বাংলা রচনা

পল্লি উন্নয়ন – রচনা (১৬ পয়েন্ট) SSC HSC JSC

Rate this post

প্রবন্ধ রচনা – পল্লি উন্নয়ন বা, গ্রামে ফিরে যাই বা, বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন


প্রবন্ধ রচনা - পল্লি উন্নয়ন বা, গ্রামে ফিরে যাই বা, বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন

ভূমিকা

‘লাগলে মাথায় বৃষ্টি বাতাস,
উল্টে কি যায় সৃষ্টি আকাশ।
বাঁচতে হলে লাঙ্গল ধর রে,
আবার এসে গাঁয়।’ – শেখ ফজলুল করিম।

হরিতে-হিরণে, সবুজে-শ্যামলে, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই দেশ বাংলাদেশ- যার মূলভিত্তি ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছােট ছােট গ্রামগুলাে। প্রায় বিরানব্বই হাজার গ্রাম (বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী) নিয়ে গঠিত এই দেশের শতকরা ৭৭ জন লােক পল্লিগ্রামে বাস করে। পল্লির সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা রূপ নিয়ে কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল –
‘আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন, মাটির তলায় এর ছড়ানাে রতন’
কিন্তপল্লির সে-সৌন্দর্য এখন আর দেখা যায় না, আমাদের অবহেলার কারণে পল্লিগ্রামগুলাে আজ শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। মানুষ কেবলই – ‘ইটের পর ইট মাঝে মানুষ-কীট, নেইকো ভালােবাসা নেইকো মায়া’ – এমনি কৃত্রিম সুখের অন্বেষণে শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অথচ কৃষিনির্ভর এই দেশের উন্নয়ন কখনােই সম্ভব নয়, যদি না পল্লির উন্নয়ন হয়। পল্লির উন্নতি মানে দেশের উন্নতি।

পল্লি উন্নয়ন কী

পল্লি উন্নয়ন বলতে পল্লির উৎপাদন বৃদ্ধি, সম্পদের সুষম বণ্টন ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য এক পরিকল্পিত পরিবর্তনকে বুঝায়। আজকের বাংলাদেশে পল্লি উন্নয়নের নির্দিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামীণ বিত্তহীনদের, বিশেষ করে পশ্চাৎপদ মহিলা ও শিশুদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম করা। এবং সে নিয়ন্ত্রণের ফলশ্রুতি হিসেবে প্রাপ্ত সুযােগ-সুবিধার যথাযথ বণ্টন। অর্থনীতিবিদ গুচ ও ফ্যাল্কন বলেন – 
“Rural development means widescale participation of the rural population in the modernization process”

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি

পল্লি উন্নয়নের একটি নবতর পদ্ধতি বা পল্লি উন্নয়নে সাম্প্রতিক ভাবনা : দেশের বৃহত্তর জনগােষ্ঠী গ্রামে বাস করে। তাই দেশের অর্থনীতি এখনও গ্রামীণ মানুষের সাবির্ক কৃষি ও অন্যান্য কর্মের ওপর। নির্ভরশীল। দেশের উন্নয়ন করতে হলে আমাদের গ্রামীণ জনগণের জীবন মান উন্নয়ন করতে হবে। অন্যদিকে দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগণ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করছে।
গ্রামীণ জনগণ প্রায়ই বিভিন্ন অপুষ্টিজনিত রােগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং অনেক সময় অকাল মৃত্যুর কবলে পড়ে অল্প বয়সে পৃথিবীর সম্ভাবনাময় জীবনের ইতি টানছেন। অপরদিকে শিক্ষার নিম্নহার আমাদের বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে দারুণভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব যখন কম্পিউটার জগতে প্রবেশ করে অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমরা এখনও গণ সাক্ষরতা কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। তাছাড়া প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যাপক হারে গ্রামীণ জনগণের জানমালের ক্ষতি করছে। ফলশ্রুতিতে আমরা বিশ্ববাসীর জীবন মানের তুলনায় বিরাট অসম দুরত্বে জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছি। এ লক্ষ্যে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য নতুন কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে গ্রাম উন্নয়ন করা হচ্ছে। এ লক্ষে পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে পারিবারিক পর্যায়ে পরিবারকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করে। গ্রামের সব পরিবারের আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়নসহ গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন সমতালে এগিয়ে নেয়ার ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সম্পদ আহরণের মাধ্যমে এবং গ্রামীণ জনগণের জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ছােট ছােট তৃণমূল পরিকল্পনার ভিত্তিতে পারিবারিক ও গ্রামীণ উন্নয়নের বিকাশ সাধনই পল্লি উন্নয়নের সাম্প্রতিক ভাবনা।

