বাংলা রচনা

পহেলা বৈশাখ নববর্ষ রচনা – ১৫ পয়েন্ট [PDF]

2.2/5 - (278 votes)

নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ রচনা ৬ ৭ ৮ ৯ ১০ SSC JSC HSC. Pohela Boishakh composition for class 6 7 8 9 10 SSC HSC JSC.

অনুরুপভাবে লিখা যায়ঃ পহেলা বৈশাখ, ১৪ এপ্রিল, নববর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্য, সার্বজনীন উৎসব।


ভূমিকা

হে নূতন, এসাে তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি/পুঞ্জ পুঞ্জ রূপেরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস গড়িয়ে আসে পহেলা বৈশাখ। চৈত্র অবসানে বর্ষ হয় শেষ। আসে নতুন বছর নববর্ষ। পৃথিবীর সর্বত্রই নববর্ষ একটি ‘ট্রাডিশন’ বা প্রচলিত সংস্কৃতিধারা। আদিকাল থেকেই যে কোনাে বছরের প্রথম দিনটি ‘নববর্ষ’ নামে পরিচিত হয়ে আসছে। পুরাতন বছরের জীর্ণ ক্লান্ত রাত্রি’-র অন্তিম প্রহর সমাপ্ত হয়। তিমির রাত্রি ভেদ করে পূর্বদিগন্তে উদিত হয় নতুন দিনের জ্যোতির্ময় সূর্য।

প্রকৃতির নিসর্গ মঞ্চে ধ্বনিত হয় নব-জীবনের সঙ্গীত। আকাশ সজ্জিত হয় অপরূপ সাজে। পত্রে পত্রে তার পুলক-শিহরন। গাছে গাছে তার আনন্দ-উচ্ছ্বাস। পাখির কণ্ঠে কণ্ঠে নব প্রভাতের বন্দনা-গীতি। দিকে দিকে মানুষের বর্ষবরণের উৎসব-আয়ােজন। অভিনন্দন-শঙ্খধ্বনিতে হয় নতুনের অভিষেক। রাত্রির তপস্যা শেষে এই শুভদিনের উদার অভ্যুদয়ে মানুষের হৃদয়-উৎসারিত কলােচ্ছাসে ভরে যায় পৃথিবী। নতুন দিনের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা, প্রার্থনা দুঃখ জয়ের।

পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ বলার কারণ

বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন বৈশাখ। কৃষিভিত্তিক আমাদের এই দেশের সব আনন্দ উৎসবের নিবিড় যােগ রয়েছে ফসলের সঙ্গে। আমাদের নববর্ষের সাথেও সম্পৃক্ত রয়েছে ফসল বােনার আনুষ্ঠানিকতা। চৈত্র মাসে ফসল বুনলে ফলনের দিক থেকে ভালাে হয় না এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে বাংলার কৃষক সমাজ বৈশাখ মাসে ফসল বােনার সূচনা করে। তাছাড়া পহেলা বৈশাখে বাঙালিরা অতীতের সুখ-দুঃখ ভুলে নতুনের আহ্বানে সাড়া দেয়। নতুনকে গ্রহণ করার জন্য উদ্দীপ্ত হয়। তাই পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ বলা হয়।

সময়কাল

বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুর মধ্যে দিয়ে দুটি করে বারােটি মাস আবর্তিত হয়। নতুন বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। নববর্ষ বলে বরণ করে নেওয়া হয় এ দিনটিকে। নতুন সব জিনিসেরই আলাদা একটা বৈচিত্র্য আছে। পুরনাে বছরের অবসানে নববর্ষ আসে তারুণ্যের প্রদীপ্ত প্রদীপ হাতে নিয়ে। আমাদের জীবনে ঐতিহ্যপূর্ণ এই দিনটি বছরের অন্য সব দিন থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে ধরা দেয়। বাঙালিরা নববর্ষকে বরণ করে অন্তরের গভীর অনুরাগ দিয়ে। পহেলা বৈশাখ আমাদের যাত্রা শুরু লগ্ন। আমাদের নববর্ষের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে ফসল বােনার আনুষ্ঠানিকতা। চৈত্রের অবসানে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে নবজাগরণের ঢেউ জাগে।

