সমাস কাকে বলে ও সমাসের প্রকারভেদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।
সমাস সম্বন্ধে কিছু কথা
সমাস মানে সংক্ষেপ, মিলন, একাধিক পদের একপদীকরণ। অর্থসম্বন্ধ আছে এমন একাধিক শব্দের এক সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি নতুন শব্দগঠনের প্রক্রিয়াকে সমাস বলে। অন্যভাবে বলা যায়, পরস্পর অর্থপূর্ণ দুই বা ততােধিক পদের একপদে পরিণত হওয়াকে সমাস বলে।
যেমন- দেশের সেবা = দেশসেবা,
বই ও পুস্তক = বইপুস্তক,
নেই পরােয়া যার = বেপরােয়া।
বাক্যে শব্দের ব্যবহার সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে সমাসের সৃষ্টি। সমাস দ্বারা দুই বা ততােধিক শব্দের সমন্বয়ে নতুন অর্থবােধক পদ সৃষ্টি হয়। এটি শব্দ তৈরি ও প্রয়ােগের একটি বিশেষ রীতি। সমাস একটি সংস্কৃত শব্দ। সমাসের রীতি সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসেছে। তবে খাঁটি বাংলা সমাসের দৃষ্টান্তও প্রচুর পাওয়া যায়। সেগুলােতে সংস্কৃতের নিয়ম খাটে না।
সমাসের সংজ্ঞা
দুই বা ততােধিক শব্দ (বা পদ) যুক্ত হলে এক শব্দ হিসেবে গণ্য হওয়ার প্রক্রিয়াকে সমাস বলে।
সমাসের প্রামাণ্য সংজ্ঞার্থ
ভাষাতাত্ত্বিকগণ সমাস সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞার্থ দিয়েছেন। নিচে তা তুলে ধরা হলাে
১. ড. সুকুমার সেন-এর মতে, “পরস্পর সম্বন্ধবিশিষ্ট দুই বা ততােধিক পদের মধ্যস্থিত বিভক্তি লােপ করিয়া একপদ করাকে
সমাস বলে।”
২. ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর মতে, “অর্থের দিক দিয়া পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ আছে, এরূপ (দুই বা তাহার অধিক)
পদ মিলিত হইয়া একপদে পরিণত হইলে, ব্যাকরণে সেই মিলনকে বলা হয় সমাস।”
৩. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ- এর মতে, “পরস্পর অর্থ-সংগতিবিশিষ্ট দুই বা বহুপদকে লইয়া একটি পদ করার নাম সমাস।”
৪. মুনীর চৌধুরী ও মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী-এর মতে, “অর্থ-সম্বন্ধ আছে এমন একাধিক শব্দের এক সঙ্গে যুক্ত হয়ে . | একটি বড়াে শব্দগঠনের প্রক্রিয়াকে সমাস বলে।”
৫. ড. মুহম্মদ এনামুল হক-এর মতে, “পরস্পর অন্বয়যুক্ত দুই বা ততােধিক পদের মধ্যবর্তী অম্বয়াংশ লােপ করিয়া পদগুলিকে এক শব্দে পরিণত করার প্রক্রিয়ার নাম সমাস।”
সমাসের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা
সমাস শব্দগঠনের অন্যতম প্রক্রিয়া। এ কারণে বাংলা ভাষার শব্দগঠনে সমাসের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম। আমরা কথা বলার সময় শুধু শুধু বাড়তি শব্দ ব্যবহারের ফলে শ্রোতা যেমন আগ্রহ হারায়, তেমনি বক্তব্যেরও ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট হয়। সমাস ভাষাকে সংক্ষেপ করে। এক বা একাধিক পদকে একপদে পরিণত করে। আর আমরা যদি সমাসবদ্ধ শব্দ ব্যবহার করি তাহলে বক্তব্যের ভাষা যেমন সাবলীল ও শ্রুতিমধুর হবে তেমনি ধ্বনিমাধুর্যও বজায় থাকবে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া হলাে- যিনি রাজা তিনিই ঋষি = রাজর্ষি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, একটি বাক্যের মধ্যে আমরা যদি বলি, যিনি রাজা তিনিই ঋষি- এটি শুনতে যতটা না শুতিমধুর লাগছে তার থেকেও বেশি শ্রুতিমধুর লাগছে রাজর্ষি বলতে। এছাড়া সময়ও কম লাগছে এবং ভাষাটা আরও সাবলীল হয়েছে। সমাসের এ প্রক্রিয়ায় গঠিত বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারে অসংখ্য শব্দ রয়েছে। তাহলে আমরা বলতে পারি
- সমাস নতুন নতুন শব্দগঠনে সাহায্য করে।