প্রাচীন পল্লি

‘চাষী ক্ষেতে চালাইতে হাল, তাঁতি বসে তাঁত বােনে, জেলে ফেলে জাল
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার। তারি পরে ভার দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার’।
– রবীন্দ্রনাথ।
প্রাচীন পল্লির এই ছিল রুপ। আদিকাল থেকেই পল্লিগ্রাম ছিল দেশের প্রাণকেন্দ্র। পল্লিবাসী মানুষের ছিল গােলাভরা ধান গােয়াল ভরা গরু, পুকুর-ভরা মাছ, গলায় গলায় গানের সুর, কুটিরশিল্পের প্রচলন। ঢাকার মসলিন কাপড় ও জামদানি শাড়ি তৎকালীন মােগল বাদশাহের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, কুমিল্লার হুক্কা ও খদ্দর-কাপড়, ময়নামতির ছিট কাপড়, পড়ি নকশীকাথাও তৎকালীন ঐতিহ্য বহন করছিল। 

বর্তমান-পল্লি

‘বড় দুঃখ, বড় ব্যথা সমুখেতে কষ্টের সংসার,
বড়ই দরিদ্র, বড় শূন্য, বড় ক্ষুদ্র, বড় অন্ধকার।
অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলাে চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উচ্ছল পরমায়ু’।

কবি রবীন্দ্রনাথের এই আবেদন-নিবেদনেই ধরা পড়ে যে, পল্লির অতীত ঐতিহ্য এখন আর নেই। পল্লির আনন্দ-উৎসব সুখ-শান্তি সব হারিয়েছে। গােলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গােয়ালভরা গরু, গলাভরা গান, মাঠে প্রান্তরে রাখালের বাঁশির সুর এখন আর শােনা যাচ্ছে না। দিন বদলের পালায় সবই বদলে গেছে। শিক্ষিত সমাজ পল্লিকে অবজ্ঞা করে ছুটে চলছে নগর পানে। নানা অশিক্ষা-কুশিক্ষা ও দুঃখে দৈন্যে পল্লিবাসী জর্জরিত। পল্লির কৃষি ব্যাবস্থাও তেমন উন্নত নয়। শিল্পের প্রসার নেই, নেই অন্ন- বস্রের সংস্থান।দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না।