কালবৈশাখির প্রমত্ত নৃত্যের তালে তালে আসে গ্রামীণ জীবনে ফসলের আশ্বাস- ফসল বােনা ও ফসল কাটার প্রাণচাঞ্চল্য। প্রকৃতিকেও নববর্ষে নতুন রূপ ধারণ করতে দেখা যায়। চৈত্রের পাতা ঝরা বিবর্ণ গাছগাছালি সব পত্র-পুষ্প-. ফলে অপরূপ হয়ে ওঠে। পৃথিবী যে তার নিজের নিয়মে চলছে নববর্ষের আগমনে সবার মনে এই চির পুরনাে কথাটি নতুন করে জাগ্রত হয়। পহেলা বৈশাখে বিগত বছরের বহু সুখ-দুঃখের স্মৃতি মনকে বিষাদময় করে তােলে বটে; কিন্তু তার সঙ্গে ভাবী বছরের সম্ভাবনা আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।

পহেলা বৈশাখ

পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি বাঙালির একটি সার্বজনীন লােকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হল নববর্ষ। অতীতের ভুল ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় পালিত হয় নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। তারপর থেকে মােগলরা জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত পহেলা বৈশাখ পালন করত।

নববর্ষের আশ্বাস

নববর্ষের দিনটি প্রতিদিনের মতােই একটি সাধারণ দিন মাত্র। প্রতিদিনের মতাে এ দিনটিও যথানিয়মেই শুরু হয়। আলােক-প্লাবনে পৃথিবী উদ্ভাসিত হয়। পাখি গান গায়। গাছে গাছে শিহরণ জাগে। কিন্তু তবু এ দিনটি অন্য দিনগুলাের চেয়ে স্বতন্ত্র বিশিষ্ট। প্রাত্যহিক তুচ্ছতার উর্ধ্বচারী। বর্ষ-প্রদক্ষিণের পথে এ দিনটি বিশেষ তাৎপর্যে মহিমাভাস্বর। এ দিনটি আমাদের কাছে মুক্তির বার্তা বয়ে আনে। মুক্তি প্রাত্যহিকতার জীর্ণ জীবন থেকে, মুক্তি প্রতিদিনের ক্ষুদ্র, আত্মসর্বস্ব জীবনের গণ্ডি থেকে। মুক্তি চিত্তের, দীনতা ও হতাশা থেকে। প্রতিদিনের জীবনে আমরা ক্ষুদ্র। নববর্ষের পুণ্য – প্রভাতে আমরা মহৎ। এ দিন আমাদের কাছে পরম আশ্বাসের, পরম প্রার্থনার। 

এই পুণ্য দিনে আমরা লাভ করি এক মহাজীবনের উদার সান্নিধ্য। বর্ষারম্ভের পুণ্য-মুহূর্তে নবােদিত সূর্যের আলােকের ঝরনা ধারায় আমরা শুচিত হয়ে অনুভব করি পরম প্রেমময়ের আনন্দ-স্পর্শ। আমাদের স্বার্থপরতা, ক্ষুদ্রতার নির্মোক ভেঙে আমরা সেদিন মিলনের উদার উৎসব প্রাঙ্গণে এসে সম্মিলিত হই। আমাদের হৃদয় কোন অসীমের রাজ্যে, কোন অনির্বচনীয় আনন্দের অভিমুখে ধেয়ে চলে। নববর্ষের পুণ্য-প্রভাতে আমাদের নিজেদের মধ্যে সর্বজয়ী মানবশক্তি উপলদ্ধি করার দিন। মানুষের জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল সুখ-দুঃখে গড়া একটি বছর। কিন্তু তার জন্য শােক নয়- যা এলাে, যা অনাগত সম্ভাবনায় সমুজ্জ্বল, তাকে আবাহন করার দিন এ দিন। 

বাংলাদেশে নববর্ষ উদযাপনের বৈশিষ্ট্য

পহেলা বৈশাখ বাংলার জনসমষ্টি অতীতের সুখ-দুঃখ ভুলে গিয়ে নতুনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওঠে। জানে এ নতুন অনিশ্চিতের সুনিশ্চিত সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। তাই মন সাড়া দেয়, চঞ্চল হয়। নতুনকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি নেয়।

