বাংলা রচনা

সময়ের মূল্য – রচনা | JSC SSC HSC

4.1/5 - (1275 votes)

সময়ের মূল্য অথবা, সময়ানুবর্তিতা অথবা, সময়ের সদ্ব্যবহার

ভূমিকা

সুন্দর এ পৃথিবীতে মানুষের আয়ুষ্কাল সামান্য। এ সামান্য আয়ুষ্কাল মানুষকে কতই না স্বপ্ন দেখায়। ইংরেজিতে একটা কথা আছে –

Man does not live in years but indeed – মানুষ বাঁচে কর্মের মধ্যে বয়সের মধ্যে নয়।

বিশ্বজগতে অনন্তকালপ্রবাহে মানুষের জীবন নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। এ জীবনও মহামহিম হয়ে উঠতে পারে মানুষের মহৎ কর্মে ও অবদানে। কেউ কেউ পারে জীবনকে রঙে রঙে সাজাতে আবার কাউকে কাউকে শুধু ব্যর্থতা, অপূর্ণতা বেদনা নিয়ে চিরকালের মতো চলে যেতে হয়। এ জগৎসংসারে জয়মাল্য তাদের ভাগ্যেই জোটে যারা সময়ের কাজ সময়ে করতে পারে। সময়ের মূল্য যারা বুঝে তারাই শ্রেঠ মানুষ। মানুষের ধনসম্পদ, মান-সম্মান, স্বাস্থ্য ইত্যাদি হারিয়ে গেলে স্বীয় চেষ্টায় হয়তাে তা ফিরে পাওয়া যায়, কিন্তু সময় একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না। এর মূল্য অন্য কোনাে জিনিস দিয়ে পরিমাপ বা বিনিময় করা যায় না। সুতরাং, আমাদের জীবনের এই অমূল্য সম্পদ সময়কে অবহেলা করে নষ্ট করা উচিত নয়।

সময়ের মূল্য

মহাকাল ছুটিছে অনন্ত ধায়

কেহ তারে ধরিতে নাহি হায়।

সময় অমূল্য সম্পদ। এ পৃথিবীতে অনেক কিছুরই আর্থিক মূল্য নিরুপন করা যায়। কিন্তু সময়ের মূল্য নিরুপন করা সম্ভব না। কোনো কিছু দিয়ে সময়কে পরিমাপ করা যায় না। বহমান নদীর মতো স্বচ্ছ, সাবলীল এর প্রবহমানতা। এক মুহূর্তের জন্যেও স্থির হবার অবকাশ নেই তার। অনাদিকাল থেকে যাত্রা শুরু করে ছুটে চলছে অনন্তের পথে। মানুষের সীমাবদ্ধ জীবন এক সময় থেমে যায়, কিন্তু দুরন্ত সময় চলতেই থাকে। জৈনক ইংরেজ কবি তাই লিখেছেন –

“Time and  tide wait for none”

অর্থাৎ সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্যে অপেক্ষা করে না।
সময়ের এ ধাবমানতার জন্যেই জীবন মানুষের কাছে এতো মূল্যবান। জন্ম ও মৃত্যুর শাসনে জীবন সদা সংকুচিত। অন্তহীন জীবন আশা করেও মানুষ তা পায় না। এখানেই জীবনের চরম ট্রাজেডি।বাংলার লোক-কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে  এ হাহাকার –

“এপার গঙ্গা ওপর গঙ্গা, মধ্যখানে চর “

অর্থাৎ, এপারে জন্ম ওপারে মৃত্যু মাঝখানে সীমাবদ্ধ জীবন। জীবনের এ সীমাবদ্ধতার জন্যেই সময় এতো বেশি মূল্যবান।

সময়ের বৈশিষ্ট্য

সময়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর গতিশীলতা। সময়কে জগতের কোন নিয়ম বাধায় বাঁধা সম্ভব না। সময় নদীর স্রোতের মত তার আপন গতিতে চলমান। কেয়ামত পর্যন্ত সময়ের অস্তিত্ব বিরাজমান থাকবে। ঘড়ির কাঁটা যতই সামনে অগ্রসর হয় সময় ততই তার অতীতকে ভারী করে। সময়কে ধরে রাখার ক্ষমতা আল্লাহ্ ছাড়া কারও নেই। আজকের মুহূর্তটি কিছু সময় পরেই অতীত হয়ে যায়। সময় একবার চলে গেলে তা ফিরে পাওয়া অসম্ভব। 

