অন্যের সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে ইসলাম কিছু বিধিমালা প্রণয়ন করেছে যেগুলো একজন মুসলিমের মেনে চলা উচিত, সর্বদা এই দৃঢ়চিত্ত বিশ্বাস রাখা উচিত যে সে যা কিছু বলে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে এবং ভালাে কথার জন্য সে পুরস্কৃত হবে ও মন্দ কথার জন্য শাস্তি পাবে। তাই কথা বলার আদব সম্পর্কে আমাদের জানা উচিত। সূরা ক্বাফের ১৮ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বল আলামীন বলেন যার অর্থটা এরকম,
(ক্ষুদ্র) একটি শব্দও সে উচ্চারণ করে না, যা সংরক্ষণ করার জন্য একজন সদা সতর্ক প্রহরী তার পাশে নিয়োজিত থাকে না।
রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে সতর্ক করেছেন এই বলে যে কথা খুবই বিপজ্জনক। তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহর রেওয়াতে বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
একজন ব্যক্তি এমন কোন কথা বলতে পারে যা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়, এবং সে এই বিষয়ে খুব একটা চিন্তা করে না কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সেটার গুরুত্ব দেন আর সেই কথার জন্য শেষ বিচারের দিনে তার ওপর সন্তুষ্ট হন। এবং একজন ব্যক্তি এমন কোন কথা বলে যে সেটা আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয় কিন্তু সে এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয় না কিন্তু আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা শেষ বিচারের দিবসে তার প্রতি ক্রোধান্বিত হবেন।
ইসলামিক বিধিমালা অনুসারে কথা বলার আদব
- আপনার কথা বলার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মহৎ ও উপকারী যদি আপনি ভালাে কথা বলতে অক্ষম হন, তাহলে আপনার উচিত চুপ থাকা, কারণ এটা আপনার জন্য মঙ্গলজনক। ইমাম বুখারী ও মুসলিমের রেওয়াতে বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ বিচারের দিবসে বিশ্বাস করে, তার উচিত উত্তম কথা বলা অথবা নীরব থাকা।
- সত্যবাদী হতে সচেষ্ট হােন এবং মিথ্যা বলা হতে বিরত থাকুন কারণ মুমিন সর্বদাই সত্যবাদী এবং এমনকি মজা করার ছলেও মিথ্যার আশ্রয় নেয় না। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেনঃ
তোমরা অবশ্যই সত্য কথা বলবে কেননা সত্য সততার দিকে পরিচালিত করে এবং সততা জান্নাতের দিকে পরিচালিত করে। যে ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বলে এবং সত্য ধারণ করে, আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসেবে পরিগণিত হয়। মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকো কেননা মিথ্যা মন্দের দিকে পরিচালিত করে আর মন্দ নিয়ে যায় জাহান্নামের পথে। যে ব্যক্তি অবিরাম মিথ্যা বলতে থাকে ও মিথ্যা বলার নিয়ত করে, আল্লাহর নিকট সে একজন মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিগণিত হয়
- মজার ছলে কথা বলার সময় সতর্ক থাকুন। মজার ছলে কিংবা একনিষ্ঠভাবে আপনার কথার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি অবাধ্য হওয়া থেকে বিরত থাকুন কারণ আল্লাহ অবাধ্যকারী, অভিশাপকারীকে ঘৃণা করেন। অবাধ্য কথাবার্তা হল সেই ধরনের কথাবার্তা যেগুলাে আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতা প্রকাশ করে, এবং অভিশপ্ত কথাবার্তা হল অন্যকে অভিশাপ দেওয়া, পাত্তা না দেওয়া এবং গালমন্দ করা। এই কারণে রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে সতর্ক করেছেন তাঁর একটি সহীহ হাদীসে এই বলেঃ