- বাক্যে পদগুলােকে সংক্ষিপ্ত রূপ দান করে বা একাধিক পদকে একপদে পরিণত করে।
- ভাষাকে সাবলীল করে ও শ্রুতিমধুর করে।
- ভাষার শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ করে।
সমাসের অভিধাসমূহ
সমাস সম্পর্কিত উপরিউক্ত কিছু বিষয়ই আরও বিস্তারিতরূপে নিচে উপস্থাপন করা হলাে-
সমস্ত পদ বা সমাসবদ্ধ পদ : সমাসের প্রক্রিয়ায় সমাসবদ্ধ বা সমাসনিষ্পন্ন পদটির নাম সমস্ত পদ। অন্যভাবে বলা যায়, সমাসের প্রক্রিয়ায় একাধিক শব্দ যুক্ত হয়ে যে একক পদটি গঠন করে তাকে সমস্ত পদ বা সমাসবদ্ধ পদ বলে। যেমন- নব যে দিগন্ত বাক্যাংশটি সমাসবদ্ধ হয়ে হয় নবদিগন্ত। এখানে নবদিগন্ত সমস্ত পদ। বিলাতফেরত রাজকুমার সিংহাসনে বসলেন। এখানে বিলাতফেরত, রাজকুমার ও সিংহাসন— এ তিনটিই সমাসবদ্ধ পদ।
সমস্যমান পদ : সমস্ত পদ বা সমাসবদ্ধ পদটির অন্তর্গত পদগুলােকে সমস্যমান পদ বলে। যেমন- পদ্ম নাভিতে যার = পদ্মনাভ। এখানে পদ্ম, নাভিতে, যার প্রত্যেকটিকে বলা হয় সমস্যমান পদ।
সমাসবাক্য /ব্যাসবাক্য / বিগ্রহবাক্য : সমস্ত পদকে ভেঙে যে বাক্যাংশ করা হয়, তার নাম সমাসবাক্য | ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য। যেমন- সমান উদর যার = সহােদর। এখানে সমান উদর যার পুরাে বাক্যাংশটি হলাে সমাসবাক্য। কিন্তু সহােদর শব্দটি হলাে সমস্তপদ।
পূর্বপদ ও পরপদ : সমাসযুক্ত পদের প্রথম অংশ (শব্দ)-কে বলা হয় পূর্বপদ এবং পরবর্তী অংশ (শব্দ)-কে বলা হয় উত্তরপদ বা পরপদ। অথাৎ সমাস হয়ে গঠিত সমস্ত পদে দুটি পদ থাকলে প্রথম পদটিকে পূর্বপদ ও শেষের পদটিকে পরপদ বলে। যেমনসমাসবদ্ধ পদ সিংহাসন = সিংহ চিহ্নিত আসন। এখানে সিংহ পূর্বপদ এবং আসন পরপদ। পরপদকে উত্তরপদ বা অন্ত্যপদও বলা হয়।
সমাসবদ্ধ শব্দ লিখন রীতি
সমাসবদ্ধ শব্দ সাধারণত নিম্নলিখিত রীতিতে লেখা হয়ে থাকে-
১. নিরেটভাবে : তিলােত্তমা, বনভূমি, হাতঘড়ি, জনসমুদ্র ইত্যাদি।
২. হাইফেন যােগে : বিলাত-ফেরত, ক্রিয়া-বিশেষণ, ঘিয়ে-ভাজা, কলে-ছাঁটা, রবীন্দ্র-চর্চা, হাতে-খড়ি ইত্যাদি।
৩. অসংলগ্নভাবে : ঘােড়ার গাড়ি, বাংলা ভাষা সম্মেলন, হাতে তৈরি, সমাজ সংস্কার আন্দোলন ইত্যাদি।
সমাসের প্রকারভেদ

সমাস প্রধানত ছয় প্রকার। যথা : দ্বন্দ্ব, কর্মধারয়, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি, দ্বিগু ও অব্যয়ীভাব সমাস।
পণ্ডিতগণ সমাসকে নিম্নোক্তভাবে ভাগ করেছেন
১. পূর্বপদের অর্থ প্রধান : অব্যয়ীভাব।
২. পরপদের অর্থ প্রধান : দ্বিগু, তৎপুরুষ ও কর্মধারয়।
৩. পূর্ব ও পরপদ উভয় পদের অর্থই প্রধান : দ্বন্দ্ব।
৪. পূর্ব ও পরপদের অর্থ গৌণ, তৃতীয় অর্থ প্রধান : বহুব্রীহি।
[দ্বিগু সমাসকে অনেক ব্যাকরণবিদ কর্মধারয় সমাসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আবার কেউ কেউ কর্মধারয়কেও তৎপুরুষ সমাসের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেছেন। এদিক থেকে সমাস মূলত চারটি : দ্বন্দ্ব, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি, অব্যয়ীভাব। কিন্তু সাধারণভাবে ছয়টি সমাসেরই আলােচনা করা গেল। এছাড়া প্রাদি, নিত্য, অলুক ইত্যাদি কয়েকটি অপ্রধান সমাস রয়েছে। সংক্ষেপে সেগুলােরও আলােচনা করা হয়েছে।]
সমাস নিয়ে আমাদের পর্বগুলোঃ
সমাস পর্ব ১ঃ দ্বন্দ্ব সমাস
সমাস পর্ব ১ঃ দ্বন্দ্ব সমাস
সমাস পর্ব ২ঃ দ্বিগু সমাস
সমাস পর্ব ৩ঃ কর্মধারয় সমাস
সমাস পর্ব ৪ঃ তৎপুরুষ সমাস
সমাস পর্ব ৫ঃ অব্যয়ীভাব সমাস
সমাস পর্ব ৬ঃ বহুব্রীহি সমাস
এই রকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন। এর পাশাপাশি গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন।
আপনাকে ধন্যবাদ