সময়ের সদ্ব্যবহার

ফকির লালন সাইয়ের একটি গান আছেঃ

সময় গেলে সাধন হবে না।

দিন থাকিতে দীনের সাধন

কেন করলে না।

সময় অনন্ত, কিন্তু সীমাবদ্ধ মানুষের আয়ুষ্কাল। কাজেই প্রতিটি মুহূর্তকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে ক্ষণস্থায়ী জীবনকে সুন্দর করে তােলা সচেতন মানুষের কাজ জীবনে উন্নতি সাধনের জন্য প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানাে অপরিহার্য। সময়ের সদ্ব্যবহার বলতে সর্বক্ষণ কেবল কাজে নিমগ্ন থাকাই বােঝায় না। কাজের সময় কাজ, বিশ্রামের সময় বিশ্রাম এবং খেলার সময় খেলা, এটাই সময়ানুবর্তিতা Work while you work and play while you play. পরে করা হবে বলে অযথা সময়ের অপচয় করা উচিত নয়। কারণ দীর্ঘসূত্রতা হরণ করে সময়কে। নির্ধারিত সময়ের কাজ যথারীতি সম্পন্ন করলেই ক্রমশ সময়ের সদ্ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে ওঠে। সময়কে সর্বদা সৃষ্টিশীল কাজে লাগানাে উচিত। কারণ কথায় বলে, “সময়ের এক ফোঁড় , অসময়ের দশ ফোড়, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলাের সমৃদ্ধির মূলে রয়েছে সময়ের প্রতি তাদের সচেতনতা ও সময়ের সদ্ব্যবহার করার প্রবল আগ্রহ। বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে যেমন বিশাল সমুদ্র, কণা কণা বালু নিয়ে যেমন সুবিস্তৃত মরুভুমি, তেমনি অসংখ্য মুহূর্তের সমন্বয়ে আমাদের জীবন। তাই এ মুহূর্তগুলোকে আমরা যত সুন্দরভাবে কাজে লাগাবো আমাদের জীবন ততই সুন্দর হবে।

ছাত্রজীবনে সময়ের মূল্য

ছাত্রজীবনকে বলা যায় জীবন সংগ্রামের প্রস্তুতির সময়। এ সময়ে যেমন বীজ বপন করা হয়, ভবিষ্যতে তেমন ফলই পাওয়া যায়। অধ্যয়নই ছাত্রদের প্রধান কর্তব্য। প্রতিদিনের পড়া পরবর্তী দিনের জন্য ফেলে না রেখে যথাসময়ে শেষ করার মানসিকতা থাকতে হবে। নিয়মিত পাঠাভ্যাসের পাশাপাশি শরীরচর্চা, চরিত্র গঠন, শৃঙ্খলা ও সংযমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কর্মজীবনে সাফল্য নির্ভর করে ছাত্রজীবনে সময়ের সঠিক মূল্যায়নের ওপর। সুতরাং, শৈশব থেকেই কাজের প্রকৃতি অনুসারে সময়ানুবর্তী হওয়া একান্ত প্রয়ােজন। ছাত্রজীবনের দৈনন্দিন কর্মসূচিকে যারা অবহেলা করে তারাই জীবনের সাফল্যের সােনার কাঠির পরশ থেকে বঞ্চিত হয়। এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বলেছেন,

 “সময়ের প্রতি যাদের শ্রদ্ধা নেই, তারাই পৃথিবীতে নিঃস্ব, বঞ্চিত ও পরমুখাপেক্ষী।”

