বাংলা রচনা

রচনাঃ স্বাধীনতা দিবস (SSC HSC)

3.1/5 - (20 votes)

লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে রাঙানাে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য। তাই এ দেশের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস সবচাইতে গৌরবময় ও পবিত্রতম দিন। ২৬ মার্চ, আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা দিবস রচনাটি সকল শ্রেণির (৬ ৭ ৮ ৯ ১০ ১১ ১২) জন্য বিভিন্ন বই থেকে নিয়ে লিখা হয়েছে। 

স্বাধীনতা দিবস রচনাটি অনন্যভাবেও বলা যায়। যেমনঃ ২৬, মার্চ, ১৯৭১, জাতীয় জীবনে স্বাধীনতার দিবসের গুরুত্ব

ভূমিকা

“সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবুও মাথা নোয়াবার নয়” – সুকান্ত ভট্টাচার্য 

২৬ মার্চ ১৯৭১, পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশের নামের অন্তর্ভুক্তি ঘটে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস এ দিনটিকে ঘিরে রচিত হয়েছে। এ দিনের নবীন সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ স্বাধীনতা দিবসের আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তের মধ্যে প্রথমেই যে কথা মনে পড়ে, তা হল এ দেশের অসংখ্য দেশপ্রেমিক শহীদের আত্মদান। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার মানুষ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসনের ২৪ বছরের গ্লানি থেকে মুক্তির পথ খুজে পেয়েছিল। লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে রাঙানাে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য। তাই এ দেশের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস সবচাইতে গৌরবময় ও পবিত্রতম দিন। ২৬ মার্চ, আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস

অনন্য ঘটনা

“শুধু ভিক্ষা করে কখনাে স্বাধীনতা লাভ করা যায় না।
স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় শক্তি দিয়ে, সংগ্রাম করে।
স্বাধীনতার মূল্য দিতে হয় রক্ত দিয়ে”। – নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিশ্বের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। কোনাে জাতিকেই জন্মভূমির জন্য এমনভাবে আত্মত্যাগ করতে হয় নি। তাই স্বাধীনতার ইতিহাসে বাঙালিরা এক গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে। সেই সূচনা শুধু বাংলাদেশের মানুষেরই নয়, বিশ্বের প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্যেই এক অভিনব প্রেরণার উৎস। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা

ছবিঃ ইন্টারনেট।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (Sheikh Mujibur Rahman) বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন। এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়ে, অর্থ দিয়ে, সম্পদ দিয়ে, সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার পতাকা এ দেশের শ্যামল ভূমিতে ওঠাতে  সক্ষম হয়েছিল। এজন্যে এ দেশের মানুষকে সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় সংগ্রাম করতে হয়েছে এক শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে। অবশেষে তারা সেই অকুতােভয় সংগ্রামে জয়ী হয়েছে। ফলে আমরা লাভ করেছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ‘বাংলাদেশ’
↬ আরও পড়ো:  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

ঐতিহাসিক পটভূমি

পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা দেয়ার পর থেকেই মূলত স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করা হয়। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে রােধ করার জন্যে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ১৯৫২ সালে পুনরায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘােষণা দিলে ছাত্র জনতা পুনরায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই
ছবিঃ সংগৃহীত।

১৯৫২ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। এ আন্দোলনকে স্তিমিত করার জন্যে গুলি চালানাে হয়। শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার বরকতসহ আরও অনেকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি এবং যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয় লাভ পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর ক্ষমতার ভিতকে নড়বড়ে করে দেয়। ১৯৬৫ সালে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে আইয়ুব খান এক প্রহসনের নির্বাচন দিয়ে এদেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে নেয়। তখন থেকেই স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপিত হয়। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে আটক করা হয়। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে তাঁকে আটকে রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে নি।

১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ(Awami League) নিরঙ্কুশ  সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে টালবাহানা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ বলে জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।

৭ মার্চ এর ভাষণে বঙ্গবন্ধু
ছবিঃ ৭ মার্চ এর ভাষণে বঙ্গবন্ধু

সারা বাংলায় শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। পঁচিশে মার্চের রাতের অন্ধকারে হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ। ২৫ মার্চ গভীররাতে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণা করেন। আহ্বান করেন বাঙালি সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্যে।
↬ আরও পড়োঃ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের তাৎপর্য