দিন বদলের পালায় বদলে যাচ্ছে গ্রাম বাংলা

‘আমাদের ছােট গ্রাম মায়ের সমান,
আলাে দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন 
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন’। – বন্দে আলী মিয়া। 
গ্রামের সেই সহজ-সরল চিত্রপট এখন আর নেই। দিন বদলের পালায় বদলে যাচ্ছে অনেক কিছুই। সর্বগ্রাসি বিশ্বায়নের এই যুগে বদলে যাচ্ছে মানুষের রুচি, অভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড, পেশাসহ অনেক কিছুই। গত এক বা দুই যুগের ব্যবধানে শুধু যে রাজধানী ঢাকা কিংবা অন্যান্য শহরের চাকচক্য ও জৌলুশ বেড়েছে তাই নয় গ্রাম পর্যায়ে আরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর আমাদের ঘরের চালে লাউ-কুমড়াের সবুজ লতানাে গাছপাতা শােভা পায় না। কোনাে গ্রামে ছায়াঘেরা মাটির দেয়াল তােলা ছনের ঘর চোখে পড়ে না। প্রায় সব গ্রামেই চোখে পড়বে। পাকা দালান-কোঠা। গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে। ফ্রিজ, টিভি এখন ঘরে ঘরে। খাওয়ার পানির জন্য গ্রামের বাড়িতে আগে ছিল পাতকুয়াে এবং ইদারা, আজ তা নিশ্চিহ্ন। সে স্থান দখল করে নিয়েছে নলকূপ। গত শতক নাকি চিহ্নিত হয়েছে প্রযুক্তির উন্নয়ন, প্রসার ও ব্যবহারের জন্য। তার ঢেউ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যে লাগে নি তা নয়। বেশ ভালােভাবেই লেগেছে। তার মধ্যে মােবাইল ফোনের ব্যবহার বেড়েছে আশ্চর্যজনকভাবে। গ্রামেগঞ্জে যার তার হাতেই এই মুঠো ফোন। এটা ছাড়া কারােই দিন চলছে না। চাষাবাদ, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দেশ-বিদেশে থাকা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা সকল ক্ষেত্রেই চলছে মােবাইলের ব্যবহার। গ্রামীণ জীবনের অচলায়তন ভাঙতে এই মােবাইলের ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বিচার বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। দক্ষিণ বাংলায় যেখানে বিদ্যুৎ যায় নি সেখানে দেখা যাচ্ছে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল, রহিম আফরােজ, গ্রামীণ শক্তি এসব প্যানেল বিক্রি করছে। আরেকটা বড় মানসিক পরিবর্তনের কথা না বললেই নয়। সেটা হল স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা। গ্রামের দরিদ্ররা আজ কোনাে না কোনােভাবে একটা কাজ খুঁজে নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছে। গ্রামেগঞ্জে এখন নানারকম কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। হাঁস-মুরগি পালন, ছাগল-গরু পালন, মাছ চাষ, নানা উন্নত জাতের কৃষি ফলনসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে গ্রামীণ জনগন এখন নিজ প্রচেষ্টায়ই স্বাবলম্বী হতে শুরু করছে। স্ব-নিয়ােজিত মানুষের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। শহরের মানুষ বাসার জন্য গ্রামের দরিদ্র ছেলেমেয়েদের খুঁজত ‘কাজের ছেলে’ বা ‘কাজের মেয়ে’ হিসেবে নিয়ােগের জন্য। আজকাল তেমন কাউকে পাওয়া মুশকিল। যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে শহর ও গ্রামের মধ্যে ব্যবধান অনেকটাই কমে আসছে। বর্তমানে গ্রামীণ জীবনে গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। গ্রামের সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এখন নব্য ধনিক শ্রেণী ও যুবক শ্রেণী গ্রামের  ক্ষমতা কাঠামাে নিয়ন্ত্রণ করে। পূর্বে গ্রামের বয়স্ক মাতব্বর এই ক্ষমতা কাঠামাে নিয়ন্ত্রণ করত। গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষালাভের আগ্রহ বাড়ছে এবং তারা শিক্ষিত হচ্ছে। এভাবে নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে গ্রামের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ও পরিবর্তন ধারা অব্যাহত আছে। 

পল্লি উন্নয়নের প্রয়ােজনীয়তা বা জাতীয় উন্নতিতে পল্লির গুরুত্ব

আমাদের জাতীয় অর্থনীতির মূল উৎস পল্লি। পল্লি উন্নয়ন ব্যতীত দেশের সর্বমুখী বা সর্বজনীন কল্যাণ সম্ভব নয়। পল্লির অবস্থান ও উন্নয়নের ওপর বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। তাই পল্লিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে হবে। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্যে যেসব উপকরণ প্রয়ােজন, পল্লিতে তার কোনাে অভাব নেই, অভাব শুধু যুগােপযােগী শিক্ষা, আদর্শ ও কর্মপ্রেরণার। পল্লি সব সময়েই উন্নয়নযােগ্য। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে পল্লির সামগ্রিক উন্নয়নসাধন সম্ভব। তাই কবিগুরুর সঙ্গে তাল । মিলিয়ে বলতে পারি—

“ফিরে চল ফিরে চল মাটির টানে।” 

পল্লি উন্নয়ন পরিকল্পনা

পল্লির ভাগ্য উন্নয়নের মাঝেই সার্বিক উন্নয়ন নির্ভরশীল একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ উন্নয়নকাজে অগ্রসর হতে হলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পল্লিবাসীকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। সকল সময় সরকারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে চলবে না। আত্মশক্তির ওপর ভরসা করেই আমাদের পল্লি-উন্নয়ন কাজে অগ্রসর হতে হবে। উন্নয়নের প্রতিটি ব্যবস্থা যাতে ধীরে ধীরে উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে, তার জন্যে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। 