জাতীয় জীবনে সময়ের মূল্য

জাতীয় জীবনে সময়ের মূল্য অপরিসীম। কোনাে জাতির উত্থানপতন নির্ভর করে জাতীয় জীবনের কর্মতৎপরতার উপর। আলস্য, ঔদাসীন্য, অনিয়মানুবর্তিতা যে-কোনাে জাতির অপমৃত্যু ঘটাতে পারে। বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে আমরা দেখি আমরা সময়ের কাজ সময়ে করি না। গালগল্প, পরনিন্দা, পরচর্চা করে আমরা অযথা সময়ের অপচয় করি। সময়ের মূল্যকে গুরুত্ব দিয়ে পাশ্চাত্যের বহু দেশ উন্নতির চরম শিখরে উঠেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া জাপান সময়ের মূল্যকে সম্মান দিয়েই আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আমাদের বৈশ্বিক ও জাগতিক উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই সময়কে গুরুত্ব দিতে হবে এবং সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। 

সময়ই শ্রেষ্ঠ সম্পদ

মানবজীবন মূলত কতকগুলাে মুহূর্তের সমষ্টি মাত্র। অতএব, প্রতিটি মুহূর্তই মানুষের জন্য মূল্যবান। সময়ের ক্ষেত্রে ‘সামান্য’ বলে কোনাে কথা নেই। ক্ষণিক মুহূর্তের অপচয় জীবনের সম্ভাবনাময় সুযােগগুলােকে নষ্ট করে দেয়। সময় হচ্ছে মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বিষয়। সময়কে কাজে লাগাতে পারলেই মানুষের জীবনে সাফল্য ধরা দেয়। অতএব, যথাযথভাবে সময়কে কাজে লাগালে মানুষ ধন-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি, যশ-খ্যাতি সব কিছুই অর্জন করতে পারে।

সময়ের অবহেলার পরিণাম

কথায় আছে:

সময়ে যে না দেয় চাষ,

তার দুঃখ বার মাস। 

কাজেই জীবনের সংক্ষিপ্ত সীমার মধ্যে যে পরম মূল্যবান সময় আমরা পাই, তাকে যদি অবহেলা করি, আলস্য ভরে সেই মূল্যবান সময় নষ্ট করি, তাহলে তা হয় সময়ের অপচয় মাত্র। সেই অপচয়ের বেদনা আমাদের জীবনে একদিন মর্মান্তিক দুঃখের মতাে নেমে আসবে। তখন বুকফাটা আর্তনাদ করে কিংবা চোখের জল কিংবা অনুতাপের অন্তর্দাহে সেই আলস্যে অতিবাহিত সময় আর কখনােই ফিরে পাওয়া যাবে না। কবি যেমন বলেছেন:

রাত্রে যদি সূর্যশােকে ঝরে অশ্রুধারা

সূর্যকভু ফেরে নাহি, ব্যর্থ হয় তারা।

সময়ানুবর্তিতার অন্তরায়

অধৈর্য আর আলস্যই সময়ের যথার্থ ব্যবহারের প্রধান অন্তরায়। কথায় আছে- “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।” কর্মক্ষমতা হরণ করে মনে কুচিন্তা অনুপ্রবেশ ঘটানাে অলস মস্তিষ্কের কাজ। সুতরাং, আলস্যকে সযত্নে পরিহার করে স্ব-স্ব আবশ্যকীয় কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে প্রাণবন্ত করে তােলা উচিত। এ প্রসঙ্গে মহামতি এডিসন যথার্থ বলেছেন-

“জীবনকে যদি উপভােগ করতে চাও, তবে আলস্যকে দূরে রাখ।”

রােগ-ব্যাধি-জরা সময়ানুবর্তী হওয়ার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে; কিন্তু যথাযথ শিক্ষা ও সাধনার মাধ্যমের সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারার মধ্যেই সার্থকতা।

সময়কে কাজে লাগানাের উপায়

কর্মময় জীবনে মানুষকে বহু রকমের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। জীবনে নির্দিষ্ট পরিসীমার মধ্যে এতসব দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে কেউ যদি তার কাজের পরিমাণ বিবেচনা করে সময়কে ভাগ করে নেয়, তাহলে ঠিক সময়ে সে কাজটি সম্পন্ন করতে পারে। কাজের সময়ের পাশাপাশি অবসর সময়ও চিহ্নিত করে রাখা প্রয়ােজন। কারণ, জীবনে কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবসর কিংবা বিনােদনের প্রয়ােজন আছে। এতে করে কাজে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। তাই অবসর কিংবা বিনােদনের সময়টুকুকে সময়ের অপচয় মনে করা যুক্তিযুক্ত নয়। তাছাড়া সময়ের কাজ সময়েই করতে হবে। যে কৃষক সময়মতাে জমিতে চাষ করে না, উপযুক্ত সময়ে আগাছা ধ্বংস করে না, প্রয়ােজন মতাে সার দেয় না- সে ফসলের আশা কী করে করতে পারে? বিশ্ব বিখ্যাত ফরাসি সম্রাট নেপােলিয়ন ওয়াটারলুর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে শােচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেন।

