বাংলা রচনা

স্বাবলম্বনের মূল্য রচনা

Rate this post

রচনা স্বাবলম্বনের মূল্য/ মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা / আত্মনির্ভরতা ৬ ৭ ৮ ৯ ১০ ১১ ১২ শ্রেণি
ছবি উৎস: iStockphoto

রচনা স্বাবলম্বনের মূল্য/ মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা / আত্মনির্ভরতা ৬ ৭ ৮ ৯ ১০ ১১ ১২ শ্রেণি

ভূমিকা

‘যদি তাের ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’

মানুষের জীবনই অনন্ত শক্তির উৎস। নিজেকে সুন্দর করা, জাতি ও দেশকে মহান করে গড়ে  তোলা মানুষের জন্মজন্মান্তরের ব্রত। মানুষই দুর্বার প্রাণশক্তির আধার। এই মহৎ উপলব্ধি তার উন্নতির বীজমন্ত্র। অন্যের ওপর নির্ভর না করে নিজের কাজ, নিজের বুদ্ধি, শ্রম প্রভৃতির সহায়তায় নিজের জীবন গঠনের চেষ্টাই হল স্বাবলম্বন। স্বাবলম্বনের সাধনা মানুষের আত্মশক্তিরই জাগরণ। কর্মই জীবন। কর্মই মানুষের জীবনকে নানা ঐশ্বর্য সম্ভারে ভরিয়ে দেয়। কর্মই মানুষের সৌভাগ্য উৎস। যারা পরনির্ভর, তাদের জীবন প্রতিপদে পঙ্গু। যারা অতিমাত্রায় অদৃষ্টবাদী ও দৈব শক্তিতে বিশ্বাসী, তারাও পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। 
দুর্বল অলস কর্মবিমুখ মানুষ কোনােদিনও মানবিক গুণাবলির উন্মেষ ও বিকাশের সুযােগ পায় না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, পরানুগ্রহে পুষ্ট সেই জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুঃখের আঁধার। তিল তিল করে সেই জীবনের হয় অপচয়। দুঃসহ বেদনাভারে হতাশা-ব্যর্থতার অগৌরবে, গ্লানি ও উপেক্ষা নিয়ে এক ব্যর্থ জীবনের ঘটে পরিসমাপ্তি। 

স্বাবলম্বনের বৈশিষ্ট্য ও অনুশীলন 

স্বাবলম্বন মানুষের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যা অর্জন করতে হলে ব্যক্তিজীবনে আরও কিছু গুণাবলি অর্জন করতে হয়। কথায় বলে, যে শুয়ে থাকে তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে। তাই পরিশ্রম ছাড়া স্বাবলম্বী হওয়ার অন্য কোনাে পথ নেই। আর যুগপৎ সন্নিবেশ ঘটবে- উদ্যেগ, উদ্যাম, নিয়মানুবর্তিতা, আগ্রহ, নিষ্ঠা, অধ্যবসায়, শিষ্টাচার, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠার। তাই স্বাবলম্বী হওয়ার জন্যে এসব গুণাবলির অনুশীলন করতে হবে। মনে রাখতে হবে- God helps those who help themselves. 

কর্মই মানুষের সৌভাগ্যের কারিগর

প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই সুপ্ত থাকে শক্তির স্ফুলিঙ্গ। উপযুক্ত পরিবেশেই ভস্মাবৃত ফুলিঙ্গের অগ্নিশিখার দীপ্ত আত্মপ্রকাশ। মুহূর্তে অন্তরশায়ী সুপ্তিমগ্নতার অবসান ঘটে। কর্মনিষ্ঠা আর আত্মপ্রত্যয়ের আলােকশিখায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার অন্তর্লোক। তখনই মানুষ খুঁজে পায় জীবনের অর্থ। তখনই তার জীবন ভরে ওঠে নানা সফলতায়। তখন আর সে পরমুখাপেক্ষী নয়। জাগ্রত চেতনার আলােকে দীপ্ত, দুর্জয় আত্মশক্তির অধিকারী সে। তখন তার কর্মবিমুখতার মােহাবরণ ছিন্ন হয়ে যায়। কর্মই মানুষের সৌভাগ্যের কারিগর। কর্মময় পৃথিবী মানুষকে নিয়ত ডাকছে। যে মানুষের কাছে সেই আহ্বান অশ্রুত থাকে, সেই মানুষই ভীত, অসহায়। ভাগ্যের হাতে নিজের জীবনকে সঁপে দিয়ে সে তখন খোঁজে বাঁচার ঠিকানা। অবাস্তব স্বপ্নচারিতা জীবনের অপচয়ের পথকে আরও প্রশস্ত করে। 