সঙ্কটময় দিন

২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালে আমাদের জাতীয় জীবনে নেমে আসে এক সংকটময় দিন। এ দিবসে আমরা প্রথমবারের মতাে নিজেদের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হই। এক নারকীয় রাত্রির অন্ধকারে আমরা আমাদের স্বাধীনতার অগ্নি – তপস্যায় নিমগ্ন হয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের এ যাত্রাপথ ছিল অতি বন্ধুর। এই অতি বন্ধুর পথটি পার হয়ে আপন ভুবন রচনা করতে আমাদের দিতে হয়েছে অগণিত প্রাণ ও রক্ত। সুখের বিষয় এই যে, শেষ পর্যন্ত এই স্বাধীনতার মাধ্যমে আমাদের চরম সার্থকতাটি অর্জিত হয়েছে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের বিবরণ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার, অসংখ্য ঘুমন্ত বাঙালি হত্যা এবং পরবর্তী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণার মধ্য দিয়ে বাঙালিরা দেশকে শত্রু মুক্ত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। আধুনিক প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে গড়ে তােলে প্রতিরােধ ব্যূহ। হানাদার বাহিনীও নিরস্ত্র মানুষদের ওপর নির্মম অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে। অগণিত ঘর-বাড়ি তারা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। যাকে পায় তাকেই গুলি করে মারতে থাকে। গরু, ছাগল, হাঁসমুরগি ইত্যাদি ধরে নিয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশের ভূখণ্ড এক ভুতুড়ে রাজ্যে পরিণত হয়। এ অবস্থায় সামরিক বাহিনীতে নিযুক্ত বাঙালি সদস্য, আধা-সামরিক লােকজন, পুলিশ, আনসার অনেকেই বিদ্রোহ করে বাঙালিদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। দেশের প্রায় এক কোটি লােক প্রাণের ভয়ে শরণার্থী হিসেবে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী প্রত্যেকেই ঝাপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে। ক্রমে ক্রমে মুক্তিযোেদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং দেশের সর্বত্র পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নাজেহাল হতে থাকে। দেশের যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ফলে হানাদার বাহিনী আরও বিপাকে পড়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে তারা আরও বেশি জ্বালাও-পােড়াও শুরু করে দেয়। সাধারণ মানুষদের ধরে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে মারতে থাকে। একপর্যায়ে তারা সাধারণ লােকের হাতেও নাজেহাল হতে থাকে এবং তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। নানা অজুহাতে দেশের লাখ লাখ লােককে হত্যা করে একপর্যায়ে তারা গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হয়।

↬ আরও পড়ঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

স্বাধীনতা অর্জন

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। মুক্তিযোেদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে হানাদার বাহিনী ক্রমেই বিপর্যস্ত হতে থাকে। এমনি ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। এ সুযােগে ভারতের সেনাবাহিনী সরাসরি মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মওকা পেয়ে যায়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটায় তৎকালীন
রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করছেন নিয়াজি।
পাশে বসে আছেন অরোরা। ছবি সংগৃহীত

শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ১৬ জিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় অর্জিত হয়।

উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য

আমাদের জাতীয় জীবনে এ দিনটির প্রধান তাৎপর্য হচ্ছে এ দিন সমগ্র দেশবাসীর বহুকাল লালিত মুক্তি ও সংগ্রামের অঙ্গীকারে ভাস্বর। এই দিবসটি দারিদ্র্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ । এ দিন আমাদের আত্মপরিচয়ের গৌরবে উজ্জ্বল, ত্যাগে ও বেদনায় মহীয়ান। প্রতিবছর গৌরবময় এ দিনটি পালন করতে গিয়ে আমাদের কর্তব্য হয়ে ওঠে স্বাধীনতার স্বপ্ন ও সাধ আমরা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি, জাতীয় জীবনে আমাদের অর্জন কতটুকু আর বিশ্বসভায় আমাদের অবস্থান কোথায় সেসব মিলিয়ে দেখা। এদিক থেকে এ দিনটি আমাদের আত্মসমালােচনার দিন, হিসেব মেলাবার দিন, আত্মজিজ্ঞাসার দিন।

বাংলা সাহিত্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা

বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা নানাভাবে রূপায়িত হয়েছে। বিগত দিনে যেসব দেশে স্বাধীনতার আন্দোলন যত দানা বেঁধে ওঠেছে ততই বেড়েছে ক্ষমতাসীন দখলদার শাসকগােষ্ঠীর অত্যাচার-নির্যাতন। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সেসময় বাংলাদেশের কবিগণ অসংখ্য কবিতা রচনা করেছেন প্রত্যাশিত স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা পরবর্তী অনুভূতির তাড়নায়। এক্ষেত্রে আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আল-মাহমুদ, জাহানারা আরজু, মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মােহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দীন, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ অগ্রণী সূচনা পালন করেন। কবি আহসান হাবীব স্বাধীনতাকে তার বুকের মধ্যে আঁকতে চেয়েছেন। আর নীল সবুজ রঙে সাজিয়ে আপন করে পেতে চেয়েছেন স্বাধীনতাকে। এ রকমই অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে তার ‘স্বাধীনতা’ কবিতায়। শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির’ থেকে গ্রন্থের অনেক কবিতায় অনেকভাবে ব্যক্ত হয়েছে স্বাধীনতার অনুভূতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে ‘তােমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’, ‘স্বাধীনতা তুমি’ প্রভৃতি শামসুর রাহমানের উল্লেখযােগ্য কবিতা। ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় তিনি বলেন:

“স্বাধীনতা তুমি
রবি ঠাকুরের অমর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুলের ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানাে
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা।”

হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অব্যক্ত সূর্যোদয়’ আলাউদ্দিন আল-আজাদের ‘স্বাধীনতা’, নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা’ প্রভৃতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ওপর রচিত অমর সাহিত্য।

স্বাধীনতার স্বপ্ন ও বিরাজমান বাস্তবতা

আমাদের এ কথাটি ভুলে গেলে চলবে না যে, সমগ্র দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষা ও আত্মত্যাগের ফলেই এই স্বাধীনতা লাভ সম্ভবপর হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আজ আমাদের দায়িত্ব, এক সমুদ্র রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সুখী-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করা। আমাদের এই স্বাধীনতা সমাজের গুটিকয়েক মানুষের আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করতে এটা হতে পারে না। কারণ আমাদের এই স্বাধীনতা জাতির রাজনিতিক, সামাজিক ও অর্থনিতিক মুক্তির মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ। এ আদর্শগুলাের প্রকৃত রূপায়ণই আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, সাধারণ মানুষের জীবনে তা কতটুকু অর্থবহ হয়েছে এবং আমরা স্বাধীনতা-উত্তর এতগুলাে বছর পরও কেন বাংলার অগণিত মানুষের দুঃখ-যাতনা, ব্যর্থতা-হতাশা, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারি নি।

স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে। একটি প্রজন্ম অতিক্রান্ত হয়ে আরেকটি প্রজন্মের সূচনা ঘটেছে। কিন্তু স্বাধীনতা শব্দটির সঙ্গে যে স্বপ্ন একদা দেশবাসী দেখেছিল আজও তা বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভবপর হয় নি। স্বাধীনতার পর থেকে সরকার পরিবর্তনের একটি ধারা ক্ৰম আমরা লক্ষ করতে পারি। প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় এসেই ঘােষণা করেন যে, “আমাদের সরকার উন্নয়নের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, আমরা উন্নয়নের রাজনীতি করি, দেশকে উন্নয়ন করাই আমাদের লক্ষ্য। সর্বোপরি উন্নয়নমূলক যত প্রকারের বিশেষণ রয়েছে তার সবকটিই তাঁরা ব্যবহার করেছেন, দেশের উন্নয়ন করেছেন, দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে গেছেন… ইত্যাদি”। কিন্তু বাস্তবতা হল- বাংলার দুঃখী মানুষের ভাগ্য রয়েছে অপরিবর্তনীয়। সমাজব্যবস্থা আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। সম্প্রতি আমাদের জাতীয় জীবনে নানা কারণে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলতা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কলে-কারখানায় , অফিসে-আদালতে, স্কুলে-কলেজে, খেলার মাঠে, ঘরে-বাইরে সর্বত্রই শৃঙ্খলার অভাব প্রকট। অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে স্বার্থান্বেষী মানুষ মাত্রই মেতে উঠেছে ক্ষমতাধর হওয়ার প্রতিযােগিতায়। কল্যাণমুখী রাজনীতি হয়ে পড়েছে কলুষিত। সমাজ জীবনের রন্ধে রন্দ্রে দুর্নীতির থাবা বিস্তৃত হচ্ছে। তার ফল হয়েছে ভয়াবহ। শিক্ষার ক্ষেত্রে, সমাজ-জীবনের। অলিতেগলিতে উচ্ছলতার ভয়াবহ কলঙ্ক-স্বাক্ষর। সামান্য কারণেই চলে ভাঙচুর। চলে খুনখারাপি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, চলে শ্লীলতাহানি।