এটিই তার জীবনের একমাত্র পরাজয়। এ পরাজয়ের কারণ, তাঁর জনৈক সেনাপতি সঠিক সময়ে সসৈন্যে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হতে পারেননি। উক্ত সেনাপতি মাত্র কয়েক মিনিট বিলম্ব করেছিলেন। এর ফলে জগৎ  বিখ্যাত সম্রাটকে পরাজয়ের গ্লানি ভােগ করতে হয়। সেনাপতির যদি এ বিলম্ব না ঘটতাে তাহলে ইউরােপ তথা বিশ্বের ইতিহাস বদলে যেতাে। কেবল নিজে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই মানবজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। মানুষের গুণগত উন্নতির জন্য যেমন অন্যের কথা ভাবতে হবে, তেমনি আত্মিক বিকাশের জন্য সৃজনশীলতার চর্চা করা আবশ্যক। সময়ের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে জগতে কীর্তিমান হওয়া সম্ভব। এ জন্য সম্মুখে আসা কর্তব্য ও দায়িত্বকে ভাগ করে নিতে হবে। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সে অনুযায়ী কর্তব্য পালনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। একদিনের কাজ অন্য দিনের জন্য ফেলে রাখা চলবে না। তাছাড়া কাজের সময়ে মতাে অবসর সময়ও চিহ্নিত করে রাখতে হবে।

সময়ের গুরুত্ব

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছেঃ

জীবনকে যদি তুমি ভালোবাসো, তাহলে সময়ের অপচয় করো না। কারণ, জীবন হচ্ছে সময়ের সমষ্টি মাত্র।

মানবজীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু তার গৌরব চিরস্থায়ী। জীবনের শিক্ষা অফুরন্ত, কর্তব্য অপরিমেয়, কর্মজগতের পরিধি ক্রমবর্ধমান। তাই সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে কর্মের সঙ্গতি বিধান করা উচিত। যথাসময়ে বীজ বপনের ওপর যেমন নির্ভর করে শস্য উৎপাদন, রােগের কারণে উপযুক্ত সময়ে যেমন গ্রহণ করতে হয় ওষুধ, তেমনি সঠিক দায়িত্বের সঙ্গে নিয়মিত পাঠাভ্যাসের মাধ্যমে পরীক্ষায় কাঙ্খিত  ফলাফল লাভ করা সম্ভব । জীবন, প্রকৃতি, পরিবেশ সর্বত্রই সময়ের নিবিড় ছকে পরিচালিত হচ্ছে। সময় ও সুযােগকে কাজে লাগাতে পারলে উন্নতির পথ প্রশস্ত হয়, জগতে কীর্তিমান হওয়ার সুযোগ  ঘটে। কবি বলেন –

“সময়ের মূল্য বুঝে করে যারা কাজ। তারা আজ স্মরণীয় জগতের মাঝ।”

সময়ের মূল্যায়ন ও জীবনে সাফল্য

সময় গতিশীল তা কখনাে থেমে থাকে না। কোনাে লােভ দেখিয়ে, কোনাে ভয় দেখিয়ে সময়কে থামানাে যায় না। সময় নির্মম ও নিষ্ঠুর। অথচ সময়কে কাজে লাগাতে পারলেই জীবনে সফলতা লাভ করা যায়। যার সময় সম্পর্কে জ্ঞান আছে ও পরিমিতিবােধ আছে সে-ই জীবনে সাফল্য লাভ করে। সময়ের অবহেলা করলে সাফল্য সােনার হরিণের মতাে কোনাে দিনই ধরা দেবে না। প্রতিটি মুহূর্তই নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। যারা সময়কে কাজে লাগাতে পারে তারাই সাফল্য লাভ করে। কিন্তু সময়কে অবহেলা করে অপব্যয় করলে জীবনে মারাত্মক পরিণতি নেমে আসে। কোনাে বিষয়ে সে সফলতার মুখ দেখতে পায় না। কবির ভাষায়-