রমনা বটমূল পহেলা বৈশাখ উদযাপনের দৃশ্য
ছবিঃ ইন্টারনেট।

আর সে দিন প্রাত্যহিক কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে ঘরবাড়ি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে। আটপৌরে জামা কাপড় ছেড়ে ধােপদুরস্ত পােশাক-পরিচ্ছদ পরে, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করে পানাহারে মেতে ওঠে। রমনার বটের তলায় জড়াে হয়ে গান গায়, হাততালি দেয়। সবকিছু মিলে দেশটা যেন হয়ে ওঠে উৎসবে আনন্দে পরিপূর্ণ। এছাড়াও এদেশের স্থানীয় কতকগুলাে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষের বৈশিষ্ট্যসমূহ ফুটে ওঠে। যেমন : মেঘের কাছে জল ভিক্ষা করা’, ‘বার্ষিক মেলা’, ‘পুণ্যাহ’, ‘হালখাতা‘ ইত্যাদি।

নববর্ষ উদযাপনে গ্রামীণ জীবন ও নগরজীবন

নববর্ষের উৎসব গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত, ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। নববর্ষে পল্লি অঞ্চলের কোথাও কোথাও বেশ বর্ণাঢ্য মেলা বসে। মেলার বিচিত্র আনন্দ-অনুষ্ঠানে, কেনা-বেচার বাণিজ্যিক লেনদেনে, মিলনের অমলিন খুশিতে, অবারিত আন্তর প্রীতির স্পর্শে নববর্ষের বিশেষ দিনটি মুখর হয়ে ওঠে। এই পুণ্য দিনেই শুরু হয় ব্যবসায়ীদের হালখাতার শুভ মহরত। প্রায় প্রতি বিক্রয়প্রতিষ্ঠানেই ক্রেতাদের মিষ্টান্ন সহযােগে আপ্যায়ন করা হয়। সর্বত্রই এক মধুর প্রীতিপূর্ণ পরিবেশ। এ ছাড়া দরিদ্র ভােজনে, নৃত্য-গীতে, সভা-সমিতিতে, আনন্দে-উৎসবে বছরের প্রথম দিনটি মহিমােজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গৃহস্থরাও নানাবিধ অনুষ্ঠানব্রতে পুণ্য দিনটিকে স্মরণীয় করায় মেতে ওঠে। পল্লির কোথাও কোথাও রচিত হয় নববর্ষ উদযাপনের উৎসব-মঞ্চ। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 

বৈশাখী মেলা

নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তােলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সার্বজনীন লােকজ মেলা। এ মেলা অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে হয়ে থাকে। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লােকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সকলপ্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়। এছাড়া শিশু-কিশােরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং বিভিন্ন লােকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন : চিড়া, মুড়ি, খই, বাতাসা ইত্যাদি, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্র্যময় সমারােহ থাকে।

ধুপখোলা মাঠে বৈশাখী মেলার দৃশ্য। ছবিঃ ইন্টারনেট।

মেলায় বিনােদনেরও ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লােকগায়ক ও লােকনর্তকদের। উপস্থিতি থাকে। তারা যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গাজীর গানসহ বিভিন্ন ধরনের লােকসঙ্গীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি বিভিন্ন আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন। লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি আখ্যানও উপস্থাপিত হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি মেলার বিশেষ আর্কষণ। এছাড়া শিশু-কিশােরদের আকর্ষণের জন্য থাকে বায়ােস্কোপ। শহরাঞ্চলে নগর সংস্কৃতির আমেজে এখনও বৈশাখি মেলা বসে এবং এই মেলা বাঙালিদের কাছে এক অনাবিল মিলন মেলায় পরিণত হয়। বৈশাখি মেলা বাঙালির আন্দঘন লােকায়ত সংস্কৃতির ধারক।

নগরজীবনে নববর্ষ উদযাপন

বর্তমানে নগরজীবনে নগর-সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমজপূর্ণভাবে  নববর্ষ উদযাপিত হয়। পয়লা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানাের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। এ সময় নতুন সূর্যকে প্রত্যক্ষ করতে উদ্যানের কোনাে বৃহৎ বৃক্ষমূলে বা লেকের ধারে অতি প্রত্যুষে নগরবাসীরা সমবেত হয়। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করে। এদিন সাধারণত সকল শ্রেণীর এবং সকল বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পােশাক পরিধান করে।

