ধ্যার অপরূপ আবছায় রহস্যমণ্ডিত এক জগতে হারিয়ে গেছি। হাওয়া বইছে ঝির ঝির করে। কোন সুদূর থেকে যেন তার প্রবাহ আসছে। আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আমি ক্রমাগত উপলব্ধির গহিনে ডুবে যাচ্ছি। বালুকাতে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে লাল কাঁকড়ার দল। সাগর পাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে জেলে নৌকা, ট্রলার। আকাশে তারার সংখ্যা বাড়ছে। আমি ক্লান্তভাবে বসে পড়লাম। সাগরের ‘সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি রুপ’ আঁধারে মলিন হয়ে এসেছে। মনে পড়তে লাগল-

দিনের ভাটার শেষে রাত্রির জোয়ার।
এল তার ভেসে আসা তারাফুল নিয়ে কালাে জলে,
অন্ধকার গিরিতট তলে
দেওদার তরুসারে সারে
মনে হল, সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে। 

আমার অস্তিত্বে অনুভবে আর কোনাে অনুভূতি নেই। শুধু পবিত্র এক পরিবেশ শুভ্রতার চাদর গায়ে দিয়ে সজাগ জীবনবোধে হৃদয়ের গভীরে নাড়া দিয়ে গেল। আমার কোনাে মালিন্য নেই, অহেতুক আতিশয্য নেই। নেই কোনাে সাংসারিক দুশ্চিন্তা কিংবা কর্মের তাড়া। এ-সময়টুকু শুধু আমাকে অনাবিল অনিন্দ্য ভুবনের মহিমাদীপ্ত প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। হঠাৎ চিৎকারের ধ্বনি ভেসে আসে কানে। আমার সম্বিৎ ফিরে আসে। বুঝতে পারি আমারই বন্ধু মিলন ডাকছে আমাকে। ওরা গাড়ি নিয়ে ফেরার জন্য রওয়ানা দিয়েছে। খুব দ্রুত আমাকে গাড়িতে তুলে নিল। গাড়ি ছুটছে কর্মকোলাহলময় ব্যস্ত শহরের দিকে, আমার মন পড়ে রইল সমুদ্র সৈকতে। একা নিঃসঙ্গ অনিকেত। ওরা সবাই গল্প করছে, হইচই করছে। শুধু কথা নেই আমার মুখে। মন পড়ে আছে দূরে কোথায়-দূরে-দূরে, আমার মন বেড়ায় ঘুরে ঘুরে।

 

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button