“নিতান্ত নির্বোধ যেই শুধু সেই জন।
এ অমূল্য সময় করে বৃথায় যাপন।”

সময়নিষ্ঠ ব্যক্তি ও জাতির উদাহরণ

জগতের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিদের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, তারা কেউই সময়ের মূল্য সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন না। তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল প্রাণচঞ্চল এবং কর্মবহুল। কোনাে রকমের অলসতা এবং জড়তা তাদেরকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। গণতন্ত্রের প্রবক্তা আব্রাহাম লিংকন- যিনি সামান্য শ্রমিক থেকে হয়েছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কৃতী প্রেসিডেন্ট। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়েছিলেন অনেক রক্ত বিসর্জন দিয়েছিলেন। এরিস্টটল- যিনি দিগবিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের গৃহশিক্ষক থেকে হয়েছিলেন জগদৃবিখ্যাত দার্শনিক, যিনি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে আছেন আধুনিক সভ্যতা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের জনক হিসেবে। বৈজ্ঞানিক নিউটন, আইনস্টাইন, আলভা এডিসন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শের-এবাংলা এ. কে. ফজলুল হক এমনি বহু মনীষীর নাম এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। আর সময়নিষ্ঠ জাতি হিসেবে ইংরেজ, আমেরিকান, জাপানি, ভিয়েতনামি, চাইনিজ, কোরিয়ানদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ইংরেজরা সাংঘাতিক রকমের সময়নিষ্ঠ জাতি, তাই তারা পৃথিবীজোড়া এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। বহু পরে যে আমেরিকার আবিষ্কার হয়, সেই আমেরিকানরাই সময়কে কাজে লাগিয়ে আজ পৃথিবীর সেরা জাতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের ফলে যে জাপানিরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিল সে জাপান সময়কে কাজে লাগিয়ে দ্রুত নিজেদেরকে আবার গড়ে নিয়েছে। তারা আজ এশিয়ার অহংকার। আমেরিকার সাথে প্রায় দশ বছর যুদ্ধ করে যে ভিয়েতনাম প্রায় ধ্বংস হয়ে পড়েছিল, সে ভিয়েতনামে আজ উন্নয়নের সুবাতাস বইছে। এশিয়ার আরও দুটি দেশ, দক্ষিণ কোরিয়া এবং মালয়েশিয়া আজ উন্নত দেশ হিসেবে বিবেচিত। সময়কে কাজে লাগিয়েই এরা আজ উন্নয়নের স্বর্ণশিখরে অধিষ্ঠিত। অনুন্নত দেশগুলাের সামনে এসব দেশ আজ মডেল হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।

বাঙালির সময়জ্ঞান

বাঙালির যে সময়জ্ঞান কম তা বলাই বাহুল্য। এর মূলে রয়েছে বাঙালির প্রাচীন জীবনযাত্রা থেকে প্রাপ্ত অভ্যাস। দীর্ঘকাল ধরে বাঙালির সমাজজীবনের কাঠামাে ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। সেখানে জীবনে জটিলতা ছিল কম। অল্প আয়াসে সােনার ফসলে মাঠ ভরে যেত বলে জীবনসংগ্রামের গতি ছিল মন্থর। প্রচুর অবসর মিলত বলে সেকালে বাঙালির জীবনে ছিল বারাে মাসে তের পার্বণের আনন্দ। বাইরের জগৎ কোথায় চলছে সেদিকে বাঙালি খুব একটা ফিরে তাকায় নি। কিন্তু বাঙালির সুখবিভাের অলস-মন্থরতা ভরা জীবনে প্রবল অভিঘাত লাগে এদেশে ইংরেজ আগমনের পর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে। দেখা গেল, পৃথিবী যেমন এগিয়ে গেছে তেমনি তাদের সময়-সচেতনতার তুলনায় বাঙালির সময়সচেতনতা রয়েছে অনেক পিছিয়ে। এরপর বাঙালি সময়-সচেতন হতে চেষ্টা করছে। কিন্তু অলস অভ্যাসের জের এখনাে চলছে। বাঙালির সময়জ্ঞান সম্পর্কে যে ঠাট্টা-বিদ্রুপ চলে সে অপবাদ এখনও আমরা মােচন করতে পারি নি।