পল্লি উন্নয়নের শর্তসমূহ

পল্লি উন্নয়নের বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। যেমনঃ
১। প্রয়ােজনীয় খাদ্যসংস্থানের সক্ষমতা অর্জন।
২। প্রয়ােজনীয় বস্ত্রের সংস্থান। 
৩। স্বাস্থ্যকর, পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশসম্মত বাসস্থান। 
৪। উৎপাদনের উপকরণের ওপর স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠাকরণ।
৫। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য প্রয়ােজন শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন। 
৬।অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশগ্রহণের জন্য সুস্থতা নিশ্চিতকরণ।

পল্লি উন্নয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

বাংলাদেশে পল্লি উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হলাে- দারিদ্র্য বিমােচন ও জীবনযাত্রার মানােন্নয়ন। আর এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। যেমনঃ
১. স্বল্পতম সময়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি। 
২. স্থানীয় সম্পদের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। 
৩. স্থানীয় নেতৃত্ব বিকাশের মাধ্যমে যথাযথ পল্লিউন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি। 
৪. বিদ্যামান সম্পদ ও সুযােগের সুষম বণ্টন নিশ্চিতকরণ। 
৫. স্থানীয় পর্যায়ে উদ্ভূত সমস্যা নিরসন করে গ্রামীণ জনগণের শহরমুখী প্রবণতা রােধ। 
৬. দরিদ্র জনগােষ্ঠীকে পরিকল্পিত পরিবার গঠনে এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধকরণ।
৭. জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। 
৮. দেশের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও গ্রামীণ অসচেতন গণমানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি। 

পল্লি উন্নয়নের উপায়: 

বাংলাদেশে পল্লি উন্নয়নের চাবিকাঠি হল : (ক) দারিদ্র্য দূরীকরণ, গ্রামীণ দরিদ্রদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, (খ) আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন, (গ) ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি, (ঘ) পরিকল্পনা প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন, সুযােগ সুবিধার অংশীদারিত্ব, পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচির মূল্যায়নে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ; (ঙ) অপ্রতুল সম্পদের ব্যবহার ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রামীণ জনগণকে অধিকতর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান। তাই সঠিক কর্মসূচি নিয়ে গ্রামে জনগণের উন্নতিকল্পে এগিয়ে যেতে হবে। এ লক্ষ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলাে নেয়া যায় 
 ১. শিক্ষার ব্যবস্থা : ‘এই সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা, ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা’। গ্রামের মানুষের জন্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পল্লির অনগ্রসরতার মূল কারণ অশিক্ষা ও কুশিক্ষা। 
২. স্বাস্থ্য উন্নয়ন : পল্লির ৭৫% শিশু অপুষ্টির শিকার। বছরে ত্রিশ হাজারেরও বেশি শিশু অন্ধত্বের কবলে পড়ে, লাখ লাখ শিশু মারা যায় ডায়রিয়া ও নিউমােনিয়ার আক্রমণে। অধিকাংশ গ্রামে রয়েছে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সমস্যা। সাম্প্রতিক কালে গ্রামে গ্রামে আর্সেনিক দূষণ গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যরক্ষায় মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত স্বাস্থ্য শক্তিশালী জাতি গঠনে সহায়ক— এ সত্যকে সামনে রেখে পল্লির জনস্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে এবং এর জন্যে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। 
৩. কৃষি উন্নয়ন : বাংলাদেশের পল্লিজীবন কৃষিভিত্তিক। বর্তমান যুগের আধুনিক স্বয়ংক্রিয় কৃষিব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে আমাদের দেশে কৃষকদের অধিক খাদ্যশস্য উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে কৃষির এ উন্নয়ন করতে হবে।
৪. কুটিরশিল্পের উন্নয়ন : কুটিরশিল্পের মাধ্যমে গ্রামের বেকারদের কর্মসংস্থান করতে হবে। কুটিরশিল্পক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় সাহায্যের হাত সরকারকে প্রসারিত করতে হবে। কারণ, গ্রামবাসীর অগ্রগতিই দেশের অগ্রগতি।
৫. যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের জন্যে রাস্তাগুলাের সংস্কার সাধন ও পর্যাপ্ত নতুন রাস্তা নির্মাণ করে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে। 
৬. মৎস্য চাষের ব্যবস্থা : গ্রামে অনেক হাজামজা পুকুর নালা ডােবা পতিত অবস্থায় আছে। এগুলাে সংস্কার করে মাছ। চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। 
৭. পল্লি বিদ্যুতায়ন : পল্লির জনগণের উন্নতির জন্যে পল্লি বিদ্যুতায়ন একান্ত অপরিহার্য। আমাদের দেশের অধিকাংশ গ্রামে এখনাে বিদ্যুৎ-সুবিধা পৌছায় নি। তাই যত শীঘ্র সম্ভব প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. সঞ্চয়ী মনােভাব গড়ে তােলা : গ্রামের জনগণকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করে তাদের সঞ্চয়ী করে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রকার সঞ্চয়ী ব্যাংক যেমন : গ্রামীণ ব্যাংক, সমবায় ব্যাংক প্রভৃতি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়াও –
৯. ভূমিহীনদের পুনর্বাসন।
১০. কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা।
১১. সমবায় প্রবর্তন।
১২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ মােকাবেলা ও পরবর্তী পুনর্বাসন এবং 
১৩. সম্পদের সুষম বণ্টন করতে হবে।