আত্মশক্তিই মনুষ্যত্ব বিকাশের হাতিয়ার

আর যেদিন মানুষ খুঁজে পায় আত্মশক্তির সন্ধান, যেদিন সে উপলদ্ধি করে, এই আত্মশক্তিই অনন্ত সম্ভাবনাভরা কর্মমুখর জীবনে প্রবেশের একমাত্র ছাড়পত্র, সেদিনই তার নবজন্ম। নতুন প্রাণচেতনায় সে তখন উদ্বুদ্ধ হয়। নিজের শক্তি সম্পর্কে তার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। কী অফুরান সম্ভাবনাময় সে-জীবন! জগতের যেখানে যা-কিছু অন্ধকার, যা-কিছু জড়, সেখানে আসে নব-জীবনের কর্ম-জোয়ার। সেই প্রাণস্রোতে যা কিছু জীর্ণ, কর্মবিমুখ, অলস-স্থবির সব ভেসে যায়। সেই আত্মজাগরণের মুহূর্তে তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘আমি ঝঞা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। সেই অমিত, দুর্জয় প্রাণজোয়ারে সকল বাধা তুচ্ছ হয়ে যায়। খুলে যায় সব বাঁধন। তার সামনে উন্মােচিত হয় আত্মবিকাশের সিংহদ্বার। সেই সিংহদ্বার পেরিয়েই পৌঁছােতে হয় সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। 

স্বাবলম্বনের পথে বাধা

শ্রমের মর্যাদাবােধের সঙ্গে আছে স্বাবলম্বন শক্তির নিবিড় সম্পর্ক। কোনাে কাজই তুচ্ছ বা নিন্দনীয় নয়। দৈহিক শ্রমের কাজ কখনও অবজ্ঞা- উপেক্ষিত হতে পারে না। কেননা, ওই কাজের ওপরই নির্ভর করে আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, নির্ভর করে আমাদের অস্তিত্ব। আত্মশক্তির বিকাশেই স্বাবলম্বনের বিকাশ। এই শক্তির অভাবে জীবনের বিনষ্টি। নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে অমর্যাদার স্থান নেই, নেই অগৌরব। বরং, শ্রমকে মর্যাদা দেওয়াই আধুনিক শিক্ষার অঙ্গ। সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে যখন সমাজবিকাশ দাস-শ্রমের ওপর নির্ভর করত, তখন শ্রমের কোনাে মর্যাদা ছিল না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রম মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত। শ্রমের ওপর নির্ভর করেই সভ্যতার বিকাশ। কর্মশক্তির অভাব অনেক সময় স্বাবলম্বনের পথে বাধা। অনভ্যাসে শ্রমশক্তি হ্রাস পায়। এভাবেও অনেকের মধ্যে পরমুখাপেক্ষিতা বৃদ্ধি পায়। 

স্বাবলম্বন ও স্মরণীয় মানুষ

জগতে যারাই বরণীয় পুরুষ, তাদেরই চরিত্রে স্বাবলম্বনশক্তির অমিত দ্যুতি। প্রবল পরাক্রান্ত সম্রাট নেপােলিয়ন প্রথম জীবনে ছিলেন সাধারণ সৈনিক। পরিশ্রম ও কর্মনিষ্ঠার বলে তিনি সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, গ্যালিলিও, নিউটন, গােয়টে, দান্তে প্রমুখ মনীষীর জীবনেও স্বাবলম্বনের শক্তিই উদ্ভাসিত। হযরত মুহম্মদ (সঃ), বুদ্ধ, জিশুখ্রিস্ট এমনই কত মহৎ-প্রাণ, পরিত্রাতা জগৎ-গুরুর জীবনে আত্মশক্তিরই বিজয়-মহিমা। কর্মময় জীবনের মধ্যেই তারা জীবনদেবতার আসন প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। 