সময়ের অপব্যবহার ও আমাদের কর্তব্য

যারা সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগায় না ও সময়ের মূল্য দেয় না, তাদের জীবনাকাশ ঘনকালাে মেঘে আচ্ছন্ন। ‘ওয়াটার-লু’র যুদ্ধে নেপােলিয়নের সেনাপতি নির্দিষ্ট সময়ের কিছুক্ষণ পরে সসৈন্যে যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির হওয়ায় নেপােলিয়নের শােচনীয় পরাজয় হয়েছিল। একটি জার্মান ছড়ায় বলছে :

For want of a nail, the shoe is lost. 

For want of a shoe, the horse was lost, 

For want of a horse, the rider was lost.

For want of a rider, the battle was lost,
For want of a battle, the kingdom was lost.
And all for the want of a horse shoe nail.

অর্থাৎ একটি পেরেকের অভাবে ঘােড়ার খুর কাজ করে নি। খুরের সমস্যার ফলে ঘােড়া কাজ করে নি। ঘােড়া না থাকাতে অশ্বারােহী সৈন্য পাওয়া যায় নি। অশ্বারােহী সৈন্যের অভাবে যুদ্ধে হেরে যেতে হল। যুদ্ধে হেরে যাওয়াতে রাজত্ব হারাতে হল। আর এ সবকিছুই ঘটেছিল সময়মতাে ঘােড়ার খুরের একটি পেরেকের অভাবে। মনে রাখতে হবে যে, ‘সময়ে একফোঁড় অসময়ে দশ ফোঁড়’। সময় মতাে একটি পেরেকের জোগান না দিতে পারায় জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে হয়েছে। এমনিভাবে সময়ের অপব্যবহারে বহু প্রতিভাবান ও শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি জীবনযুদ্ধে হেরে গেছেন। সময়ের কোন মহর্তটি যে মূল্যবান তা কেউ জানে না বলেই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকেই মহামূল্যবান ভেবে কাজে লাগাতে হবে। সময়ের অবহেলা মানে জীবনকে অবহেলা করা। ঘড়ির কাঁটাটি টিক টিক করে যেন ঠিক এ কথাটিই বলে চলেছে ‘সাবধান! আমাকে ভুলাে না, তােমার সুপ্ত চৈতন্য জাগ্রত কর, কল্যাণ তােমারই হবে।’ 

উপসংহার

ইংরেজিতে বলা হয়, “Time is money.”— অর্থাৎ সময়ই অর্থ। সীমাবদ্ধ জীবনে উন্নতির সােপান হলাে সময়ের মূল্য অনুধাবন করা। সময়ের সঠিক ব্যবহার জীবনকে করে মহিমান্বিত। মানুষের মূল্যবান এ জীবন বারেবারে আসে না, একবারই আসে। মানুষের উচিত তার এ জীবনকে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে তােলা। এজন্য সময়ানুবর্তিতা একান্ত প্রয়ােজন। অতীতে তারাই সফল হয়েছে, যারা সময়ের মূল্য দিয়েছে। ভবিষ্যতেও তারাই সফল হবে যারা সময়কে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে। মানুষের চরম ও পরম পাওয়ার মূলে রয়েছে সময়ের প্রতি সচেতনতা আর সময়ের সঠিক মূল্যায়ন। সফল ব্যক্তিদের সাফল্যের চাবিকাঠি এর মধ্যে নিহিত রয়েছে। সুতরাং জীবনকে অর্থবহ করতে, দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করে তুলতে আমাদের প্রত্যেকেরই সময়ের মূল্য অনুধাবন করা উচিত।

Rimon

This is RIMON Proud owner of this blog. An employee by profession but proud to introduce myself as a blogger. I like to write on the blog. Moreover, I've a lot of interest in web design. I want to see myself as a successful blogger and SEO expert.

2 Comments

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button