পল্লি  উন্নয়নের অন্যান্য দিক

গ্রামীণ অবকাঠামাে উন্নয়নের অন্যান্য দিক হলাে
১। গ্রামে নলকূপ বসিয়ে পানীয় জলের সুব্যবস্থা করতে হবে। 
২। গ্রামের রাস্তাঘাটও মারাত্মক অবহেলার শিকার। এসব রাস্তাঘাটের সংস্কার সাধন করে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে হবে। 
৩। অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। 
৪। সভা-সমিতির ব্যবস্থা করে তাদেরকে সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। 
৫। গ্রামের মানুষকে কিছু কিছু সঞ্চয় করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। 
৬। গ্রামের পুকুর, ডােবা-নালা ইত্যাদিতে মাছের চাষ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
৭। আজ অবধি বাংলার প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। তাই সরকারি উদ্যোগে গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে বিদ্যুৎশক্তির ওপর ভিত্তি করে গ্রামে ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তােলা সম্ভব হবে। 

গৃহীত উদ্যোগ

বর্তমান পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচিকে জাতীয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি বেসরকারি প্রচেষ্টা পল্লি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। পল্লির বৃহত্তম জনগােষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটানাের জন্যে কৃষি, গবাদি পশু পালন, সমবায়, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে প্রশিক্ষণ, গণসচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কার্যক্রম এই কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। সর্বোপরি উপযুক্ত আলােচনায় পল্লি উন্নয়নের জন্যে যেসব পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে সরকার ইতােমধ্যে সবকটি পদক্ষেপই নিয়েছেন, তন্মধ্যে 
১. গ্রামে শিক্ষাবিস্তারের জন্যে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। 
২. বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, গণশিক্ষা, সর্বজনীন শিক্ষা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বয়স্ক শিক্ষা, অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। 
৩. গ্রামীণ অর্থনীতিকে সবল করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। 
৪. কুটির শিল্পের উৎকর্ষ বিধানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দান ও মূলধন সরবরাহ করা হচ্ছে। 
৫. কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ হচ্ছে। 
৬. জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। 
৭. জনসংখ্যা বৃদ্ধি মোকাবেলায় এবং বেকার-সমস্যা সমাধানে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। 
৮. যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুতায়ন, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাকল্পে নানা ধরনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ৯. ঋণের ব্যবস্থা করেছেন। 
১০. থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে গ্রামীণ উন্নয়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রামীণ অবকাঠামাে রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮০ মে. টন চাল।
ব্যয়ে ৯৪ হাজার ১৭০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। পল্লি উন্নয়নের জন্যে সরকারের এভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে পল্লির জীবনে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। একবিংশ শতাব্দীর গ্রামকে আর অবহেলিত বলা চলে না, আগামী শতাব্দীতে শহর আর গ্রামের পার্থক্য নির্ণয় করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে যা আমাদের সবার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনও বহুবিধ সমস্যা ও বাধা রয়ে গেছে। 