নববর্ষকে স্বাগত জানাতে তরুণীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খােপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ পরে। আর ছেলেরা পরে পাজামা ও পাঞ্জাবি। কেউ কেউ ধুতি-পাঞ্জাবিও পরে। এদিন সকালবেলা পানতা ভাত খাওয়া একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে থাকে ইলিশ মাছ ভাজা। এভাবে লোকজ বর্ষবরণ প্রথাগুলাের কোনাে কোনােটির অনুসরণের মাধ্যমে গ্রামীণ ঐতিহ্য অনেকটা সংরক্ষিত হচ্ছে। 

রাজধানী ঢাকার বর্ষবরণ আয়ােজন

বর্ষবরণের চমকপ্রদ ও জমজমাট আয়ােজন ঘটে রাজধানী ঢাকায়। এখানে বৈশাখি উৎসবের অনুষ্ঠানমালা এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে রমনা উদ্যান ও এর চারপাশের এলাকায় উজ্জ্বল। জনস্রোতে সৃষ্টি হয় জাতীয় বন্ধন।

ছায়ানটের প্রতীকী ছবি।

ছায়ানটের উদ্যোগে জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথেরআগমনী গান ‘এসাে হে বৈশাখ এসাে, এসাে’-এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলার প্রভাতি অনুষ্ঠানেও নববর্ষকে স্বাগত জানানাে হয়। এখানকার চারুশিল্পীদের বর্ণাঢ্য শােভাযাত্রা নববর্ষের আহ্বানকে করে তােলে নয়ন-মনােহর। এ শােভাযাত্রা উপভােগ করে সকল শ্রেণীর আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। এদিন শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ, টি. এস. সি. এবং চারুকলাসহ সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে। 

জাতীয় কর্মসূচি ও নববর্ষ পালন

বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, জাতীয় জাদুঘর, ছায়ানট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, নজরুল একাডেমী , মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলাে বিভিন্ন জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করে।

বাংলা নববর্ষ ও উপজাতি সম্প্রদায়

বাংলা নববর্ষ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি) উপজাতীয়দের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয়-সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ আনন্দমুখর পরিবেশে পালিত হয়। এটি পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ উৎসবকে চাকমারা ‘বিজু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ এবং ত্রিপুরারা ‘বৈসুক’ বলে আখ্যা দিলেও গােটা পার্বত্য এলাকায় তা ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত।

নববর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

আমাদের জীবনেতিহাসের সার্বিক পটভূমিতে এ দিবসের নববর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। আমাদের জাতীয় চেতনা অর্থাৎ বাঙালি সত্তার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতির অস্থিমজ্জার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে বাংলা নববর্ষের মাহাত্ম। রূপকথার জিয়ন কাঠির মতাে এ দিনটির মর্মস্পর্শে দূরীভূত হয় পুরােনাে দিনের সকল জরাজীর্ণতা। নতুনের ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে ওঠে বাঙালির ক্লান্ত-শ্রান্ত জীবন। প্রতিবছর এ দিনটি আমাদের সামনে হাজির হয় নতুনের বার্তা- আশার আলাে নিয়ে। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছেই দিনটি হয়ে উঠে উৎসবমুখর। বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুজাতি-গােষ্ঠী অধ্যুষিত একটি শান্তির দেশ। 

এখানে প্রতিটি সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব। এগুলাের অধিকাংশই নির্দিষ্ট গােষ্ঠীর আনন্দ অনুষঙ্গ বলে স্বীকৃত, কিন্তু পহেলা বৈশাখই একমাত্র উৎসব যা কোনাে ধর্মের বা গােষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি গােটা জাতির তথা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অখণ্ড বাঙালি জাতির উৎসব। পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গে দেশের সকল মানুষ একই সময় অভিন্ন আনন্দ-অনুভূতিতে উদ্বেল হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের মনে করে এক অখণ্ড সত্তা রূপে। ফলে জাতিগত সংহতি ও ঐক্য সুদৃঢ় হয়ে মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে দূরত্ব কমে আসে। নববর্ষ পরিণত হয় একটি সার্বজনীন অনুষ্ঠানে।