ছাত্রজীবন ও স্বাবলম্বন

ছাত্রজীবনই হল স্বাবলম্বন শক্তি অর্জনের যথার্থ ক্ষেত্র। স্বাবলম্বনই ছাত্রজীবনে সাফল্যের সােপান। শুধু চর্বিত-চর্বণ করে বা পরনির্ভরশীল হয়ে কখনও স্বাধীন চিন্তাশক্তিকে বিকশিত করা সম্ভব নয়। পঠিত বিষয় সম্পর্কে মৌলিক চিন্তাশক্তির জাগরণ ঘটায় স্বাবলম্বন-শক্তি। এই সময়ই প্রয়ােজন স্বাবলম্বন-শক্তির অনুশীলন। মানুষ জীবনের প্রভাতে যে দুর্লভ গুণাবলি আয়ত্তের সাধনা করে, পরবর্তী জীবনে তারই সিদ্ধি লাভ করে। শিশু যেমন স্ব-চেষ্টায় চলার শক্তি সংগ্রহ করে, যেমন করে সে খেতে শেখে, রপ্ত করে কথা বলার কলাকৌশল, সেভাবেই মানুষকে ছাত্রাবস্থায় স্বাবলম্বনশক্তিকে জাগ্রত করতে হয়। 

প্রথম থেকেই উপলব্ধি করতে হবে, সে মানুষ। তার মধ্যেই নিহিত আছে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ। তারই মধ্যে সুপ্ত আছে অসীম অনন্ত শক্তি। স্বাবলম্বন সেই সুপ্তশক্তিরই জাগরণমন্ত্র। শৈশবই সেই পূজা-বেদি। তা না হলে ভবিষ্যৎ জীবনে তিলে তিলে ব্যর্থতা, হতাশায় মৃত্যুবরণের দুঃসহ জ্বালা। 

সমাজ ও জাতীয়জীবনে স্বাবলম্বন

শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, সমাজজীবনে, বৃহত্তর জাতীয় জীবনেও স্বাবলম্বন এক মহান ব্রত। এই ব্রত যে জাতির জীবনে সত্য হয়ে ওঠে, সেই জাতিরই সমৃদ্ধি আর সমুন্নতি। আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের দিকে তাকালে এ সত্য হৃদয়ঙ্গম হবে। এ দেশে প্রযুক্তি ও কারিগরি কাজে বিদেশিদেরই অবাধ অধিকার। বাঙালিরা সমাজজীবনে আজও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে নি বলেই অর্থনৈতিক জীবনে তার অনগ্রসরতার করুণ চিত্র দেখি। আজও যদি মানুষ কর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়, যদি আলস্যনিদ্রায় গা ভাসায়, যদি সে শুনতে না পায় বিশ্বের দিকে দিকে প্রাণচঞ্চল কর্মের আহ্বান, যদি দেখতে না পায় বিশ্বজুড়ে বিপুল কর্মযজ্ঞের আয়ােজন, তবে তার জীবনে বর্ষিত হবে অন্তহীন দুঃখদৈন্যের অভিশাপ। জাতীয় জীবনে শুধু সৃঞ্চিত হবে জড়ত্বের দীর্ঘশ্বাস। জীবনের অগ্রগতি হবে স্তন্ধ। কর্মই মানুষের একমাত্র পরিচয়, কর্মই তার যথার্থ অভিজ্ঞান। এরই মধ্যে রয়েছে মনুষ্যত্ব অর্জনের মন্ত্র। স্বাবলম্বন-শক্তিই সমাজজীবনে সফলতা ও সার্থকতার প্রেরণা। 

উপসংহার

স্বাবলম্বনে বংশগৌরবের কোনাে মূল্য নেই। পৌরুষই মানুষের যথার্থ শক্তি। আর পৌরুষের ভিত্তিই হল স্বাবলম্বন। একে স্বীকার করেই কর্মী মানুষের অমরত্বের দুর্গম পথে অন্তহীন যাত্রা। আত্মশক্তির জাগরণেই মানুষ লাভ করে বিরাটের সান্নিধ্য। উপলদ্ধি করে দুর্জয় শক্তির মহিমা। যারা পেয়েছে এই অনন্ত শক্তির সন্ধান, দুর্গমতার পথেই তাদের নিত্য অভিসার। অন্যের অনুগ্রহ নয়, গলগ্রহতা নয়, নয় অপরের করুণা প্রার্থনা, আত্মশক্তিকে আশ্রয় করেই সে প্রতিকূলতার মধ্যে ঝাঁপ দেয়। এই পথেই সে জয় করে আনে সৌভাগ্যের দুর্লভ বিজয়মাল্য। কোনাে ভয় বা ভীরুতার কাছেই সে নতজানু হতে জানে না। সে চির-উন্নত শির। হিমাদ্রিশিখরও তার কাছে নত-শির। কোনাে বাধা বা প্রতিবন্ধকতাই তার জয়যাত্রাকে রুদ্ধ করতে পারে না। স্বাবলম্বনই মানবজন্মের সার্থকতা, স্বাবলম্বনই তার যুগ-যুগান্তরের জীবন-সাধনা।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button