পল্লি উন্নয়নের সমস্যা

পল্লি উন্নয়ন প্রয়াস সম্পর্কিত অতীত অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ থেকে বড় ধরনের বেশ কিছু সমস্যাকে চিহ্নিত করা যায়, যেগুলাে উন্নয়ন প্রয়াসের সফল সম্পাদনকে ব্যাহত করে আসছে । এসব সমস্যা হচ্ছে : ১। পল্লি উন্নয়ন সংস্থাসমূহের অস্থায়িত্ব, ২। অযােগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্ব, ৩। কেন্দ্রীয় শাসকগােষ্ঠী কর্তৃক স্থানীয় সরকারগুলােকে অসহযােগিতা, ৪। একটা সুবিন্যস্ত পল্লি উন্নয়ন নীতিমালার অভাব, ৫। পল্লি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে উদ্ভূত সুযােগ-সুবিধার অসম বণ্টন, ৬। প্রাকৃতিক ও লন্ধ সম্পদের সীমাবদ্ধতা, ৭। পল্লি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও পরিকল্পনায় উচ্চশ্রেণীর আধিপত্য এবং অসহায়ক এক গ্রামীণ সমাজ। বাংলাদেশের পল্লির আর্থসামাজিক বুনিয়াদের প্রকৃতিই পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচির কার্যকর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দেখা দেয়। সেসব বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- পুঁজি গঠনের নিম্নস্তর, কৃষি নির্ভর অর্থনীতি, নিপুণ ও শিক্ষিত জনশক্তির অভাব, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, বিদেশি সহায়তার ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, গ্রাম্য রাজনৈতিক দলাদলি, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনুন্নত বাজার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়ােগ। 

একবিংশ শতাব্দীর পল্লি উন্নয়ন চিন্তা 

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এ দেশের ব্যাপক জনগােষ্ঠী বিশ্বের দরিদ্র দেশসমূহের মধ্যে দরিদ্রতম এবং বেশির ভাগ জনসংখ্যা মূলত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে অপরিকল্পিত এবং মাত্রাধিক্য ব্যবহারের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ এবং শস্য উৎপাদন এ দেশের কৃষির অন্যতম একক অবলম্বন। এর জন্য মাটি এবং ভূমির ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। শস্য উৎপাদনের জন্য মাটির উর্বরতা । কিংবা উৎপাদনশীলতা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব। আর স্বয়ংসম্পন্ন কৃষি ব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করছে গ্রামীণ উন্নয়ন। এ জন্য একবিংশ শতাব্দীর পল্লি উন্নয়ন চিন্তা ভাবনায় কৃষিকে প্রাধান্য। দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে মাটির উপাদান, এগুলাের রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণের প্রতি জোর দেয়া হচ্ছে। 

পল্লি উন্নয়নে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

গ্রামে সহস্র অভাব, এই ভেবে গ্রাম ত্যাগ করলে চলবে না। গ্রামের মানুষকে ফিরে যেতে হবে গ্রামে এবং গড়তে হবে কলুষমুক্ত গ্রাম। সমস্যা এড়িয়ে গেলে সমস্যার সমাধান হয় না। গ্রামের উন্নয়নকে নিজের মনে করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রবল প্রচেষ্টায় গ্রামের হতশ্রী পুনরুদ্ধার সম্ভব।

উপসংহার

দেশের পঙ্গু অর্থনীতিকে সজীব ও জীবন্ত করে তুলতে হলে গ্রামকে সজীব করে তুলতে হবে। গ্রামই দেশের প্রাণ। এটা ভুলে গেলে চলবে না। ড. লুত্যফর রহমান বলেছেন- 
‘জাতিকে বড় করতে হলে পল্লির মানুষকে প্রথমে জাগাতে হবে’। 
গ্রামের উন্নতি ও দেশের উন্নতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আশা করা যায়, অচিরে আমাদের সরকার ও সচেতন দেশবাসীর সক্রিয় সহযােগিতায় গ্রামগুলােকে আমরা ‘সােনার গ্রাম’ হিসেবে দেখার সুযােগ পাব। তখন আমরা অতি আনন্দে নিমন্ত্রণ করব –
“তুমি যাবে ভাই / যাবে মাের সাথে / আমাদের  ছোট গাঁয়?”

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button