মুমিন ব্যক্তি কাউকে দোষারােপ করে না, অভিশাপ দেয় , আল্লাহর অবাধ্য হয় না কিংবা অন্যকে গালমন্দ করে না।
আরেকটি সহীহ হাদীসে তিনি বলেনঃ
একজন মুসলিমের জন্য অভিশাপ প্রদান করা হচ্ছে অবাধ্যতার শামিল। মৃত ব্যক্তির প্রতি অভিশাপ প্রদান যেমন নিষিদ্ধ তেমনি জীবিতদের প্রতি অভিশাপ করাও নিষিদ্ধ। রাসূল (সাঃ) আমাদের নিষেধ করেছেন এই বলেঃমৃতদের প্রতি অভিশাপ করাে না, কেননা তারা তাদের পার্থিব কৃতকর্মের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে।
আরেকটি সহীহ হাদীসে তিনি (সাঃ) আমাদের নিষেধ করেছেন এই বলেঃ
মৃতদের সম্বন্ধে সর্বদা উত্তম কথা বলাে
- গীবত তথা পরনিন্দা (কারাে অনুপস্থিতিতে তার সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যা তার উপস্থিতিতে বললে সে আঘাতপ্রাপ্ত হয়) হতে বিরত থাকুন এবং একজন অপরজনের বিরুদ্ধে গীবত করবেন না। নামিমাহ্ (এটি হল মানুষের মধ্যে একজন আরেকজনের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়ার নিমিত্তে কথাবার্তা) হতেও বিরত থাকুন কেননা রাসূল (সাঃ) একটি সহীহ্ হাদীসে বলেনঃ
যে নামিমাহ্ চর্চা করে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
বাছবিচার না করেই যারা নামিমাহ ছড়ায় তাদের প্রতি কর্ণপাত করা হতেও বিরত থাকুন। কারণ, আপনি যদি তা করেন, তাহলে আপনিও তাদের গুনাহর অংশীদার হবেন। প্রয়ােজন ব্যতীত কসম করা হতে বিরত থাকুন আল্লাহ সুবহানাওয়াতা’আলা বলেনঃ
তােমরা তােমাদের (এমন) শপথের জন্য আল্লাহর নামকে কখনাে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করাে না। (সূরা বাকারাঃ২২৪)
- আপনার জ্ঞানসীমা ও দক্ষতার নিরিখে কথাবার্তা বলুন। এবং যা আপনি জানেন না সেই বিষয়ে কথা বলবেন না। আল্লাহ বলেনঃ
যে বিষয়ে তােমার কোনাে জ্ঞান নেই, (অযথা) তার পেছনে পড়াে না। (সুরা আল-ইসরাঃ৩৬)
- নিশ্চিত হয়ে কথা বলুন যাচাই-বাছাই ও নিশ্চয়তা ব্যতীত কারাে সাথে যা শােনেন তা বলবেন না, কারণ আপনি অন্যদের কাছ থেকে সত্য ও মিথ্যা এবং সত্য ও সন্দেহযুক্ত কথাবার্তা শুনতে পারেন। যদি আপনি যা শােনেন তাই বলে বেড়ান, তাহলে আপনি গুনাহ এর ভাগীদার হবেন। সহীহ হাদীসে রাসূল (সাঃ) আমাদের সতর্ক করেছেন এইভাবেঃ
কোনাে ব্যক্তির জন্য গুনাহ করার জন্য এটা যথেষ্ট যে সে যা শােনে, তাই প্রচার করে
- অপ্রয়ােজনীয় তর্ক (যার মুখ্য উদ্দেশ্যই থাকে অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করা কিংবা অন্যের ওপর জয়লাভ করা) জড়িত হওয়া হতে বিরত থাকুন। কারণ উদ্দেশ্যহীনভাবে তর্কে জড়িত হওয়া বিপথগামীতার লক্ষণ(আমরা আল্লাহর নিকট এর থেকে পানাহ চাই)। এই কারণে তিরমিযী কর্তৃক বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে রাসূল (সাঃ) আমাদের সতর্ক করেছেন এই বলেঃ
আল্লাহর পক্ষ হতে হিদায়াত পাওয়া সত্ত্বেও তারা পথভ্রষ্ট হয়েছিল, কেননা তারা অযথা তর্কে জড়িত হত।
- আপনার বক্তব্য সুস্পষ্ট ও প্রাঞ্জল করুন এবং বুঝতে অসুবিধা হয় এমন শব্দ পরিহার করুন ও অপ্রয়োজনীয় বাকপটুতা পরিহার করুন এবং অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করে এমন কিছু বলবেন না কেননা রাসূল (সাঃ) এই ধরনের কথাবার্তা বলা ঘৃণা করতেন। তিরমিযী কর্তৃক বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেনঃ
সেই সকল লােকদের আমি চরম ঘৃণা করি ও কিয়ামত দিবসে তারা আমার নিকট হতে সর্বাপেক্ষা দূরে থাকবে, যারা অপ্রয়ােজনে কথা বলে ও অন্যদের হেয় প্রতিপন্ন করে এবং কথা বলার সময় যারা লােকপ্রদর্শনী করে।
- আপনার বক্তব্য ধীরস্থির, স্পষ্ট, শ্রুতিযােগ্য ও অন্যের নিকট বােধগম্যময় করুন। রাসূল (সাঃ) শব্দাবলী তিনবার করে পুনরাবৃত্তি করতেন এটা নিশ্চিত করার জন্য যে তা সবার বােধগম্য হল কিনা ও তাঁর সাঃ) বক্তব্য ছিল সহজ যাতে করে সবাই বুঝত।
- কথা বলার সময় আন্তরিক হােন এবং অত্যধিক ঠাট্টা করবেন না, আর যদিও করেন তবে রাসূল (সাঃ) এর অনুরূপ সত্যবাদী হবেন।
- কারাে কথা বলার সময় তাকে বাধাগ্রস্ত করবেন না ও তার বক্তব্য সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত শুনতে থাকুন এবং পরবর্তীতে তার বক্তব্যের ভালাে ও উপকারী দিক সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ আলােকপাত করতে পারেন, এমন নয় যে আপনি অযথা উদ্দেশ্যহীনভাবে কথা বলবেন
- কথা বলুন ও বিতর্ক করুন সুন্দরভাবে কথা বলুন ও বিতর্ক করুন সুন্দরভাবে যা কিনা অন্যের প্রতি ক্ষতি, আঘাত, হেয়প্রতিপন্নতা ও উপহাস প্রদর্শন বর্জিত হয়। এই ধরনের কথা বলা সকল আম্বিয়া-রসূল কর্তৃক আদেশ করা হয়েছে। মুসা (আঃ) ও তাঁর ভাই হারূন (আঃ) কে ফেরাউনের নিকট প্রেরণের সময় আল্লাহ বলেছিলেনঃ
(হেদায়াত পেশ করার সময়) তােমরা তার সাথে নম্রভাবে কথা বলবে, হতে পারে সে তােমাদের উপদেশ কবুল করবে অথবা সে আমায় (ভয়) করবে। (সূরা ত্বাহাঃ৮৪)
- কারাে বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে বর্জন করবেন না শুধুমাত্র এই কারণে যে আপনি তার বক্তব্যে সঠিক ও ভুল এবং সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ খুঁজে পেয়েছেন, কেননা সত্য বর্জন করা উচিত নয় এমনকি যদি তা অন্য কিছুর সাথে মিশ্রিত থাকে যা স্বতন্ত্র ভাবে স্বাধীন। সত্য বর্জন করা উচিত নয় এমনকি যদি অ মিথ্যার সাথে মিশ্রিত অবস্থায়ও বলা হয়। আপনি সত্য ও যথার্থ বক্তব্য গ্রহণ করবেন এবং কেবলমাত্র মন্দ ও মিথ্যাটুকু বর্জন করবেন আর এটাই হল আল্লাহ কর্তৃক আমাদের প্রতি ন্যায্য আদেশ।
- অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থেকে দূরে থাকুন। লোকের সামনে নিজেকে পরিপূরক কিংবা সিদ্ধান্তে অটল হিসেবে উপস্থপন করবেন না, কেননা এটা হল ঔদ্ধত্যের ফল যা আল্লাহ আমাদেরকে করতে নিষেধ করেছেন। সূরা নাজমের ৩২ নং আয়াতে বলা হয়েছে,
অতএব, তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না। তিনি জানেন কে সংযমী।
অযথা তর্ক করা পরিহার করুন যদিও সত্য আপনার পক্ষে থাকে। ইমাম আবু দাউদ কর্তৃক বর্ণিত। আরেকটি সহীহ্ হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেনঃ
আমি সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাত পরিবেষ্টিত একটি গৃহের নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে সঠিক হওয়া সত্ত্বেও অকারণ বিতর্কে লিপ্ত হয় না।
আসুন আমরা হাদিসের আলোকে কথা বলার চেষ্টা করি এবং সেই সাথে অন্যদেরকেও উৎসাহিত করি। লিখাটি ভালো লাগলে সবার সাথে শেয়ার করুন।
এই রকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন। এর পাশাপাশি গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন।