সামাজিক স্বার্থ ভুলে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জঘন্য প্রবণতার ফলে সমাজকে আজ গ্রাস করেছে চরম। বিশৃঙ্খলতা ও নৈরাজ্য এ যেন জাতীয় জীবনের অপমৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি। বর্তমান ছাত্রসমাজের উচ্ছলতার কথা বলতে গেলে তা হবে খুবই দুঃখের ও বেদনাদায়ক। যেখানে তাদের ওপরই নির্ভর করে দেশ ও জাতির গৌরব, সেখানে আজ তারা নানা কারণে রুদ্ধগতি। হতাশা আর নৈরাশ্য এই, যুবশক্তিকে এক সর্বনাশা অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। দেশব্যাপী নৈরাশ্য, তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, চরম দারিদ্র্য, ধনবৈষম্য, মূল্যবােধের অবনতি, কুনীতি-দুর্নীতিভরা রাজনীতি ইত্যাদি বহু কারণে ছাত্রসমাজ নিয়মহীনতার দিকে চুম্বক-আকর্ষণে নিয়ত ধাবিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি এই স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম? এই কি আমাদের ইতিহাস ও সভ্যতার মূলমন্ত্র ? এভাবে কি আমরা শক্তিধর মহান জাতির অস্তিত্বকে তুলে ধরতে পারব? এভাবে কি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা হবে? স্বাধীনতা অর্জনের এত বছর পর এখনাে অসংখ্য লােক অশিক্ষা ও দারিদ্র্য কবলিত অবস্থায় রয়েছে। জনগণের জীবনের নিরপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। বেকারত্বের জালে আবদ্ধ যুবক বেছে নিচ্ছে সন্ত্রাস আর ড্রাগের মরণনেশা।
↬ আরও পড়ঃ মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার ।  বেকার সমস্যা ও প্রতিকার

এক কথায় এখনাে আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে সঠিকভাবে অর্থবহ করে তুলতে পারি নি। সবচেয়ে বেশি দুঃখজনক, বেদনাদায়ক ও লজ্জার কথা হল, স্বাধীনতার চেতনাকে পরিবর্তন ও ইতিহাসকে বিকৃত করার ধারাবাহিক অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে সমাজের তথা কথিত বিশেষজ্ঞ ইতিহাসবিদগণ, ফলে আজ যদি নতুন প্রজন্মের কেউ জানতে চায় যে, আমাকে আমার দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস শােনাও, কিংবা একটি বই দাও যেখানে আমার দুঃখিনী মায়ের কথা লেখা আছে, যেখানে ভাইয়ের রক্তে ভেজা চিঠির কথা লেখা আছে, যেখানে বােনের বুকফাটা আর্তনাদের কথা লেখা আছে, যেখানে আমার এই বাংলাদেশের জন্মকথার লাল দাগগুলাে কালাে হয়ে আছে। তবে আমরা কী শােনাব, কী দেব? কোন বইটি দেব? কোন ঐতিহাসিকের লেখা দেব? কোন সরকারের বই দেব? উত্তর নেই!!

পরিস্থিতি উত্তরণের উপায়

অজস্র রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা যাতে কারাে ব্যক্তিগত বা দলগত চোরাবালিতে পথ না হারায় সেই প্রচেষ্টা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় এই স্বাধীনতার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে এবং জাতির বিপর্যয়ের অশনিসংকেতে জীবন আরও মুখ থুবড়ে পড়বে। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করা আরও কঠিন। আজ বিশ্বের দিকে দিকে উৎকর্ষসাধনের প্রতিযােগিতা। এক্ষেত্রে আমাদেরও সৃষ্টি করতে হবে উন্নয়নের ধারা। দেশ গড়ার কাজে আজ প্রয়ােজন সমগ্র জাতির নতুন করে শপথ গ্রহণ করার। সর্বপ্রকার স্বৈরতন্ত্র থেকে দেশকে মুক্ত করে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠতে হবে। তবেই গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
↬ আরও পড়ঃ স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন

উপসংহার

আমাদের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা যেমন তাৎপর্য বহন করে, তেমনি লক্ষ লক্ষ ক্লিষ্ট ও আর্তমানুষ যাতে জাতীয় পতাকাকে সমুন্নত রেখে নতুন জীবনকে পাথেয় করে নিজেদের গড়ার শপথ নিতে পারে সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয়। তাহলেই আমরা নতুন স্বপ্ন-সম্ভাবনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠব এবং দুঃখ-বেদনা ক্ষণকালের জন্য হলেও ভুলতে পারব। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি বটে, কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি এখনাে আসে নি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেই আমাদের স্বাধীনতার রূপ পূর্ণাঙ্গ হবে। তাই এই নতুন রাষ্ট্রকে নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বিতাড়িত করতে হবে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, বেকারত্ব, বুভুক্ষা ও দারিদ্র। তবেই না আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে পারব। তাই আসুন সবরকম বিভেদ-বিচ্ছেদ ভুলে, হানাহানি সংঘাত ভুলে, সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা জলাঞ্জলি দিয়ে দেশ গড়ার কাজে ব্রতী হই।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button