দিন বদলের পালায় নববর্ষ

আজ উৎসবের অঙ্গে যুগ-পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। উৎসবে যেখানে একদা হৃদয়-আবেগের প্রাধান্য ছিল, ছিল প্রীতিময় আন্তরিকতা, আজ কৃত্রিমতা তাকে গ্রাস করেছে। সেখানে হৃদয়হীন আচার-অনুষ্ঠানের মাতামাতি। চোখ-ঝলসানাে চাকচক্য আজ উৎসবের বৈশিষ্ট্য। নাগরিক সভ্যতার যান্ত্রিকতা আজ আমাদের হৃদয়-ঐশ্বর্য লুণ্ঠন করেছে। নির্বাসিত করেছে শুষ্ক, নিষ্প্রাণ জড়জগতে। উৎসবে তাই আজ আমাদের হৃদয়-দৈন্যের নগ্নতা। উৎসবের মহতী কল্যাণী রূপটি তাই আজ আমাদের কাছে অনুদ্ভাসিত।

নববর্ষের উৎসব-অনুষ্ঠানেও আজ আন্তরিক প্রীতির অনেক অভাব। মাইকে চটুল গানের বাড়াবাড়ি। সেখানেও উল্লাস মত্ততার চিত্র। সেখানে আমাদের হৃদয়-সংকুচিত, আমাদের দ্বার রুদ্ধ। বর্ষবরণ উৎসবেও দীপালােকের উজ্জ্বলতা, খাদ্য-প্রাচুর্য, আয়ােজন-বৈচিত্র্য। সেখানে আমাদের শুষ্কতা, আমাদের দীনতা, আমাদের নির্লজ্জ কৃপণতারই প্রকাশ। তাই আজ এই সর্ব-বন্দনার পুণ্য-মুহূর্তে আমাদের মনে রাখতে হবে, সমারােহ সহকারে আমােদ প্রমােদ করায় আমাদের উৎসব কলা কিছুমাত্র চরিতার্থ হয় না। তাহার মধ্যে সর্বদলের আন্তরিক প্রসন্নতা ও ইচ্ছাটুকু না থাকিলেই নয়। নববর্ষে যেন ফিরে পাই আমাদের সেই হৃত-গৌরব। আবার যেন আমাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে আন্তরিক প্রসন্নতা ও কল্যাণী ইচ্ছার ভাবরসে। আবার যেন আমরা বর্ষারম্ভের উৎসবে খুঁজে পাই মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করার মহত্ত্ব। আজ নববর্ষ উৎসব ‘সত্যের গৌরবে, প্রেমের গৌরবে, মঙ্গলের গৌরবে, নির্ভীক মহত্বের গৌরবে’ উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক।

উপসংহার

নববর্ষ সমগ্র মানুষের কাছে নবজীবনের দ্বার উন্মােচিত করে দিক। নতুন বছর যেন মুষ্টিমেয় ধনীর ভােগবিলাসের সঙ্কীর্ণ উল্লাসে পরিণত না হয়। দারিদ্র্য লাঞ্ছিত পীড়িত মানুষের নিষ্ফল বিলাপে যেন পৃথিবী বিষন্ন না হয়ে ওঠে। যুদ্ধদীর্ণ বিশ্বের পাশবশক্তির তাণ্ডব যেন শান্তির শুভশক্তির কাছে পরাভূত হয়।

আসুন পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে আমরা আমাদের মধ্যকার সকল বিভেদ ও দ্বিধা দূর করতে সচেষ্ট হই। আমরা জাগ্রত হই অখণ্ড জাতীয় চেতনায়। আমরা ঋদ্ধ হই আগামীর গর্বিত প্রেরণায়। নতুন বছর আমাদের সবার জীবনে সুখ-সম্ভার বয়ে আনুক এটাই হােক আমাদের প্রত্যাশা। আজ নববর্ষের এই শুভক্ষণে, আসুন, কবিকণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা বলি,

যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবাে জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযােগ্য করে যাবাে আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার

 

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

One Comment

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button